প্রজাপার্টি

প্রজাপার্টি একটি রাজনৈতিক দল। ১৯২৯ সালের জুলাই মাসে একটি বিচ্ছিন্ন পার্লামেন্টারি গ্রুপ হিসেবে এ দলের প্রথম আত্ম প্রকাশ। বেঙ্গল প্রজা পার্টি নামে প্রথম আত্মপ্রকাশ করলেও পরবর্তীতে দলটি ‘নিখিল বঙ্গ প্রজা সমিতি’ নাম ধারণ করে এবং সংসদীয় গ্রুপ থেকে থেকে চরিত্র বদলে হয়ে ওঠে জনতার রাজততিক মঞ্চ। ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনের অধীনে অনুষ্ঠিত প্রথম প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে অংশগ্রহনের স্বার্থে  ১৯৩৬ সালের জুলাই মাসে দরের পরিবর্তিত নামকরণ হয় ‘কৃষক প্রজা পার্টি’। ১৯৩৭ সালের নির্বাচনের সাফল্য পেলেও ওই নির্বাচনের পরপরই দলটি বিলুপ্ত হয়ে যায়।

বেঙ্গল টেনান্সি অ্যামেন্ডমেন্ট অ্যাক্ট এর প্রশ্নে বাংলার সকল হিন্দু কাউন্সিল সদস্যগণ জমিদারদের পক্ষে তাঁদের ভোট প্রদান করেন এবং সকল মুসলিম সদস্যবৃন্দ বাংলার ৮০ শতাংশ মুসলিম কৃষক শ্রেণির পক্ষে ভোট প্রদান করেন। এভাবেই হাউজ একটি সাম্প্রদায়িক নীতিতে দ্বিধা বিভক্ত হয়ে যায়। তা ছাড়াও প্রজা আইনের ফলে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের উপর থেকে  প্রায় সম্পূর্ণভাবেই বাংলার মুসলমানদের আস্থা চলে যায়। এর ফলে মওলানা আকরাম খাঁ সহ অন্যান্য অনেকেই কংগ্রেস ত্যাগ করেন। এরূপ পরিস্থিতিতে বেঙ্গল লেজিসলেটিভ কাউন্সিল এর অন্তর্গত বিভিন্ন দলের ২৭ সদস্য কলকাতায় ১৯২৯ সালের ১ জুলাই এক সভা করেন। সভার ফলাফলে দু’টি সংগঠন আত্মপ্রকাশ করে; এক. বেঙ্গল মুসলিম কাউন্সিল নামে একটি সংঘবদ্ধ মুসলিম দল এবং অপরটি হল বেঙ্গল প্রজা পার্টি। প্রজা পার্টি ফজলুল হককে সভাপতি এবং দিল্লীতে জন্মগ্রহণকারী উর্দুভাষী কলকাতার ধনী ব্যবসায়ী আব্দুর রহিমকে (স্যার আব্দুর রহিম নন) সহ সভাপতি করে আনুষ্ঠানিকভাবে ১৯২৯ সালের ৪ জুলাই যাত্রা শুরু করে। কাউন্সিলের অন্যান্য সদস্য ছিলেন তমিজউদ্দিন খান (সম্পাদক), খান বাহাদুর মোহাম্মদ আজিজুল হক এবং শাহ আব্দুল হামিদ (সহ-সম্পাদক), ফজলুল্লাহ ও মোহাম্মদ হুসেইন (পার্টি হুইপ)। বেঙ্গল প্রজাপার্টি কাউন্সিলের সদস্যগণ দলের অভ্যন্তরের সব বিষয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠের সিদ্ধান্তের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকায় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হন। দলের অন্যান্য সিদ্ধান্তসমূহ ছিল, কৃষক ও শ্রমজীবী মানুষের স্বার্থ রক্ষা করা, দ্বৈতশাসনের প্রতি সমর্থন প্রদান করা ও দলের পছন্দ অনুযায়ী মন্ত্রী মনোনীত হলে তাদেরকে সমর্থন প্রদান করা।

প্রজাপার্টির দ্বিতীয় পর্বে গঠিত হয় নিখিল বঙ্গ প্রজা সমিতি। গ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষের অধিকার রক্ষায় বৃহত্তর রাজনৈতিক আদর্শের ভিত্তিতে এ দল গঠিত হয়। দলের শ্লোগান হয় ‘নাঙ্গল যার জমি তার।’ নিখিল বঙ্গ প্রজা সমিতি মূলত পৃথক পৃথক রাজনৈতিক ভাবাদর্শের ধারক মুসলিম নেতৃবৃন্দের সমন্বয়ে গঠিত হয় যাদের অধিকাংশই ছিলেন কলকাতাকেন্দ্রিক। এ দলের সভাপতি স্যার আব্দুর রহিম ও সহ-সভাপতি ছিলেন পাঁচ জন। তাঁরা হলেন এ কে ফজলুল হক, আব্দুল্লাহ আল মামুন সোহরাওয়ার্দী, খান বাহাদুর আবদুল মোমিন, আবদুল করিম ও মুজিবুর রহমান। একইভাবে সমিতির সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ আকরাম খান ও দু’জন সহ-সম্পাদক, সামসুদ্দিন আহম্মেদ এবং তমিজউদ্দিন খানকে নিয়ে নিখিল বঙ্গ প্রজা সমিতির যাত্রা শুরু হয়। ১৯২৯ সালের শেষাবধি নিখিল বঙ্গ প্রজা সমিতি গঠিত হলেও ১৯৩২ সালের পূর্ব পর্যন্ত একটি অধিভুক্ত সংগঠন হিসেবে সমিতি তার কাজ শুরু করতে বাধাগ্রস্থ হতে থাকে। দলের কার্যক্রম শুরু হওয়ার পরেও মফস্বলের বেশ কয়েকটি দল, বিশেষ করে ত্রিপুরা কৃষক সমিতি এ দলের অধিভুক্ত হতে অস্বীকৃতি জানায়।

কৃষকদের দুঃখ-দুর্দশাসমূহকে চিহ্নিত করে তাদের ক্ষতিপূরণের দিকটা সামনে তুলে এনে বার্ষিক সম্মেলন অনুষ্ঠানের মধ্যেই সমিতির কার্যক্রম সীমাবদ্ধ ছিল। নিখিল বঙ্গ প্রজা সমিতি বাংলার সবচাইতে নিগৃহীত ও বঞ্চিত মুসলিম ও তফসিলি সম্প্রদায়ের অধিকার সুরক্ষার উদ্দেশ্যে গঠিত হয়েছিল। সমিতির নেতৃবৃন্দ ও অনুসারীদের সবাই ছিলেন মুসলিম সম্প্রদায়ভূক্ত। এমনকি কোন কোন মুসলিম জমিদার সমিতিতে অধিক মাত্রায় সক্রিয় ছিলেন। উদাহরণ স্বরূপ, ময়মনসিংহ জেলার ধনবাড়ির নওয়াবজাদা সৈয়দ হাসান আলী শুধু সমিতিতে যোগই দেন নি, তিনি দলের জন্য আর্থিক সহায়তাও প্রদান করতেন। তাঁর অর্থ সহায়তায় সমিতি তার নিজস্ব মুখপত্র ’চাষী’ প্রকাশের জন্য একটি ছাপাখানা ক্রয় করেছিল। এভাবেই নিখিল বঙ্গ প্রজা সমিতি বাংলার মধ্যবিত্ত শ্রেণির স্বার্থ রক্ষার্থে একটি রাজনৈতিক মঞ্চে পরিণত হয়েছিল।

স্যার আবদুর রহিম ১৯৩৫ সালে ভারতীয় আইন পরিষদের সভাপতি মনোনীত হলে সমিতিতে প্রথম ভাঙন দেখা দেয়। ফজলুল হক পূর্ববঙ্গের শ্রমিক শ্রেণির পূর্ণ সমর্থন নিয়ে সমিতির নতুন সভাপতি হিসেবে নিজেকে ঘোষণা দেন। একই বছর গ্রামীণ জনগণের ভোট বা সমর্থন আদায়ের লক্ষ্যে ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনের আওতায় অনুষ্ঠিত প্রাদেশিক নির্বাচনকে সামনে রেখে ১৯৩৬ সালে নিখিল বঙ্গ প্রজা সমিতির নতুন নামকরণ হয় কৃষক প্রজাপার্টি

সামগ্রিকভাবে জনগণের প্রতিনিধিত্বকারী প্রজাপার্টি বাংলার রাজনীতিতে গ্রামীণ অনগ্রসর জনগোষ্ঠীকে সক্রিয় করে গতিশীলতা প্রদান করতে সক্ষম হয়। ১৯২৮ সালের বঙ্গীয় প্রজাসত্ব (সংশোধনী) আইন, ১৯২৮ ইস্যু করে ভূস্বামীদের আক্রমণের লক্ষবস্ত্ততে পরিণত করে এ দল কৃষকের আস্থা অর্জনে সক্ষম হয় ও বিনা ক্ষতিপূরণে জমিদারি প্রথা (চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত) উচ্ছেদের পূর্ণ সুযোগ গ্রহণ করে।  [বি.আর খান]