লী কমিশন

লী কমিশন  ভারত সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের জাতিগত গঠন বিচার-বিশ্লেষণের জন্য ১৯২৩ সালে গঠিত একটি কমিটি। এর সভাপতি ছিলেন লর্ড লী। এ কমিশনে ব্রিটিশ ও ভারতীয়দের সমান সংখ্যক সদস্য ছিলেন। কমিশন ইসলিংটন কমিশন রিপোর্ট এর সুপারিশসমূহ পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে এবং সর্ব ভারতীয় ও কেন্দ্রীয় - এ দুধরনের চাকরির বিদ্যমান অবস্থার পর্যালোচনা করে। প্রাদেশিক চাকরিসমূহ কমিশনের বিবেচনায় আনা হয়নি, কারণ ইতোমধ্যেই সেগুলি প্রাদেশিক সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীনে চলে গিয়েছিল। কমিশন তার ১৯২৪ সালের প্রতিবেদনে সর্বভারতীয় চাকরিগুলিকে দুটি ভাগে বিভক্ত করে। প্রথম ভাগে অন্তর্ভুক্ত ছিল ঐ সকল চাকরি যা বদলির মাধ্যমে সম্পাদিত হতো। উদাহরণস্বরূপ উচ্চ শিক্ষা (আই.ই.এস), কৃষি, পশুরোগ সংক্রান্ত, প্রকৌশল (রাস্তাঘাট ও দালানাদি নির্মাণ) এবং চিকিৎসাশাস্ত্রগত চাকরিসমূহ। এ চাকরিগুলিকে প্রাদেশিকীকরণ করা হয় এবং এগুলিতে নিয়োগ দানের ক্ষমতা প্রাদেশিক সরকারের উপর ন্যস্ত করা হয়। এ কাজ মন্টেগু-চেমসফোর্ড সংস্কার এর নীতি অনুসারেই করা হয়, যা উচ্চপদস্থ চাকরিসমূহের ভারতীয়করণের সমস্যার উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেছিল। সংরক্ষিত ক্ষেত্রে কার্যকর চাকরিগুলি দ্বিতীয় ভাগের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ভারত সরকারের বেসামরিক, পুলিশ, প্রকৌশল (সেচ শাখা) এবং বনবিভাগের চাকরিসমূহের নিয়োগ ও নিয়ন্ত্রণ আপাতত ভারত সচিবের হাতে অব্যাহত রাখা উচিত বলে কমিশন পরামর্শ দেয়। এ চার ধরনের চাকরি সর্ব ভারতীয় ভিত্তির উপর রাখতে হবে।

মন্টেগু-চেমসফোর্ড রিপোর্ট (১৯১৮) উচ্চপদে নিয়োগের ক্ষেত্রে ভারতীয়দেরকে ১/৩ ভাগ পদে নিয়োগ দেওয়ার জন্য প্রস্তাব করে, অন্যদিকে ইসলিংটন কমিশন ভারতীয়দের জন্য শতকরা ২৫ ভাগ পদ সংরক্ষিত রাখার সুপারিশ করেছিল। ফলে ইসলিংটন কমিশনের সুপারিশ বাতিল হয়ে যায়। চাকরির ক্ষেত্রে যখন এ সকল পরিস্থিতির উদ্ভব হচ্ছিল, তখন প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষা যুগপৎভাবে ভারতে নেওয়ার জন্য ভারতীয়দের একটি বড় দাবি সরকার মেনে নেয়। ১৯২২ সালে লন্ডন ও নতুন দিল্লিতে যুগপৎ প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষা গ্রহণের ব্যবস্থা করা হয়। ইতোমধ্যে রাজনৈতিক অগ্রগতি সাধিত হওয়ার কারণে অনেক অনিশ্চয়তা দেখা দেয় এবং ব্রিটিশ প্রতিযোগীদের সংখ্যা কমে যায়। এ পরিস্থিতিতে লী কমিশন সুপারিশ করে যে, উচ্চপদস্থ চাকরির বেলায় শতকরা ২০ ভাগ প্রাদেশিক সার্ভিস হতে পদোন্নতির মাধ্যমে পূরণ করতে হবে এবং বাকি ৮০ ভাগের ৪০ ভাগ ব্রিটিশ ও ৪০ ভাগ ভারতীয়দের মধ্য থেকে প্রতিযোগিতার মাধ্যমে নিয়োগ দিতে হবে। জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে বেশ কিছু দিন ধরেই সরকারি কর্মকর্তাগণ বেতন বৃদ্ধি ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা বাড়ানোর জন্য দাবি করে আসছিলেন। এ ব্যাপারে কমিশন মূল বেতন কমানো বা বাড়ানো কোনটাই করেনি, বরং কমিশন বিভিন্ন ভাতাদির মাধ্যমে ইউরোপীয় কর্মকর্তাদের সুযোগ-সুবিধা বহুগুণে বাড়ানোর প্রস্তাব করে। ইউরোপীয় কর্মকর্তাগণ কমিশনের সুপারিশমালাকে খুবই অপর্যাপ্ত বলে মনে করেন। তাদের কেউ কেউ মনে করেন যে, কমিশনের রিপোর্ট উচ্চ প্রশাসনের ভারতীয়করণের ক্ষেত্রে খুবই উদার ছিল। অপরদিকে ভারতের রাজনৈতিক মহলের মতে কমিশন ইউরোপীয় কর্মকর্তাদের প্রতি খুব বেশি পক্ষপাতিত্ব ও উদারতা দেখায়। ভারতীয় আইন পরিষদ বিদেশভাতা ও অন্যান্য সুবিধাদির মাধ্যমে ইউরোপীয় সরকারি কর্মকর্তাদের সম্মানী বাড়ানোর প্রস্তাবের সমালোচনা করে। মোটের উপর যে হারে আই.সি.এস এবং অন্যান্য উচ্চপদস্থ চাকরিগুলিকে ভারতীয়করণ করা হচ্ছিল, তাতে ভারতীয়রা সন্তুষ্ট হতে পারে নি। পরবর্তী উল্লেখযোগ্য কমিশন, যেটি লী কমিশনের পর ভারতের উচ্চপদস্থ চাকরিসমূহের সম্যসাদি বিচার-বিশ্লেষণ করে, সেটি হচ্ছে ১৯৩০ সালের স্ট্যাট্যুটরি কমিশন। ১৯৪৭ সাল নাগাদ প্রায় ১০০০ সরকারি কর্মকর্তার মধ্যে শতকরা ৫০ ভাগের বেশি ছিল ভারতীয়। এঁদের মধ্যে অনেকেই ছিলেন দীর্ঘ অভিজ্ঞতা সম্পন্ন ও উচ্চপদে অধিষ্ঠিত।  [এ.বি.এম মাহমুদ]