আরাকান

NasirkhanBot (আলোচনা | অবদান) কর্তৃক ১৮:০৯, ৪ মে ২০১৪ তারিখে সংশোধিত সংস্করণ (Added Ennglish article link)
(পরিবর্তন) ← পূর্বের সংস্করণ | সর্বশেষ সংস্করণ (পরিবর্তন) | পরবর্তী সংস্করণ → (পরিবর্তন)

আরাকান  মায়ানমার (বার্মা)-এর একটি অঙ্গরাজ্য। এটি বাংলাদেশের দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্বাংশে অবস্থিত এবং অতি প্রাচীনকাল থেকে রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিকভাবে বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পৃক্ত।  বঙ্গোপসাগর এবং নাফ নদীর দক্ষিণ-পশ্চিম মোহনা-বেষ্টিত আরাকান-ইয়োমা নামের দীর্ঘ পর্বতশৃঙ্গ আরাকানকে মায়ানমারের অন্যান্য অংশ থেকে আলাদা করেছে।

আরাকানের প্রাচীন নাম ‘রাখাইনপিয়ে’। রাখাইন শব্দটি এসেছে  সংস্কৃত রাক্ষস এবং  পালি শব্দ ইয়াক্কা (যক্ষ) থেকে যার অর্থ দৈত্য অথবা দানব। বৌদ্ধধর্ম প্রচারের আগে অধিকাংশ আরাকানি ছিল প্রকৃতি পূজক।

বর্তমানকালের আরাকানের চারটি প্রশাসনিক ইউনিট হচ্ছে স্যান্ডোয়ে, সিটটয়ে, মাইয়ু এবং কিয়াউকপিউ। কোলাদানের মুখে অবস্থিত আকিয়াব আরাকানের রাজধানী শহর এবং প্রধান বন্দর। ১৮২৬ সালে ব্রিটিশ শাসনের আগে এটি ছিল একটি ছোট্ট মৎস্য পল্লী। অন্যান্য প্রধান শহর এবং বন্দরগুলি হচ্ছে কিয়াকটও, মংডো, বুথিডং এবং স্যান্ডোয়ে।

আরাকানিদের প্রধান খাদ্য ভাত। জনসংখ্যা প্রায় দু মিলিয়ন, এর মধ্যে অধিকাংশই বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী। জনসংখ্যার অবশিষ্ট অংশের মধ্যে রয়েছে  ইসলাম, হিন্দু, খ্রিস্ট এবং অন্যান্য ধর্মাবলম্বী। সংখ্যার দিক থেকে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের পরেই মুসলমান সম্প্রদায়ের অবস্থান। এরা চারটি দল যথা তামবুকিয়া, তুর্ক-পাঠান, কামাঞ্চি এবং রোহিঙ্গ্যা নামে পরিচিত। তামবুকিয়াদের ইতিহাস শুরু হয়েছে আট শতক থেকে যখন তাদের পূর্বপুরুষরা রাজা মহা তায়িং চন্দ্রের (৭৮৮-৮১০) শাসনামলে আরবদেশ থেকে দক্ষিণ আরাকানে এসে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে থাকে। তুর্ক-পাঠানরা আরাকানের সর্বশেষ রাজধানী ম্রোহং-এর শহরতলি এলাকায় তাদের প্রধান নিবাস গড়ে তোলে। আরাকানি রাজা মীন সোয়া মুয়ং ওরফে নরমিখলা (১৪০৩-৩৩) বাংলার সেনাবাহিনীতে কর্মরত তাঁর পূর্বপুরুষদের সহায়তায় রাজক্ষমতা পুনর্দখল করে। তামবুকিয়াদের মতো তারা রাজার অনুমোদনক্রমে আরাকানে স্থায়ী নিবাস গড়ে। কামানঞ্চিদের পূর্বপুরুষ এসেছিল শাহ সুজার বংশধরদের মধ্য থেকে। বাংলার গভর্নর  শাহ সুজা (১৬৩৯-৫৯) তাঁর ভাই আওরঙ্গজেব কর্তৃক পুনরায় সিংহাসন দখলের পর সপরিবারে আরাকানে আশ্রয় গ্রহণ করেছিলেন। তাদের বংশধরদের অনেককেই রমরী দ্বীপে দেখা যায়। রোহিঙ্গ্যাদের বংশধররা চট্টগ্রাম থেকে আসা মুসলমান এবং বর্তমানে তাদের বসবাস প্রধানত উত্তর আরাকানে কেন্দ্রীভূত। সাধারণত অতীতে তাদের অভিবাসন সংঘটিত হতো কৃষি মৌসুমে, আরাকানে কৃষি শ্রমিকের ঘাটতির সময়ে।

বাংলার দক্ষিণ-পূর্বাংশের সাথে ভৌগোলিক নৈকট্যের কারণে আরাকানের সঙ্গে বাংলার রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে। ক্ষমতার রদবদল বা উঠানামার সাথে দু দেশের রাজনৈতিক সম্পর্ক ছিল পরস্পরের ওপর নির্ভরশীল। বাংলার সুলতান বারবাক শাহর দুর্বলতার সুযোগ গ্রহণ করে বোসাউপিউ ১৪৫৯ খ্রিস্টাব্দে চট্টগ্রাম জেলা দখল করে নেন। ১৬৬৬ সালে মুগলদের দ্বারা বিতাড়িত না হওয়া পর্যন্ত প্রায় দুই শত কাল ধরে আরাকানিরাই এখানে রাজত্ব করে। মুসলমান সংস্কৃতি আরাকানের জনগণের জীবন এবং আরাকানের ইতিহাসকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে। পাঠান সুলতানের মতো আরাকানের রাজারা বাংলা সাহিত্যকে পৃষ্ঠপোষকতা করেন এবং বিভিন্ন অঞ্চলের অনেক মেধাবী কবিকে আরাকান রাজসভায় জায়গা করে দেন। অনেক বাঙালি মুসলমান কবি আরাকান রাজসভায় অংশগ্রহণ করেন। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, কবি আশরাফ খান রাজা থাদোমেন্তরের (১৬৪৫-৫২) সময় যুদ্ধমন্ত্রী পদে অধিষ্ঠিত হন। আশরাফ খান ‘উজির লস্কর’ নামে সুপরিচিত ছিলেন। তিনি ছিলেন শক্তিশালী মন্ত্রী এবং তাঁর কৃতকর্মের জন্য রাজা তাঁকে একটি তলোয়ার ও কিছু হাতি দিয়ে পুরস্কৃত করেছিলেন। আরাকান রাজসভায় মধ্যযুগের আরো দুজন বিখ্যাত বাঙালি কবি তাদের প্রতিভার স্বাক্ষর রাখেন। এরা হলেন, দৌলতকাজী ও আলাওল। এদের মধ্যে মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি আলাওল আরাকান রাজসভায় অমাত্য হিসেবে স্থান পান। আরাকান রাজা ও মন্ত্রীরা তাকে পৃষ্ঠপোষকতা প্রদান করেন এবং তাদের প্রেরণায় তিনি বাংলায় ছয়টি পুস্তক রচনা করেন। এর মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত হলো হিন্দি কবি মালিক মুহম্মদ জায়সীর কাব্য অনুসরণে লেখা পদ্মাবতী গ্রন্থটি।

আরাকানি শাসনামলে চট্টগ্রামে নিজেদের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সুদৃঢ় করার জন্য ত্রিপুরা ও মুসলমান অধিকৃত অঞ্চলে অগ্রবর্তী প্রতিরক্ষা ঘাঁটি হিসেবে মাটির দুর্গ বা কোট নির্মাণ করে। চট্টগ্রামের উত্তরাঞ্চলে মীরসরাই, ফটিকছড়ি ও হাটহাজারীতে আরাকানিদের নির্মিত বেশ কিছু মাটির কোট বা দুর্গ ছিল। সীতাকুন্ডে তাঁরা নির্মাণ করেছিল কাঠের দুর্গ। সমুদ্রবেষ্টিত সন্দ্বীপেও ছিল কাঠের দুর্গ। কাঠগড় নামে পরিচিত সেসব স্মারকের কোনো চিহ্ন এখন আর নেই। মাটির তৈরি আরাকানি দুর্গ সমূহকে বলা হত ‘কোট’। মাটির দুর্গগুলি ‘কোটের পাড়’ নামেও পরিচিতি লাভ করে। কোট শব্দটি সংস্কৃত ‘কোট্ট’ থেকে উৎপন্ন হয়েছে, যার অর্থ দুর্গ। কোটের অধিপতি, কোট্টপাল,  অর্থাৎ ‘দুর্গরক্ষক’। বাংলাদেশে পাথর সহজলভ্য নয় বলে প্রাচীন কাল থেকে এ অঞ্চলে প্রতিরক্ষার জন্য মাটির  দুর্গ নির্মিত হয়ে এসেছে। সম্ভবত আরাকানিরাই এদেশে প্রথম মাটির দুর্গ বা কোট নির্মাণ করেছিল। পরবর্তী সময়ে মোগলরাও এ দুর্গসমূহ ব্যবহার করেছিল। আরাকানিদের নির্মিত কোটেরপাড় জাঁহাপুর, হাটহাজারী, কাঠিরহাট ও ফতেয়াবাদ অঞ্চলে ছিল। এর মধ্যে হিঙ্গুলী কোটটির অংশবিশেষ বিশ শতকের শেষ পর্যন্তও টিকে ছিল। পরবর্তী সময়ে মাটির পাড়গুলো কেটে সমান করে গড়ে উঠেছে বাড়ি-ঘর, পুকুর। জমিতে চাষাবাদও শুরু হয়েছে। জাঁহাপুর কোটের পাড়ের অংশ বিশেষ আজও দেখতে পাওয়া যায়।

১৬৬৬ সালে চট্টগ্রামের পতনের পর আরাকান রাজ্য সংকুচিত হয়ে একটি ছোট্ট অঞ্চলে পরিণত হয় এবং রাজনৈতিকভাবে বেশ অস্থিতিশীল হয়ে ওঠে। ১৭৩১ থেকে ১৭৮৪ সালের মধ্যে আরাকান রাজ্যকে ১৩ জন রাজা শাসন করেন এবং এ রাজাদের গড় শাসনকাল দু বছরের বেশি ছিল না। ১৭৮৪ সালে বোদাউপায়ার (১৭৮২-১৮১৯) সময়ে আরাকান রাজ্য বার্মা পর্যন্ত বর্ধিত করা হয় এবং ১৮২৬ সালে এটি ব্রিটিশ ডোমিনিয়নের অংশে পরিণত হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ১৯৪২ থেকে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত এটি সাময়িকভাবে জাপানের দখলে ছিল। ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি বার্মা স্বাধীনতা লাভ করে।

স্বাধীনতা লাভের পরপরই ১৯৪৮ সালে বার্মায় আরাকানি বৌদ্ধ এবং মুসলিম রোহিঙ্গ্যাদের মধ্যে উত্তেজনা বাড়তে থাকায় বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গ্যা কক্সবাজার এ শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় নেয়। বর্মি সরকার অভিযোগ উত্থাপন করে যে, রোহিঙ্গ্যারা ভারতীয় উপমহাদেশ থেকে সদ্য অভিবাসিত একটি উপজাতি। অতএব তাদেরকে স্থানীয় আদিবাসী গণ্য করে বর্মি শাসনতন্ত্র অনুযায়ী বার্মার নাগরিকত্ব দেওয়া যায় না। ১৯৭৮ সালের মার্চে বর্মি সরকার ব্যাপক ধরপাকড় শুরু করলে বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গ্যা বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। ১৯৯১-১৯৯২ সালে বার্মা থেকে প্রায় ২,৫০,০০০ জন রোহিঙ্গ্যা বাংলাদেশে প্রবেশ করে। এ ঘটনা রাজনৈতিক, সামাজিক এবং অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে দ্রুত জটিল পরিস্থিতি সৃষ্টি করে, এতে মানবাধিকারও বিঘ্নিত হতে থাকে। ১৯৯৬ এবং ১৯৯৭ সালে কয়েক লক্ষ রোহিঙ্গ্যা বাংলাদেশে প্রবেশ করে। তাদের মধ্য থেকে প্রায় ২,০০,০০০ জন আরাকানে ফিরে যায়। সাম্প্রতিক হিসাব অনুসারে প্রায় ২০,০০০ জন রোহিঙ্গ্যা এখনও বাংলাদেশেই রয়ে গেছে। ফলে সীমান্ত এলাকায় জনমনে অসন্তোষ, পরিবেশ বিপর্যয়, কালোবাজারি কারবার ইত্যাদি সমস্যা সৃষ্টি হচ্ছে। এসব কারণে বাংলাদেশ এবং মায়ানমারের মধ্যে শীতল সম্পর্ক বিরাজ করছে।  [সাদাত উল্লাহ খান]