পাঁচালি: সংশোধিত সংস্করণের মধ্যে পার্থক্য

(Added Ennglish article link)
 
সম্পাদনা সারাংশ নেই
 
১ নং লাইন: ১ নং লাইন:
[[Category:বাংলাপিডিয়া]]
[[Category:বাংলাপিডিয়া]]
'''পাঁচালি ''' লোকগীতির একটি ধারা। এতে গানের মাধ্যমে কোনো আখ্যান বর্ণিত হয়। পঞ্চাল বা পঞ্চালিকা শব্দ থেকে পাঁচালি শব্দের উৎপত্তি। আবার এতে গান, বাজনা, ছড়া কাটা, গানের লড়াই ও নাচ এই পঞ্চাঙ্গের সমাবেশে ঘটে বলেও কেউ কেউ একে পাঁচালি বলেন। পূর্বে প্রধানত কাহিনীমূলক গানের সঙ্গে  [[পুতুলনাচ|পুতুলনাচ]] প্রদর্শনের প্রথা প্রচলিত ছিল বলে এই গীতকে পাঁচালি বলা হতো। পরে (১৮ শতকে ও ১৯ শতকের প্রথমদিকে) পুতুলনাচ হ্রাস পেলে মূল গায়েন নিজে পায়ে নূপুর এবং হাতে চামর ও মন্দিরা নিয়ে নৃত্য পরিবেশন করতেন। কখনও কখনও তিনি বিভিন্ন পাত্রপাত্রীর রূপ ধারণ করে হাস্যরসও পরিবেশন করতেন। এই ক্রমোন্নত অ্যাখায়িকা বা কাহিনীপ্রধান  [[সঙ্গীত|সঙ্গীত]] ধারাটিও পাঁচালি নামে প্রসিদ্ধ হয়। পাঁচালিতে এক সময় টপ্পাসহ বিভিন্ন গানের অনুপ্রবেশ ঘটে। মধ্যযুগে  [[রামায়ণ|রামায়ণ]],  [[মহাভারত|মহাভারত]],  [[মঙ্গলকাব্য|মঙ্গলকাব্য]] প্রভৃতি আখ্যানকাব্যও পাঁচালির সুরে গাওয়া হতো। এমনকি অনেক পুথিও পাঁচালির সুরে পাঠ করা হতো।
'''পাঁচালি''' লোকগীতির একটি ধারা। এতে গানের মাধ্যমে কোনো আখ্যান বর্ণিত হয়। পঞ্চাল বা পঞ্চালিকা শব্দ থেকে পাঁচালি শব্দের উৎপত্তি। আবার এতে গান, বাজনা, ছড়া কাটা, গানের লড়াই ও নাচ এই পঞ্চাঙ্গের সমাবেশে ঘটে বলেও কেউ কেউ একে পাঁচালি বলেন। পূর্বে প্রধানত কাহিনীমূলক গানের সঙ্গে  [[পুতুলনাচ|পুতুলনাচ]] প্রদর্শনের প্রথা প্রচলিত ছিল বলে এই গীতকে পাঁচালি বলা হতো। পরে (১৮ শতকে ও ১৯ শতকের প্রথমদিকে) পুতুলনাচ হ্রাস পেলে মূল গায়েন নিজে পায়ে নূপুর এবং হাতে চামর ও মন্দিরা নিয়ে নৃত্য পরিবেশন করতেন। কখনও কখনও তিনি বিভিন্ন পাত্রপাত্রীর রূপ ধারণ করে হাস্যরসও পরিবেশন করতেন। এই ক্রমোন্নত অ্যাখায়িকা বা কাহিনীপ্রধান  [[সঙ্গীত|সঙ্গীত]] ধারাটিও পাঁচালি নামে প্রসিদ্ধ হয়। পাঁচালিতে এক সময় টপ্পাসহ বিভিন্ন গানের অনুপ্রবেশ ঘটে। মধ্যযুগে  [[রামায়ণ|রামায়ণ]],  [[মহাভারত|মহাভারত]],  [[মঙ্গলকাব্য|মঙ্গলকাব্য]] প্রভৃতি আখ্যানকাব্যও পাঁচালির সুরে গাওয়া হতো। এমনকি অনেক পুথিও পাঁচালির সুরে পাঠ করা হতো।


পাঁচালিতে পৌরাণিক, লৌকিক বা সমসাময়িক যেকোনো বিষয় উপজীব্য হতে পারত। এতে একজন প্রধান গায়ক নাটকীয় ভঙ্গিতে আবৃত্তি,  [[ছড়া|ছড়া]] ও গীতদ্বারা মূল কাহিনী বিবৃত করতেন। কালক্রমে পাঁচালির বিবর্তন ও প্রসারের ফলে মূল গায়কের সঙ্গে একাধিক গায়েনের সংযোগ ঘটে। তারা মৃদঙ্গ, ঢোল, কাঁসি প্রভৃতি  [[লোকবাদ্যযন্ত্র|লোকবাদ্যযন্ত্র]] বাজিয়ে পাঁচালি গাইতেন।
পাঁচালিতে পৌরাণিক, লৌকিক বা সমসাময়িক যেকোনো বিষয় উপজীব্য হতে পারত। এতে একজন প্রধান গায়ক নাটকীয় ভঙ্গিতে আবৃত্তি,  [[ছড়া|ছড়া]] ও গীতদ্বারা মূল কাহিনী বিবৃত করতেন। কালক্রমে পাঁচালির বিবর্তন ও প্রসারের ফলে মূল গায়কের সঙ্গে একাধিক গায়েনের সংযোগ ঘটে। তারা মৃদঙ্গ, ঢোল, কাঁসি প্রভৃতি  [[লোকবাদ্যযন্ত্র|লোকবাদ্যযন্ত্র]] বাজিয়ে পাঁচালি গাইতেন।
৬ নং লাইন: ৬ নং লাইন:
আঠারো শতকের শেষদিকে পাঁচালি নতুন রূপ লাভ করে। তখন এতে আখ্যান, কবিগানের ছড়া কাটা, অঙ্গভঙ্গি ও অভিনয়ের সংমিশ্রণ ঘটে। উনিশ শতকে পাঁচালিতে সংযুক্ত হয় সংলাপরীতি, যা মূল গায়েনের দ্বারাই অভিনীত হতো। এ সময় নতুন সংযোজন হিসেবে যুক্ত হয় একটি ‘সঙ’ চরিত্র। এ চরিত্রটি গান ও ছড়া আবৃত্তি বা নাচের মাধ্যমে বিভিন্ন সামাজিক অসঙ্গতির হাস্যকর অনুকরণের দ্বারা হাস্যরসের সৃষ্টি করত। উনিশ শতকে বাংলার সমসাময়িক সামাজিক বিষয়াদি, যেমন তালাকপ্রাপ্ত রমণীর পুনর্বিবাহ, আয়কর সমস্যা বা প্রতিমাপূজাবিরোধী  [[ইয়ং বেঙ্গল|ইয়ং বেঙ্গল]] সম্পর্কিত পাঁচালি খুবই জনপ্রিয় ছিল। এই পাঁচালি থেকেই পরবর্তীকালে বহুল জনপ্রিয় যাত্রাগানের উদ্ভব হয়।
আঠারো শতকের শেষদিকে পাঁচালি নতুন রূপ লাভ করে। তখন এতে আখ্যান, কবিগানের ছড়া কাটা, অঙ্গভঙ্গি ও অভিনয়ের সংমিশ্রণ ঘটে। উনিশ শতকে পাঁচালিতে সংযুক্ত হয় সংলাপরীতি, যা মূল গায়েনের দ্বারাই অভিনীত হতো। এ সময় নতুন সংযোজন হিসেবে যুক্ত হয় একটি ‘সঙ’ চরিত্র। এ চরিত্রটি গান ও ছড়া আবৃত্তি বা নাচের মাধ্যমে বিভিন্ন সামাজিক অসঙ্গতির হাস্যকর অনুকরণের দ্বারা হাস্যরসের সৃষ্টি করত। উনিশ শতকে বাংলার সমসাময়িক সামাজিক বিষয়াদি, যেমন তালাকপ্রাপ্ত রমণীর পুনর্বিবাহ, আয়কর সমস্যা বা প্রতিমাপূজাবিরোধী  [[ইয়ং বেঙ্গল|ইয়ং বেঙ্গল]] সম্পর্কিত পাঁচালি খুবই জনপ্রিয় ছিল। এই পাঁচালি থেকেই পরবর্তীকালে বহুল জনপ্রিয় যাত্রাগানের উদ্ভব হয়।


পাঁচালি রচয়িতাদের মধ্যে বিশেষ প্রসিদ্ধ  [[রায়, দাশরথি|দাশরথি রায়]]। তিনি প্রথম জীবনে কবিয়াল ছিলেন। ‘দাশু রায়ের পাঁচালি’ সারা বাংলায় বিশেষ খ্যাতি অর্জন করে। দাশরথি রায় প্রমুখ জনপ্রিয় কবিগণের প্রচেষ্টায় উনিশ শতকে যে নব্য পাঁচালি-ধারার সূত্রপাত হয়, তা মূলত  [[কীর্তন|কীর্তন]] গান থেকেই উদ্ভূত। দাশরথি রায়ের পাঁচালি সাধারণের মধ্যে লোকশিক্ষা, সাহিত্যবোধ, ধর্মবোধ এবং সমাজচেতনা জাগ্রত করে। তাঁর পাঁচালির মধ্য দিয়েই সর্বপ্রথম মধ্যযুগ থেকে আধুনিক যুগের বাংলা সাহিত্যের বিবর্তনের পরিচয় পাওয়া যায়। পরে  [[বসু, মনোমোহন|মনোমোহন বসু]] প্রবর্তিত নব্য ধারার পাঁচালিতে কবিগানের গভীর প্রভাব পড়েছিল। এ সময়ের অন্যান্য খ্যাতিমান পাঁচালিকাররা হচ্ছেন ঠাকুরদাস দত্ত (১৮০১-১৮৭৬), রসিকচন্দ্র রায় (১৮২০-১৮৯২), ব্রজমোহন রায় (১৮৩১-১৮৭৬), রসিকচন্দ্র গোস্বামী, নন্দলাল রায়, কৃষ্ণকমল গোস্বামী প্রমুখ। শীতলার পাঁচালি, সত্যনারায়ণ বা সত্যপীরের পাঁচালি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য দুটি পাঁচালি কাব্য।
পাঁচালি রচয়িতাদের মধ্যে বিশেষ প্রসিদ্ধ  [[রায়, দাশরথি|দাশরথি রায়]]। তিনি প্রথম জীবনে কবিয়াল ছিলেন। ‘দাশু রায়ের পাঁচালি’ সারা বাংলায় বিশেষ খ্যাতি অর্জন করে। দাশরথি রায় প্রমুখ জনপ্রিয় কবিগণের প্রচেষ্টায় উনিশ শতকে যে নব্য পাঁচালি-ধারার সূত্রপাত হয়, তা মূলত  [[কীর্তন|কীর্তন]] গান থেকেই উদ্ভূত। দাশরথি রায়ের পাঁচালি সাধারণের মধ্যে লোকশিক্ষা, সাহিত্যবোধ, ধর্মবোধ এবং সমাজচেতনা জাগ্রত করে। তাঁর পাঁচালির মধ্য দিয়েই সর্বপ্রথম মধ্যযুগ থেকে আধুনিক যুগের বাংলা সাহিত্যের বিবর্তনের পরিচয় পাওয়া যায়। পরে  [[বসু, মনোমোহন|মনোমোহন বসু]] প্রবর্তিত নব্য ধারার পাঁচালিতে কবিগানের গভীর প্রভাব পড়েছিল। এ সময়ের অন্যান্য খ্যাতিমান পাঁচালিকাররা হচ্ছেন ঠাকুরদাস দত্ত (১৮০১-১৮৭৬), রসিকচন্দ্র রায় (১৮২০-১৮৯২), ব্রজমোহন রায় (১৮৩১-১৮৭৬), রসিকচন্দ্র গোস্বামী, নন্দলাল রায়, কৃষ্ণকমল গোস্বামী প্রমুখ। শীতলার পাঁচালি, সত্যনারায়ণ বা সত্যপীরের পাঁচালি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য দুটি পাঁচালি কাব্য। [সমবারু চন্দ্র মহন্ত]


[সমবারু চন্দ্র মহন্ত]
[[en:Panchali]]
[[en:Panchali]]
[[en:Panchali]]


[[en:Panchali]]
[[en:Panchali]]

০৬:৫৭, ৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ তারিখে সম্পাদিত সর্বশেষ সংস্করণ

পাঁচালি লোকগীতির একটি ধারা। এতে গানের মাধ্যমে কোনো আখ্যান বর্ণিত হয়। পঞ্চাল বা পঞ্চালিকা শব্দ থেকে পাঁচালি শব্দের উৎপত্তি। আবার এতে গান, বাজনা, ছড়া কাটা, গানের লড়াই ও নাচ এই পঞ্চাঙ্গের সমাবেশে ঘটে বলেও কেউ কেউ একে পাঁচালি বলেন। পূর্বে প্রধানত কাহিনীমূলক গানের সঙ্গে  পুতুলনাচ প্রদর্শনের প্রথা প্রচলিত ছিল বলে এই গীতকে পাঁচালি বলা হতো। পরে (১৮ শতকে ও ১৯ শতকের প্রথমদিকে) পুতুলনাচ হ্রাস পেলে মূল গায়েন নিজে পায়ে নূপুর এবং হাতে চামর ও মন্দিরা নিয়ে নৃত্য পরিবেশন করতেন। কখনও কখনও তিনি বিভিন্ন পাত্রপাত্রীর রূপ ধারণ করে হাস্যরসও পরিবেশন করতেন। এই ক্রমোন্নত অ্যাখায়িকা বা কাহিনীপ্রধান  সঙ্গীত ধারাটিও পাঁচালি নামে প্রসিদ্ধ হয়। পাঁচালিতে এক সময় টপ্পাসহ বিভিন্ন গানের অনুপ্রবেশ ঘটে। মধ্যযুগে  রামায়ণমহাভারতমঙ্গলকাব্য প্রভৃতি আখ্যানকাব্যও পাঁচালির সুরে গাওয়া হতো। এমনকি অনেক পুথিও পাঁচালির সুরে পাঠ করা হতো।

পাঁচালিতে পৌরাণিক, লৌকিক বা সমসাময়িক যেকোনো বিষয় উপজীব্য হতে পারত। এতে একজন প্রধান গায়ক নাটকীয় ভঙ্গিতে আবৃত্তি,  ছড়া ও গীতদ্বারা মূল কাহিনী বিবৃত করতেন। কালক্রমে পাঁচালির বিবর্তন ও প্রসারের ফলে মূল গায়কের সঙ্গে একাধিক গায়েনের সংযোগ ঘটে। তারা মৃদঙ্গ, ঢোল, কাঁসি প্রভৃতি  লোকবাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে পাঁচালি গাইতেন।

আঠারো শতকের শেষদিকে পাঁচালি নতুন রূপ লাভ করে। তখন এতে আখ্যান, কবিগানের ছড়া কাটা, অঙ্গভঙ্গি ও অভিনয়ের সংমিশ্রণ ঘটে। উনিশ শতকে পাঁচালিতে সংযুক্ত হয় সংলাপরীতি, যা মূল গায়েনের দ্বারাই অভিনীত হতো। এ সময় নতুন সংযোজন হিসেবে যুক্ত হয় একটি ‘সঙ’ চরিত্র। এ চরিত্রটি গান ও ছড়া আবৃত্তি বা নাচের মাধ্যমে বিভিন্ন সামাজিক অসঙ্গতির হাস্যকর অনুকরণের দ্বারা হাস্যরসের সৃষ্টি করত। উনিশ শতকে বাংলার সমসাময়িক সামাজিক বিষয়াদি, যেমন তালাকপ্রাপ্ত রমণীর পুনর্বিবাহ, আয়কর সমস্যা বা প্রতিমাপূজাবিরোধী  ইয়ং বেঙ্গল সম্পর্কিত পাঁচালি খুবই জনপ্রিয় ছিল। এই পাঁচালি থেকেই পরবর্তীকালে বহুল জনপ্রিয় যাত্রাগানের উদ্ভব হয়।

পাঁচালি রচয়িতাদের মধ্যে বিশেষ প্রসিদ্ধ  দাশরথি রায়। তিনি প্রথম জীবনে কবিয়াল ছিলেন। ‘দাশু রায়ের পাঁচালি’ সারা বাংলায় বিশেষ খ্যাতি অর্জন করে। দাশরথি রায় প্রমুখ জনপ্রিয় কবিগণের প্রচেষ্টায় উনিশ শতকে যে নব্য পাঁচালি-ধারার সূত্রপাত হয়, তা মূলত  কীর্তন গান থেকেই উদ্ভূত। দাশরথি রায়ের পাঁচালি সাধারণের মধ্যে লোকশিক্ষা, সাহিত্যবোধ, ধর্মবোধ এবং সমাজচেতনা জাগ্রত করে। তাঁর পাঁচালির মধ্য দিয়েই সর্বপ্রথম মধ্যযুগ থেকে আধুনিক যুগের বাংলা সাহিত্যের বিবর্তনের পরিচয় পাওয়া যায়। পরে  মনোমোহন বসু প্রবর্তিত নব্য ধারার পাঁচালিতে কবিগানের গভীর প্রভাব পড়েছিল। এ সময়ের অন্যান্য খ্যাতিমান পাঁচালিকাররা হচ্ছেন ঠাকুরদাস দত্ত (১৮০১-১৮৭৬), রসিকচন্দ্র রায় (১৮২০-১৮৯২), ব্রজমোহন রায় (১৮৩১-১৮৭৬), রসিকচন্দ্র গোস্বামী, নন্দলাল রায়, কৃষ্ণকমল গোস্বামী প্রমুখ। শীতলার পাঁচালি, সত্যনারায়ণ বা সত্যপীরের পাঁচালি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য দুটি পাঁচালি কাব্য। [সমবারু চন্দ্র মহন্ত]