জগদ্দল মহাবিহার
জগদ্দল মহাবিহার বাংলায় বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী পাল রাজাদের চার শতকব্যাপী গৌরবময় রাজত্বকালে তাদের বিশাল সাম্রাজ্যের সর্বত্র বিভিন্ন রাজারা অসংখ্য বৌদ্ধ মঠ, মন্দির ও স্তূপ নির্মাণ করেছিলেন। রাজা ধর্মপাল কমপক্ষে ৫০টি স্বয়ংসম্পূর্ণ বৃহদায়তন ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নির্মাণ করেন বলে মনে করা হয়। পাল রাজাদের নির্মিত প্রতিষ্ঠানের মধ্যে মগধের বিশালায়তন বিক্রমশীলা মহাবিহার, বিক্রমপুরের বিক্রমপুরী বিহার এবং বরেন্দ্র অঞ্চলের সোমপুর মহাবিহার ও জগদ্দল মহাবিহার বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
জগদ্দল মহাবিহার নির্মাণ করেন সম্ভবত রামপাল (১০৭৭-১১২০)। মদনপালের রাজত্বকালে রচিত সন্ধ্যাকরনন্দীর রামচরিতম গ্রন্থ অনুসারে এ বিহারের অবস্থান বরেন্দ্রীতে। বিভূতি চন্দ্র, দানশীল, মোক্ষকর গুপ্ত ও শুভকর গুপ্তের ন্যায় তিববতের কয়েকজন বিখ্যাত বৌদ্ধ পন্ডিত এ বিহারের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। গবেষকগণ প্রমাণ করেন যে, মহাযান ধর্মমতের বজ্রযান ও তন্ত্রযান দর্শন সংক্রান্ত বেশ কিছু সংস্কৃত শাস্ত্রগ্রন্থ জগদ্দল বিহারেই তিববতীয় ভাষায় অনূদিত হয়েছিল। এ ‘সংঘরাম’-এর প্রধান বৌদ্ধ-দেবতা ছিলেন অবলোকিতেশ্বর।
শুভকর গুপ্ত ও অভয়কর গুপ্ত বিক্রমশীলা মহাবিহারের অন্যান্য পন্ডিতসহ ওই বিহারের ধ্বংসের পর জগদ্দল মহাবিহারে আশ্রয় নিয়েছিলেন বলে মনে করা হয়। এখানে তাঁরা বৌদ্ধধর্ম বিষয়ক বহু সংস্কৃত গ্রন্থ রচনা করেন। এসব পন্ডিতের মধ্যে অনেকেই ছিলেন বাঙালি। ধর্মীয় বিষয় নিয়ে লেখালেখির পাশাপাশি এঁরা ধর্মনিরপেক্ষ সংস্কৃত সাহিত্য, বিশেষ করে কবিতার বিকাশে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখতেন। ‘সুভাষিত রত্নকোষ’-এর সংকলক বিদ্যাকর ছিলেন সুদূরখ্যাত জগদ্দল মহাবিহারের একজন পন্ডিত।
জগদ্দল প্রত্নস্থলটি অনুসন্ধান করতে গিয়ে গবেষক আ ক ম জাকারিয়া একই নামের পাঁচটি প্রাচীন স্থানকে চিহ্নিত করেন। এর মধ্যে চারটি বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে অবস্থিত, আর একটির অবস্থান পশ্চিমবঙ্গের মালদহ জেলায়। এগুলি হলো: (ক) পঞ্চগড়ের জগদল, (খ) ঠাকুরগাঁও জেলার হরিপুর উপজেলার জগদল, (গ) দিনাজপুর জেলার বোচাগঞ্জ উপজেলার জগদল, (ঘ) নওগাঁ জেলার ধামইরহাট উপজেলার জগদল এবং (ঙ) পশ্চিমবঙ্গের মালদহ জেলার বামনগোলা থানার জগদল। ব্যক্তিগতভাবে এসব স্থান ভ্রমণ করে সতর্ক পর্যালোচনার মাধ্যমে জাকারিয়া এ সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, কেবল নওগাঁ জেলার জগদল ছাড়া অন্য চারটি স্থানে বিবেচনায় আনার মতো প্রাচীন যুগের তেমন কোনো চিহ্ন অবশিষ্ট নেই। তাই তিনি ধামইরহাটের জগদলের বিস্তৃত ঢিবিকেই বিখ্যাত জগদ্দল মহাবিহারের সম্ভাব্য স্থান হিসেবে চিহ্নিত করেন।
জগদ্দল গ্রামের এক বৃহৎ অংশ জুড়ে রয়েছে ইতস্তত বিক্ষিপ্ত প্রাচীন ঢিবি ও পরিত্যক্ত পুকুর। জয়পুরহাট-ধামইরহাট মহাসড়কের হাতিটাকিডাঙা বাজারের তিন কিলোমিটার উত্তর-পূর্বে, বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তের প্রায় ১.৫ কিলোমিটার দক্ষিণে এবং ধামইরহাট উপজেলা কার্যালয়ের ৮ কিলোমিটার উত্তর-পূর্ব দিকে এর অবস্থান। এ স্থান থেকে পাহাড়পুর ও হলুদ বিহার বৌদ্ধ মন্দিরের দূরত্ব যথাক্রমে মাত্র ২০ ও ১৮ কিলোমিটার।
এ সকল ধ্বংসাবশেষের একটি চমৎকার বর্ণনা পাওয়া যায় ১৯৪০ সালের দিকে প্রকাশিত বাংলা ভাষায় লেখা অমিয় বসুর ‘বাংলায় ভ্রমণ’ শীর্ষক রেলওয়ে গাইড বুকে। জাকারিয়া এর একটি ইংরেজি অনুবাদ করেছেন। এখানে বলা হয়েছে, গুরব স্তম্ভ (pillar) থেকে প্রায় ৩ মাইল দূরে চিরি বা শ্রী নদীর নিকটে প্রায় ১০০০ ফুট পরিধির বৃত্তাকার একটি স্তূপ (প্রকৃতপক্ষে ঢিবি) রয়েছে। এখানে রয়েছে প্রায় ৬৮.৫৮মি. পরিমাপের আরও একটি স্তূপ এবং এর কাছেই রয়েছে একটি বিশাল দিঘি। এখান থেকে একটি অষ্টকোণী প্রস্তরস্তম্ভও আবিষ্কৃত হয়েছে। উপরিউক্ত গাইড বইয়ে উল্লিখিত খোদাইকৃত অষ্টকোণী একশিলা স্তম্ভটি জগদ্দল গ্রাম থেকে ৫ কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্বে মঙ্গলবাড়িতে অবস্থিত। এটিই রাজা নারায়ণপালের (৮৫৪-৯০৮খ্রি.) মন্ত্রী ভট্ট গুরব মিশ্র কর্তৃক স্থাপিত ইতিহাসখ্যাত গরুড় স্তম্ভ বা বাদল স্তম্ভলিপি।
কাল পরিক্রমায় এ গ্রামের প্রাচীন ঢিবিগুলির বেশির ভাগই বিধ্বস্ত এবং পুকুরগুলি ভরাট হয়ে গেলেও কিছু ঢিবি এখনও বিচ্ছিন্নভাবে টিকে আছে। অবশ্য এগুলিও এখন হয় গ্রামবাসীদের অবৈধ দখলে রয়েছে, অথবা তাদের দ্বারাই বিনষ্ট হয়েছে। সরকারের প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের কর্মকর্তা মোশাররফ হোসেন ১৯৮৩-৮৪ সালে এ এলাকায় প্রাথমিক জরিপ করতে গিয়ে জনৈক বেনজামিন চোরার বাড়ি থেকে কালো ব্যাসল্ট পাথরের একটি ভাঙা ফলক ও ব্রোঞ্জের তৈরী একটি ভাঙ্গা ঘণ্টা উদ্ধার করেন। ফলকটিতে ধ্যানী বুদ্ধের তিনটি মূর্তি খোদিত রয়েছে। উল্লিখিত দুটি নিদর্শনই জগদল প্রত্নস্থল থেকে উদ্ধার করা হয়েছে বলে মনে করা হয়।
জগদ্দল গ্রামের দক্ষিণ প্রান্তে এবং জগৎনগর গ্রামের উত্তর সীমায় কয়েকটি ঢিবি রয়েছে। এগুলির মধ্যে রয়েছে পূর্ব-পশ্চিমে ১০৫ মিটার এবং উত্তর-দক্ষিণে ৮৫ মিটার দীর্ঘ একটি মনোরম আয়তাকার ঢিবি। চারপাশের সমতল ভূমি থেকে এর গড় উচ্চতা প্রায় ৫.৫ মিটার। ঢিবিটির মধ্যস্থলে রয়েছে একটি খাদ।
এ প্রত্নস্থলটির গুরুত্ব বিবেচনা করে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর ১৯৯৬ সালে শীত মৌসুমে উল্লিখিত ঢিবিটিতে উৎখনন শুরু করে। এর ফলে একটি বৌদ্ধ বিহারের ধ্বংসাবশেষ আংশিক উন্মোচিত হয়। এখন পর্যন্ত এ বিহারের দক্ষিণ দিকের পার্শ্ব-ইমারতের ৭টি এবং পশ্চিম পার্শ্ব-ইমারতের ৪টি কক্ষই কেবল আবিষ্কৃত হয়েছে। এগুলির প্রত্যেকটির পরিমাপ ৩.৫ মি × ৩.৩ মি। সন্ন্যাসীদের এ কক্ষগুলির কয়েকটির অভ্যন্তরে এবং এগুলির সামনের বারান্দাতেও দেবমূর্তি স্থাপনের জন্য পাথরের তৈরী বেদি ছিল। পাহাড়পুর বিহারের পূর্ব দিকের পার্শ্ব-ইমারতে কয়েকটি কক্ষে যে রকম বেদি পাওয়া গেছে, এগুলি তারই অনুরূপ। উপরিউক্ত ১১টি নিভৃত কক্ষ ছাড়াও উৎখননে পূর্বদিকে একটি প্রবেশ-তোরণ এবং পশ্চিম দিকের পার্শ্ব-ইমারতে একটি ছোট সমাধিও আবিষ্কৃত হয়েছে। কৌতূহলের ব্যাপার এ যে, বিহারটির চারকোণে সম্ভবত চারটি অর্ধবৃত্তাকার পার্শ্ববুরুজ ছিল, যেমনটি প্রাচীনকালের মন্দিরগুলিতে সাধারণত দেখা যায় না।
এক মৌসুমের উৎখননে আলোচ্য ঢিবিতে কেবল এ মন্দিরের একটি ক্ষুদ্র অংশই উন্মোচিত হয়েছে। এর বেশিরভাগ অংশই এখনও চাপা পড়ে রয়েছে মাটির নিচে। তবে স্থাপত্যিক ধ্বংসাবশেষ ছাড়াও এখান থেকে আবিষ্কৃত প্রত্নবস্ত্ত যথেষ্ট উৎসাহব্যঞ্জক। এখান থেকে ১৫০টিরও বেশি শিল্প নিদর্শন ও দৈনন্দিন ব্যবহার্য সামগ্রী আবিষ্কৃত হয়েছে। এদের মধ্যে রয়েছে প্রস্তর-মূর্তি, শিলালিপি, পোড়ামাটির ফলক ও পোড়ামাটির তৈরী মানুষের মাথা, অলংকৃত ইট, একটি স্বর্ণপিন্ড, মাটির তৈরী বিভিন্ন রকম পাত্র, লোহার পেরেক, মসৃণ ও কর্তিত প্রস্তরখন্ড, বেদিমূল ও জপমালার পুঁতি।
এই ঢিবি থেকে উদ্ধারকৃত তিনটি অপূর্ণাঙ্গ প্রস্তরমূর্তির মধ্যে একটি কালো পাথরের বিষ্ণুমূর্তি (৯ সেমি × ৭ সেমি × ২ সেমি) বিহারের দক্ষিণ দিকের পার্শ্ব-ইমারত খুঁড়ে পাওয়া গেছে। মূর্তিটির বেদি ও লক্ষ্মীমূর্তির অংশটুকু পাওয়া যায় নি। নির্মাণরীতি অনুসারে মূর্তিটি দশ ও এগারো শতকে নির্মিত বলে মনে করা হয়। দ্বিতীয় মূর্তিটি হচ্ছে ‘উপাসকদের রক্ষাকর্তা’ বৌদ্ধদেবতা হেরুকের। শক্তির সঙ্গে আলিঙ্গনাবদ্ধ হেরুকের এ মূর্তি (৯০ সেমি × ৮ সেমি × ৪ সেমি) চুনাপাথরে খোদাই করে তৈরি। পাহাড়পুর বিহারে পাওয়া অপর একটি মূর্তির সঙ্গে এর সাদৃশ্য রয়েছে এবং সম্ভবত এটিও ওই একই সময়ে নির্মিত।
তৃতীয়টি হচ্ছে পরিচয়হীন এক দেবতার মস্তকবিহীন বড় আকারের প্রস্তর-মূর্তি। মূর্তিটির (১.৩৩ সেমি × ০.৫০ সেমি × ০.৩৬ সেমি) দুটি হাতই ভাঙ্গা এবং দ্বিপত্রযুক্ত পদ্মাসনে আসীন মূর্তির পা সম্বলিত পাদপীঠ পাওয়া গেছে বিচ্ছিন্ন অবস্থায়। মূর্তিটির রয়েছে ধুতি, বাম বাহুতে বাজুবন্ধ, কোমরে বিছা, গলায় কণ্ঠহার এবং গায়ে রয়েছে বাম কাঁধ থেকে ডান দিকে ঝুলন্ত পৈতা।
বিহারের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণ থেকে বিচ্ছিন্ন অবস্থায় উদ্ধারকৃত পোড়ামাটির তৈরী মস্তকটি ছাড়াও বিহারের বিভিন্ন অংশ থেকে পাওয়া গেছে মানুষ ও জীবজন্তুর মূর্তি সম্বলিত কয়েকটি পোড়ামাটির ফলক। এগুলিতে দ্বাররক্ষী, ধনুর্বিদ, হরিণ, পাখি প্রভৃতির মূর্তি উৎকীর্ণ রয়েছে। পশ্চিম দেয়ালের বাইরের অংশের অলংকরণ হিসেবে ব্যবহূত এ রকম অনেকগুলি ফলক অবিকৃত অবস্থায় যথাস্থানে পাওয়া গেছে। এখানে প্রাপ্ত অলংকৃত ইটে রয়েছে পদ্মপাপড়ি, শিকল ও অাঁকাবাঁকা সর্পিল নকশা। অন্যান্য ছোটখাট প্রত্নবস্ত্তর মধ্যে প্রচুর পুরাতন মৃৎপাত্র ছাড়াও লোহার পেরেক, পাথরের জপ-গুটিকা ইত্যাদি রয়েছে।
এখান থেকে উদ্ধারকৃত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রত্নবস্ত্ত অবশ্য উৎকীর্ণ লিপিযুক্ত দুটি পাথরের স্তম্ভ, যা এ প্রত্নস্থলের সময় নির্ধারণে সহায়তা করে। এর একটি পাওয়া গেছে বিহারের পূর্বদিকের প্রবেশপথের কাছে, অন্যটি দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে। পূর্বদিকের প্রবেশপথের নিকটে প্রাপ্ত প্রথম স্তম্ভটির অষ্টকোণ দন্ডের (Shaft) গায়ে বারো/তেরো শতকের প্রাচীন বাংলা হরফে এর লিপিকার গঙ্গাপুরের শ্রী মক্কড় নন্দীর নাম উৎকীর্ণ আছে। মন্দিরের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে প্রাপ্ত প্রস্তর-স্তম্ভটি এখনও উৎখনন-খাদে অর্ধপ্রোথিত রয়েছে। এটিতেও একই সময়ের প্রাচীন বাংলা লিপিতে উৎকীর্ণ রয়েছে লিপিকার সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত জনৈক শ্রী ভবদাসের নাম। শ্রী মক্কড় নন্দী ও শ্রী ভবদাস উভয়েই ছিলেন লিপিকার সম্প্রদায়ের লোক এবং সম্ভবত জগদ্দল কিংবা এর পার্শ্ববর্তী এলাকার বাসিন্দা।
জগদ্দল গ্রামের বিশাল ঢিবিতে ১৯৯৬ সালে পরিচালিত সংক্ষিপ্ত খননকার্যের ফলাফল উৎসাহব্যঞ্জক হলেও চূড়ান্ত নয়। জগদ্দল মহাবিহারের অবস্থান, সম্ভাব্য সময় এবং ধ্বংসাবশেষের পরিব্যাপ্তি এখনও অনুমানসাপেক্ষ। এ বিষয়ে সুস্পষ্ট ধারণা পেতে হলে জরুরি ভিত্তিতে এখানে দীর্ঘমেয়াদি ও নিয়মানুগ উৎখননের উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন। [নাজিমউদ্দিন আহমদ]
গ্রন্থপঞ্জি AKM Zakaria, 'Jagaddala Mahavihara', The Journal of the Varendra Research Museum, 8, 1994; Abul Hashem Miah, 'Jagaddala Viharer Sampratik Khanan', Itihas Parishd Patrika, 1404 BS.