কর্ণফুলী পানি বিদ্যুৎ কেন্দ্র
কর্ণফুলী পানি বিদ্যুৎ কেন্দ্র (Karnafuli Hydro Power Station) বন্দর নগরী চট্টগ্রামের ৫০ কিলোমিটার দূরবর্তী রাঙ্গামাটি জেলার কাপ্তাই উপজেলায় অবস্থিত দেশের একমাত্র জলীয় শক্তি দ্বারা পরিচালিত বিদ্যুৎ স্থাপনা। বাংলাদেশের বৃহত্তম জলসম্পদ উন্নয়ন প্রকল্প ‘কর্ণফুলী বহুমুখী প্রকল্প’-এর অংশ হিসেবে এ জলবিদ্যুৎ স্থাপনাটি তৈরি করা হয়েছে। ১৯৬২ সালে চালু করার পর জলবিদ্যুৎ স্থাপনা জাতীয় গ্রিডে ৮০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে সক্ষম ছিল। পরবর্তী সময়ে দুটি পর্বে স্থাপনাটির বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা বৃদ্ধি করে মোট ২৩০ মেগাওয়াটে উন্নীত করা হয়। এ বহুমুখী প্রকল্প দেশের বিদ্যুৎ চাহিদা পূরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখা ছাড়াও বাঁধের ভাটি অঞ্চলের সেচ ও বন্যা ব্যবস্থাপনা স্থাপনা হিসেবে মূল্যবান অবদান রেখে আসছে।
কাপ্তাই বাঁধ এটি মাটি ভরাট করে নির্মিত ৬৭০.৬ মিটার দীর্ঘ একটি বাঁধ। বাঁধটি ৪৫.৭ মিটার উঁচু যা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৩৬ মিটার (এম.এস.এল) উচ্চতার সমান। এর চূড়ার সর্বোচ্চ প্রস্থ ৭.৬ মিটার ও পাদদেশের প্রস্থ ৪৫.৭ মিটার। ১২.২ মিটার দৈর্ঘ্য ও ১১.৩ মিটার প্রস্থ বিশিষ্ট মোট ১৬টি জলকপাট সংযুক্ত একটি জল নির্গমন কাঠামো রয়েছে যার মাধ্যমে একত্রে ৬,২৫,০০০ কিউসেক পানি নির্গমন সম্ভব। জলাধারটিতে গড় বার্ষিক প্রবাহের পরিমাণ প্রায় ১৫৬৪.৬ কোটি ঘন মিটার, বন্যা বিশোষণ ক্ষমতা ৮২.৫ লক্ষ একর-ফুট এবং ৩৩ মিটার এম.এস.এল উচ্চতা পর্যন্ত প্লাবিত অঞ্চল ৭৭৭ বর্গ কিলোমিটার।
প্রকল্পটির মূল লক্ষ্য ছিল জলবিদ্যুৎ উৎপাদন। এ লক্ষ্যকে সামনে রেখে তৎকালীন ইংরেজ সরকার বেশ কিছু জরিপ পরিচালনা করেছিল। অবশেষে ১৯৫২ সালের শুরুর দিকে বাঁধ নির্মাণের জন্য কাপ্তাইকে নির্বাচিত করা হয়। প্রকৃতপক্ষে কাপ্তাই হলো ধনুকাকৃতির বাঁকযুক্ত একটি খাল যার উজানে রেংখিয়াং নদী ও ভাটিতে পাহাড়ি ছড়া ফ্রিংখিয়াং। প্রকল্পের নক্সা অনুযায়ী বাঁধ দিয়ে বাঁকের উঁচু পাহাড়ি অঞ্চলের শেষ প্রান্তে পানিপ্রবাহ বন্ধ করে দিয়ে সঞ্চিত পানির বিরাট জলাধার সৃষ্টির পরিকল্পনা করা হয় এবং এ সঞ্চিত পানিই সুড়ঙ্গ সদৃশ নিদিষ্ট পথে বেগে ধাবিত করলে জলের তোড়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী যন্ত্রসমূহ সক্রিয় হয়ে উঠবে। পরিকল্পনাটি চূড়ান্ত করে তৎকালীন পাকিস্তান সরকার কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ প্রকল্পে অর্থায়নের জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে প্রস্তাব রাখে। যুক্তরাষ্ট্র প্রস্তাবটি গ্রহণ করে এবং ১৯৫৬ সালে ইন্টারন্যাশনাল ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি (International Engineering Company) বাঁধ তৈরীর জন্য নিয়োগপ্রাপ্ত হয়। ইউতাহ ইন্টারন্যাশনাল ইনকর্পোরেট (Utah International Inc.) নামের আরেকটি কোম্পানি ১৯৫৭ সালে বাঁধ নির্মাণের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়। নির্মাণ কাজ সমাপ্ত হয় ১৯৬১ সালের শেষ নাগাদ এবং নির্গমন দ্বারগুলি ১৯৬২ সালের প্রথম দিকেই বন্ধ করে দেওয়া হয়। ওই বছরেই বর্ষাকালে পরিকল্পিত সর্বোচ্চ মাত্রার পানি অর্জন সম্ভব হয় এবং জলবিদ্যুৎ স্থাপনাটি চালুর মাধ্যমে চট্টগ্রাম এলাকা ও জাতীয় গ্রিডে বিদ্যুৎ সরবরাহ শুরু হয়। কাপ্তাইয়ে কর্ণফুলি নদীর উপর বাঁধ নির্মাণ করে কর্ণফুলী বিদ্যুৎ স্থাপনা প্রকল্পের জন্য যে বিশাল জলাধারটি গড়ে তোলা হয়েছে সেটি কাপ্তাই লেক নামে পরিচিত।
জলাধারটির কারণে বিশাল এলাকা জলমগ্ন হয়ে পড়ে। হাজার হাজার লোক ঘরবাড়ি, আবাদি জমি হারিয়ে সর্বস্বান্ত হয়। ক্ষতিগ্রস্ত জনগণ অবশ্য এসকল জমির প্রকৃত মালিক ছিল না, কারণ পার্বত্য চট্টগ্রাম ম্যানুয়েল অনুসারে এলাকার সব জমিই রাষ্ট্রীয় সম্পত্তি হিসেবে ঘোষিত হয়েছিল। তথাপি মানবিক কারণে সরকারকে ক্ষতিগ্রস্তদের ন্যায্য ক্ষতিপূরণ ও পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করতে হয়েছিল। প্রকল্পের দলিল-দস্তাবেজ অনুযায়ী লেকের কারণে সমুদ্রপৃষ্ঠের সর্বোচ্চ ৩৩.২২ মিটার উঁচু পর্যন্ত এলাকাসমুহ নিমজ্জিত হওয়ার কথা। মূল লেকটির আয়তন প্রায় ১৭২২ বর্গ কিমি, তবে আশপাশের আরও প্রায় ৭৭৭ বর্গ কিমি এলাকাও প্লাবিত হয়। কাপ্তাই বাঁধের কারণে আনুমানিক ১৮,০০০ পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়, ৫৪ হাজার একর কৃষিজমি পানিতে তলিয়ে যায় এবং প্রায় ৬৯০ বর্গ কিমি বনভূমি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সরকার ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলিকে ক্ষতিপূরণ হিসেবে ৪ কোটি ১৫ লক্ষ টাকা বরাদ্দ দিলেও সবাইকে নগদ ক্ষতিপূরণ দেওয়া সম্ভব হয়নি।
জলবায়ু প্রকল্প অঞ্চলটি ভারি আর্দ্রতাবাহী মৌসুমি বায়ুর গতিপথে অবস্থিত। বর্ষাকাল জুন থেকে অক্টোবর মাস পর্যন্ত প্রলম্বিত এবং মোট বৃষ্টির প্রায় ৮০ শতাংশ এ সময়ে সংঘটিত হয়। এ অঞ্চলে বার্ষিক বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ২,২০০ থেকে ৩,৬০০ মিলিমিটার। নভেম্বর থেকে মার্চ মেয়াদে আর্দ্রতার পরিমাণ ৩৫ শতাংশ থেকে ৪৫ শতাংশের মধ্যে থাকলেও বর্ষাকালে তা বেড়ে ৮০ শতাংশ বা তারও বেশি হয়। বার্ষিক গড় বাষ্পীভবন প্রায় ৫০০ মিলিমিটার, তবে অধিকাংশ বাষ্পীভবনই শুষ্ক মৌসুমে ঘটে থাকে। প্রবল বজ্রবৃষ্টি ও ঘূর্ণিঝড় ব্যতীত বাতাসের বেগ সাধারণত মৃদু বলেই বিবেচিত, রেকর্ডকৃত বায়ুর সর্বোচ্চ গতিবেগ ঘন্টায় ৯৬.৫৪ কিলোমিটার।
বন্যার প্রকোপ সাধারণত জুন থেকে অক্টোবর মাস পর্যন্ত বর্ষা মৌসুমে বড় আকারের বন্যা দেখা দেয়। বন্যা পরিস্থিতি তুঙ্গে অবস্থান করে সচরাচর ৪ থেকে ৫ দিন এবং ভরা কটালের সময় এ পরিস্থিতি বিরাজ করে। ঝড়ঝঞ্ঝার সময় জোয়ারের উচ্চতা বৃদ্ধি পেলে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি ঘটে। কর্ণফুলি নদীতে বন্যা যখন তুঙ্গে তখন হালদা নদীতে পানি নিষ্ক্রমণ মন্থর থাকে বিধায় ভাটির নিম্নাঞ্চলে তীব্র বন্যা সংঘটিত হয়।
বিদ্যুৎ উৎপাদন ১৯৬২ সালের শুরুতে বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি উদ্বোধন হলে পরিকল্পিত ৩টি জেনারেটরের মধ্যে ২টিতে উৎপাদিত ৮০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ জাতীয় বিদ্যুৎ গ্রিডে সরবরাহ শুরু হয়। ৫০ মেগাওয়াট ক্ষমতাবিশিষ্ট তৃতীয় জেনারেটরটি স্থাপনার কাজ শেষ হলে ১৯৮২ সালের জানুয়ারি মাস থেকে এটি বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু করে। একটি সম্ভাব্যতা যাচাই জরিপে দেখা গেছে যে প্রাক্কলিত হিসাবের চাইতে জলাধারটির ধারণ ক্ষমতা ২৫% বেশি রয়েছে। ব্যবহারিক উপাত্তে মূল হিসাবের চেয়ে বেশি বিদ্যুৎ প্রবাহের তথ্য বিদ্যমান থাকার বিষয়টি ধরা পড়ে। তাই এ অতিরিক্ত ক্ষমতা আহরণের উদ্দেশ্যে প্রতিটি ৫০ মেগাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতাসম্পন্ন আরও দুটি অতিরিক্ত জেনারেটর ১৯৮৭ সালে স্থাপন করা হয়।
কর্ণফুলী পানি বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে প্রাপ্ত স্বল্পমূল্যের বিদ্যুৎ শক্তির কারণে বাংলাদেশে শিল্প কলকারখানা স্থাপন ও সম্প্রসারণ গতিশীল হচ্ছে। বিদ্যুতের সহজলভ্যতার কারণে ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলনের মাধ্যমে বিপুল এলাকায় সেচ সুবিধা অর্জন সম্ভব হয়েছে। জলাধারটি চট্টগ্রাম শহর ও চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দরসহ আশপাশের অঞ্চলকে বন্যার ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি থেকে রক্ষা করে চলেছে। কাপ্তাই লেককে কেন্দ্র করে যে মৎস্য শিল্প গড়ে উঠেছে তা থেকে বছরে ৭০০ টনেরও বেশি স্বাদুপানির মাছ উৎপাদিত হচ্ছে। বাঁধের উজানে লেকের স্বচ্ছনীল জলরাশি বিসর্পিল রেখায় পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ময় নিসর্গের প্রতিটি প্রান্তর ছুঁয়ে বয়ে চলেছে। ফলে প্রত্যন্ত বরকল নদীপ্রপাত থেকে শুরু করে রাঙ্গামাটি হয়ে উত্তরে কাসালং-এর সংরক্ষিত বনভূমি পর্যন্ত এলাকায় যাতায়াত লঞ্চ, নৌকা ও অন্যান্য জলযানের মাধ্যমে খুবই সহজ হয়ে উঠেছে। কাপ্তাইয়ে বৈদ্যুতিক রজ্জুপথের মাধ্যমে বাঁধের ওপর দিয়ে বিভিন্ন আকারের নৌকা ও অন্যান্য ভাসমান মালামাল লেক থেকে কর্ণফুলি নদীতে বা নদী থেকে লেকে পারাপার করা হয়। [সিফাতুল কাদের চৌধুরী]