সাহিত্য পরিষদ পত্রিকা
সাহিত্য পরিষদ পত্রিকা একটি গবেষণানির্ভর মাসিক পত্রিকা। ১৩০০ বঙ্গাব্দের ৮ শ্রাবণ (২৩ জুলাই, ১৮৯৩) এল লিওটার্ড ও ক্ষেত্রপাল চক্রবর্তী কর্তৃক শোভাবাজারস্থ বাসভবনে ‘The Bengal Academy of Literature’ প্রতিষ্ঠিত হয়। একই নামে এবং অ্যাকাডেমির সেক্রেটারি ক্ষেত্রপাল চক্রবর্তীর সম্পাদনায় ১৮৯৩ সালের আগস্ট মাস থেকে একটি মাসিক পত্রিকার প্রকাশনা শুরু হয়। এতে সাপ্তাহিক সভার প্রতিবেদন, গবেষণামূলক প্রবন্ধ ও সমালোচনা স্থান পেত এবং এগুলির বেশির ভাগই ছিল ইংরেজিতে। ১৮৯৩ সালে রাজনারায়ণ বসু অ্যাকাডেমির সভাগুলিতে পত্রিকায় বাংলা ব্যবহারের অনুরোধ করেন। ১৮৯৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে উমেশচন্দ্র বটব্যাল একই অনুরোধ জানান। তিনি এর নাম পরিবর্তন করে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ রাখার প্রস্তাব করেন। ১৮৯৪ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি তারিখে অনুষ্ঠিত সভায় উমেশচন্দ্রের প্রস্তাবগুলি গৃহীত হয়। আট থেকে এগারো সংখ্যা পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানের এই পত্রিকার সংখ্যাগুলি বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ (The Bengal Academy of Literature) নামে প্রকাশিত হয়। শেষ পর্যন্ত ১৩০১ বঙ্গাব্দের ১৭ বৈশাখ (২৯ এপ্রিল, ১৮৯৪) একাডেমিকে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ রূপে পুনর্গঠিত করা হয় এবং একই বছর পরিষদের মুখপত্র হিসেবে বাংলায় ত্রৈমাসিক সাহিত্য পরিষদ পত্রিকার প্রকাশনা শুরু হয়। কখনও কখনও যৌথ সংখ্যা প্রকাশ, এমনকি কয়েক বছরের পত্রিকা একসঙ্গে প্রকাশ করতে হলেও, পত্রিকাটি আজও টিকে আছে। দেবজ্যোতি দাস ও শান্তিপদ ভট্টাচার্য ১৩৯২ বঙ্গাব্দ পর্যন্ত প্রকাশিত পত্রিকাটির একটি তালিকা সংকলন করেছেন। সংকলনটি পরিষদে পাওয়া যায়।
শুরু থেকেই গবেষণা-পত্রিকা হিসেবে সাহিত্য পরিষদ পত্রিকার পরিকল্পনা করা হয়েছিল। পরিষদের পনেরোতম বার্ষিক প্রতিবেদনে রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী স্পষ্টভাবে পত্রিকার আদর্শ ও উদ্দেশ্যের রূপরেখা প্রদান করেন। প্রতিবেদন থেকে জানা যায় যে, শুরু থেকেই এতে উপন্যাস ও কবিতার কোন স্থান থাকবে না মর্মে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছিল। এমনকি নতুন আবিষ্কৃত তথ্য বা নতুন তত্ত্ব না থাকলে সেসব প্রবন্ধও প্রকাশিত হবে না বলে স্থির হয়। প্রবন্ধ নির্বাচনে পরিষদ প্রধানত Journal of the Asiatic Society of Bengal এর পদাঙ্ক অনুসরণ করেছিল, যদিও এর পরিধি ছিল বাংলা ও বাঙালিদের মধ্যে সীমাবদ্ধ।
সাহিত্য পরিষদ প্রাচীন পান্ডুলিপি সংগ্রহের মাধ্যমে প্রাচীন বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস, আচার অনুষ্ঠান ও রীতিনীতি, সামাজিক উৎসব ও দেশীয় খেলাধুলা সম্পর্কিত তথ্য সংগ্রহের মাধ্যমে বাংলার সামাজিক ইতিহাস, মুদ্রা, শিলালিপি ও দলিলপত্র নিয়ে গবেষণার মাধ্যমে বাংলার রাজনৈতিক ইতিহাস এবং আঞ্চলিক ভাষা ও অনুরূপ বিষয়ে গবেষণার মাধ্যমে বাংলাভাষার ইতিহাস রচনার উদ্যোগ গ্রহণ করে। শতবর্ষের যাত্রাপথের উত্থান-পতনে এই পত্রিকা উপরোল্লিখিত সব ক্ষেত্রেই উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছে। বাংলার বিভিন্ন এলাকা থেকে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ বহুসংখ্যক পান্ডুলিপি সংগ্রহ করে। এসব পান্ডুলিপি ও অন্যান্য পান্ডুলিপির বিবরণ এবং সেগুলি সম্পর্কে আলোচনা ছিল এই পত্রিকার অন্যতম প্রধান বিষয়। বাংলার আঞ্চলিক ভাষার অভিধান সংকলনের প্রচেষ্টায় পরিষদ বাংলার বিভিন্ন জেলা থেকে সংগৃহীত বহু শব্দ প্রকাশ করে। প্রধানত নতুন আবিষ্কৃত মুদ্রা ও লিপির ভিত্তিতে স্থানীয় ইতিহাস সম্পর্কে এই পত্রিকায় প্রকাশিত গবেষণামূলক প্রবন্ধগুলি বাংলার ইতিহাস পুনর্গঠনের সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে। এমনকি, এর বিজ্ঞান বিষয়ক প্রবন্ধগুলি মাতৃভাষায় বিজ্ঞান চর্চার সূচনা করে। পরিভাষা রচনার ক্ষেত্রেও সাহিত্য পরিষদ পত্রিকা পথিকৃতের ভূমিকা পালন করে।
এই পত্রিকার লেখকদের মধ্যে জ্ঞানের প্রায় সব শাখায় নবীন ও প্রবীণ গবেষকবৃন্দ অন্তর্ভুক্ত। কীর্তিমান লেখকদের মধ্যে অচ্যুতচরণ চৌধুরী, অমূল্যচরণ ঘোষ, সাহিত্যবিশারদ আব্দুল করিম, চিন্তাহরণ চক্রবর্তী, দীনেশচন্দ্র ভট্টাচার্য, নগেন্দ্রনাথ বসু, নলিনীকান্ত ভট্টশালী, নির্মল কুমার বসু, পদ্মনাথ ভট্টাচার্য, বসন্তরঞ্জন রায়, বিমান বিহারী মজুমদার, ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, মুহম্মদ শহীদুল্লহ্, যদুনাথ সরকার, যোগেশচন্দ্র বাগল, 'যোগেশচন্দ্র রায়' বিদ্যানিধি, রজনীকান্ত গুপ্ত, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী, সুকুমার সেন, সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, সুশীলকুমার দে, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী মহাহোপাধ্যায়, দীনেশচন্দ্র সরকার, রমেশচন্দ্র মজুমদার প্রমুখ ছিলেন অন্যতম। [ইন্দ্রজিৎ চৌধুরী]