ফররুখ সিয়ারের ফরমান
ফররুখ সিয়ারের ফরমান ১৭১৭ খ্রিস্টাব্দে মুগল সম্রাট কর্তৃক ইংলিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে প্রদত্ত একটি আদেশ বা নির্দেশনামা। এর মাধ্যমে কোম্পানিকে বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার মুগল সুবায় শুল্কমুক্ত একচেটিয়া বাণিজ্যের সুবিধা প্রদান করা হয়। কোম্পানি কর্তৃক দীর্ঘদিন শুল্কমুক্ত বা টোল ফাঁকি দিয়ে বানিজ্যিক সুবিধা গ্রহণ করায় সৃষ্ট জটিলতা নিরসনকল্পে সম্রাট উক্ত ফরমান জারি করেন। কোম্পানির অধিকাংশ কর্মচারি একাধারে ব্যক্তিগত বানিজ্যে সম্পৃক্ত ছিল এবং তারা প্রথম থেকেই মুগল কর্তৃপক্ষ থেকে বাৎসরিক একটা নির্দিষ্ট অংকের টাকা বা পেশকাস প্রদানের বিনিময়ে একপ্রকার বিনা শুল্কে বানিজ্য করার অনুমতি আদায়ের চেস্টা চালিয়ে আসছিল। ইতিপূর্বে সম্রাট সাহজাহান ১৬৫০ খ্রিস্টাব্দে এক ফরমানের দ্বারা কোম্পানিকে আগ্রা ও অযোদ্ধা প্রদেশ দুটি সহ তার নিকটবর্তী অঞ্চলসমূহের উপর ধার্য বিধিবদ্ধ রাস্তা শুল্ক বা রাহাদারি প্রদান থেকে অব্যাহতি দিয়েছিলেন।
বাংলায় কোম্পানির বাণিজ্য সম্প্রসারিত হলে, উপকূলীয় অঞ্চল থেকে যে সকল পণ্য ক্রয় করা যেত না, তারা তা দেশের অভ্যন্তরে বিভিন্ন স্থান থেকে সংগ্রহ করতে বাধ্য হতো। সে পণ্যসামগ্রী পরিবহণে বাংলার অসংখ্য নদী প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি কোম্পানি বহু বাঁধার সম্মুখীন হতে লাগল; সে সঙ্গে তাদেরকে বিভিন্ন স্থানের শুল্ক-দফতরে শুল্কও প্রদান করতে হতো, তার ওপর ছিল জমিদার ও স্থানীয় কর্মকর্তাদের হয়রানিমূলক দাবি। এ অবস্থা নিরসনকল্পে একটি আবেদনের প্রেক্ষিতে কোম্পানি ১৬৫১ খ্রিস্টাব্দে সুবাহদার শাহ সুজার নিকট থেকে একটি নিশান বা অনুমতি আদায় করতে সক্ষম হয়, যেখানে তারা বার্ষিক নির্ধারিত ৩০০০ রুপি প্রদানের মাধ্যমে শুল্কমুক্ত বাণিজ্যিক অধিকার ভোগ করার অধিকার পায়। তবে তারপরও জল-স্থলপথে কোম্পানির মালামাল পরিবহনের বাধা দূর হয় নি। কারণ ব্যক্তিগত বানিজ্যের অভিযোগে অভিযুক্ত করে স্থানীয় কর্মকর্তাগণ প্রায়শই তালাশি নিত ও বাড়তি শুল্ক দাবি করত। ফলে কোম্পানির আবেদনে সাড়া দিয়ে সুবাহদার ১৬৫৬ সালের আরেকটি নিশানে ইংরেজ কোম্পানিকে কোনরূপ বাধা প্রদান ব্যতিরেকে বাণিজ্য করার সুযোগ দেওয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দেন। এ সকল সরকারি নির্দেশ থাকার পরও বাংলা, মুম্বাই ও মাদ্রাজের বিভিন্ন স্থানে কোম্পানির এজেন্টদের কাছ থেকে স্থানীয় শুল্ক অফিসার প্রায়ই শুল্ক দাবি করত এবং তাদের মালামাল আটক করে রাখত।
আঠারো শতকের গোড়ার দিকে ভারতে ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এর বাণিজ্য পরিধি বৃদ্ধি এবং ভারতে তাদের প্রভাব এক নতুন মোড় নেয়। ১৭১৫ সালে সমগ্র ভারতব্যাপী বাণিজ্য ও বাণিজ্যিক সুবিধাদি আদায় এবং সেই সাথে সুতানটি, গোবিন্দপুর ও কলকাতায় সদ্যপ্রতিষ্ঠিত জমিদারির পার্শ্ববর্তী এলাকায় বিশেষ সুবিধা ভোগের লক্ষে কোম্পানি মুগল দরবারে একটি প্রতিনিধি দল প্রেরণ করে। এই জমিদারিই পরবর্তীকালে কলকাতা নগরের ভিত্তি হিসেবে কাজ করে।
প্রতিনিধি দলের প্রধান জন সুরম্যানের নামানুসারে ‘সুরম্যান প্রতিনিধি’ দলটির অন্যান্য সজযোগীরা ছিলেন, একজন আর্মেনীয় দোভাষী খাজা সারহাদ, সেক্রেটারি এডওয়ার্ড স্টিফেনসন ও চিকিৎসক ডা. উইলিয়ম হ্যামিল্টন। প্রাথমিকভাবে প্রতিনিধি দলের লক্ষ্য ছিল, ইতিপূর্বে সমগ্র রাজ্যে যে সুবিধাদি অর্জন করা সম্ভবপর হয় নি, তেমন সকল ধরনের সুবিধাদি আদায় নিশ্চিত করা। দীর্ঘকাল অসুস্থ ফররুখ সিয়ারকে ড. হ্যামিল্টন সুস্থ করে তুললে বাংলা, মুম্বাই এবং মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সির জন্য ফররুখ সিয়ার পৃথক পৃথক ফরমান জারি করেন। প্রধানমন্ত্রী সৈয়দ আব্দুল্লাহ খান কর্তৃক ইস্যুকৃত সীলেও প্রতিনিধি দলের সকল দাবিকৃত সুবিধাদি মেনে নিয়ে অনেকগুলো ‘হাসব আল-হুকুম’ (নির্দেশনা) অন্তর্ভুক্ত হয়।
১৭১৭ সালের ফররুখ সিয়ারের ফরমানে বাংলা সুবাহর জন্য প্রযোজ্য সুবিধাদি ছিল নিম্নরূপ: (১) ইংরেজ কোম্পানির প্রতিনিধি কর্তৃক জল বা স্থলে বহনকৃত সকল মালামাল ও জরুরি দ্রব্যাদি বার্ষিক ৩০০০ রুপি পেশকাসের বিনিময়ে শুল্কমুক্ত হবে। (২) যদি কোম্পানির মালামাল লুণ্ঠিত হয় তবে হারিয়ে যাওয়া সকল মাল উদ্ধারের জন্য যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে এবং অপরারীদের উপযুক্ত শাস্তি প্রদানের ব্যবস্থা নিতে হবে। (৩) কোম্পানি যে কোন জায়গায় বাণিজ্যকুুঠি স্থাপনের উদ্যোগ নিলে তাদের যথাযথ সহযোগিতা প্রদান করা হবে। (৪) কোম্পানির ফ্যাক্টর বা এজেন্টের কাছে স্থানীয় বণিক বা তাঁতি ঋণগ্রস্ত হলে ধার্যকৃত অর্থ শোধ করতে হবে। (৫) কোম্পানির নিজস্ব জাহাজ বা ভাড়া করা জাহাজ কারও দ্বারা বিঘ্নিত বা উত্ত্যক্ত না হওয়ার ব্যবস্থা নিতে হবে। (৬) কোম্পানি কর্তৃক ক্রয়কৃত গ্রামগুলির অধিকার কোম্পানিরই থাকবে এবং সেগুলির পার্শ্ববর্তী গ্রামসমূহ ভাড়া নেওয়ার ব্যাপারে সুবাহর দীউয়ানও অনুমতি দিতে একমত থাকবেন। (৭) মাদ্রাজ টাকশাল থেকে জারিকৃত রৌপ্য মুদ্রার মান যদি সুরাট বন্দরে জারিকৃত মুদ্রার সমমানের হয় তাহলে কোন কমিশন দাবি করা হবে না। (৮) যদি কখনও কোম্পানির কোন কর্মচারী ঋণগ্রস্ত হয়ে পালিয়ে যেতে চায়, তাহলে তাকে কুঠির প্রধানের কাছে সোপর্দ করতে হবে। (৯) জাহাজডুবিতে কোম্পানির মালামাল খোয়া গেলে সেই মালামালের প্রতি বিশেষ যত্ন নিতে হবে।
ফরমানে সম্রাট কর্তৃক প্রদত্ত এসকল গুরুত্বপূর্ণ সুবিধাদি প্রদান ব্যতিরেকেও প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক প্রদত্ত হাসব আল-হুকুমে আরও কিছু বাড়তি সুযোগ-সুবিধা প্রদান করা হয়। সুবিধাসমূহ হলো: (ক) বানিজ্য কুঠির প্রধান দস্তক (পাস) জারি করতে পারবেন, যার মাধ্যমে কাস্টমহাউজের তল্লাশি ছাড়াই ইংরেজ কোম্পানির নামে মালামাল বিনা বাধায় যাতায়াত করতে পারবে; (খ) সপ্তাহে তিন দিন মুর্শিদাবাদ টাকশাল থেকে কোম্পানি তার নিজস্ব সোনা ও রূপা মুদ্রায় রূপান্তরিত করতে পারবে যদি তা নওয়াবের ক্ষতির কারণ না হয়; (গ) কলকাতা ও তার পার্শ্ববর্তী গ্রামসমূহে জমিদারি সত্ব ও তার অধিকার সেই সাথে অন্যান্য আরও কিছু গ্রামে জমিদারি সম্প্রসারণের আবেদন উক্ত সুবাহর দীউয়ানের অনুমতি ওপর নির্ভরশীল থাকবে।
১৭১৭ সালের রাজকীয় এই ফরমান উপমহাদেশের পরবর্তীকালের ইতিহাসে এক সুদূরপ্রসারী প্রভাব রেখেছে। কূটনৈতিক ক্ষেত্রে এটি ছিল ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বিশেষ এক সাফল্য। এটি শুধুমাত্র বাংলায় ইংরেজ কোম্পানির বাণিজ্যিক প্রসার ঘটানোরই সুযোগ করে দেয় নি বরং দেশের রাজনৈতিক ক্ষেত্রে তাদের প্রভাব খাটাতেও তারা সক্ষম হয়। বাংলায় ইংরেজ বাণিজ্যের ম্যাগনা কার্টা হিসেবে বিবেচিত এ ফরমান অন্যান্য বণিকদের ওপর ইংরেজদের অহেতুক বাড়তি সুবিধা প্রদান করে। এটি রাজকীয় রাজস্বের জন্য এক বিশাল ক্ষতি হিসেবেও প্রমাণিত হয়। কোম্পানির বাণিজ্যিক ক্ষেত্র দ্রুত বৃদ্ধি পেলেও সরকারকে প্রদেয় পেশকাসের পরিমাণ বৃদ্ধি পায় নি।
বাংলার যোগ্য ও অভিজ্ঞ সুবাহদার মুর্শিদকুলী খান শীঘ্রই ইংরেজদের ৩৮টি গ্রামের জমিদারি সত্ব রহিত করার ব্যাপারে তৎপর হয়ে ওঠেন। মুর্শিদাবাদ টাকশাল কর্তৃপক্ষও বিরোধী মনোভাব প্রকাশ করে। তার ওপর একটি বিদেশি কোম্পানিকে প্রদত্ত এ ধরনের সুবিধায় প্রাদেশিক কর্মকর্তাদের ঈষৎ সমর্থন আইন কার্যকরকারী কর্তৃপক্ষের সাথে দ্বন্দ্বে কোম্পানিকে একটি নাজুক অবস্থায় নিয়ে দাঁড় করায়। এরূপ দ্বন্দ্বময় পরিস্থিতি ইংরেজ ও বাংলার শাসনকর্তাদের মাঝে বৈরি মানসিকতা বৃদ্ধিতে ইন্ধন যোগায় এবং এর ফলে বাংলার রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ইতিহাস প্রভাবিত হয়। [শিরীন আখতার]