বসু, মনোমোহন

বসু, মনোমোহন (১৮৩১-১৯১২)  কবি, নাট্যকার ও সাংবাদিক। যশোরের নিশ্চিন্তপুর গ্রামে মামার বাড়িতে তাঁর জন্ম। তাঁর পৈতৃক নিবাস পশ্চিমবঙ্গের চবিবশ পরগনা জেলার ছোট জাগুলিয়া গ্রামে। পিতা দেবনারায়ণ বসু ছিলেন পোস্টাল ডিপার্টমেন্টের একজন ঠিকাদার।

মনোমোহন শৈশবেই পিতৃহীন হন। যশোরের একটি সংস্কৃত স্কুলে অধ্যয়নের পর তিনি কলকাতার হেয়ার স্কুল এবং জেনারেল অ্যাসেমব্লিজ ইনস্টিউশনে (বর্তমান স্কটিশ চার্চ কলেজ) অধ্যয়ন করেন। ছাত্রজীবনে তিনি অত্যন্ত মেধাবী ছিলেন।

ঈশ্বর গুপ্তের অনুপ্রেরণায় বাল্যকাল থেকেই মনোমোহনের সাহিত্য চর্চা শুরু হয়। প্রাথমিক পর্যায়ে ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের  সংবাদ প্রভাকর ও অক্ষয়কুমার দত্তের  তত্ত্ববোধিনী পত্রিকায় নিয়মিত তাঁর রচনা প্রকাশিত হতো। পরবর্তীকালে নিজ সম্পাদিত সংবাদ বিভাকর (১৮৫২) ও মধ্যস্থ (১৮৭২) পত্রিকায় তাঁর লেখা প্রকাশিত হয়। মধ্যস্থ পত্রিকার মাধ্যমে তিনি ভারতীয় জীবনধারা ও রাজনীতির মধ্যে সমন্বয় সাধনের চেষ্টা করেন এবং বিশেষভাবে ভারতীয়দের মধ্যে পারস্পরিক ঐক্য ও সহিষ্ণুতার প্রয়োজনের কথা প্রচার করেন। এ কারণে পত্রিকাটি তখন  হিন্দু মেলার মুখপত্র হিসেবে পরিগণিত হয়।

মনোমোহনের প্রধান অবদান বাংলা রঙ্গমঞ্চের ক্ষেত্রে। তাঁর সময়ে রুচিশীল মৌলিক নাটকের খুবই অভাব ছিল।  যাত্রা ও  পাঁচালি ধরনের অশ্লীল নাটকের সংখ্যাই ছিল বেশি, যা রুচিশীল দর্শকদের আকর্ষণ করতে পারত না। এ অবস্থায় মনোমোহন অনেকগুলি পৌরাণিক নাটক রচনা করে মঞ্চনাটকের অভাব পূরণ করেন। তাঁর নাটকগুলি পুরাতন যাত্রা-পাঁচালি-কথকতার সঙ্গে নতুন নাট্যরীতির মিশ্রণ ঘটিয়ে বাংলা নাটকের ইতিহাসে আদি, মধ্য ও আধুনিক যুগের মধ্যে এক সেতুবন্ধ রচনা করেছে। নাটকের এই নতুন ধারা তৎকালীন শিক্ষিত ও মার্জিত রুচিসম্পন্ন দর্শকদের নিকট খুবই জনপ্রিয় ও প্রশংসিত হয়। তাঁর নাটকগুলির জনপ্রিয়তার আরও একটি কারণ হলো, এগুলির মধ্য দিয়ে সেযুগের নবজাগ্রত জাতীয়তাবাদের সুর ফুটে উঠেছে। উপনিবেশিক শাসনে পীড়িত এবং করভারে জর্জরিত ভারতের দুঃখ-দুর্দশার কথা এসব নাটকে বর্ণিত হয়েছে। তাঁর রচিত নাটকগুলির মধ্যে সতী (১৮৭৩) শ্রেষ্ঠ। রামাভিষেক (১৮৬৭), প্রণয়পরীক্ষা (১৮৬৯), হরিশচন্দ্র (১৮৭৫), পার্থপরাজয় (১৮৮১), রাসলীলা (১৮৮৯) ও আনন্দময় (১৮৯০) তাঁর অন্যান্য উল্লেখযোগ্য নাটক। এ নাটকগুলি  অপেরা বা গীতিনাট্যানুরূপ। মনোমোহন বসু প্রবর্তিত এই নতুন নাট্যধারা দ্বারা পরবর্তীকালে অনেকেই প্রভাবিত হয়েছেন।  গিরিশচন্দ্র ঘোষ নাট্য রচনায় মনোমোহন বসুর আদর্শই অনুসরণ করেন। মনোমোহনের অন্যান্য উল্লেখযোগ্য রচনা: হিন্দুর আচার-ব্যবহার (১৮৭৩), বক্তৃতামালা (১৮৭৩) এবং দুলীন (ঐতিহাসিক উপন্যাস, ১৮৯১)। মনোমোহন গীতাবলী নামে তাঁর একখানা গানের বইও প্রকাশিত হয়।

মনোমোহন বসু হিন্দু মেলার একজন সক্রিয় সমর্থক ছিলেন। তিনি ন্যাশনাল থিয়েটারের সঙ্গেও জড়িত ছিলেন এবং তাঁর রচিত নাটকগুলি প্রধানত এই মঞ্চেই অভিনীত হয়। বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের কার্যনির্বাহী পরিষদের সদস্য এবং সহসভাপতি (১৩০৩ ব) হিসেবেও তিনি কিছুকাল দায়িত্ব পালন করেন। তিনি কলকাতায় ‘মনোমোহন লাইব্রেরী’ নামে একটি গ্রন্থবিপণি প্রতিষ্ঠা করেন।  [সমবারু চন্দ্র মহন্ত]