ব্রাহ্ম সভা

ব্রাহ্ম সভা  হিন্দুধর্ম সংস্কারক রামমোহন রায় (১৭৭২-১৮৩৩) কর্তৃক ১৮২৮ সালের আগস্ট মাসে প্রতিষ্ঠিত। রামমোহনের ধর্মীয় সত্য অনুসন্ধানের তৃষ্ণা তাঁকে উদার মন নিয়ে সকল গুরুত্বপূর্ণ ধর্মের শাস্ত্রসমূহ অধ্যয়নে প্রণোদিত করে। এভাবে তিনি শুধু সংস্কৃত ভাষায় হিন্দু ধর্মশাস্ত্রসমূহ, যেমন সংস্কৃত ভাষায় বেদ, অধ্যয়ন করেই ক্ষান্ত হন নি; তিনি আরবি ভাষায় কুরআন এবং হিব্রু ও গ্রিক ভাষায় বাইবেলও পাঠ করেন। বিভিন্ন ধর্ম অধ্যয়ন তাঁর মনে দৃঢ়প্রত্যয় জন্মায় যে, যেহেতু প্রত্যেক ধর্মেরই উদ্দেশ্য অভিন্ন, যথা, মানব জাতির নৈতিক পুনর্জাগরণ, তাই পরিবর্তিত সময়ের প্রেক্ষাপটে প্রত্যেক ধর্মের পুনর্ব্যাখ্যা ও পুনর্মূল্যায়ন প্রয়োজন। সুতরাং তিনি চিন্তা করে দেখলেন যে, তাঁর পক্ষে হিন্দুধর্ম ত্যাগ করে অন্য কোন ধর্ম গ্রহণের পেছনে কোন যুক্তি নেই। তিনি প্রত্যেক ধর্মের গোঁড়ামি, শাস্ত্রীয় আচারপালন ও কুসংস্কার বাদ দিয়ে সর্বজনীন নৈতিক উপদেশাবলি গ্রহণ করবেন। ঐ বছরের আগস্ট মাসে তিনি ব্রাহ্ম সভা (পরবর্তীসময়ে ব্রাহ্ম সমাজ) অর্থাৎ ঈশ্বরের সমাজ প্রতিষ্ঠা করেন। যদিও এ নব প্রতিষ্ঠিত সমাজের তাত্ত্বিক দাবি ছিল যে, এটাকে সর্বজনীন ধর্ম হিসেবে বিবেচনা করতে হবে, তবুও এটা হিন্দুধর্মের একটি শাখায় পরিণত হয় এবং সেভাবেই বিরাজমান। এ নতুন ধর্মবিশ্বাসের ধর্মীয় মতবাদসমূহ ব্রাহ্ম সমাজের ট্রাস্টের দলিলে লিপিবদ্ধ আছে।

১৮৩৩ সালে ইংল্যান্ডে রামমোহন রায়ের মৃত্যু হয়। এর পর ধর্মীয় সংস্কার আন্দোলনটি বাধার সম্মুখীন হয়। রামমোহনের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ও সহযোগী দ্বারকানাথ ঠাকুর এর (১৭৯৪-১৮৪৬) পুত্র দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮১৭-১৯০৫) তাঁর অসম্পূর্ণ কাজটি হাতে নেন। তাঁর নেতৃত্বে ব্রাহ্ম সমাজ আন্দোলনটি নতুন মাত্রা ও বৈশিষ্ট্য পরিগ্রহ করে। তিনি ১৮৩৯ সালে তত্ত্ববোধিনী সভা নামে একটি সমিতি প্রতিষ্ঠা করেন যা এ নতুন ধর্মমতটি প্রচারে ভীষণভাবে সচেষ্ট হয়। তিনি তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা নামে একটি সংবাদপত্রও প্রকাশ করেন যেটি এ নতুন ধর্মবিশ্বাস প্রচারের সঙ্গে সঙ্গে সামাজিক সংস্কার সাধনের পক্ষেও জনমত গড়ে তোলে। এ সময়ে হিন্দুধর্মের বিপক্ষে খ্রিস্টান ধর্ম প্রচারকদের অত্যধিক আক্রমণাত্মক প্রচারণা চলছিল। ব্রাহ্ম সমাজের মধ্য থেকে আমূল সংস্কারের সমর্থক শ্রেণিটি বেদ এর অভ্রান্ততার বিষয়টি নিয়ে প্রশ্ন তুলতে শুরু করে। এঁদের মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ছিলেন অক্ষয়কুমার দত্ত (১৮২০-১৮৮৬)। ওই সময় পর্যন্ত বেদ যে অভ্রান্ত, তা ব্রাহ্ম ধর্মীয় বিশ্বাসের অবিচ্ছেদ্য অংশ বলে বিবেচিত হতো। ১৮৪৭ সালের দিকে পুঙ্খানুপুঙ্খ সমীক্ষার পর ব্রাহ্ম নেতৃবৃন্দের মনে দৃঢ়প্রত্যয় জন্মে যে, বেদের অভ্রান্ততার মতবাদ আর গ্রহণযোগ্য নয়। তাই একেশ্বরবাদী ধারণা সম্বলিত উপনিষদের নির্বাচিত অংশসমূহের ওপর ভিত্তি করে ব্রাহ্ম ধর্মবিশ্বাস পুনর্নিমাণের প্রচেষ্টা নেওয়া হয়। ব্রাহ্ম সমাজের সংশোধিত মতবাদটি ১৮৫০ সালে ‘ব্রাহ্ম ধর্ম’ অথবা ‘এক সত্য ঈশ্বরের পূজারীদের ধর্ম’ নামে পুস্তকাকারে প্রকাশিত হয়। উল্লেখযোগ্য যে, বেদকে অস্বীকার করা হলেও, ব্রাহ্ম আন্দোলনের অপরিহার্য হিন্দু চরিত্রসমূহ ধরে রাখা হয়। রামমোহন রায় এর মৃত্যুর পর দেবেন্দ্রনাথ মৃতপ্রায় ব্রাহ্ম সমাজে নতুন জীবনের সূচনা করেন। সেনের (১৮৩৮-১৮৮৪) প্রগতিশীল নেতৃত্বে আন্দোলনটি আরও গতিশীলতা লাভ করে।  কেশবচন্দ্র সেন ১৮৫৭ সালে ব্রাহ্ম সমাজে যোগ দেন এবং এক বছরের মধ্যে তিনি দেবেন্দ্রনাথের প্রধান সহযোগীতে পরিণত হন। তবে প্রধানত বর্ণপ্রথা ও সামাজিক সংস্কারসমূহকে কেন্দ্র করে তাঁদের দুজনের মধ্যে মতপার্থক্য দেখা দেয়। দেবেন্দ্রনাথ ছিলেন কিছুটা রক্ষণশীল, কিন্তু কেশব সেন জাতিভেদ প্রথা পুরোপুরি বিলোপ করার পক্ষে মত প্রকাশ করেন। তিনি সমাজ সংস্কার সাধনের পক্ষে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন, বিশেষত  স্ত্রীশিক্ষা ও নারীমুক্তি আন্দোলনের পক্ষে তিনি অবস্থান নেন। ১৮৬৮ সালে কেশবচন্দ্র সেন ভারতের ব্রাহ্ম সমাজ নামে একটি নতুন সংগঠন গড়ে তোলেন। দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের নেতৃত্বে অন্য সংগঠনটি আদি ব্রাহ্ম সমাজ নামে পরিচিতি লাভ করে। বোম্বাই, মাদ্রাজ ও অন্যান্য স্থানে বক্তৃতা-সফরের মাধ্যমে কেশব সেন ভারতের বৃহৎ অংশব্যাপী ব্রাহ্ম সমাজের বাণী ছড়িয়ে দেন। প্রধানত তিনি উদ্যোগ গ্রহণ করার ফলে ১৮৭২ সালে সিভিল ম্যারেজ অ্যাক্ট (Civil Marriage Act, 1872) পাস হয়। এটি ধর্মীয় আচারাদি পালন ব্যতিরেকে অযাজকীয় বিবাহ অনুষ্ঠানের বিধান প্রবর্তন করে। আইনটি একবিবাহকেও বাধ্যতামূলক করে এবং কনে ও বরের বয়সের নিম্নসীমাও যথাক্রমে ১৪ ও ১৮ বছরে নির্ধারিত করে দেয়।

কেশব সেন ব্রাহ্ম ধর্মবিশ্বাসে নির্দিষ্ট কিছু নতুন উপাদান প্রবর্তন করে সেটাকে পুনর্নির্ধারণ করেন। তিনি চাচ্ছিলেন হিন্দুধর্ম, বৌদ্ধধর্ম, খ্রিস্টধর্মইসলাম ধর্মের সারাংশ আহরণ করে একটি মহান সমন্বয় সৃষ্টি করতে। তিনি আন্তরিকভাবে বিশ্বাস করতেন যে, ‘সকল ধর্মই সত্য।’ তিনি তাঁর ধর্মীয় আচারের মধ্যে হিন্দু ধর্মের প্রচলিত ধারণা-ভক্তি বা আরাধনার উৎসাহকে অন্তর্ভুক্ত করেন এবং ‘ঈশ্বরের নৈতিক চেতনা’র মতবাদের ওপর জোর দেন। পরিশেষে, ১৮৮০ সালের জানুয়ারি মাসে তিনি ‘নববিধান’ অথবা ‘নতুন নিয়ম’ নামে তাঁর ধর্মীয় বিশ্বাস জনসমক্ষে ঘোষণা করলে তাঁর ধর্মীয় ধ্যান-ধারণা কিছুটা হলেও একটা নির্দিষ্ট আকার ধারণ করে। এতে প্রাণবন্ত ঈশ্বরের প্রতি বিশ্বাস এবং বিশ্বের বিভিন্ন ধর্মে ব্যাখ্যাগত দিক দিয়ে বৈচিত্র্য ও অপরিপূর্ণতা থাকা সত্ত্বেও এরা স্বতন্ত্র নয় বরং পরস্পরের পরিপূরক- এ বিশ্বাস স্থাপনের পক্ষে আহবান জানানো হয়। কিন্তু কেশবচন্দ্র সেনএর নির্দিষ্ট কিছু ধারণা ও কার্যকলাপ তাঁর অনুসারিবৃন্দ, বিশেষত যুবা ও চরমপন্থীদের মনে অসন্তোষের সৃষ্টি করে। তারা ব্রিটিশ সরকারের প্রতি তাঁর অত্যুৎসাহী আনুগত্য প্রকাশকে অপছন্দ করত এবং কুচবিহারের রাজার সাথে তাঁর কন্যার বিবাহের ব্যাপারে তাঁর আচরণ নিয়েও ক্ষুব্ধ ছিল। কারণ, কনে ও বর উভয়ই অপ্রাপ্তবয়স্ক থাকা সত্ত্বেও ব্রাহ্মণ পুরোহিত সনাতন হিন্দু ধর্মীয় আচার অনুযায়ী এ বিয়ের অনুষ্ঠান সম্পাদন করেছিল। এটা ব্রাহ্ম সমাজের ধর্মবিশ্বাস ও প্রথার বিপক্ষে গিয়েছিল। কেশবের কর্তৃত্বপরায়ণতা ও অযৌক্তিক আচরণও তাঁর অনুসারীদের অনেকের উত্তেজিত হওয়ার কারণ ঘটিয়েছিলো। শেষ পর্যন্ত শিবনাথ শাস্ত্রী (১৮৪৭-১৯১৪) ও আনন্দমোহন বসুর (১৮৪৭-১৯০৬) নেতৃত্বে আমূল সংস্কারের পক্ষপাতী শ্রেণির লোকজন কেশব সেনের সমাজ থেকে বের হয়ে আসে এবং ১৮৭৮ সালে সাধারণ ব্রাহ্ম সমাজ গঠন করে। এটি প্রাপ্তবয়স্কদের ভোটাধিকারের ভিত্তিতে একটি গঠনতন্ত্র তৈরি করে এবং একটি সর্বজনীন ধর্ম প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যকে এগিয়ে নিতে এর আকাঙ্ক্ষা জনসমক্ষে ঘোষণা করে। এ মহিমান্বিত দাবি সত্ত্বেও ব্রাহ্ম আন্দোলন আর বেশি দূর অগ্রসর হতে পারে নি, বরং দিনে দিনে শক্তি  হারাতে থাকে। উনিশ শতকের শেষের দিকে নবজাগ্রত হিন্দুধর্ম ব্রাহ্ম সমাজ আন্দোলনের অধিকাংশ ধর্মীয় ও সামাজিক ধ্যান-ধারণা আত্মস্থ করতে শুরু করে।  [এ.এফ সালাহ উদ্দিন আহমেদ]

গ্রন্থপঞ্জি  SD Collet, Life and Letters of Raja Rammohun Roy, London, 1900; Sivnath Sastri, History of the Brahmo Samaj, Calcutta, 1911; JN Farquhar, Modern Religious Movements in India, New York, 1915.