হাম্মাম
হাম্মাম সম্প্রদায়ভুক্তদের একত্রে গোসল অথবা শুধুই গোসল করার স্থান। এটি ফার্সি শব্দ। উচ্চারণ hu-mam এর ব্যুৎপত্তিগত অর্থ, hammam-hu-mamheat বা তাপ। অন্য এক ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে, at-hamim থেকে এর উৎপত্তি- যার অর্থ ‘গ্রীষ্মের তাপ’। ইসলামী দেশসমূহে হাম্মাম এর ধারণার জন্ম হয়েছিলো। সাধারণত পুরুষ ও নারীদের জন্য পৃথক পৃথক স্থানে গোষ্ঠীবদ্ধভাবে গোসলের ব্যবস্থা করা হতো। আরব দেশসমূহে সাধারণভাবে হাম্মাম শব্দটি ব্যাপকভাবে ‘গোসলখানা’ অর্থেই ব্যবহূত হতো। তুরস্কের সাধারণ জনগনের জন্য নির্ধারিত গোসলের স্থানকেও ‘হাম্মাম’ বলা হতো। মধ্যপ্রাচ্যে হাম্মামসমূহ সামাজিক, সাংস্কৃতিক, ধর্মীয় শুদ্ধিকরণ এবং ঐতিহ্যের ধারা চলমান রাখার মিলন ক্ষেত্র রূপে কাজ করত।
মুসলিম সভ্যতায় প্রথম স্নানাগার বা হাম্মাম নির্মিত হয় এশিয়া মাইনর অঞ্চলে। তুরস্ক এবং পারস্যে-এর চূড়ান্ত বিকাশ ঘটে। উমাইয়া যুগে নির্মিত ‘কুসায়ের আমরা প্রাসাদ’ সংলগ্ন হাম্মামটি মুসলিম সভ্যতার প্রথম স্নানাগার। এর নির্মাণকাল ৭১২-৭১৫ খ্রিস্টাব্দ। আববাসী যুগেও হাম্মাম নির্মাণের ধারা অব্যাহত থাকে। তুর্কিদের সংস্পর্শে এসে এই ধারণা মধ্যপ্রাচ্য থেকে ইউরোপে যায় এবং সেখানে তা ‘তার্কিশ হাম্মাম’ নামে পরিচিতি পায়। ভিক্টোরিয় যুগেই পশ্চিম ইউরোপে মানুষের গোসল করা ও আরাম করার নিয়ামক হিসেবে হাম্মাম জনপ্রিয় হয়েছিল।
বাংলার মধ্যযুগের স্থাপত্যের মধ্যে হাম্মাম বিশেষ এক বৈশিষ্ট্য বয়ে এনেছিল। বাংলায় হাম্মাম ছিল সেক্যুলার স্থাপনা। স্থাপত্যিক সৌকর্যে ও মুসলিম রাজসিক ঐতিহ্যের সঙ্গে এর সম্পর্ক বিশেষ বৈশিষ্টপূর্ণ স্থান দখল করে আছে। তুরস্কের মুসলমানেরা এই ধারণা পেয়েছিলো ইজিয়ান গ্রিক ও রোমানদের কাছ থেকে। আরও আগে প্রাচীন সিন্ধু সভ্যতায় বড় আকারের স্নানাগার নির্মাণের প্রমাণ আছে। মহেঞ্জোদারোর ‘বৃহৎ স্নানাগার’ (Great Bath) এর নাম এক্ষেত্রে উলেখযোগ্য। বাংলায় হাম্মাম স্থাপত্যের বিকাশ ঘটেছে মধ্যযুগের শেষভাগে। সুলতানী (তেরো শতকের সূচনা পর্ব থেকে ষোলো শতকের প্রথমার্ধ) এবং মোগল যুগে বাংলায় স্থাপত্যশিল্পের বিকাশে ব্যাপক উৎকর্ষ সাধিত হয় এবং নির্মাণশৈলীতে উলেখযোগ্য পরিবর্তন ঘটে। মধ্যযুগের বাংলার সমাজ কাঠামো এবং সংস্কৃতিতে স্থাপত্য হিসেবে হাম্মামখানা একটি নতুন ও অভিনব সংযোজন। স্থাপত্যবিদ্যার ক্ষেত্রে এই ধরনের গোসলখানা বা ইমারত নতুন ধারণার জন্ম দিয়েছে।
পশ্চিম বাংলার মালদা জেলার হজরত পান্ডুয়ায় অবস্থিত সাতাইশগড় হাম্মামখানাটি প্রাচীনতম হাম্মামখানা হিসেবে চিহ্নিত। ১৮০৮ সালে বুকানন হ্যামিলটন হাম্মামখানাটি পরিদর্শন করেন। এতে মোট সাতাশটি স্নানকক্ষ রয়েছে বলেই স্থাপত্যটির নাম এরূপ হয়েছে বলে ধারণা করা হয়। অপর একটি মতে হযরত পান্ডুয়ার সুলতানী প্রাসাদটি এক সময় সাতাশটি গ্রাম সংলগ্ন স্থানে অবস্থিত ছিল বলেই হাম্মামখানাটির এমন নাম হয়েছিল। উত্তর ভারতের ফতেহপুর সিক্রির হাম্মামখানাসমূহ স্থাপত্যিক সৌকর্যে অন্যতম। এই হাম্মামসমূহ বাংলা সহ মুগল প্রশাসিত অন্যান্য প্রদেশের হাম্মাম নির্মাণে গভীর প্রভাব বিস্তার করেছিল। পশ্চিম বাংলার গৌড় ও রাজমহলের হাম্মাম দুইটির নির্মাণ কৌশল ও পরিকল্পনায় মুগলদের গড়া উত্তর ভারতীয় স্টাইল অনুসরণ করা হয়েছিল। অধিকাংশ হাম্মামখানা মুগল প্রশাসকদের বাসভবন সমূহের সন্নিকটে নির্মাণ করা হতো।
উত্তর ভারত, পশ্চিম এশিয়া বা ইউরোপ থেকে হাম্মাম নির্মাণের ধারণা বাংলায় প্রবেশ করলেও বাংলায় তা স্বতন্ত্র ধারার স্থাপত্য হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। এখানে মুগল বা প্রাক মুগল সময়ে বেশ কিছু হাম্মাম নির্মিত হয়েছিল। এর মধ্যে এ পর্যন্ত ছয়টি হাম্মামকে চিহ্নিত করা হয়েছে। এগুলো হলো, ঢাকার লালবাগ ও জিনজিরা, যশোরের মির্জানগর, সাতক্ষীরার ঈশ্বরীপুর ও জাহাজঘাটা এবং চাঁপাই নবাবগঞ্জের ছোট সোনা মসজিদ সংলগ্ন হাম্মাম। এদের মধ্যে ঢাকা, মির্জানগর, ঈশ্বরীপুর ও জাহাজঘাটা (দুইটি) হাম্মামখানার নির্মাণ কৌশল ও পরিকল্পনা উত্তর ভারতীয় স্টাইল অনুসরণে নির্মিত।
মির্জানগর হাম্মামটি যশোর জেলার কপোতাক্ষ নদীর তীরে কেশবপুরে অবস্থিত। কালিবাড়ির আঙ্গিনায় অবস্থিত ইট নির্মিত ইমারতটি এখনও পর্যন্ত বাংলাদেশের সুরক্ষিত হাম্মামখানা হিসেবে চিহ্নিত। একটি চার গম্বুজ বিশিষ্ট ইমারতের অভ্যন্তরে রয়েছে চারটি খোলা কক্ষ এবং একটি পাথর ও চুন-সুরকির তৈরি বৃহৎ কূপ। একমাত্র প্রবেশপথটি পশ্চিম দেয়ালে অবস্থিত এবং এর সঙ্গে সংযুক্ত ১৭ ফুট তিন ইঞ্চি মাপের বর্গাকৃতির কক্ষটি সম্ভবত প্রসাধন কক্ষ (সভাকক্ষ বা উষ্ণ কক্ষও হতে পারে)। কক্ষের চার পাশের প্রত্যেক দেয়ালে রয়েছে একটি করে কুলুঙ্গি। প্রসাধন কক্ষ থেকে খিলানযুক্ত ধনুকাকার পথ দিয়ে সোজা অপর আরেকটি বর্গাকৃতি কক্ষে প্রবেশ করা যায়। কক্ষটি পোশাক বদলানোর কাজে ব্যবহার করা হতো। এর উত্তর-দক্ষিণ কোণে রয়েছে একটি ছোট জলাধার বা ট্যাঙ্ক। এই কক্ষের পূর্বে রয়েছে দুইটি বর্ধিত গম্বুজাকৃতির কক্ষ যা ছিল সম্ভবত মূল গোসলখানা। কক্ষে কোন বড় জানালা নেই। তবে কেবলমাত্র একটি ছোট অর্ধগোলাকার জানালা সদৃশ ফোকর (oeil-de-beuf or blue-eyes) দিয়ে আলো ঢোকার পথ করা হয়েছিল। এর বাইরে পূর্ব পাশের লাগোয়া চারটি খোলা কক্ষ সম্ভবত জলাধার হিসেবে ব্যবহূত হতো। জলাধারে পানি ধরে রেখে সেখান থেকে মাটির পাইপ এর মাধ্যমে ভেতরের গোসলখানার জলাধারে পানি সরবরাহ করা হতো। সম্পূর্ণ হাম্মামখানাটির মাঝ বরাবর রয়েছে একটি পানি গরম করার চুলি যা মাটির নীচ থেকে একটি টানা পাইপ (hypocaust-heat from bellow) দ্বারা সংযুক্ত।
জাহাজঘাটা হাম্মামটি বাংলাদেশের সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগর থানা সদরের চার কিলোমিটার উত্তরে অবস্থিত। আশির দশকে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর এটির সংস্কার ও প্রায় সম্পূর্ণ পুনর্নির্মাণ করে। নির্মাণশৈলীর দিক থেকে জাহাজঘাটা হাম্মামটি মুগল স্থাপত্যের বৈশিষ্ট্য বহন করে। সুন্দরবনের একাংশ জাহাজঘাটায় ষোল শতকের শেষভাগে ভূঁইয়াদের অন্যতম প্রতাপাদিত্যের প্রশাসনিক কেন্দ্র ছিল। কিন্তু মুগল আক্রমণে তাঁর পতন হলে জাহাজঘাটার গুরুত্ব কমে যায়। আঠারো শতকের শেষভাগে এ এলাকায় পুনরায় বসতি গড়ে ওঠে। হাম্মামখানাটি মুগল বৈশিষ্ট্য ধারণ করলেও এটি ঠিক কখন নির্মিত তার কোনো সঠিক তথ্য পাওয়া যায় না। তবে জমিদার প্রতাপাদিত্যের সময় নির্মিত হয়েছিলো বলে অনুমান করা হয়। হাম্মামটির নির্মাণ কাঠামোতে জটিল স্থাপত্যিক কৌশল অবলম্বন করা হয়েছে বলে বিশেষজ্ঞদের মত। উত্তর-দক্ষিণে দীর্ঘ আয়তাকার দালানটিতে মূল কক্ষ রয়েছে পাঁচটি। অতিরিক্ত ষষ্ঠ কক্ষটির অভ্যন্তরে রয়েছে কূপের অবস্থান। হাম্মামখানাটিতে রয়েছে বিশ্রাম কক্ষ, পোশাক পরিবর্তন কক্ষ, প্রসাধন কক্ষ, এবং স্নানকক্ষ। পুনর্নির্মাণের ফলে হাম্মামটির মূল বা আদি স্থাপত্যশৈলী ও নির্মাণ উপকরণ চিহ্নিত করা কঠিন। হাম্মামখানার অলংকরণের মধ্যে ভেতরের দেয়ালে কুলুঙ্গি ও প্যানেল-এর প্রাধান্য রয়েছে।
ঈশ্বরীপুর হাম্মামটি স্থানীয়ভাবে হাবসিখানা নামে পরিচিত। সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগর থানার প্রায় ৫ কিলোমিটার দক্ষিণ পূর্বে ঈশ্বরীপুর হাম্মামখানাটির অবস্থান। মধ্যযুগে এ অঞ্চল সুন্দরবনের অন্তর্ভুক্ত ছিল। হাম্মাম এর নির্মাণকাল সম্পর্কে নির্দিষ্ট করে কিছু বলা যায় না। তবে, মুগল পর্বে অর্থাৎ সতেরো শতকের শুরুতেই এটি নির্মিত বলে ধারণা করা হয়ে থাকে। কারণ এর নির্মাণশৈলী ও অলংকরণে মুগল ছাপ সুস্পষ্ট। তিন কক্ষবিশিষ্ট আয়তাকার এ হাম্মামখানার ছাদে গম্বুজ রয়েছে। তিন কক্ষের মধ্যে রয়েছে প্রাক স্নানকক্ষ, স্নানকক্ষ এবং জল সংরক্ষণাগার ও চুলিকক্ষ। হাম্মামখানার অলংকরণের কোনো চিহ্নই এখন খুঁজে পাওয়া যায় না। প্রথম নির্মাণকালে এর অভ্যন্তরভাগে প্যানেল ও কুলুঙ্গির ব্যবহার হয়েছিল। গম্বুজের নিচের দিকে স্তম্ভের সঙ্গে খিলানের মিলনস্থলে সূঁচাকৃতির ফুলেল মোটিফ বসানো রয়েছে। হাম্মামে গরম ও ঠান্ডা পানি সরবরাহের ব্যবস্থা ছিল। নির্মাণ উপকরণ ছিল ইট ও চুন-শুরকি এবং পানি সরবরাহের জন্য ২ ইঞ্চি ব্যাসের পোড়ামাটির নল ব্যবহূত হয়েছে। এটি বাংলায় নির্মিত একমাত্র হাম্মাম যার কক্ষ অভ্যন্তরে স্তম্ভ রয়েছে।
দুর্গ নগরী গৌড়ের বড় সোনা মসজিদ অঞ্চলের ফিরোজপুর গ্রামের তাহখানা বা শাহ সুজার বিশ্রাম প্রাসাদ কমপেক্স এর অভ্যন্তরে বৃহদাকার জলাধারের পাশের ইমারতটি হাম্মাম হিসেবে পরিচিত। বর্তমান এটি চাঁপাই নবাবগঞ্জ জেলার শিবগঞ্জ থানা সদর হতে প্রায় ১৩ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে অবস্থিত। দ্বিতল এই হাম্মামটির নির্মাণকাল সম্পর্কে কোনো লিখিত সূত্র না থাকলেও নির্মাণশৈলী এবং গৌড় অঞ্চলের ইতিহাস পর্যালোচনায় ধারণা করা হয় যে, বাংলার সুবাদার শাহ সুজা (১৬৩৯-১৬৬০) সতেরো শতকের প্রথম পর্বে এটি নির্মাণ করেন। উত্তর-দক্ষিণে আয়তাকার হাম্মামটির দু’টি তলার নির্মাণকৌশল একটির থেকে অপরটি পৃথক। তাহখানা নামে হাম্মাম-এর যে কক্ষটিকে বোঝানো হয়েছে সেটি একটি ভূগর্ভস্থ কক্ষ। কক্ষটি মূল ইমারতের পূর্ব দিকের ভিত্তির সঙ্গে লাগোয়াভাবে তৈরি। তাহখানায় যাওয়ার জন্য রয়েছে একটি সিঁড়ি। এছাড়াও ছাদে ওঠার জন্য রয়েছে আরও দু’টি সিঁড়ি। হাম্মামের প্রথম তলাটিই ইমারতের মূল অংশ। এতে রয়েছে বিশ্রাম কক্ষ, নামায ঘর, উন্মুক্ত হল ঘর, হল ঘর, দরবার কক্ষ, কূপ যুক্ত কক্ষ, পোশাক পরিবর্তন কক্ষ, স্নান কক্ষ, চুলিকক্ষ ইত্যাদি। মূল ইমারতটি ইট নির্মিত হলেও-এর সঙ্গে পাথর ও কাঠও ব্যবহূত হয়েছে। ছাদের কড়ি বা বিমে কাঠ এবং দরোজার সিলে পাথরের ব্যবহার হয়েছে। এটি একটি ব্যতিক্রমধর্মী ইমারত। এর নির্মাণ পদ্ধতিও স্বতন্ত্র। হাম্মামটির দেয়াল বাংলাদেশে টিকে থাকা হাম্মামসমূহর মধ্যে সবচেয়ে কম চওড়া এবং এর ছাদ সমতল ও গম্বুজাকৃতি, এই মিশ্র রীতিতে নির্মিত।
সবচেয়ে সুরক্ষিত অবস্থায় টিকে থাকা ঢাকার লালবাগ দুর্গ অভ্যন্তরের হাম্মামখানাটি অধিক জাঁকজমকপূর্ণ। ঢাকার লালবাগ অঞ্চলে মুগল সুবাহদার শায়েস্তা খানের (১৭শতকের দ্বিতীয়ার্ধে) সময়ে এই হাম্মামখানাটি নির্মিত হয়। সে সময়ে প্রায় ১ কিলোমিটারেরও কম দূরত্ব থেকে বুড়িগঙ্গা নদী বয়ে যেতো এবং হাম্মামের অভ্যন্তরে পানি সরবরাহের জন্য বুড়িগঙ্গাই ছিল একমাত্র উৎস। এটি একটি দ্বিতল ও আয়তাকার ভবন এবং জটিল স্থাপত্যিক পরিকল্পনার নির্মিত। লালবাগ হাম্মামটির নিচের তলার দৈর্ঘ্য ৮.১০ মিটার এবং প্রস্থে ৫.৫৬ মিটার। নিচতলার উত্তর ও দক্ষিণপ্রান্তে রয়েছে দু’টি সিঁড়ি কক্ষ এবং এ সিঁড়ি কক্ষে জানালা রয়েছে। পূর্ব-পশ্চিমে রয়েছে বিশ্রামকক্ষ, সবচেয়ে বড়টি সদর কক্ষ এবং তাতে রয়েছে চৌবাচ্চার মধ্যভাগে একটি ফোয়ারা। পূর্ব-পশ্চিমে আরো আছে একটি পরিচারিকা কক্ষ যার সঙ্গে রান্নাঘরে যাওয়ার সংযোগ পথ রয়েছে। আরও রয়েছে শৌচাগার, জলসংরক্ষণ কক্ষ, স্নানকক্ষ, পোশাক পরিবর্তন কক্ষ এবং চুলি কক্ষ। তাছাড়াও শীতকালে সম্পূর্ণ হাম্মামখানাকে গরম রাখার জন্য ছিল অভিনব পন্থায় গরম রাখার ব্যবস্থা। মাটির নিচের গরম কক্ষের উষ্ণ বাতাস প্রবাহিত করে হাম্মাম এর প্রত্যেক স্তম্ভ এবং দেয়ালের অসংখ্য ছিদ্র দিয়ে ছড়িয়ে দেয়ার মাধ্যমে পুরো দালানটিকে গরম করে রাখার ব্যবস্থা ছিল। দ্বিতীয় তলাটি প্রথম তলার পূর্ব অংশের ওপর নির্মিত। এতে রয়েছে তিনটি কক্ষ। মাঝের কক্ষটি সবচেয়ে বড় এবং অষ্টভূজাকৃতির। এতে প্রবেশ পথ রয়েছে তিনটি। এটি দুর্গের দরবার কক্ষ হিসেবে ব্যবহূত হতো বলে ধারণা করা হয়। বাকি দু’টি কক্ষ বিশ্রামঘর হিসেবে ব্যবহূত হতো। হাম্মামটি চমৎকারভাবে অলংকৃত। দেয়াল কেটে প্যানেল তৈরি, নিচের সদরকক্ষের ওপরে চৌচালাকৃতির ছাদ প্রভৃতি এতে ভিন্ন মাত্রার সৌন্দর্য দান করেছে। স্নানাগার এর অংশে বেশ কয়েকটি গম্বুজের মধ্যে কেন্দ্রীয় গম্বুজটিতে রয়েছে জালির কাজ করা। তাছাড়াও রয়েছে সাদা কালো ষড়ভূজাকৃতির টালি বসানো। নিরাপত্তার জন্য রয়েছে প্রহরী কক্ষ। লালবাগ হাম্মামখানাটির নির্মাণ পদ্ধতিতে মুগল স্থাপত্যেরশৈলীর ছাপ সুস্পষ্ট। এটি একটি পূর্ণাঙ্গ হাম্মাম কমপেক্স হিসেবে চিহ্নিত।
জিনজিরা প্রাসাদ কমপ্লেক্স এর দ্বিতীয় ব্লকটি হাম্মামখানা হিসেবে চিহ্নিত। এটি ঢাকা জেলার কেরানীগঞ্জ সদর থেকে ৪ কিলোমিটার পশ্চিমে অবস্থিত। মুগল সুবাহদার ইবরাহিম খান ফতেহ জঙ্গ (প্রথম) সতের শতকের শেষভাগে এটি নির্মাণ করেন বলে ঐতিহাসিকদের অভিমত। এই হাম্মামটি পূর্ব-পশ্চিমে দীর্ঘ এবং এর নয়টি কক্ষএখনো পর্যন্ত টিকে রয়েছে। একতলা এ হাম্মামের ছাদ গম্বুজাকৃতি, চৌচালাকৃতি ও সামান্য উঁচু বৃত্তাকার ভল্ট বিশিষ্ট এবং মাঝে রয়েছে ছিদ্র। অন্যান্য হাম্মাম-এর মতই এতে রয়েছে সদর কক্ষ, বিশ্রাম কক্ষ, স্নানকক্ষ, গরম পানির কক্ষ, পানি সংরক্ষণ কক্ষ, প্রসাধন কক্ষ, প্রক্ষালণ কক্ষ প্রভৃতি। হাম্মামের নির্মাণের প্রধান উপকরণ ইট এবং পানি সরবরাহের জন্য পোড়ামাটির নল রয়েছে। জিনজিরা হাম্মাম-এর কক্ষগুলো বিভিন্ন আকৃতির ভল্ট দিয়ে আচ্ছাদিত এবং এই ইমারতের একটি মাত্র গম্বুজ তৈরি হয়েছে স্নানকক্ষের ছাদে। মেরামত বা সংস্কারের কারণে জিনজিরা হাম্মামটি বর্তমানে তার পূর্বের বৈশিষ্ট্য বা রূপ ধরে রাখতে না পারলেও মুগল স্থাপত্যের বৈশিষ্ট্যগুলো এ ক্ষেত্রে পরিদৃষ্ট হয়।
বাংলাদেশে প্রাপ্ত হাম্মাম সমূহের মধ্যে নির্মাণশৈলী এবং স্থাপত্যিক কৌশলে প্রায় একই বৈশিষ্ট্য দেখা যায়। সাধারণত রাজকীয় ইমারত-এর সঙ্গেই হাম্মামখানা নির্মিত হতো। সাধারণ জনগণ বা কোনো ধনাঢ্য সাধারণ মানুষের প্রয়োজনে কোনো হাম্মাম নির্মিত হয়নি। সে কারণেই হয়তো বাংলাদেশে স্বল্প সংখ্যক হাম্মাম-এর অস্তিত্ব পাওয়া যায়। তবে হাম্মাম শিল্পটি যেহেতু মুগল দরবারী মেজাজের সঙ্গে উত্তর ভারতে প্রথম প্রবেশ করে, সেহেতু ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে স্থাপত্যের এ ধারার বিকাশ ঘটেছিলো বেশি। বাংলাদেশের স্থাপিত অন্যান্য স্থাপত্যিক ধারা যেভাবে স্থানীয় ভাবধারা, জলবায়ু এবং কৌশলগত দিকটি একসঙ্গে মিশে গিয়ে নতুন ধারার সৃষ্টি করেছিলো, হাম্মামখানা নির্মাণের ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম ছিল না। [আয়শা বেগম এবং নাসরীন আক্তার]