ঠাকুর, দ্বিজেন্দ্রনাথ: সংশোধিত সংস্করণের মধ্যে পার্থক্য

(Added Ennglish article link)
 
সম্পাদনা সারাংশ নেই
১ নং লাইন: ১ নং লাইন:
[[Category:Banglapedia]]
[[Category:Banglapedia]]
'''ঠাকুর'''''', ''''''দ্বিজেন্দ্রনাথ '''(১৮৪০-১৯২৬)  কবি, দার্শনিক, গণিতজ্ঞ, বাংলা শর্টহ্যান্ড ও স্বরলিপির উদ্ভাবক, চিত্রশিল্পী ও স্বদেশপ্রেমিক। ১৮৪০ সালের ১১ মার্চ কলকাতার জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে তাঁর জন্ম। পিতা মহর্ষি  [[১০২২৩৫|দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর]] এবং মাতা সারদা দেবী। দ্বিজেন্দ্রনাথের ছদ্মনাম ‘বঙ্গের রঙ্গ দর্শক’ ও ‘দেশের ব্যথার ব্যথী’।
'''ঠাকুর, দ্বিজেন্দ্রনাথ''' (১৮৪০-১৯২৬)  কবি, দার্শনিক, গণিতজ্ঞ, বাংলা শর্টহ্যান্ড ও স্বরলিপির উদ্ভাবক, চিত্রশিল্পী ও স্বদেশপ্রেমিক। ১৮৪০ সালের ১১ মার্চ কলকাতার জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে তাঁর জন্ম। পিতা মহর্ষি  [[ঠাকুর, দেবেন্দ্রনাথ|দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর]] এবং মাতা সারদা দেবী। দ্বিজেন্দ্রনাথের ছদ্মনাম ‘বঙ্গের রঙ্গ দর্শক’ ও ‘দেশের ব্যথার ব্যথী’।


রবীন্দ্রনাথের জ্যেষ্ঠাগ্রজ দ্বিজেন্দ্রনাথের বাল্যশিক্ষা স্বগৃহেই সম্পন্ন হয়। পরে তিনি দুবছর সেন্ট পলস স্কুলে এবং কিছুদিন হিন্দু কলেজে অধ্যয়ন করেন। পরে তিনি আজীবন স্বপ্রচেষ্টায় জ্ঞানসাধনা চালিয়ে যান। পরিবারে ‘বড়বাবু’ বলে খ্যাত দ্বিজেন্দ্রনাথ বাল্যকাল থেকেই ছিলেন আত্মভোলা প্রকৃতির এবং বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের প্রতি অনুরক্ত। সংস্কৃত ভাষায়ও তাঁর বিশেষ ব্যুৎপত্তি ছিল; তাই মাত্র বিশ বছর বয়সে তিনি মেঘদূত-এর প্রথম বাংলা পদ্যানুবাদ করেন।
রবীন্দ্রনাথের জ্যেষ্ঠাগ্রজ দ্বিজেন্দ্রনাথের বাল্যশিক্ষা স্বগৃহেই সম্পন্ন হয়। পরে তিনি দুবছর সেন্ট পলস স্কুলে এবং কিছুদিন হিন্দু কলেজে অধ্যয়ন করেন। পরে তিনি আজীবন স্বপ্রচেষ্টায় জ্ঞানসাধনা চালিয়ে যান। পরিবারে ‘বড়বাবু’ বলে খ্যাত দ্বিজেন্দ্রনাথ বাল্যকাল থেকেই ছিলেন আত্মভোলা প্রকৃতির এবং বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের প্রতি অনুরক্ত। সংস্কৃত ভাষায়ও তাঁর বিশেষ ব্যুৎপত্তি ছিল; তাই মাত্র বিশ বছর বয়সে তিনি মেঘদূত-এর প্রথম বাংলা পদ্যানুবাদ করেন।


কবি হিসেবে দ্বিজেন্দ্রনাথের স্থান বিশিষ্ট। ১৮৭৫ সালে স্বপ্নপ্রয়াণ নামে একখানি রূপক  [[১০০৯৬৭|কাব্য]] রচনা করে তিনি বাংলা সাহিত্যে নিজস্ব স্থান করে নেন। ভাষা,  [[১০১৮৯৬|ছন্দ]] ও রচনাভঙ্গির দিক দিয়ে ঈশ্বর গুপ্তের বোধেন্দুবিকাশ (১৮৬৩) ও বিহারীলালের সারদামঙ্গল (১৮৭০) দুইয়েরই আদর্শ স্বপ্নপ্রয়াণে সম্মিলিত হয়েছে। পরে কাব্যমালা (১৯২০) নামে দ্বিজেন্দ্রনাথের আরও একটি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়।
কবি হিসেবে দ্বিজেন্দ্রনাথের স্থান বিশিষ্ট। ১৮৭৫ সালে স্বপ্নপ্রয়াণ নামে একখানি রূপক  [[১০০৯৬৭|কাব্য]] রচনা করে তিনি বাংলা সাহিত্যে নিজস্ব স্থান করে নেন। ভাষা,  [[ছন্দ|ছন্দ]] ও রচনাভঙ্গির দিক দিয়ে ঈশ্বর গুপ্তের বোধেন্দুবিকাশ (১৮৬৩) ও বিহারীলালের সারদামঙ্গল (১৮৭০) দুইয়েরই আদর্শ স্বপ্নপ্রয়াণে সম্মিলিত হয়েছে। পরে কাব্যমালা (১৯২০) নামে দ্বিজেন্দ্রনাথের আরও একটি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়।


দ্বিজেন্দ্রনাথ বাংলা ভাষায় প্রথম গানের  [[১০৬২১৯|স্বরলিপি]] ও বাংলা শর্টহ্যান্ডবিষয়ক গ্রন্থ রেখাক্ষর বর্ণমালা (১৯১২) রচনা করেন। বাংলা  [[১০৪২৪৬|ব্যাকরণ]] নিয়েও তিনি চর্চা করেন। স্বদেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে তিনি কলকাতায় হিন্দুমেলার (১৮৬৭) আয়োজন করেন এবং ১৮৭০-৭৩ পর্বে এর সম্পাদক ছিলেন। বিদ্বজ্জন-সমাগম (১৮৭৪), সারস্বত সমাজ (১৮৮২), ভারতবর্ষীয় বিজ্ঞান সভা, ন্যাশনাল সোসাইটি, বেঙ্গল থিওসফিক্যাল সোসাইটি,       [[১০৩৫১১|বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ]], বঙ্গীয় সাহিত্য সম্মেলন প্রভৃতি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গেও তিনি জড়িত ছিলেন।
দ্বিজেন্দ্রনাথ বাংলা ভাষায় প্রথম গানের  [[স্বরলিপি|স্বরলিপি]] ও বাংলা শর্টহ্যান্ডবিষয়ক গ্রন্থ রেখাক্ষর বর্ণমালা (১৯১২) রচনা করেন। বাংলা  [[ব্যাকরণ|ব্যাকরণ]] নিয়েও তিনি চর্চা করেন। স্বদেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে তিনি কলকাতায় হিন্দুমেলার (১৮৬৭) আয়োজন করেন এবং ১৮৭০-৭৩ পর্বে এর সম্পাদক ছিলেন। বিদ্বজ্জন-সমাগম (১৮৭৪), সারস্বত সমাজ (১৮৮২), ভারতবর্ষীয় বিজ্ঞান সভা, ন্যাশনাল সোসাইটি, বেঙ্গল থিওসফিক্যাল সোসাইটি, [[বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ|বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ]], বঙ্গীয় সাহিত্য সম্মেলন প্রভৃতি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গেও তিনি জড়িত ছিলেন।


দ্বিজেন্দ্রনাথ ১৮৯৪ সালে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের বিশিষ্ট সদস্য এবং পরপর তিনবার (১৮৯৭-১৯০০) এর সভাপতি নির্বাচিত হন। তিনি বঙ্গীয় সাহিত্য সম্মেলনের (১৯১৩) মূল সভাপতি এবং আদি ব্রাহ্মসমাজের সম্পাদকের (১৮৬৬-৭১) দায়িত্বও পালন করেন। ১৮৭৭ সাল থেকে দীর্ঘ সাত বছর তিনি'''  '''[[১০৪৩৩২|ভারতী]] ও ১৮৮৪ সাল থেকে সুদীর্ঘ ২৫ বছর তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা সম্পাদনা করেন। তিনি সাপ্তাহিক হিতবাদী (১৮৯১) পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন।
দ্বিজেন্দ্রনাথ ১৮৯৪ সালে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের বিশিষ্ট সদস্য এবং পরপর তিনবার (১৮৯৭-১৯০০) এর সভাপতি নির্বাচিত হন। তিনি বঙ্গীয় সাহিত্য সম্মেলনের (১৯১৩) মূল সভাপতি এবং আদি ব্রাহ্মসমাজের সম্পাদকের (১৮৬৬-৭১) দায়িত্বও পালন করেন। ১৮৭৭ সাল থেকে দীর্ঘ সাত বছর তিনি [[ভারতী|ভারতী]] ও ১৮৮৪ সাল থেকে সুদীর্ঘ ২৫ বছর তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা সম্পাদনা করেন। তিনি সাপ্তাহিক হিতবাদী (১৮৯১) পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন।


পরে দ্বিজেন্দ্রনাথ দীর্ঘকাল প্রাচীন ভারতীয় দর্শন ও সমাজতত্ত্ব চর্চায় মগ্ন ছিলেন। এসব বিষয়ে তাঁর অনেক মূল্যবান রচনা আছে। দর্শনবিষয়ক রচনাগুলিতে তিনি শঙ্করের অদ্বৈতবাদকে খন্ডন করার চেষ্টা করেন। তিনি মহর্ষি-নির্দিষ্ট আদর্শ অনুসরণে উপাসনামূলক ব্রহ্মবাদের ব্যাখ্যা করেন। সমাজতত্ত্ববিষয়ক রচনায় দ্বিজেন্দ্রনাথ উনিশ শতকে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য আদর্শের সংঘাতের তাৎপর্য গভীর পর্যবেক্ষণ সহকারে আলোচনা করেন। এ বিষয়ে বঙ্কিমচন্দ্রের সঙ্গে তাঁর সাদৃশ্য লক্ষ করা যায়।
পরে দ্বিজেন্দ্রনাথ দীর্ঘকাল প্রাচীন ভারতীয় দর্শন ও সমাজতত্ত্ব চর্চায় মগ্ন ছিলেন। এসব বিষয়ে তাঁর অনেক মূল্যবান রচনা আছে। দর্শনবিষয়ক রচনাগুলিতে তিনি শঙ্করের অদ্বৈতবাদকে খন্ডন করার চেষ্টা করেন। তিনি মহর্ষি-নির্দিষ্ট আদর্শ অনুসরণে উপাসনামূলক ব্রহ্মবাদের ব্যাখ্যা করেন। সমাজতত্ত্ববিষয়ক রচনায় দ্বিজেন্দ্রনাথ উনিশ শতকে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য আদর্শের সংঘাতের তাৎপর্য গভীর পর্যবেক্ষণ সহকারে আলোচনা করেন। এ বিষয়ে বঙ্কিমচন্দ্রের সঙ্গে তাঁর সাদৃশ্য লক্ষ করা যায়।


দ্বিজেন্দ্রনাথ চিত্রাঙ্কনেও বিশেষ দক্ষ ছিলেন। গণিত,  [[১০২৫৪৫|দর্শন]], সাহিত্য প্রভৃতি বিষয়ে তাঁর বেশ কয়েকটি গ্রন্থ আছে। সেগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো: ভ্রাতৃভাব (১৮৬৩), তত্ত্ববিদ্যা (৪ খন্ড, ১৮৬৬-৬৯), সোনার কাঠি রূপার কাঠি (১৮৮৫), সোনায় সোহাগা (১৮৮৫), আর্য্যামি এবং সাহেবিআনা (১৮৯০), সামাজিক রোগের কবিরাজী চিকিৎসা (১৮৯১), অদ্বৈতমতের সমালোচনা (১৮৯৬),'' ''ব্রহ্মজ্ঞান ও ব্রহ্মসাধনা (১৯০০),'' ''বঙ্গের রঙ্গভূমি (১৯০৭),'' ''হারামণির অন্বেষণ (১৯০৮), গীতাপাঠের ভূমিকা (১৯১৫), প্রবন্ধমালা (১৯২০) প্রভৃতি। ইরেজি ভাষায়ও তাঁর কয়েকটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়, যেমন ''Boxometry'' (বাক্স রচনা সম্পর্কিত, ১৯১৩),'' Ontology'' (১৮৭১) ইত্যাদি। এছাড়া জ্যামিতি-বিষয়ে তাঁর একটি গুরুত্বপূর্ণ ইংরেজি গ্রন্থ আছে, যাতে বারোটি পুরানো স্বতঃসিদ্ধ বাতিল করে তিনি বারোটি নতুন স্বতঃসিদ্ধ উদ্ভাবন করেন।
দ্বিজেন্দ্রনাথ চিত্রাঙ্কনেও বিশেষ দক্ষ ছিলেন। গণিত,  [[দর্শন|দর্শন]], সাহিত্য প্রভৃতি বিষয়ে তাঁর বেশ কয়েকটি গ্রন্থ আছে। সেগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো: ভ্রাতৃভাব (১৮৬৩), তত্ত্ববিদ্যা (৪ খন্ড, ১৮৬৬-৬৯), সোনার কাঠি রূপার কাঠি (১৮৮৫), সোনায় সোহাগা (১৮৮৫), আর্য্যামি এবং সাহেবিআনা (১৮৯০), সামাজিক রোগের কবিরাজী চিকিৎসা (১৮৯১), অদ্বৈতমতের সমালোচনা (১৮৯৬),'' ''ব্রহ্মজ্ঞান ও ব্রহ্মসাধনা (১৯০০), বঙ্গের রঙ্গভূমি (১৯০৭), হারামণির অন্বেষণ (১৯০৮), গীতাপাঠের ভূমিকা (১৯১৫), প্রবন্ধমালা (১৯২০) প্রভৃতি। ইরেজি ভাষায়ও তাঁর কয়েকটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়, যেমন ''Boxometry'' (বাক্স রচনা সম্পর্কিত, ১৯১৩),'' Ontology'' (১৮৭১) ইত্যাদি। এছাড়া জ্যামিতি-বিষয়ে তাঁর একটি গুরুত্বপূর্ণ ইংরেজি গ্রন্থ আছে, যাতে বারোটি পুরানো স্বতঃসিদ্ধ বাতিল করে তিনি বারোটি নতুন স্বতঃসিদ্ধ উদ্ভাবন করেন।


দ্বিজেন্দ্রনাথ কয়েকটি  [[১০৪২৬৪|ব্রহ্মসঙ্গীত]] ও স্বদেশী গান রচনা করে বেশ প্রশংসিত হন। হিন্দুমেলার জন্য রচিত তাঁর এরূপ একটি জনপ্রিয় দেশাত্মবোধক গান হলো: ‘মলিন মুখচন্দ্রমা ভারত তোমারি।’ সমকালীন জ্ঞানাঙ্কুর,'' ''প্রতিবিম্ব, তত্ত্ববোধিনী, ভারতী,  [[১০৫৯২১|সাধনা]], নবপর্যায়ের  [[১০৩৪৮০|বঙ্গদর্শন]],  [[১০৪৬৫৬|মানসী]],  [[সাহিত্য পরিষদ পত্রিকা|সাহিত্য পরিষৎ পত্রিকা]], শান্তিনিকেতন, বুধবার, শ্রেয়সী,  [[১০৩৩০৫|প্রবাসী]],  [[১০৫৮০৬|সবুজপত্র]], সুপ্রভাত প্রভৃতি পত্রিকায় তাঁর অনেক রচনা প্রকাশিত হয়। ১৯ জানুয়ারি, ১৯২৬ শান্তিনিকেতনে তাঁর মৃত্যু হয়।  [দুলাল সরকার]
দ্বিজেন্দ্রনাথ কয়েকটি  [[ব্রহ্মসঙ্গীত|ব্রহ্মসঙ্গীত]] ও স্বদেশী গান রচনা করে বেশ প্রশংসিত হন। হিন্দুমেলার জন্য রচিত তাঁর এরূপ একটি জনপ্রিয় দেশাত্মবোধক গান হলো: ‘মলিন মুখচন্দ্রমা ভারত তোমারি।’ সমকালীন জ্ঞানাঙ্কুর, প্রতিবিম্ব, তত্ত্ববোধিনী, ভারতী,  [[সাধনা|সাধনা]], নবপর্যায়ের  [[বঙ্গদর্শন|বঙ্গদর্শন]],  [[মানসী|মানসী]],  [[সাহিত্য পরিষদ পত্রিকা|সাহিত্য পরিষৎ পত্রিকা]], শান্তিনিকেতন, বুধবার, শ্রেয়সী,  [[প্রবাসী|প্রবাসী]],  [[সবুজপত্র|সবুজপত্র]], সুপ্রভাত প্রভৃতি পত্রিকায় তাঁর অনেক রচনা প্রকাশিত হয়। ১৯ জানুয়ারি, ১৯২৬ শান্তিনিকেতনে তাঁর মৃত্যু হয়।  [দুলাল সরকার]


<!-- imported from file: ঠাকুর, দ্বিজেন্দ্রনাথ.html-->


[[en:Tagore, Dwijendranath]]
[[en:Tagore, Dwijendranath]]

১০:২০, ২২ ডিসেম্বর ২০১৪ তারিখে সংশোধিত সংস্করণ

ঠাকুর, দ্বিজেন্দ্রনাথ (১৮৪০-১৯২৬)  কবি, দার্শনিক, গণিতজ্ঞ, বাংলা শর্টহ্যান্ড ও স্বরলিপির উদ্ভাবক, চিত্রশিল্পী ও স্বদেশপ্রেমিক। ১৮৪০ সালের ১১ মার্চ কলকাতার জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে তাঁর জন্ম। পিতা মহর্ষি  দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং মাতা সারদা দেবী। দ্বিজেন্দ্রনাথের ছদ্মনাম ‘বঙ্গের রঙ্গ দর্শক’ ও ‘দেশের ব্যথার ব্যথী’।

রবীন্দ্রনাথের জ্যেষ্ঠাগ্রজ দ্বিজেন্দ্রনাথের বাল্যশিক্ষা স্বগৃহেই সম্পন্ন হয়। পরে তিনি দুবছর সেন্ট পলস স্কুলে এবং কিছুদিন হিন্দু কলেজে অধ্যয়ন করেন। পরে তিনি আজীবন স্বপ্রচেষ্টায় জ্ঞানসাধনা চালিয়ে যান। পরিবারে ‘বড়বাবু’ বলে খ্যাত দ্বিজেন্দ্রনাথ বাল্যকাল থেকেই ছিলেন আত্মভোলা প্রকৃতির এবং বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের প্রতি অনুরক্ত। সংস্কৃত ভাষায়ও তাঁর বিশেষ ব্যুৎপত্তি ছিল; তাই মাত্র বিশ বছর বয়সে তিনি মেঘদূত-এর প্রথম বাংলা পদ্যানুবাদ করেন।

কবি হিসেবে দ্বিজেন্দ্রনাথের স্থান বিশিষ্ট। ১৮৭৫ সালে স্বপ্নপ্রয়াণ নামে একখানি রূপক  কাব্য রচনা করে তিনি বাংলা সাহিত্যে নিজস্ব স্থান করে নেন। ভাষা,  ছন্দ ও রচনাভঙ্গির দিক দিয়ে ঈশ্বর গুপ্তের বোধেন্দুবিকাশ (১৮৬৩) ও বিহারীলালের সারদামঙ্গল (১৮৭০) দুইয়েরই আদর্শ স্বপ্নপ্রয়াণে সম্মিলিত হয়েছে। পরে কাব্যমালা (১৯২০) নামে দ্বিজেন্দ্রনাথের আরও একটি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়।

দ্বিজেন্দ্রনাথ বাংলা ভাষায় প্রথম গানের  স্বরলিপি ও বাংলা শর্টহ্যান্ডবিষয়ক গ্রন্থ রেখাক্ষর বর্ণমালা (১৯১২) রচনা করেন। বাংলা  ব্যাকরণ নিয়েও তিনি চর্চা করেন। স্বদেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে তিনি কলকাতায় হিন্দুমেলার (১৮৬৭) আয়োজন করেন এবং ১৮৭০-৭৩ পর্বে এর সম্পাদক ছিলেন। বিদ্বজ্জন-সমাগম (১৮৭৪), সারস্বত সমাজ (১৮৮২), ভারতবর্ষীয় বিজ্ঞান সভা, ন্যাশনাল সোসাইটি, বেঙ্গল থিওসফিক্যাল সোসাইটি, বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ, বঙ্গীয় সাহিত্য সম্মেলন প্রভৃতি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গেও তিনি জড়িত ছিলেন।

দ্বিজেন্দ্রনাথ ১৮৯৪ সালে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের বিশিষ্ট সদস্য এবং পরপর তিনবার (১৮৯৭-১৯০০) এর সভাপতি নির্বাচিত হন। তিনি বঙ্গীয় সাহিত্য সম্মেলনের (১৯১৩) মূল সভাপতি এবং আদি ব্রাহ্মসমাজের সম্পাদকের (১৮৬৬-৭১) দায়িত্বও পালন করেন। ১৮৭৭ সাল থেকে দীর্ঘ সাত বছর তিনি ভারতী ও ১৮৮৪ সাল থেকে সুদীর্ঘ ২৫ বছর তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা সম্পাদনা করেন। তিনি সাপ্তাহিক হিতবাদী (১৮৯১) পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন।

পরে দ্বিজেন্দ্রনাথ দীর্ঘকাল প্রাচীন ভারতীয় দর্শন ও সমাজতত্ত্ব চর্চায় মগ্ন ছিলেন। এসব বিষয়ে তাঁর অনেক মূল্যবান রচনা আছে। দর্শনবিষয়ক রচনাগুলিতে তিনি শঙ্করের অদ্বৈতবাদকে খন্ডন করার চেষ্টা করেন। তিনি মহর্ষি-নির্দিষ্ট আদর্শ অনুসরণে উপাসনামূলক ব্রহ্মবাদের ব্যাখ্যা করেন। সমাজতত্ত্ববিষয়ক রচনায় দ্বিজেন্দ্রনাথ উনিশ শতকে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য আদর্শের সংঘাতের তাৎপর্য গভীর পর্যবেক্ষণ সহকারে আলোচনা করেন। এ বিষয়ে বঙ্কিমচন্দ্রের সঙ্গে তাঁর সাদৃশ্য লক্ষ করা যায়।

দ্বিজেন্দ্রনাথ চিত্রাঙ্কনেও বিশেষ দক্ষ ছিলেন। গণিত,  দর্শন, সাহিত্য প্রভৃতি বিষয়ে তাঁর বেশ কয়েকটি গ্রন্থ আছে। সেগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো: ভ্রাতৃভাব (১৮৬৩), তত্ত্ববিদ্যা (৪ খন্ড, ১৮৬৬-৬৯), সোনার কাঠি রূপার কাঠি (১৮৮৫), সোনায় সোহাগা (১৮৮৫), আর্য্যামি এবং সাহেবিআনা (১৮৯০), সামাজিক রোগের কবিরাজী চিকিৎসা (১৮৯১), অদ্বৈতমতের সমালোচনা (১৮৯৬), ব্রহ্মজ্ঞান ও ব্রহ্মসাধনা (১৯০০), বঙ্গের রঙ্গভূমি (১৯০৭), হারামণির অন্বেষণ (১৯০৮), গীতাপাঠের ভূমিকা (১৯১৫), প্রবন্ধমালা (১৯২০) প্রভৃতি। ইরেজি ভাষায়ও তাঁর কয়েকটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়, যেমন Boxometry (বাক্স রচনা সম্পর্কিত, ১৯১৩), Ontology (১৮৭১) ইত্যাদি। এছাড়া জ্যামিতি-বিষয়ে তাঁর একটি গুরুত্বপূর্ণ ইংরেজি গ্রন্থ আছে, যাতে বারোটি পুরানো স্বতঃসিদ্ধ বাতিল করে তিনি বারোটি নতুন স্বতঃসিদ্ধ উদ্ভাবন করেন।

দ্বিজেন্দ্রনাথ কয়েকটি  ব্রহ্মসঙ্গীত ও স্বদেশী গান রচনা করে বেশ প্রশংসিত হন। হিন্দুমেলার জন্য রচিত তাঁর এরূপ একটি জনপ্রিয় দেশাত্মবোধক গান হলো: ‘মলিন মুখচন্দ্রমা ভারত তোমারি।’ সমকালীন জ্ঞানাঙ্কুর, প্রতিবিম্ব, তত্ত্ববোধিনী, ভারতী,  সাধনা, নবপর্যায়ের  বঙ্গদর্শনমানসীসাহিত্য পরিষৎ পত্রিকা, শান্তিনিকেতন, বুধবার, শ্রেয়সী,  প্রবাসীসবুজপত্র, সুপ্রভাত প্রভৃতি পত্রিকায় তাঁর অনেক রচনা প্রকাশিত হয়। ১৯ জানুয়ারি, ১৯২৬ শান্তিনিকেতনে তাঁর মৃত্যু হয়।  [দুলাল সরকার]