অস্টেন্ড কোম্পানি
অস্টেন্ড কোম্পানি ইউট্রেক্টের সন্ধির পর ভারতে বাণিজ্যিক কার্যক্রম পরিচালনার লক্ষ্যে অস্ট্রিয়ার সম্রাটের পরিকল্পনা অনুযায়ী গঠিত হয়েছিল। ১৭১৪ সালে সম্রাট অস্টেন্ডে কোম্পানির বন্দর প্রতিষ্ঠা করে কোম্পানিকে ভারতে জাহাজ পাঠানোর ক্ষমতা দান করেন।
কোম্পানি মুর্শিদকুলী খানের কাছ থেকে একটি পরওয়ানা লাভ করে বাঁকিবাজারে (বর্তমান ইছাপুর) বাণিজ্যকুঠি স্থাপন করে এবং এ কুঠিতে কামান বসিয়ে সুরক্ষিত করা হয়। ইংরেজ ও ওলন্দাজরা নওয়াবের কাছে অস্টেন্ড কোম্পানির বিরুদ্ধে অভিযোগ উত্থাপনের জন্য হুগলির ফৌজদার আহসানউল্লাহ্ খানকে ঘুষ প্রদান করে। নওয়াব অস্টেন্ড কুঠির প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা অপসারণের আদেশ দেন। অস্টেন্ড কোম্পানি এতে অস্বীকৃতি জানালে হুগলির একজন কাশ্মীরি মুসলমান বণিকের মধ্যস্থতার চেষ্টা সত্ত্বেও যুদ্ধ শুরু হয়। ফরাসি দলিলপত্র (অপ্রকাশিত) থেকে মনে হয়, ১৭২৪ সালের দিকে এ ঘটনা ঘটেছিল। অস্টেন্ড কোম্পানির প্রথম জাহাজটি ১৭১৯ সালে বালেশ্বরে পৌঁছে এবং মুর্শিদকুলী খান ১৭২১ সালে পরওয়ানা জারি করেন।
ইংরেজ ও ওলন্দাজদের বৈরিতা সত্ত্বেও অস্টেন্ড কোম্পানির বাণিজ্য অব্যাহত থাকে। ১৭২৪ সালে হুগলির ফৌজদার দেশের আইন অমান্য করার অভিযোগে অস্টেন্ড কোম্পানির বাণিজ্যকুঠি আক্রমণ করেন এবং এতে বাণিজ্যকুঠির প্রধান নিহত হন। তবুও অন্য একটি জাহাজ কিছু তহবিল নিয়ে আসায় ১৭২৫ সালে বাংলায় কোম্পানির পণ্য ক্রয় অব্যাহত থাকে।
ইউরোপে আইলা-শ্যাপেলের সম্মেলনে (১৭২৭) স্পেনের রাজা সম্রাটের পক্ষ ত্যাগ করেন এবং ইংরেজ ও ওলন্দাজগণ কোম্পানির কর্মকান্ডের বিরুদ্ধে আপত্তি জানায়। তখন এরূপ সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় যে, বাংলায় অস্টেন্ড কোম্পানির একটি বাণিজ্য দপ্তর থাকবে, তবে সাত বছর পর্যন্ত সেখানে কোনো জাহাজ পাঠানো হবে না।
খাজা সফর নামে এক আর্মেনীয় বণিক বালেশ্বরে অস্টেন্ড কোম্পানিকে একটি বাণিজ্যকুঠি প্রতিষ্ঠার অনুমতি দানের জন্য তথাকার ফৌজদারকে রাজি করান। ইংরেজ ও ওলন্দাজরা এতে বাধা দেয় এবং অস্টেন্ড কোম্পানিকে বিতাড়িত করার জন্য তারা ফৌজদারকে ১ লক্ষ ২৫ হাজার টাকা দেওয়ার প্রস্তাব করে। ইত্যবসরে সরফরাজ খানের মাধ্যমে অস্টেন্ড কোম্পানি ১ লক্ষ ২০ হাজার টাকা প্রদানের বিনিময়ে তাদেরকে পরওয়ানা দিতে নওয়াবকে সম্মত করায়। ফরমান লাভের জন্য তারা নওয়াবকে আরও ১ লক্ষ টাকা দিতেও সম্মত হয়। অস্টেন্ড কোম্পানি ৩০ হাজার টাকা প্রদান করে এবং জগৎ শেঠ এর নিকট ৭০ হাজার টাকা জমা রাখে। মৃত্যুর দুসপ্তাহ আগে মুর্শিদকুলী খান অস্টেন্ড কোম্পানি-প্রধানকে একটি শিরোপা এবং বাঁকিবাজারে তাদের বাণিজ্যকুঠি স্থাপনের অনুমতি দিয়ে পরওয়ানা জারি করেন।
ইউরোপে অস্ট্রিয়ার সম্রাট এ চুক্তি থেকে বেরিয়ে আসতে চেয়েছিলেন এবং তিনি ডেনমার্ক ও সুইডেনের সঙ্গে একটি জোট গঠন করেন। পোল্যান্ড ভারতে দুটি জাহাজ পাঠানোর প্রস্ত্ততি গ্রহণ করছিল বলে এতে যোগদান করে নি। ইংরেজ ও ওলন্দাজরা এ জাহাজ দুটি দখল করে এবং ডেনমার্ককে জোট ত্যাগ করতে রাজি করায়। চন্দননগরের ফরাসিরা পোল্যান্ডের বণিকদের নিরাপত্তা দান করে।
১৭৩০ সাল নাগাদ হুগলি নদীর তীরবর্তী এলাকায় পলাতক ইউরোপীয় সৈন্য ও ভাগ্যান্বেষীরা ভিড় করে। প্রথমে দিনেমাররা ও পরে অস্টেন্ড কোম্পানি তাদের নিয়োগ দান করে। এদের মধ্যে সবচেয়ে উদ্যোগী ছিলেন অ্যান্টওয়ার্পের ফ্রাঁসোয়া ডি শোনমিলে। তিনি নিজেকে বাঁকিবাজারের প্রধান বলে ঘোষণা করেন। ইতোমধ্যে দিনেমাররা বাণিজ্য গুটিয়ে চলে গিয়েছিল এবং অস্ট্রিয়ার সম্রাট প্রথমে সাময়িকভাবে কোম্পানির কার্যক্রম বন্ধ এবং পরে তা বিলুপ্ত করেন। অবশ্য এ তথ্য বহু বছর ধরে বাংলায় অজ্ঞাত ছিল।
শোনমিলে দেশিয় বাণিজ্যে নিয়োজিত ছিলেন এবং প্রায়ই ইংরেজ ও ওলন্দাজ বণিকদের সঙ্গে ব্যবসা করতেন। ১৭৩০ সালে তিনি বাংলায় পোল্যান্ডবাসী ও ইঙ্গ-ওলন্দাজ বাণিজ্য জোটের মধ্যে মধ্যস্থতার ব্যর্থ চেষ্টা করেন। এ ধরনের অপর একজন স্বঘোষিত ক্যাপ্টেন ছিলেন জন কম্বেস যিনি নিজেকে অস্টেন্ড কোম্পানির ক্যাপ্টেন বলে ঘোষণা করেন। তিনি হিউমসের সঙ্গে বিবাদে লিপ্ত হন। হিউমস কম্বেসকে তার কলহপরায়ণ নীতি সংযত করা এবং নওয়াবের উপর নির্ভরশীলতা সম্পর্কে সতর্ক করেছিলেন। কিন্তু কম্বেস কোম্পানির বাকি কর্মকর্তাদের বোঝাতে সমর্থ হয়েছিলেন, যদিও ইঙ্গ-ওলন্দাজ জাহাজের ওপর পরিকল্পিত আক্রমণ কোম্পানির নামে করা হবে নাকি পোল্যান্ডের রাজার নামে করা হবে সে সম্পর্কে কেউই নিশ্চিত ছিলেন না। ইংরেজ ও ওলন্দাজরা এ পরিকল্পনা সম্পর্কে জানতে পেরে জাহাজটি দখল করে নেয়। পরিকল্পনা বাস্তবায়নে বিলম্বের জন্য কম্বেস হিউমসকে দোষারোপ করেন। হিউমস তখন শোনমিলেকে বাঁকিবাজারের বাণিজ্যকুঠির দায়িত্ব দিয়ে একটি ফরাসি জাহাজে করে ইউরোপের উদ্দেশে যাত্রা করেন।
ওলন্দাজদের অবরোধ সত্ত্বেও অস্টেন্ড কোম্পানির জাহাজ ১৭৩৩ সাল পর্যন্ত নিয়মিত বাংলায় আসতে থাকে। ডুপ্লের পত্র থেকে এর প্রমাণ পাওয়া যায়, যদিও ১৭৩২ সালের মধ্যে অস্টেন্ড কোম্পানির নিশ্চিত বিলুপ্তি ঘটেছিল। তা সত্ত্বেও একজন ফরাসি পর্যটক ১৭৩৪ সালের জানুয়ারি মাসে বাঁকিবাজারের অস্টেন্ড বাণিজ্যকুঠিতে অস্ট্রিয়ার সম্রাটের পতাকা উড়তে দেখেছিলেন। মনে হয় চুক্তির সাত বছর পর থেকে ইংরেজ ও ওলন্দাজরা সম্রাটের পতাকাবাহী অস্টেন্ড কোম্পানির জাহাজগুলিকে আসার অনুমতি দিয়েছিল। ১৭৩৫ সালের শেষে ডুপ্লে অস্টেন্ড কোম্পানিকে নিঃস্ব অবস্থায় দেখতে পান; তখন তাদের কোনো মূলধন ছিল না, ছিল না কোনো জাহাজ। ১৭৩৯ সালে লেখা ফরাসিদের আরেকটি চিঠিতে অস্টেন্ড কোম্পানির অবস্থাকে নৈরাশ্যকর বর্ণনা করা হয়েছে। ১৭৪৪ সাল পর্যন্ত শোনমিলে ও অস্টেন্ড কোম্পানির অপর কয়েকজন প্রধানত দিনেমার ও সুইডিস পর্যটকদের সাহায্য নিয়ে জীবনযাপন করছিলেন। তাদের দুর্দশার প্রধান কারণ হিসেবে তিনি ভিয়েনা থেকে সহায়তার অভাবকে দায়ী করেছেন। কিন্তু ১৭৪১ সালে বাঁকিবাজারে আগত একজন ফ্লেমিশ বণিকের চিঠি থেকে জানা যায় যে, অস্টেন্ড কোম্পানি ও বাঁকিবাজারের মধ্যে যথেষ্ট বেসরকারি বাণিজ্যিক যোগাযোগ ছিল এবং বাঁকিবাজার বাংলায় ইউরোপীয় অভিযাত্রীদের প্রধান কেন্দ্র হয়ে দাঁড়িয়েছিল।
সম্ভবত ওলন্দাজদের অর্থায়নে ১৭৪৪ সালে হুগলির ফৌজদার মারাঠা বণিকদের সঙ্গে কথিত ষড়যন্ত্রের অভিযোগে শোনমিলেকে জরিমানা করেন। শোনমিলে এ অভিযোগ অস্বীকার করেন এবং ফৌজদারের সৈন্যদলকে আক্রমণ করে সহজেই পরাজিত করেন। এরপর ফৌজদার আরও বেশিসংখ্যক সৈন্যের এক বাহিনী নিয়ে অগ্রসর হলে শোনমিলে ব্রহ্মদেশের সিরিয়ামে পালিয়ে যান এবং সেখানে নির্মমভাবে নিহত হন। বাঁকিবাজার লুণ্ঠিত হয় এবং সম্রাটের পতাকা নামিয়ে ফেলা হয়। অর্থনৈতিকভাবে টিকে থাকতে সম্পূর্ণ সক্ষম অস্টেন্ড কোম্পানিকে রাজনৈতিক কূটকৌশলের যুপকাষ্ঠে বলি দেওয়া হয়।
অস্টেন্ড কোম্পানি প্রধানত বাংলা ও চীনের প্রতি পূর্ণ মনোযোগ দিয়েছিল। ইংরেজদের সঙ্গে প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অবতীর্ণ হওয়ার জন্য তারা সেখান থেকে চা আমদানি করত। ওলন্দাজ ও ফরাসিরা অস্ট্রিয়া থেকে ভারতীয় ও চৈনিক পণ্য অধিকতর সস্তামূল্যে পুনঃরপ্তানি করত বলে তারা অস্টেন্ড কোম্পানির বিরোধিতা করত। পণ্যবহনে কম খরচ এবং অল্পসংখ্যক বিরতিস্থল থাকায় তাদের যাত্রাপথে ব্যয় ছিল বাংলায় সক্রিয় অন্যান্য ইউরোপীয় কোম্পানির চেয়ে অনেক কম। তাদের শেষ কর্মচাঞ্চল্য দেখা গিয়েছিল আঠারো শতকের শেষভাগে, তবে ইংরজদের প্রাধান্যের কারণে দ্রুত এর অবসান ঘটে। [অনিরুদ্ধ রায়]