বসু, নগেন্দ্রনাথ প্রাচ্যবিদ্যামহার্ণব

বসু, নগেন্দ্রনাথ প্রাচ্যবিদ্যামহার্ণব (১৮৬৬-১৯৩৮)  বাংলা তথা ভারতীয় ভাষায় প্রথম বিশ্বকোষ রচয়িতা, প্রত্নতত্ত্ববিদ, ঐতিহাসিক, লেখক। ১৮৬৬ সালের ৬ জুলাই কলকাতায় তাঁর জন্ম। তাঁদের আদি নিবাস ছিল হুগলির মাহেশে। নগেন্দ্রনাথ জ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় অসাধারণ প্রতিভার স্বাক্ষর রাখলেও তাঁর প্রধান পরিচয় বাংলা বিশ্বকোষ রচয়িতা হিসেবে। রঙ্গলাল মুখোপাধ্যায়ের সংকলন এবং তাঁর ভ্রাতা ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায়ের সম্পাদনায় এর প্রথম খন্ড প্রকাশিত হয়। পরে দীর্ঘ ২৭ বছরের পরিশ্রমে নগেন্দ্রনাথ বিশ্বকোষের ২২টি খন্ড প্রকাশ করেন। শেষ খন্ডটি প্রকাশিত হয় ১৯১১ সালে। ১৯১৬-৩১ সালে ২৪ খন্ডে এর একটি হিন্দি সংস্করণও প্রকাশিত হয়। ১৯৩৩-৩৮ সালের মধ্যে বিশ্বকোষের দ্বিতীয় সংস্করণের চারটি খন্ড প্রকাশের পর তাঁর মৃত্যু হয়।

নগেন্দ্রনাথ প্রাচ্যবিদ্যামহার্ণববসু

প্রথম জীবনে নগেন্দ্রনাথ কবিতা ও  উপন্যাস রচনায় ব্রতী হন। কিন্তু অল্পদিন পরেই তিনি সম্পাদনা কাজে মনোনিবেশ করেন। এ সময় তিনি তপস্বিনী ও ভারত নামে দুটি মাসিক পত্রিকা সম্পাদনা করেন। পরবর্তীকালে দীর্ঘকাল বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের মুখপত্র  সাহিত্য পরিষৎ পত্রিকা সম্পাদনা করেন। তিনি কায়স্থসভার কায়স্থ পত্রিকারও সম্পাদক ছিলেন। শুধু পত্রিকাই নয়, তিনি অনেক মূল্যবান প্রাচীন গ্রন্থও সম্পাদনা করেন, যেমন: পীতাম্বর দাসের রসমঞ্জরী, জয়ানন্দের চৈতন্যমঙ্গল, চন্ডীদাসের অপ্রকাশিত রচনাবলি, জয়নারায়ণের কাশী-পরিক্রমা, ভাগবতাচার্যের কৃষ্ণপ্রেমতরঙ্গিণী প্রভৃতি। এগুলি  বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ থেকে প্রকাশিত হয়।

নগেন্দ্রনাথ একজন বিশিষ্ট প্রত্নতত্ত্ববিদ ছিলেন। প্রত্নতাত্ত্বিক উপকরণ সংগ্রহের জন্য তিনি ভারতের নানা স্থান, বিশেষত, উড়িষ্যার বিভিন্ন তীর্থ ও দুর্গম স্থান ঘুরে বেড়ান। সেসব স্থান থেকে তিনি প্রচুর শিলালিপি, তাম্রশাসন ও প্রাচীন বাংলা, সংস্কৃত ও উড়িয়া  পুথি সংগ্রহ করেন। প্রাপ্ত লিপিগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো শুশুনিয়া প্রত্নলিপি, মদনপালের অনুশাসন ইত্যাদি। এগুলির পাঠোদ্ধার করে তিনি প্রকাশ করেন যা বাংলা তথা ভারতের ইতিহাস রচনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এছাড়া নিজের সংগৃহীত প্রত্নতাত্ত্বিক তথ্যের ওপর ভিত্তি করে সংশ্লিষ্ট স্থানের প্রাচীন ইতিহাস এবং নাগরাক্ষরের উৎপত্তি সস্পর্কে তিনি অনেক গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধ রচনা করেন। ব্যক্তিগতভাবে তিনি যে প্রাচীন পুথিগুলি সংগ্রহ করেন, সেগুলি নিয়েই কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগ খোলা হয়।

১৮৮৪ সালে নগেন্দ্রনাথ শব্দেন্দু মহাকোষ নামে একটি ইংরেজি-বাংলা অভিধান সংকলন ও প্রকাশ করেন। এ কাজের সূত্র ধরেই তাঁর ঘনিষ্ঠ পরিচয় হয় আনন্দকৃষ্ণ বসু ও হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর সঙ্গে এবং তাঁদের আগ্রহেই তিনি কলকাতার এশিয়াটিক সোসাইটির সদস্য হন। ১৮৯৪ সালে বাংলার অনেক ঐতিহাসিক তথ্যসমৃদ্ধ প্রবন্ধাবলি তিনি এখানে উপস্থাপন করেন। নগেন্দ্রনাথ শব্দকল্পদ্রুমের পরিশিষ্ট সংকলনের কাজেও যুক্ত ছিলেন। তাঁর কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ গবেষণাগ্রন্থ হলো: বঙ্গের জাতীয় ইতিহাস (কয়েক খন্ড), কায়স্থের বর্ণপরিচয়, শূন্যপুরাণ, Archaeological Survey of Mayurbhanja, Modern Buddhism and its Followers in Orissa, Social History of Kamrup ইত্যাদি।

গবেষণার পাশাপাশি নগেন্দ্রনাথ নাটক রচনা ও অনুবাদের কাজও করেন। বিহারীলাল সরকারের আগ্রহে তিনি দর্জিপাড়া থিয়েট্রিক্যাল ক্লাবের জন্য শঙ্করাচার্য (১৮৮৮), পার্শ্বনাথ, হরিরাজ, লাউসেন প্রভৃতি গদ্যপদ্যময় কয়েকটি নাটক রচনা করেন। এছাড়া তিনি শেক্সপীয়রের হ্যামলেট এবং কর্ণবীর (১৮৮৪) নামে ম্যাকবেথ নাটকের বঙ্গানুবাদ করেন। নগেন্দ্রনাথ ছিলেন বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের স্তম্ভস্বরূপ। এছাড়া তিনি কায়স্থসভারও অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন। ভারতীয় পুরাতত্ত্বে অসাধারণ গবেষণার জন্য তাঁকে ‘প্রাচ্যবিদ্যামহার্ণব’ উপাধিতে ভূষিত করা হয়।  [দুলাল ভৌমিক]