পালাগান
পালাগান কাহিনীমূলক লোকগীতি। পাঁচালি ছন্দে রচিত দেবতার কথা বা ধর্মসঙ্গীতও পালা নামে পরিচিত। কৃষ্ণকমল গোস্বামীর দিব্যোন্মাদ এবং গোবিন্দ অধিকারীর মুক্তালতাবলী দুটি বিশিষ্ট পালাগান। মঙ্গলকাব্যে দিনে পরিবেশিত কাহিনী দিবাপালা এবং রাতে পরিবেশিত কাহিনী নিশাপালা নামে অভিহিত। পালার অন্য নাম ‘পাট’, যেমন ধোবার পাট।
পালাগান প্রধানত পৌরাণিক ও লৌকিক আখ্যানভাগ নিয়ে রচিত। কৃষ্ণ ও গৌরাঙ্গ লীলা অবলম্বনে রচিত পালাসমূহকে পালাকীর্তনও বলা হয়। উল্লেখযোগ্য কয়েকটি পৌরাণিক পালাকীর্তন হচ্ছে: মান, মাথুর, নৌকাবিলাস, কালীয়দমন, নিমাইসন্ন্যাস প্রভৃতি। চন্দ্রাবতী, মহুয়া, মলুয়া, কমলা, দেওয়ান মদিনা, দেওয়ান ভাবনা, রূপবতী, দস্যু কেনারামের পালা, ভেলুয়া ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য লৌকিক আখ্যানমূলক পালাগান। পালাগানে প্রস্তাবনা ও গৌরচন্দ্রিকা থাকে। এতে গদ্যের অংশ থাকে কম এবং তত্ত্বব্যাখ্যা, শ্লোক ও দীর্ঘ গানের সংখ্যা থাকে বেশি। পালাগানের কবিকে বলা হয় পদকর্তা বা অধিকারী।
পালাগানে একজন মূল গায়েন বা বয়াতি থাকেন। তিনি দোহারদের সহযোগে গান পরিবেশন করেন। এ গান কাহিনীমূলক হওয়ায় তা কথোপকথন আকারে পরিবেশিত হয়। এ ক্ষেত্রে মূল গায়েনই বিভিন্ন চরিত্রে রূপদান করেন। কখনও কখনও দোহাররা তাকে এ কাজে সাহায্য করে। নাটকের আদর্শে সাজসজ্জাসহ এই চরিত্রগুলি মঞ্চে উপস্থাপিত হলে তখন তাকে বলা হয় যাত্রা। এরূপ যাত্রাপালার প্রচলন প্রাচীন কাল থেকেই ছিল, যেমন তরণীসেনবধ পালা, জয়দ্রথবধ পালা, রামযাত্রা, কৃষ্ণযাত্রা প্রভৃতি। এ ধরনের পালা সাধারণত রামায়ণ-মহাভারত থেকে নেয়া হতো এবং এগুলি সমধিক জনপ্রিয় ছিল। এছাড়া চৈতন্যযাত্রা, বিদ্যাসুন্দরযাত্রা, চন্ডীযাত্রা, ভাসানযাত্রা এগুলিও অতীতের ন্যায় বর্তমানেও জনপ্রিয়।
যুগের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে পালাগানেরও আঙ্গিক এবং বিষয়গত পরিবর্তন ঘটেছে। পৌরাণিক ও দেব-দেবীর কাহিনীর পরিবর্তে বিভিন্ন সামাজিক ঘটনা এবং ব্যক্তিকেন্দ্রিক ঘটনা নিয়েও পালাগান রচিত হয়েছে। যেমন মৈফল রাজার পালা, জামাল বাদশার পালা, রাজবিদ্যার পালা ইত্যাদি। এগুলি ক্ষেত-খামারে কিষাণ-মজুরেরা গেয়ে থাকে। অনেক সময় পরিচিত কোনো রূপকথাকেও পালাগানে রূপান্তরিত হতে দেখা যায়, যেমন রূপভান যাত্রা।
পালাগানের উৎসভূমি ময়মনসিংহ। সেখানকার গীতিকাগুলিকে সাধারণভাবে পালা বলা হয়। পূর্ব ময়মনসিংহের অনেক বাস্তব ঘটনা নিয়েও প্রচুর পালাগীতিকা রচিত হয়েছে। কাহিনীর মনোরম বর্ণনা ও জীবনমুখী চরিত্রাঙ্কন এসব পালাগানের বিশেষ বৈশিষ্ট্য এবং এতে রচয়িতাগণ অসাধারণ কবিত্বের পরিচয় দিয়েছেন। গ্রামের অমার্জিত ভাষা, লোকগীতির রাগিণীভিত্তিক ছন্দ এবং আঞ্চলিক শব্দে এই পালাগুলি রচিত। পালাগুলি যাঁরা রচনা করেছেন তাঁদের সবার নাম পাওয়া যায়নি, মাত্র কয়েকজনের নাম পাওয়া গেছে, যেমন মনসুর বয়াতি (দেওয়ানা মদিনা), ফকির ফৈজু (ছুরত জামাল ও অধূয়া সুন্দরী), দ্বিজ কানাই, চন্দ্রাবতী, দ্বিজ ঈশান, সুলাগাইন (মহিলা) ইত্যাদি। উল্লিখিত পালাগানগুলির মধ্য দিয়ে তৎকালীন সমাজের অনেক চিত্র ফুটে উঠেছে। দীনেশচন্দ্র সেনের প্রচেষ্টায় মৈমনসিংহ-গীতিকা ও পূর্ববঙ্গ-গীতিকা নামে কয়েক খন্ডে পালাগানগুলির সংগ্রহ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক প্রকাশিত হয়েছে। [সমবারু চন্দ্র মহন্ত]