কাসিম খান চিশতি
কাসিম খান চিশতি মুগল সুবাহদার। তাঁর উপাধি ছিল মুহতাসিম খান। তিনি সুবাহদার ইসলাম খান চিশতির ছোট ভাই। ইসলাম খানের পরেই কাসিম খান বাংলার সুবাহদার হয়ে আসেন। ১৬১৩ খ্রিস্টাব্দে তাঁকে নিয়োগ দান করা হলেও কার্যত তিনি ১৬১৪ খ্রিস্টাব্দের মে মাসে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। রাস্ট্র পরিচালনার কৌশল, দক্ষতা ও বুদ্ধিমত্তায় তিনি তাঁর বড় ভাইয়ের চেয়ে ভিন্ন ছিলেন এবং ভাইয়ের তুলনায় তাঁর সাহস, উদ্যম, সততা ও অধ্যবসায় কম ছিল। তিনি ছিলেন কলহপ্রবণ, স্বেচ্ছাচারী ও উদ্ধত স্বভাবের এবং কর্মচারীদের সাথে তাঁর আচরণে সৌজন্য ও মর্যাদাবোধের অভাব ছিল।
কাসিম খান কোনো উল্লেখযোগ্য সাফল্য ব্যতিরেকেই প্রায় তিন বছর (মে ১৬১৪ থেকে এপ্রিল ১৬১৭) বাংলা শাসন করেন। তিনি দীউয়ান মির্জা হুসাইন বেগের সাথে দ্বন্দ্বে লিপ্ত হন। তাঁর অন্যায় আচরণে বখশী ও ওয়াকিয়ানবিশদের বৈরীভাবাপন্ন করে তোলে। তিনি কুচবিহারের রাজা লক্ষ্মীনারায়ণ ও কামরূপের রাজা পরীক্ষিৎ নারায়ণকে বন্দি করে তাদের ধর্মে আঘাত দেন। মুগল গভর্নরের এ কার্যক্রমের প্রতিবাদে কুচবিহার ও কামরূপএ বিদ্রোহ দেখা দেয়। কাসিম খান কাছাড়ের বিরুদ্ধে অভিযান প্রেরণ করেন এবং তা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। পরবর্তী সময়ে বীরভুম, পাচেট, হিজলি ও চন্দ্রকোনার জমিদার যথাক্রমে বীর হামির, শামস্ খান, বাহাদুর খান ও বীর বাহুর বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক অভিযান প্রেরিত হয়েছিল।
এরপর কাসিম খান তাঁর সময়ের প্রথম ও প্রচন্ড বহিরাক্রমণের সম্মুখীন হন। আরাকানের রাজা মং খামৌংগ (হাসাইন খান) এবং পর্তুগিজ স্বেচ্ছা-সৈনিক সিবাস্টিয়ান গঞ্জালেস বাংলায় মুগলদের সীমান্ত থানায় সম্মিলিত আক্রমণ পরিচালনা করেন। প্রথম দিকে আরাকান রাজা ও পর্তুগিজ হামলাকারীরা সাফল্য অর্জন করে। তাদের সম্মিলিত সেনাদল বড় ফেনী ও ছোট ফেনী নদী অতিক্রম করে ভুলুয়া অধিকার করে এবং দেশীয় রাজ্যসমূহে ধ্বংসযজ্ঞ ও লুণ্ঠন চালিয়ে উত্তর দিকে অগ্রসর হয়। মুগলদের পরাজয় অত্যাসন্ন হলে আকস্মিকভাবে তাদের ভাগ্যের মোড় ঘুরে যায়। আরাকানি ও পর্তুগিজ বাহিনীর মধ্যে মতানৈক্য দেখা দেয় এবং এতে করে তাদের মৈত্রীর অবসান ঘটে। তাদের পারস্পরিক সংঘর্ষকালে মুগলরা আরাকানিদের ওপর আক্রমণ পরিচালনা করে। ফলে আরাকানিরা অধিকৃত অঞ্চল থেকে পশ্চাদপসরণ করে। আরাকানিরা মুগল অধিকৃত অঞ্চলে দ্বিতীয়বার প্রবেশের চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। আরাকান রাজা ও তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্র চারদিক থেকে মুগল বাহিনী দ্বারা পরিবেষ্টিত হন এবং নিরাপদে পশ্চাদপসরণের নিশ্চয়তা লাভের জন্য মুগলদের সঙ্গে অপমানজনক চুক্তি স্বাক্ষর করতে বাধ্য হন।
কাসিম খান কর্তৃক আসাম আক্রমণ কালে তাঁর শোচনীয় পরিণতি ঘটে এবং এতে তাঁর সৈন্য ও সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি হয়। এ অভিযানে মুগল নৌবাহিনী ব্যর্থতার পরিচয় দেয়। চট্টগ্রামকে প্রথম লক্ষ্যবস্ত্ত করে কাসিম খান আরাকানিদের বিরুদ্ধে আর একটি অভিযান প্রেরণ করেন। কিন্তু মুগলদের প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। ক্রমাগত সামরিক ব্যর্থতার কারণে সম্রাট জাহাঙ্গীর বাংলা থেকে কাসিম খানকে প্রত্যাহার করতে বাধ্য হন এবং তাঁর স্থলে নতুন সুবাহদার ইবরাহিম খানকে প্রেরণ করেন। [কে.এম করিম]