আমলাতন্ত্র
আমলাতন্ত্র বাংলায় কোম্পানি শাসনের প্রথমদিকে সরকার সনাতন আমলাতন্ত্রের সহায়তায় শাসনকার্য পরিচালনার চেষ্টা করে। রবার্ট ক্লাইভ তাঁর শাসনব্যবস্থায় সনাতন আমলাতন্ত্র প্রায় পুরোপুরি অব্যাহত রাখেন। তবে ওয়ারেন হেস্টিংস এমন এক নতুন আমলাতন্ত্র প্রবর্তন করেন যাতে ইউরোপীয়দের সংখ্যাধিক্য ও প্রাধান্য ছিল। উচ্চ পদগুলো থাকত ইউরোপীয়দের দখলে আর নিম্নতর পদে স্থানীয়রা। এটি ছিল কোম্পানি ও সনাতন আমলাতন্ত্রের একটি সংমিশ্রণ। লর্ড কর্নওয়ালিস স্থানীয় লোকদের প্রশাসনে সম্পৃক্ত করে গঠিত আমলাতন্ত্রের সাহায্যে কোম্পানির শাসনকার্য পরিচালনার পরীক্ষা-নিরীক্ষা বাতিল করে নিরঙ্কুশভাবে শ্বেতাঙ্গদের নিয়ে গঠিত ঔপনিবেশিক আমলাতন্ত্রের ভিত্তি স্থাপন করেন।
কর্নওয়ালিসের নতুন সিভিল সার্ভিস প্রর্বতনের পূর্ব পর্যন্ত কোম্পানির বেনিয়া আমলাতন্ত্র বাংলা শাসন করত। একে বলা হতো সনদী সিভিল সার্ভিস (সিসিএস)। এ সিভিল সার্ভিসের সদস্যরা কোর্ট অব ডিরেক্টর্স কর্তৃক সরাসরি নিয়োগ লাভ করত এবং তাদের কাছে দায়বদ্ধ থাকত। ফোর্ট উইলিয়ম কর্তৃপক্ষ কর্তৃক স্থানীয়ভাবে নিযুক্ত কর্মকর্তারা ছিল অ-সনদী সিভিল সার্ভিসের অন্তর্ভুক্ত। তারা প্রধানত বিশেষ কাজে ও স্বল্পমেয়াদে নামমাত্র বেতনে নিযুক্ত হতো। সনদী কর্মকর্তাদের বেতন কম হলেও ব্যক্তিগত ব্যবসায়ের অধিকার ও সুযোগ তাদের স্বল্পবেতনের ঘাটতি পুষিয়ে দিত। তারা অবশ্য অঘোষিতভাবে কমিশন ও বেতনের অতিরিক্ত ভাতাদি গ্রহণ করতে পারত। এদের হাতেই যুগপৎ ব্যবসা ও সরকারি প্রশাসনের দায়িত্ব ন্যস্ত ছিল। কর্নওয়ালিস সিভিল সার্ভিস থেকে ব্যবসা আলাদা করে ঔপনিবেশিক শাসন পরিচালনার জন্য পেশাগত সিভিল সার্ভিস প্রতিষ্ঠা করেন। সনদী সিভিল সার্ভিস সদস্যদের বেতন কাঠামো অত্যন্ত আকর্ষণীয় করা হয়। সিভিল সার্ভিসের সদস্যদের উচ্চ হারে বেতন দিয়ে কোম্পানি একদিকে যোগ্য লোকদের চাকুরিতে আকৃষ্ট করা এবং অন্যদিকে প্রশাসন থেকে অবাধ দুর্নীতি দূর করার প্রয়াস চালায়। এর পর থেকে সরকারি কর্মকর্তাদের নিয়োগ, প্রশিক্ষণ, পদায়ন ও পদোন্নতি নির্দিষ্ট ও অবশ্য পালনীয় বিধি দ্বারা নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা করা হয়। আশা করা হয় যে, অতঃপর সিভিল সার্ভিসের সদস্যরা প্রতিষ্ঠিত বিধিবিধানের প্রতি একান্ত বিশ্বস্ত থাকবে এবং কোনো অবস্থাতেই সংশ্লিষ্ট পক্ষের কাছ থেকে উপহার, ঘুষ, কমিশন গ্রহণের পুরনো অভ্যাসের বশবর্তী হবে না। সিভিল সার্ভিসকে পুরোপুরি শ্বেতাঙ্গদের করায়ত্ত করা হয়। স্থানীয়দের জন্য ছিল শুধু গুরুত্বহীন ছোটখাট চাকুরি। কর্নওয়ালিস বিশ্বাস করতেন যে, স্থানীয় লোকেরা এতটাই দুর্নীতিগ্রস্ত ও অযোগ্য যে তাদের চরিত্র সংশোধনের কোনো পথ নেই এবং সিভিল সার্ভিসে তাদের অংশগ্রহণ প্রশাসনকে দুর্বল ও দুর্নীতিগ্রস্ত করে তুলবে। চাকুরির বিধিবিধান ও চাকুরি কাঠামো সম্বলিত সিভিল সার্ভিস ম্যানুয়েল ১৭৯৩ সালের চার্টার অ্যাক্টে বিধিবদ্ধ করা হয়েছিল।
পরিবর্তনসমূহ (১৭৯৩-১৮৫৪) কর্নওয়ালিস প্রশাসন কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত সিভিল সার্ভিসের মূল কাঠামো ১৮৩৩ সাল পর্যন্ত অনেকটা অক্ষুণ্ণ থাকলেও এরপরেই কাঠামোতে ব্যাপক পরিবর্তন সাধিত হয়। ১৭৯৩ সালে সংস্কারের পর রাষ্ট্রীয় আমলাতন্ত্র থেকে স্থানীয়দের সম্পূর্ণ বাদ দেয়া হয়। তবে এ বর্জননীতি বেশিদিন টিকিয়ে রাখা যায় নি। নতুন অধিকৃত অঞ্চলগুলোর প্রশাসন শুধু আমলাতন্ত্রের নির্ধারিত জনবলের ওপরই নয়, রাষ্ট্রের রাজস্বের ওপরও চাপ সৃষ্টি করেছিল। রাজস্ব সংগ্রহ আনুপাতিক হারে বৃদ্ধি ছাড়াই রাষ্ট্রের ব্যয় বাজেট বৃদ্ধি পেয়েছিল। লর্ড ওয়েলেসলী বর্জননীতি নমনীয় করে অ-সনদী সিভিল সার্ভিস পুনর্গঠনের মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করেন। তিনি অ-সনদী সার্ভিসের নিম্নতর পদে যোগ্য স্থানীয়দের নিয়োগের সিদ্ধান্ত নেন। ছোটখাট মামলা নিষ্পত্তির জন্য তিনি বিচার বিভাগে সদর আমিন নামে একটি নতুন পদ সৃষ্টি করেন। ঔপনিবেশিক আমলাতন্ত্রে সদর আমিন ছিল প্রথম স্থানীয় সদস্য। কর্নওয়ালিসের শাসনব্যবস্থায় স্থানীয়রা মুন্সেফ, পন্ডিত, মুন্সি, সেরেস্তাদার, থানাদার, সিপাহি, বরকন্দাজ ইত্যাদি পদে কাজ করত। তবে এগুলো ছিল শ্বেতাঙ্গ অ-সনদী কর্মকর্তার অধীনস্থ সহায়ক অধস্তন পদ। এরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কাজের বিনিময়ে মজুরি ও কমিশন পেত। লর্ড বেন্টিঙ্কের শাসনামলে অ-সনদী সিভিল সার্ভিসে দেশিয়দের অংশগ্রহণ আরও বৃদ্ধি পায়। ব্যয়সংকোচনের জন্য লর্ড বেন্টিঙ্ক সদর আমিনের ক্ষমতা ও দায়িত্ব বৃদ্ধি করেন এবং সদর আমিনের উর্ধ্বতন পদ হিসেবে মুখ্য সদর আমিন নামে একটি নতুন পদ সৃষ্টি করেন। বিচার বিভাগীয় স্তরবিন্যাস অনুসারে মুখ্য সদর আমিন ছিল অতিরিক্ত জেলা জজের অধস্তন পদমর্যাদার দেশিয় ম্যাজিস্ট্রেট ও বিচারক।
১৮৩৩ সালের চার্টার অ্যাক্টের আওতায় সনদী সিভিল সার্ভিস কাঠামোর ব্যাপক পরিবর্তন ঘটে। কোম্পানির বাংলা রাজ্য শাসনের উদ্দেশ্যেই কর্নওয়ালিসের সিভিল সার্ভিস কাঠামো গড়ে তোলা হয়েছিল। তবে পরবর্তীকালে ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রের ব্যাপক সম্প্রসারণ ঘটে। ওয়েলেসলি (১৭৯৮-১৮০৫) থেকে লর্ড আমহার্স্টের (১৮২৩-১৮২৮) শাসনকালে রাজ্যের ব্যাপক বিস্তৃতি, ১৮১৩ সাল থেকে কোম্পানির একচেটিয়া ক্ষমতা লোপ, মফস্বলে ভূমি মালিকানা অর্জন ও বসতি স্থাপনে ইউরোপীয়দের উপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার, কোম্পানির বাণিজ্যিক অধিকার লোপ এবং বেন্টিঙ্ক প্রশাসনের (১৮২৮-১৮৩৫) উদার নীতির ফলে কর্নওয়ালিস প্রবর্তিত আমলাতন্ত্র কার্যত অকেজো হয়ে পড়ে। ১৭৯৩ সালের চার্টার অ্যাক্টের আওতায় কোর্ট অব ডিরেক্টর্স সিভিল সার্ভিসের সদস্যদের নিয়োগদানের যে সুবিধা ভোগ করত ১৮১৩ সালে কোম্পানির একচেটিয়া ক্ষমতা বিলুপ্তির পর এ সুবিধা ভোগের বিরুদ্ধে ব্যাপক জনমত সৃষ্টি হয়। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে শুধু শ্বেতাঙ্গ আমলাতন্ত্র দিয়ে ঔপনিবেশিক রাষ্ট্র চালানো কার্যত অসম্ভব হয়ে পড়ে। ফলত ১৮৩৩ সালের চার্টার অ্যাক্টে এ বিধান করা হয় যে, অতঃপর সিভিল সার্ভিসে অন্তর্ভুক্তি জাতি, ধর্ম ও বর্ণ নির্বিশেষে সকলের জন্য উন্মুক্ত থাকবে। কিন্তু শ্বেতাঙ্গ কর্মকর্তাদের চাপের ফলে চার্টার ঘোষণার পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন বাধাগ্রস্ত হয়। বেন্টিঙ্ক শুধু সরকারের বিচার বিভাগে সংস্কার সাধনে সক্ষম হন। তিনি জেলা আদালতে মুখ্য সদর আমিন নিয়োগ করেন এবং জেলা প্রশাসনে দেশিয় ডেপুটি কালেক্টর নিয়োগের প্রস্তাব দেন। কিন্তু শ্বেতাঙ্গ কর্মকর্তাদের বিরোধিতার মুখে ঊনিশ শতকের চল্লিশের দশক পর্যন্ত প্রস্তাবটি বাস্তবায়ন করা যায় নি। বেন্টিঙ্কের শাসনকালে সরকারি কর্মকর্তা নিয়োগ ও প্রশিক্ষণে বড় ধরনের পরিবর্তন ঘটে। চার্টার অ্যাক্টের আওতায় সিসিএস নিয়োগ ছিল কোম্পানির একচেটিয়া এখতিয়ার। কোম্পানির পরিচালক ও বোর্ড অব কন্ট্রোলের সদস্যরা প্রত্যেকে কোম্পানির সিভিল সার্ভিসের অন্তত একজন মুনশি (শিক্ষানবিস) মনোনয়নের সুবিধা ভোগ করত। এ ব্যবস্থাকে ‘পৃষ্ঠপোষকতা’ বলা হতো এবং কোম্পানির পদস্থ কর্মকর্তারা এ সুবিধা ভোগ করত। মুনশিরা ছিল খুবই তরুণ, ১৪-১৬ বছর বয়সী, স্বল্পশিক্ষিত ও অনভিজ্ঞ। নবনিযুক্তদের প্রশিক্ষণের কোনো ব্যবস্থা ছিল না। তারা অভিজ্ঞ কর্মীদের সঙ্গে কয়েক বছর মুনশি বা শিক্ষানবিস হিসেবে কাজ করে নিয়োগের যোগ্যতা অর্জন করত। কোম্পানি যখন নিছক একটি বাণিজ্যিক সংস্থা রূপে পরিচালিত হতো তখন কোম্পানির কার্যক্রম পরিচালনার জন্য পৃষ্ঠপোষকতা ও শিক্ষানবিসী ব্যবস্থা চালু করা হয়। কিন্তু রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য এ ধরনের ব্যবস্থা ছিল খুবই অপ্রতুল। লর্ড ওয়েলেসলি সাম্রাজ্যের সিভিল সার্ভিসের নিয়োগ ও প্রশিক্ষণ ব্যবস্থার আশু সংস্কারের প্রয়োজন উপলব্ধি করেন। তবে রাজনৈতিক ও অন্যান্য আইনগত জটিলতার দরুণ পৃষ্ঠপোষকতা ব্যবস্থা কিছুকাল অব্যাহত থাকে। এমতাবস্থায় ওয়েলেসলি মুনশিদের নিজস্ব উপায়ে শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ দানের চেষ্টা করেন। এজন্য তিনি ১৮০০ সালে কলকাতায় ফোর্ট উইলিয়ম কলেজ নামে একটি শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন করেন। মুনশিরা কোনো কার্যভার গ্রহণের পূর্বে উক্ত কলেজে তিন বছরের শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ লাভ করত। তাদের জন্য অন্তত দুটি ভারতীয় ভাষা, ভারতের ইতিহাস ও সংস্কৃতি, শিক্ষা, হিন্দু ও মুসলিম আইন, প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য সভ্যতা এবং সরকার ও প্রশাসন বিষয়ে তাত্ত্বিক ও প্রয়োগিক শিক্ষালাভ বাধ্যতামূলক ছিল।
কোর্ট অব ডিরেক্টর্স মুনশিদের প্রশিক্ষণ দানে ওয়েলেসলির ধারণাটি অনুমোদন করলেও কলকাতার কলেজে প্রশিক্ষণ দানের বিষয়টি অনুমোদন করে নি। তার পরিবর্তে কোর্ট ১৮০৫ সালে ইংল্যান্ডে ইস্ট ইন্ডিয়া কলেজ নামে অনুরূপ একটি প্রতিষ্ঠান স্থাপন করে। এ প্রতিষ্ঠান সাধারণে হেইলিবেরি কলেজ নামে পরিচিত ছিল। পরিচালক ও অন্যান্য পৃষ্ঠপোষক কর্তৃক মনোনীত প্রার্থীদের এ কলেজে ৩ বছর পড়াশোনা করতে হতো। তাদের পাঠ্যসূচির অন্তর্ভুক্ত ছিল রাষ্ট্রীয় অর্থনীতি, চিরায়ত ও সাধারণ সাহিত্য, গণিত, ইংল্যান্ডের ইতিহাস ও আইন, ভারতের ইতিহাস ও আইন, প্রাকৃতিক দর্শন এবং আরবি, ফার্সি, হিন্দুস্তানি, বাংলা ও সংস্কৃত সহ কতিপয় প্রাচ্য ভাষা। সাফল্যের সঙ্গে তিন বছরের কোর্স সমাপ্তির পর প্রার্থীদের মুনশির চাকরিতে যোগদানের জন্য ভারতে যাওয়ার নির্দেশ দেয়া হতো। মুনশিদের ফোর্ট উইলিয়ম কলেজে তাদের জন্য নির্ধারিত কর্মস্থল হিসেবে সংশ্লিষ্ট প্রদেশের প্রচলিত ভাষা শিখতে হতো। মেধাতালিকায় শীর্ষস্থান দখলকারী মুনশিরা বঙ্গদেশে চাকুরির জন্য নির্বাচিত হতো। হেইলিবারি কলেজে অকৃতকার্য প্রার্থীরা পরীক্ষায় দ্বিতীয়বার অংশ গ্রহণের সুযোগ পেত। দ্বিতীয়বার অকৃতকার্য প্রার্থীরা বাদ পড়ত এবং পৃষ্ঠপোষকদের কাছ থেকে নতুন মনোনয়ন আহবান করা হতো। ১৮৫৩ সালের চার্টার অ্যাক্টের আওতায় সিভিল সার্ভিসে নিয়োগে পৃষ্ঠপোষকতা ব্যবস্থা লোপ পায় এবং ১৮৫৮ সালে হেইলিবেরি কলেজও বিলুপ্ত হয়।
নিয়োগের জন্য প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষা সিভিল সার্ভিসের কর্মকর্তা নিয়োগে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির একচেটিয়া অধিকারের বিলুপ্তি (১৮১৩) এবং পৃষ্ঠপোষকতা ব্যবস্থার অবলুপ্তির (১৮৫৩) ফলে পার্লামেন্ট সনদী সিভিল সার্ভিসের সদস্যদের নিয়োগ ও প্রশিক্ষণ বিষয়ে সুপারিশ প্রণয়নের জন্য টি.বি ম্যাকলের নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করে। ম্যাকলে কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী মেধার ভিত্তিতে সিভিল সার্ভিসের সদস্য নিয়োগের জন্য সিভিল সার্ভিস কমিশনার্স নামে একটি স্থায়ী কমিটি গঠিত হয়। সিভিল সার্ভিস কমিশনার্স লন্ডনে বার্ষিক প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার আয়োজন করত এবং মেধানুসারে একটি প্রার্থীতালিকা কোর্টের কাছে সুপারিশ করত। ১৮ থেকে ২৩ বছর বয়সের ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সকল নাগরিকের জন্য এ পরীক্ষা উন্মুক্ত ছিল। শিক্ষাগত যোগ্যতা ছিল স্নাতক বা সমমানের ডিগ্রি। পরীক্ষার সর্বমোট নম্বর ছিল ১২৫০ এবং পরীক্ষার বিষয় ছিল ইংরেজি কম্পোজিশন; ইংরেজি সাহিত্য ও ইতিহাস; গ্রিক ভাষা, সাহিত্য ও ইতিহাস; রোমান ভাষা, সাহিত্য ও ইতিহাস; ফরাসি ভাষা, সাহিত্য ও ইতিহাস; জার্মান ভাষা, সাহিত্য ও ইতিহাস; ইতালীয় ভাষা, সাহিত্য ও ইতিহাস; গণিত, প্রকৃতি বিজ্ঞান, নৈতিক ও রাজনৈতিক দর্শন, সংস্কৃত ভাষা ও সাহিত্য এবং আরবি ভাষা ও সাহিত্য।
কৃতকার্য প্রার্থীদের চূড়ান্ত প্রশিক্ষণ ও পদায়নের পূর্ব পর্যন্ত তাদের বলা হতো শিক্ষানবিস কর্মকর্তা। তাদের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে ২ বছরের প্রশিক্ষণ নিতে হতো। শিক্ষানবিসীকালে তারা প্রধান প্রধান ভারতীয় ভাষা এবং ভারতীয় ইতিহাস, ভূগোল, সমাজ, অর্থনীতি, রাজনীতি, সংস্কৃতি ও আইন বিষয়ে অধ্যয়ন করত। প্রত্যেকের জন্য পদায়নপ্রাপ্ত প্রদেশের আঞ্চলিক ভাষাসহ দুটি ভারতীয় ভাষায় দক্ষতা অর্জন বাধ্যতামূলক ছিল। কোনো শিক্ষানবিস কর্মকর্তা একাডেমিক ও শারীরিক পরীক্ষাগুলোর কোনো একটিতে অকৃতকার্য হলে তাকে অপসারণ করা যেত। পরীক্ষায় অর্জিত মেধার ভিত্তিতে কৃতকার্য শিক্ষানবিসদের বিভিন্ন প্রদেশে পদায়ন করা হতো। ম্যাকলের রিপোর্টে সিভিলয়ানদের এ ধরনের কঠোর একাডেমিক প্রশিক্ষণের প্রয়োজনীয়তার কথা বিস্তারিত বিবৃত রয়েছে। এতে বলা হয়েছে যে, ব্রিটেনে পার্লামেন্ট ও স্থানীয় সংস্থার নির্বাচিত সদস্যরা রাজ্যশাসনে যে ভূমিকা পালন করেন, ব্রিটিশ ভারত শাসনে সিভিল সার্ভিসের সদস্যরাও সে ভূমিকাই পালন করবে। অতএব তারা হবে কার্যত এ দেশ ও জনগণের প্রভু এবং সেজন্য তাদের নৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে ক্ষমতা প্রয়োগে এতটা ন্যায়নিষ্ঠ হতে হবে যাতে তারা ইংরেজ জাতির যথার্থ প্রতিনিধি এবং ভারতীয় জনগণের সদাশয় অভিভাবক হতে পারে।
মেধাতালিকার উপরের দিকের শিক্ষানবিসদের বেঙ্গল প্রেসিডেন্সিতে পদায়ন করা হতো। কোনো প্রদেশে পদায়ন লাভের পর তারা জেলা কালেক্টর ও ম্যাজিস্ট্রেটের অধীনে সহকারী কালেক্টর হিসেবে হাতেকলমে প্রশিক্ষণ লাভ করত। এসকল পরীক্ষা সফলভাবে সমাপ্ত করার পর একজন শিক্ষানবিস সনদী সিভিল সার্ভিসের একজন নিয়মিত সদস্য হিসেবে নিয়োগ লাভ করত।
আমলাতন্ত্রের ভারতীয়করণ কোম্পানি শাসনের শেষ দশকের পূর্ব পর্যন্ত ব্রিটিশ ভারতের পেশাগত আমলাতন্ত্র ছিল সম্পূর্ণভাবে শ্বেতাঙ্গদের নিয়ে গঠিত। লর্ড ওয়েলেসলি ও লর্ড বেন্টিঙ্ক প্রশাসন অ-সনদী সিভিল সার্ভিসের সর্বনিম্ন স্তর, বিশেষত বিচার বিভাগ স্থানীয় এলিটদের নিয়োগের জন্য উন্মুক্ত রাখে। ১৮৩৩ সালের চার্টার অ্যাক্ট সিভিল সার্ভিসে দেশিয়দের নিয়োগের ক্ষেত্রে কর্নওয়ালিসের নিষেধাজ্ঞা তুলে নিলেও বাস্তবে ১৮৫৪ সাল পর্যন্ত বর্জননীতি অব্যাহত থাকে, যতদিন কোম্পানির পৃষ্ঠপোষকতার ব্যবস্থার বিলুপ্তি এবং উন্মুক্ত প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার মাধ্যমে নিয়োগ ব্যবস্থার সূত্রপাত না হয়। সিভিল সার্ভিসে ভারতীয়দের অন্তর্ভুক্তির ক্ষেত্রে উন্মুক্ত প্রতিযোগিতায় বস্ত্তত জাতিগত পার্থক্যের সমাপ্তি ঘটে নি। সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় অংশ নেওয়ার জন্য ভারতীয় প্রার্থীদের লন্ডন যেতে হতো। এর অর্থ দাঁড়ায় যে, একজন দেশিয় প্রার্থী যতই মেধাবী হোক না কেন তাকে লন্ডন যাত্রার খরচ যোগাতে হতো এবং অবশ্যই ধর্মীয় সংস্কারমুক্ত হতে হতো। তদুপরি পরীক্ষার বিষয়সূচিতে প্রাধান্য ছিল ইউরোপীয় ভাষা, সাহিত্য ও ইতিহাস প্রভৃতি সহ এমন সব বিষয়ের যেগুলোর সঙ্গে ভারতীয় ছাত্ররা পরিচিত ছিল না। ফলত সিভিল সার্ভিসে শ্বেতাঙ্গদেরই একচেটিয়া আধিপত্য থেকে যায়। ১৮৫৫ থেকে ১৯১৪ সাল পর্যন্ত ভারতীয়দের নিয়োগ ছিল নগণ্য (২৬৪৪ জন ইউরোপীয়ের বিপরীতে ৮৪ জন ভারতীয়) এবং কোনো ভারতীয়ই জেলা জজ বা জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের পদের উপরে উঠতে পারে নি।
এসব বিষয়ের প্রতি ভারতীয় জাতীয়তাবাদী ব্যক্তিবর্গ এবং স্থানীয় ভাষার সংবাদপত্রের দৃষ্টি আকৃষ্ট হয়। তাদের অব্যাহত দাবি ছিল যে ভারত শাসনে ভারতীয়দের অংশগ্রহণ গুরুত্ববহ হতে হবে। অ-সনদী সিভিল সার্ভিস পুনর্গঠনের মাধ্যমে আমলাতন্ত্রে দেশিয়দের অংশগ্রহণ বৃদ্ধির পদক্ষেপ নেয়া হয়েছিল। ১৮৬১ সালের সিভিল সার্ভিস অ্যাক্টের আওতায় সাবেক অ-সনদী সিভিল সার্ভিস বিলুপ্ত হয় এবং ভারতীয় ও অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান সম্প্রদায়ের জন্য সাব-অর্ডিনেট এক্সিকিউটিভ সার্ভিস নামে নতুন সার্ভিস প্রবর্তিত হয়। এ সার্ভিসের আওতায় বিভাগীয় প্রার্থীদের মধ্য থেকে ডেপুটি ও সাব-ডেপুটি কালেক্টর নিয়োগ করা হতো। বিভাগীয় পর্যায়ে প্রস্ত্তত তিন জনের প্যানেল থেকে বিভাগীয় প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার মাধ্যমে মেধার ভিত্তিতে একজন নিয়োগ লাভ করত। জাতীয়তাবাদীদের চাপে ১৮৭৯ সালে স্ট্যাটুটরি সিভিল সার্ভিস নামে নতুন সিভিল সার্ভিস সৃষ্টির মাধ্যমে সিভিল সার্ভিসকে অধিকতর ভারতীয়করণ করা হয় এবং তাতে কিছুসংখ্যক ভারতীয়কে উচ্চতর নির্বাহী পদে মনোনয়নের মাধ্যমে নিয়োগের ব্যবস্থা রাখা হয়। হিন্দু ও মুসলিম সম্প্রদায়ের অভিজাত তথা ব্রিটিশরাজের অনুগত কিছু লোকের নিয়োগ দানই ছিল এ সার্ভিসের লক্ষ্য। কিন্তু এ বিভেদমূলক ব্যবস্থা বাংলার সংবাদপত্র ও বুদ্ধিজীবীদের তীব্র সমালোচনার সম্মুখীন হয়। তাদের দাবি ছিল ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিসের (আইসিএস) পরীক্ষা ভারতে অনুষ্ঠিত হতে হবে এবং আইসিএস ও অন্যান্য সার্ভিসে ভারতীয়দের নিয়োগ বৃদ্ধি করতে হবে। ফলে ১৮৮৬ সালে সাধারণভাবে আইচিসন কমিশন নামে অভিহিত একটি পাবলিক সার্ভিস কমিশন গঠন করা হয়। সিভিল সার্ভিসকে অধিকতর ভারতীয়করণের উপায় ও পদ্ধতি সম্পর্কে সুপারিশ করার জন্য এ কমিশনকে নির্দেশ দেয়া হয়।
আইচিসন কমিশন সাব-অর্ডিনেট সির্ভিল সার্ভিস ও স্ট্যাটুটরি সিভিল সার্ভিস বিলোপ এবং তৎপরিবর্তে সংশ্লিষ্ট প্রদেশের নামানুসারে প্রাদেশিক সিভিল সার্ভিস গঠনের সুপারিশ করে, যেমন বেঙ্গল প্রভিন্সিয়াল সিভিল সার্ভিস, পাঞ্জাব প্রভিন্সিয়াল সিভিল সার্ভিস। আইচিসন কমিশন আরও সুপারিশ করে যে, সনদী সিভিল সার্ভিসের জন্য সংরক্ষিত কিছু পদ প্রাদেশিক সিভিল সার্ভিসে স্থানান্তর করা হবে এবং প্রত্যেক প্রাদেশিক সিভিল সার্ভিসে সাব-অর্ডিনেট সিভিল সার্ভিস নামে একটি অধস্তন ক্যাডার থাকবে, আর এসব সার্ভিসে বিভাগীয় মনোনীত প্রার্থীদের মধ্যে প্রতিযোগিতার ভিত্তিতে নিয়োগ দান করা হবে। এক কথায় আইচিসন কমিশনের মূল কথা ছিল একটি শক্তিশালী ও মর্যাদাসম্পন্ন প্রাদেশিক সিভিল সার্ভিস প্রতিষ্ঠা। সার্ভিসের নামসহ আইচিসন কমিশনের সকল সুপারিশ বাস্তবায়িত হয়। সনদী সিভিল সার্ভিসের পরির্বতে এর নামকরণ হয় ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিস এবং এ নামটি ছিল প্রদেশে প্রবর্তিত প্রাদেশিক সিভিল সার্ভিসের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ।
আইচিসন কমিশনের রিপোর্টের ভিত্তিতে গঠিত অন্যান্য প্রাদেশিক সিভিল সার্ভিসের মতো বেঙ্গল প্রভিন্সিয়াল সিভিল সার্ভিসও আইসিএসদের সংরক্ষিত সুপিরিয়র সার্ভিসে নিয়োগের নতুন কোনো সুযোগ সৃষ্টি করে নি, যাতে তখনও ছিল শ্বেতাঙ্গদের প্রায় একচেটিয়া আধিপত্য। ফলে সিভিল সার্ভিস কাঠামোতে ঘটিত সংস্কার সিভিল সার্ভিসকে অর্থবহভাবে ভারতীয়করণের জন্য স্থানীয়দের বিক্ষোভ আদৌ প্রশমিত করতে পারে নি।
সিভিল সার্ভিসের অসংরক্ষিত ব্যবস্থা ও অবাধ ভারতীয়করণের বিরুদ্ধে কেন্দ্রীয় সরকারের যুক্তি ছিল যে, ব্রিটিশ ভারতের সকল প্রদেশ উন্মুক্ত প্রতিযোগিতার জন্য সমান উপযুক্ত নয়। এমনকি একটি বিশেষ প্রদেশেও সকল সম্প্রদায় অবাধ প্রতিযোগিতার জন্য সমভাবে প্রস্ত্তত ছিল না। এ ছাড়াও ছিল জাতিগত ও নিম্নবর্ণ সমস্যা। এমন যুক্তিও দেখানো হয় যে, অসংরক্ষিত অবাধ প্রতিযোগিতা সিভিল সার্ভিসে বাংলার হিন্দু ‘ভদ্রলোকদের’ নিরংকুশ প্রাধান্য সৃষ্টি করবে যা নিঃসন্দেহে নতুন রাজনৈতিক সমস্যার জন্ম দেবে। উদাহরণস্বরূপ, বাংলায় মুসলমানরা সংখ্যাগরিষ্ঠ থাকা সত্ত্বেও ১৯১৫ সালে সিভিল সার্ভিসে তাদের প্রতিনিধিত্ব ছিল মাত্র ৫ শতাংশ। অবাধ প্রতিযোগিতায় নিশ্চিতভাবে অবস্থার আরও অবনতি ঘটত।
ইসলিংটন কমিশন (১৯১২-১৯১৫) সমস্যাটি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করে। রাজনৈতিক দিক বিবেচনায় রেখে এ কমিশন ভারতীয় ও প্রাদেশিক সিভিল সার্ভিসে প্রধান প্রধান সম্প্রদায় ও জাতিগোষ্ঠীর আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বভিত্তিক নিয়োগের সুপারিশ করে। ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস ও জাতীয়তাবাদী সংবাদপত্রগুলি এ রিপোর্টের তীব্র বিরোধিতা করে। ১৯১৮ সালে মন্টেগু-চেমস্ফোর্ড রিপোর্ট প্রস্তাব দেয় যে, সুপিরিয়র সিভিল সার্ভিসে এক-তৃতীয়াংশ ভারতে নিয়োগ দেয়া হবে এবং স্বশাসিত প্রতিষ্ঠানগুলোর বিকাশের স্বার্থে নিয়োগের এ হার ক্রমাগত বৃদ্ধি করা হবে। ১৯২৪ সালে লী কমিশন মন্টেগু-চেমসফোর্ড কমিশনের রিপোর্টের সুপারিশ আরেক দফা পর্যালোচনা করে এবং সিভিল সার্ভিসের পরিকল্পিত ভারতীয়করণের জন্য সুপারিশ পেশ করে। লী কমিশনের সুপারিশ অনুসারে শূণ্য আইসিএস পদের ২০% প্রাদেশিক সিভিল সার্ভিস থেকে পদোন্নতির মাধ্যমে এবং অবশিষ্ট ৮০% ভারতীয় ও ইউরোপীয়দের মধ্যে সমানভাবে ভাগ করা হবে। ভারত ও ইংল্যান্ডে অনুষ্ঠিত প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার ভিত্তিতে এ নিয়োগ দান করা হবে। নিয়োগ ও পদোন্নতির ক্ষেত্রে সম্প্রদায়গত ও জাতিগত বিষয়গুলির প্রতি লক্ষ্য রাখার জন্য সরকারকে পরামর্শ দেয়া হয়। ১৯২২ সালে প্রথমবারের মতো ভারতে আইসিএস পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। লী কমিশনের সুপারিশ মোতাবেক ১৯২৬ সালে ইন্ডিয়ান পাবলিক সার্ভিস কমিশন গঠিত হয় এবং ১৯৩৫ সালে এর নতুন নামকরণ হয় ফেডারেল পাবলিক সার্ভিস কমিশন। কমিশনের উপর সিভিল সার্ভিসের বিধিবিধান প্রস্ত্তত, প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষা অনুষ্ঠান এবং প্রাদেশিক ও কেন্দ্রীয় উভয় পর্যায়ে সামগ্রিকভাবে ভারতীয়করণ প্রক্রিয়া দেখাশুনার দায়িত্ব অর্পিত হয়। পাবলিক সার্ভিস কমিশন একজন চেয়ারম্যানসহ ৫ জন সদস্য নিয়ে গঠিত ছিল। এ কমিশন স্টেট ইন-কাউন্সিলের সেক্রেটারি কর্তৃক সরাসরি নিযুক্ত হতো এবং তার কাছে দায়বদ্ধ থাকত। ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইন অনুসারে অনেকগুলো সুপিরিয়র সার্ভিস প্রাদেশিক সিভিল সার্ভিসের এক্তিয়ারে স্থানান্তরিত হয়। কিন্তু ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ শাসনের অবসানের পূর্ব পর্যন্ত জেলা প্রশাসন আইসিএস ক্যাডারের হাতেই থেকে যায়।
১৯৪৭ সালে ভারত উপমহাদেশ বিভক্তির ফলে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক ধারার আইসিএস বিলুপ্ত হয়। তবে ভারত ও পাকিস্তান উভয় দেশেই ব্রিটিশ প্রশাসনিক কাঠামো অনেকাংশে অক্ষুণ্ণ থাকে এবং সেখানে সিভিল সার্ভিসের উচ্চস্তরে একটা এলিট ক্যাডার শ্রেণি বহাল থাকে। এভাবে ভারত ১৯৪৭ সালের পর থেকে একটি অভিজাত ইন্ডিয়ান অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস বজায় রেখে এসেছে। পাকিস্তানের ছিল সিভিল সার্ভিস অব পাকিস্তান (সিএসপি)-এর অধীনে নিজস্ব অভিজাত সরকারি কর্মকর্তা ক্যাডার। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের বিভক্তি এবং স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পূুর্ব পর্যন্ত সিএসপি ক্যাডার-এর পূর্বতন অবস্থা বহাল ছিল। নতুন পরিস্থিতিতে নবগঠিত রাষ্ট্রের প্রয়োজনে অভিজাত সিভিল সার্ভিসকে নতুন করে ঢেলে সাজানো হয়।
১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত পাকিস্তান সিভিল সার্ভিস আমলাতন্ত্রের এলিটদেরই প্রতিনিধিত্ব করত। মহকুমা, জেলা ও সচিবালয়ের সর্বোচ্চ পদগুলোতে তাঁরাই নিয়োজিত থাকত। এ ছাড়াও ছিল কিছু বিশেষ এলিট সার্ভিস যেমন পাকিস্তান পররাষ্ট্র সার্ভিস, হিসাব ও নিরীক্ষা, কর, শুল্ক ও আবগারি, সামরিক হিসাব, সচিবালয় ও ডাক বিভাগ ইত্যাদি। ঊর্ধ্বতন সার্ভিসের প্রতিটি শাখায় অভিজাত আমলাদের অবস্থান ছিল। ব্রিটিশ আমলের ধারাবাহিকতায় চলে আসা এলিট সিভিল সার্ভিসের বিশেষ ধরনের কতকগুলো বৈশিষ্ট্য ছিল। তাদের নিয়োগ কাঠামো, স্তরবিন্যাস, প্রশিক্ষণ ও রীতিনীতি ছিল আলাদা ধরনের। নিয়োগ লাভের পর সকল এলিট ক্যাডার সার্ভিসের সদস্যদের ২ বছর ধরে ব্যাপক ও কঠোর প্রশিক্ষণ নিতে হতো।
সুসংগঠিত, সুযোগ্য ও সুপ্রশিক্ষণপ্রাপ্ত আমলাতন্ত্রের সঙ্গে প্রশাসনিক প্রক্রিয়া সম্পর্কে পর্যাপ্ত ধারণাহীন রাজনীতিকদের সম্পর্ক ছিল দ্বন্দ্বময়। পাকিস্তান আমলে ও বাংলাদেশের স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে সামরিক বাহিনীর বারবার ও দীর্ঘমেয়াদি হস্তক্ষেপের ফলে তা আরও প্রকট রূপ লাভ করে। রাজনীতিতে সামরিক বাহিনীর হস্তক্ষেপ এবং সামরিক নেতৃত্ব কর্তৃক রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখলের ফলে রাজনীতিকদের ওপর আমলাতন্ত্রের কর্তৃত্ব ও প্রভাব প্রবলতর হয়। সামরিক বাহিনীর ক্ষমতা দখলের পর সিভিল প্রশাসনে আধিপত্যকারী সামরিক আমলারা সাধারণত বেসামরিক আমলাদের অধস্তন ভূমিকায় ঠেলে দিয়ে একটা নতুন সমীকরণ তৈরিতে সচেষ্ট থাকত। বেসামরিক আমলারা যে সবসময় তা মেনে নিতে রাজি ছিলেন না তাও নয়। সামরিক শাসনামলে প্রশাসনিক প্রক্রিয়ায় সম্পূর্ণ কর্তৃত্ব ছিল সামরিক ও বেসামরিক আমলাতন্ত্র উভয়ের হাতে। রাষ্ট্রপতিশাসিত পদ্ধতির সরকারগুলোতে স্থায়ী সচিবদের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে নির্বাহি প্রধান ও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে প্রধান হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা করা হয়। তাদের রাজনৈতিক উর্ধ্বতন পদে থাকতেন মন্ত্রীরা, যাদের ওই বিধানে সচিবদের তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে বর্ণনা করা হয়। অর্থাৎ রাজনৈতিক কর্তাব্যক্তিরা ছিলেন কার্যত রাষ্ট্রপতির উপদেষ্টা মাত্র, যাদের বস্ত্তত কোনো ক্ষমতা ছিল না। যেটুকু প্রভাব তারা খাটাতে পারতেন তা তাদের সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী রাষ্ট্রপতির হুকুম তামিল করার মাধ্যমেই অর্জন করতে হতো। রাষ্ট্রপতি স্থায়ী সচিবদের সহায়তা ও সহযোগিতায় প্রশাসন পরিচালনা করতে পারতেন এবং প্রায়শই তা করতেন। এ সচিবদের অধিকাংশই ছিল বেসামরিক আমলা।
সামরিক বা বেসামরিক শক্তির সমর্থনপুষ্ট কর্তৃত্ববাদী শাসনের ফলে একটি অংশগ্রহণমূলক জনপ্রশাসনের প্রাণশক্তিই কেবল ক্ষয়প্রাপ্ত হয় নি, সরকারি খাতের প্রশাসনিক সাভিসসমূহের স্বাধীনতা, বস্ত্তনিষ্ঠতা, নিরপেক্ষতা এবং দক্ষতাও হ্রাস পেয়েছিল। বাংলাদেশের মতো একটি দারিদ্র্যপীড়িত সমাজে সর্বতোব্যাপ্ত আর্থ-সামাজিক সমস্যাবলি এদেশের জনপ্রশাসনের শক্তি নিঃশেষ করে ফেলেছে। জনগণের বিপুল অংশের ব্যাপক দারিদ্র্য ও সে সঙ্গে ক্রমবর্ধনশীল জনসংখ্যা, অনুন্নত কৃষি-অর্থনীতি, ক্রমবর্ধমান নগরায়ণ ও বর্হিমুখী অভিবাসন সরকারি খাতে প্রশাসনিক সার্ভিসগুলির আত্মবিশ্বাস ও দক্ষতাকে আরও কমিয়ে ফেলেছে। বর্তমানে সরকারি খাতের প্রশাসনিক সার্ভিসসমূহে যে অবস্থা বিরাজ করছে তা বাংলাদেশের রাজনীতিক ও জনগণের চাহিদা ও প্রয়োজন মেটাতে অক্ষম।
বেসামরিক ও সামরিক কর্তৃত্ববাদী শাসনের জের হিসেবে জনপ্রশাসনে যুক্তিসঙ্গত ও সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গির আশানুরূপ বিকাশ ঘটে নি। ফলত সরকারি চাকুরিতে নিয়োগ, প্রশিক্ষণ, পদবণ্টন ও জনপ্রশাসন খাতে কর্মকর্তাদের পদোন্নতির ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতাহীন অ্যাড-হক প্রথা চালু হয়। সংস্কার প্রচেষ্টাগুলোও অ্যাড-হক পদক্ষেপ থেকে মুক্ত থাকে নি। এ সবকিছুর ফলে সিভিল প্রশাসনিক সার্ভিসগুলোর শক্তি আরও লোপ পায় এবং সিভিল প্রশাসনে বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়।
সিভিল সার্ভিস ও জনপ্রশাসন সংস্কারের পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নের জন্য একাধিক উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বিভিন্ন সরকার পরিস্থিতির চাপে সেসব সংস্কারের উদ্যোগ গ্রহণ করে। বিশ শতকের সত্তর দশকের শেষ ও আশির দশকের গোড়ার দিকে জনপ্রশাসনে সাধারণ ও বিশেষজ্ঞ কর্মকর্তাদের মধ্যে সৃষ্ট ও ক্রমবর্ধমান অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের চাপের মুখে ওই সময়কার সরকারগুলো গোটা ব্যবস্থাটিতে পরিবর্তন ঘটাতে বাধ্য হয়। তারা চিকিৎসক, কৃষি-বিশেষজ্ঞ, অর্থনীতিবিদ প্রভৃতি পেশাজীবী গ্রুপের ক্যাডারদের অসন্তোষ দূর করার লক্ষ্যে ক্যাডার সার্ভিসের লোকবল বাড়ায় এবং তাদের জনপ্রশাসনে সম্পৃক্ত করে। বস্ত্তনিষ্ট পরিকল্পনা ছাড়াই এসব পরিবর্তন সাধনের ফলে সংশ্লিষ্ট পেশাজীবী গ্রুপের অসন্তোষ তেমন দূর হয় নি। এসব পরিবর্তনের মধ্যে পেশাগত উন্নতির পথ সঠিকভাবে চিহ্নিতকরন এবং চাকুরি ক্ষেত্রে পূর্বাপর সঙ্গতিপূর্ণ ও তুলনামূলকভাবে দ্রুত উন্নতির সুযোগ স্পষ্টভাবে নির্ধারিত বা প্রদত্ত হয় নি। পেশাদারিত্বের উৎকর্ষ সাধন এবং প্রশিক্ষণের প্রয়োজনীয়তার বিষয়গুলোও যথেষ্ট গুরুত্ব পায় নি।
পাবলিক সার্ভিসের ব্যাপারে জনগণের অসন্তোষ ও বিদেশি দাতাদের চাপে পাবলিক সেক্টরের সমস্যাবলি বিশ্লেষণ ও দূরীকরণের লক্ষ্যে তা সংস্কারের জন্য প্রয়োজনীয় সুপারিশমালা প্রণয়নের উদ্যোগ নেয়া হয়। বস্ত্তত এ সবকিছুই পরীক্ষা-নিরীক্ষা, অনুমোদন ও বাস্তবায়নের অপেক্ষায় আছে। জনপ্রশাসন সংস্কারের লক্ষ্যে সর্বশেষ উদ্যোগ হচ্ছে ১৯৯৭ সালে গঠিত প্রশাসনিক সংস্কার কমিশন, কিন্তু অদ্যাবধি তা কোনো উল্লেখযোগ্য সুফল দিতে পারে নি। [সিরাজুল ইসলাম এবং মিজানুর রহমান শেলী]
আরও দেখুন সিভিল সার্ভিস।