চলচ্চিত্র, পূর্ণদৈর্ঘ্য

চলচ্চিত্র, পূর্ণদৈর্ঘ্য  বাংলাদেশে বিশ শতকের ৯০-এর দশকে গড়ে ৮০টির মতো পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র মুক্তি পেয়েছে, বিশাল অঙ্কের পুঁজি লগ্নি হচ্ছে এ শিল্পে এবং দেশের ১,৫০০টির মতো প্রেক্ষাগৃহে প্রতিদিন দশ লাখেরও অধিক দর্শক ছবি দেখছে। এ শিল্পের সঙ্গে অসংখ্য পরিচালক, শিল্পী, কলাকুশলী, কর্মী জড়িত। সরকারি সহায়তায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে চলচ্চিত্র উন্নয়ন সংস্থা (এফডিসি) ও  চলচ্চিত্র আর্কাইভ এবং চালু হয়েছে পুরস্কার ও অনুদান তহবিল। আন্তর্জাতিক মেলা, উৎসব ও প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশের চলচ্চিত্র পুরস্কার পাচ্ছে ও প্রশংসিত হচ্ছে। গত প্রায় পঞ্চাশ বছরের মধ্যে বাংলাদেশের চলচ্চিত্র শিল্প, সংস্কৃতি, বিনোদন ও গণযোগাযোগের ক্ষেত্রে তার বৈশিষ্ট্য ও ভিত্তি নিয়ে দাঁড়িয়ে গেছে।

ঐতিহাসিক পটভূমি  চলচ্চিত্রের ইতিহাস খুব পুরানো নয়। প্রায় ১০০ বছর পূর্বে ১৮৯৫ সালের ২৮ ডিসেম্বর প্যারিস নগরীতে অগাস্ট লুমিয়ের (১৮৬২-১৯৫৪) ও লুই লুমিয়ের (১৮৬৪-১৯৪৮) নামে দুই ভাই বায়োস্কোপের প্রথম সফল বাণিজ্যিক প্রদর্শনী করেন। এ ঘটনার মাত্র ছয় মাস পরই লুমিয়ের ভ্রাতৃদ্বয়ের একজন প্রতিনিধি মুম্বাইয়ের ওয়াটসন হোটেলে ১৮৯৬ সালের ৭ জুলাই উপমহাদেশে প্রথম বায়োস্কোপের প্রদর্শনী করেন। ওই বছরের শেষ দিকে কলকাতায় শুরু হয় বায়োস্কোপের প্রদর্শনী। ঢাকায় প্রথম বায়োস্কোপ প্রদর্শনের প্রামাণ্য তথ্য পাওয়া যায় সাপ্তাহিক  ঢাকা প্রকাশ সূত্রে। ১৮৯৮ সালের ১৭ এপ্রিল বায়োস্কোপ দেখানো হয় ঢাকার সদরঘাটস্থ পাটুয়াটুলীর ক্রাউন থিয়েটারে (এখন অবলুপ্ত)। কলকাতা থেকে আগত ব্রেডফোর্ড বায়োস্কোপ কোম্পানি এ প্রদর্শনীর আয়োজন করে। প্রদর্শিত ছোট ছোট ছবির মধ্যে ছিল মহারানী ভিক্টোরিয়ার জুবিলি মিছিল, গ্রিস ও তুরস্কের যুদ্ধ, তিনশত ফুট উঁচু থেকে প্রিন্সেস ডায়ানার লাফ, রুশ সম্রাট জারের অভিষেক, পাগলা নাপিতের ক্ষৌর কর্ম, সিংহ ও মাহুতের খেলা, ইংল্যান্ডের তুষারপাতে ক্রীড়া, ফ্রান্সের রাস্তাঘাট ও পাতাল রেলপথ ইত্যাদি দৃশ্য। টিকেটের হার ছিল আট আনা থেকে তিন টাকা। পরে বাংলাদেশের আরও অনেক স্থানে যেমন মানিকগঞ্জের বগজুরি গ্রামে, ভোলার এসডিওর বাংলোতে, ঢাকার  জগন্নাথ কলেজ মিলনায়তনে,  ভাওয়াল এস্টেটএর রাজপ্রাসাদে, ফরিদপুরের পালং-এ, ঢাকার  ভিক্টোরিয়া পার্ক ও  আহসান মঞ্জিলএ বায়োস্কোপ দেখানো হয়। ঢাকায় নিয়মিতভাবে বায়োস্কোপ প্রদর্শন শুরু হয় ১৯১৩-১৪ সালের দিকে আরমানিটোলার পাটের গুদামে। পরে এখানে স্থায়ী প্রেক্ষাগৃহ স্থাপিত হয় ‘পিকচার হাউজ’ (পরবর্তীকালে শাবিস্তান) নামে। এটিই বাংলাদেশের প্রথম সিনেমা হল। ১৯৯৪ সালে দেশে সিনেমা হলের সংখ্যা ছিল প্রায় দেড় হাজার। বর্তমানে (২০১০) টিভি, ডিভিডি, ইন্টারনেটের কারণে সিনেমা হলের দর্শক কমে গেছে একই সঙ্গে হলের সংখ্যাও কমে প্রায় ৭৫০-এ এসে দাঁড়িয়েছে।

এদিকে ১৮৯৮ সালে কলকাতায় বাঙালিদের মধ্যে প্রথম বায়োস্কোপ কোম্পানি গঠন করেন মানিকগঞ্জ জেলার বগজুরী গ্রামের হীরালাল সেন (১৮৬৬-১৯১৭)। তাঁর প্রতিষ্ঠিত কোম্পানির নাম দ্য রয়েল বায়োস্কোপ কোম্পানি। তিনি অবিভক্ত বাংলার প্রথম চলচ্চিত্র নির্মাতাও। তাঁর তোলা খন্ডচিত্র (নাটক থেকে) সীতারাম, আলীবাবা, দোললীলা, ভ্রমর, হরিরাজ বুদ্ধ ১৯০১ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি কলকাতার ক্ল্যাসিক থিয়েটারে প্রদর্শিত হয়। তিনি প্রামাণ্য চিত্র, বিজ্ঞাপন চিত্র এবং সংবাদচিত্রও নির্মাণ করেন।

১৯১৩ সালে মুম্বাইতে মুক্তি পায় উপমহাদেশের প্রথম পূর্ণাঙ্গ নির্বাক চিত্র দাদাভাই ফালকের পরিচালনায় রাজা হরিশচন্দ্র। আর কলকাতায় ১৯১৬ সালের দিকে ম্যাডান থিয়েটারস কোম্পানি চলচ্চিত্র নির্মাণ শুরু করে। এ প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগে প্রথম বাংলা নির্বাক পূর্ণদৈর্ঘ্য চিত্র বিল্বমঙ্গল মুক্তি পায় ১৯১৯ সালের ৮ নভেম্বর। এ ছবির পরিচালক জ্যোতিষ ব্যানার্জি (মতান্তরে রোস্তমজী দুতিওয়ালা) হলেও নেপথ্য স্থপতি ছিলেন ঢাকার নওয়াব এস্টেটের ম্যানেজারের পুত্র পরবর্তীকালের বিখ্যাত প্রযোজক-পরিচালক প্রিয়নাথ গাঙ্গুলি। ১৯২১ সালে বরিশালের ধীরেন্দ্রনাথ গাঙ্গুলি (ডি জি) কলকাতায় বিলাত ফেরৎ নামে চলচ্চিত্র প্রযোজনা ও তাতে অভিনয় করেন।

১৯২৭-২৮ সালের দিকে ঢাকার নওয়াব পরিবারের কয়েকজন তরুণ চলচ্চিত্র নির্মাণের উদ্যোগ নেন। তারা সুকুমারী নামে চার রিলের একটি নির্বাক ছবি বানান। ছবিটি পরিচালনা করেন বিশিষ্ট নাট্যকর্মী ও জগন্নাথ কলেজের শরীরচর্চার প্রশিক্ষক অম্বুজ প্রসন্ন গুপ্ত। ছবির নায়ক চরিত্রে অভিনয় করেন খাজা নসরুল্লাহ ও নায়িকা চরিত্রে অভিনয় করেন সৈয়দ আবদুস সোবহান।

সুকুমারীর সাফল্যের পর নওয়াব পরিবারের তরুণরা ঢাকা ইস্ট বেঙ্গল সিনেমাটোগ্রাফ কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেন এবং অম্বুজ গুপ্তের পরিচালনায় ও খাজা আজাদের ক্যামেরায় দ্য লাস্ট কিস নামে একটি নির্বাক পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন। এতে বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করেন খাজা আজমল, খাজা আদিল, খাজা আকমল, খাজা শাহেদ, খাজা নসরুল্লাহ, শৈলেন রায় বা টোনা বাবু। অভিনেত্রীদের মধ্যে ছিলেন লোলিটা বা বুড়ি (নায়িকা), চারুবালা, দেববালা বা দেবী এবং হরিমতি। প্রথমোক্ত তিনজন অভিনেত্রীকে পতিতালয় থেকে আনা হয়। ছবির বাংলা ও ইংরেজি সাব টাইটেল রচনা করেন পরিচালক নিজে এবং উর্দু সাব টাইটেল রচনা করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আন্দালিব শাদানী। ১৯৩১ সালের দ্য লাস্ট কিস মুক্তি পায় ঢাকার মুকুল (বর্তমানে আজাদ) হলে। ছবিটির প্রিমিয়ার শো-র উদ্বোধন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক বিশিষ্ট ইতিহাসবিদ ড.  রমেশচন্দ্র মজুমদার

অখন্ড বাংলার চলচ্চিত্রের ইতিহাসে ব্যতিক্রর্মী সংযোজন জাতীয় কবি  কাজী নজরুল ইসলাম (১৮৯৯-১৯৭৬)। ১৯৩১ সালে তিনি চলচ্চিত্রে জড়িত হন কলকাতার বিখ্যাত প্রতিষ্ঠান ম্যাডান থিয়েটারসের সুরভান্ডারি হিসেবে। পরে তিনি চিত্র পরিচালক, সঙ্গীত পরিচালক, সুরকার, গায়ক, গীতিকার, অভিনেতা, কাহিনীকার, সংগঠক হিসেবে অবদান রাখেন। ১৯৩৪ সালে তিনি সত্যেন্দ্রনাথ দে-র সঙ্গে যৌথভাবে ধ্রুব চিত্র নির্মাণ করেন। ১৯৪১ সালে তিনি শেরে বাংলার নামে বি.টি পিকচার্স গঠন করেন। নজরুলের পর আরও কয়েকজন সাহসী মুসলমান ধর্মীয় ও সামাজিক কঠোর দৃষ্টিভঙ্গি এড়িয়ে চলচ্চিত্রে জড়িত হন। এঁদের মধ্যে রয়েছেন  আববাসউদ্দীন আহমদ, হিমাদ্রী চৌধুরী (ওবায়েদ-উল হক), কিরণকুমার বা ফতেহ লোহানী, স্বপনকুমার বা কাজী খালেক, উদয়ন চৌধুরী বা ইসমাইল মোহাম্মদ, বনানী চৌধুরী বা বেগম আনোয়ারা,  আবদুল আহাদ, নাজীর আহমদ, ইনাম আহমদ, বেবী ইসলাম, কিউ.এম জামান প্রমুখ। এঁদের মধ্যে হিমাদ্রী চৌধুরী দুঃখে যাদের জীবন গড়া (১৯৪৬) প্রযোজনা ও পরিচালনা করেন। উদয়ন চৌধুরী মানুষের ভগবান (১৯৪৭) চিত্র নির্মাণ করে অভিযুক্ত হন ও জেলে যান। দেশ বিভাগের পর কলকাতার চিত্রকর্মীরা ঢাকায় এসে চলচ্চিত্রের ভিত্তি স্থাপনে সক্রিয় অবদান রাখেন।

১৯৪৭ সালে সৃষ্ট পাকিস্তান রাষ্ট্রের নতুন প্রদেশ পূর্ব পাকিস্তান নতুন প্রত্যাশার সৃষ্টি করে। রাজধানী ঢাকাকে কেন্দ্র করে নতুন করে শুরু হয় সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড। অনেক ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান চলচ্চিত্র প্রযোজনা, পরিবেশনা এবং স্টুডিও নির্মাণের উদ্যোগ নেয়। ১৯৪৮ সালের মার্চ মাসে পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল  মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ পূর্ব পাকিস্তান সফরে এলে বেতার-ব্যক্তিত্ব নাজীর আহমদকে একটি তথ্যচিত্র নির্মাণের দায়িত্ব দেওয়া হয়। তিনি কলকাতার কুশলীদের সহায়তায় ইন আওয়ার মিডস্ট নামে একটি তথ্যচিত্র নির্মাণ করেন। এটিই পূর্ব পাকিস্তান তথা আজকের বাংলাদেশের প্রথম তথ্যচিত্র।

১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে বাংলা ভাষা আন্দোলন ও কয়েকজন শহীদের রক্তদান এ অঞ্চলের সচেতন বাঙালিদের স্বাধিকার চেতনায় উদ্বুদ্ধ করে। পশ্চিম পাকিস্তানিদের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, প্রশাসনিক শোষণের সঙ্গে চলছিল সাংস্কৃতিক শোষণও। ভাষা আন্দোলনের বছর দুয়েকের মধ্যেই চলচ্চিত্র নির্মাণের জন্য শহীদুল আলম,  আব্দুল জববার খান, কাজী নূরুজ্জামান প্রমুখের নেতৃত্বে ইকবাল ফিল্মস এবং ড. আব্দুস সাদেক, দলিল আহমদ (বুলবুল আহমদের পিতা), আজিজুল হক, দুদু মিয়া (আলমগীরের পিতা), কবি  জসীমউদ্দীন, কাজী খালেক, সারওয়ার হোসেন প্রমুখকে নিয়ে গঠিত হয় কো-অপারেটিভ ফিল্ম মেকার্স লিমিটেড।

সরকারি উদ্যোগে জনসংযোগ বিভাগের অধীনে প্রচারচিত্র নির্মাণের জন্য চলচ্চিত্র ইউনিট (১৯৫৩) গঠিত হয়। এজন্য ঢাকার তেজগাঁও স্টুডিও এবং ল্যাবরেটরি স্থাপনের চেষ্টা চলে। এ ইউনিট থেকে নাজীর আহমদের পরিচালনায় নির্মিত হয় প্রামাণ্য চিত্র সালামত (১৯৫৪)। ১৯৫৪ সালে ইকবাল ফিল্মসের প্রথম ছবি মুখ ও মুখোশ-এর কাজ শুরু হয় আব্দুল জববার খানের পরিচালনায়। কো-অপারেটিভ ফিল্ম মেকার্সের উদ্যোগে সারোয়ার হোসেনের পরিচালনায় শুরু হয় আপ্যায়ন নামে একটি স্বল্পদৈর্ঘ্য চিত্রের কাজ। ১৯৫৫ সালে জুন মাসে তেজগাঁওয়ে সরকারি ফিল্ম স্টুডিও চালু হয়।

পূর্ব পাকিস্তানের প্রথম সবাক বাংলা পূর্ণদৈর্ঘ্য চিত্র মুখ ও মুখোশ মুক্তি পায় ১৯৫৬ সালের ৩ আগস্ট। এর প্রযোজনায় ছিলেন নুরুজ্জামান, শহীদুল আলম, কলিমউদ্দিন আহমেদ, এম.এ হাসান ও আব্দুল জববার খান। পরিচালকের নিজের লেখা নাটক ডাকাত অবলম্বনে এ ছবির কাহিনী তৈরি হয়। তিনি নায়ক চরিত্রে অভিনয় করেন। অন্যান্য পাত্র-পাত্রী ছিলেন ইনাম আহমেদ, পূর্ণিমা সেন, নাজমা (পিয়ারী), জহরত আরা, আলী মনসুর, রফিক, নুরুল আনাম খান, সাইফুদ্দীন, বিলকিস বারী প্রমুখ। কিউ. এম জামান ছবির চিত্রগ্রহণ এবং সমর দাস সংগীত পরিচালনা করেন। ছবির গানে কণ্ঠ দেন  আবদুল আলীম ও মাহবুবা হাসানাত। ছবিটি পরিবেশনা করেন পাকিস্তান ফিল্ম ট্রাস্টের পক্ষে মোশাররফ হোসেন চৌধুরী ও পাকিস্তান ফিল্ম সার্ভিসের পক্ষে এম এ আউয়াল।

১৯৫৭ সালের ৩ এপ্রিল পূর্ব পাকিস্তান আইন পরিষদে বিল পাসের মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তান চলচ্চিত্র উন্নয়ন সংস্থা (ইপিএফডিসি) প্রতিষ্ঠত হয়। এফডিসি প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বাংলাদেশের চলচ্চিত্র শিল্পের ভিত্তি স্থাপিত হয়। এখানকার সুযোগ-সুবিধা নিয়ে ১৯৫৯ সালে থেকে নিয়মিতভাবে প্রতিবছর চলচ্চিত্র মুক্তি পেতে থাকে। এর আগে পর্যন্ত এ অঞ্চলের হলগুলিতে কেবল ভারত, পশ্চিম পাকিস্তান, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, রাশিয়া, ইতালি ও অন্যান্য দেশের চলচ্চিত্র প্রদর্শন করা হতো। এফডিসির পর বেসরকারি পর্যায়েও কয়েকটি স্টুডিও যেমন, পপুলার স্টুডিও (পাগলা), বারী স্টুডিও (তেজতুরী বাজার), বেঙ্গল স্টুডিও (টিকাটুলী) স্থাপিত হয়।

এফডিসি প্রতিষ্ঠার চল্লিশ বছরের মধ্যে (১৯৫৭-১৯৯৭) বাংলাদেশের চলচিত্রের ইতিহাসে বিভিন্ন ধারা লক্ষ্য করা যায়। বিশ শতকের পঞ্চাশ ও ষাটের দশকের প্রারম্ভে নির্মিত চলচ্চিত্রগুলিতে জীবনবোধ, শিল্পশোভনতা ও পরিচ্ছন্নতার ছাপ ছিল। নির্মাতারা পরে বাণিজ্যিক কারণে উর্দু ভাষা ও লোককাহিনী-ভিত্তিক ছবি নির্মাণ শুরু করে। এক্ষেত্রে এহতেশামের উর্দু ভাষায় নির্মিত চান্দা (১৯৬২) ও সালাহউদ্দিনের লোকগাথা-ভিত্তিক রূপবান (১৯৬৫) দুটি ধারা সৃষ্টিকারী চলচ্চিত্র হিসেবে বিবেচিত।

ঐ শতকের ষাটের দশকের মধ্যভাগে দেশের উত্তপ্ত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে  খান আতাউর রহমান-এর ইতিহাসভিত্তিক নবাব সিরাজউদ্দৌলা (১৯৬৭) ও  জহির রায়হান-এর গণআন্দোলন ভিত্তিক জীবন থেকে নেয়া (১৯৭০) নির্মিত হয়। ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে বাংলাদেশের  মুক্তিযুদ্ধ নির্মাতাদের নতুন চেতনায় উদ্বুদ্ধ করে। এ চেতনায় প্রথম চলচ্চিত্র নির্মাণের কৃতিত্ব জহির রায়হানের। তিনি ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে স্টপ জেনোসাইড ও কয়েকটি স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাণ এবং প্রযোজনা করেন।  আলমগীর কবির নির্মাণ করেন লিবারেশন ফাইটার্স নামে একটি স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র। চাষী নজরূল ইসলাম মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে চিত্রায়ন করেন প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ওরা ১১ জন (১৯৭২)।

সত্তরের দশকের শুরুতে বাণিজ্যিক কারণে চলচ্চিত্রে যোগ হয় মারপিট, সংঘাত, অতি আবেগ, সস্তা রোমান্স, নাচ-গান, যৌনতা, ভাঁড়ামি, কৌতুক এবং বিদেশি ভাবধারা ও কাহিনীর নকল। এ ধারা অব্যাহত থাকে ২০১০ সাল পর্যন্ত। এ সময়ের চলচ্চিত্রকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে হয় স্যাটেলাইট প্রযুক্তিনির্ভর বিশ্বব্যাপী টিভি নেটওয়ার্কের সঙ্গে।

চলচ্চিত্র চর্চার সংগঠন হিসেবে আছে বেসরকারি পর্যায়ে ১৯৬৩ সালে স্থাপিত পাকিস্তান চলচ্চিত্র সংসদ (বর্তমানে বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সংসদ), ১৯৬৯ সালে স্থাপিত ঢাকা ফিল্ম ইনস্টিটিউট ও সরকারি পর্যায়ে ১৯৭৮ সালে স্থাপিত বাংলাদেশ ফিল্ম ইনস্টিটিউট ও আর্কাইভ, ১৯৭৫ সালে চালুকৃত জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার ও অনুদান তহবিল। এসব উদ্যোগ বাংলাদেশে সুস্থ, শোভন ও উন্নতমানের চলচ্চিত্র নির্মাণে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে।

বর্তমান অবস্থা  অতীতের তুলনায় বর্তমানে ছবির পরিমাণ সংখ্যার দিক থেকে অনেক বৃদ্ধি পেলেও মান এবং গুণগত দিক বৃদ্ধি পায় নি। ১৯৫৬ সালে ১টি ছবি মুক্তির মাধ্যমে বাংলাদেশে চলচ্চিত্রের যাত্রা শুরু হয়। বিশ শতকের ষাটের দশকে মুক্তিপ্রাপ্ত ছবির সংখ্যা বেড়ে গিয়ে গড়ে ২০টিতে দাঁড়ায়, যা ৯০-এর দশকে গড়ে প্রায় ৮০টিতে উন্নীত হয়। মুক্তি পাওয়া ছবির সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়া সত্ত্বেও বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের বর্তমান অবস্থা খুবই নাজুক। স্যাটেলাইট চ্যানেলে বিশ্বজুরে নেটওয়ার্ক বিস্তার, ভিসিআর, ভিসিডি, হোম স্ক্রিনিং, কম্পিউটার সিডি-র সহজলভ্যতা চলচ্চিত্র দর্শকদেরকে গৃহমুখী করে তুলেছে। ফলে অভিজাত, শিক্ষিত ও ধনী দর্শকরা টিকেট কিনে প্রেক্ষাগৃহে ছবি দেখতে যায় না। স্যাটেলাইট চ্যানেল ও অন্যান্য যন্ত্রনির্ভর বিনোদন মাধ্যমের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা এবং সাধারণ দর্শকদের অধিকতর মনোরঞ্জনের জন্যে নির্মাতারা চলচ্চিত্রে অবাস্তব কাহিনী ও ঘটনা, নগ্নতা, অ্যাকশন, নাচ-গান, ভাঁড়ামোর আশ্রয় নিয়েছে। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে, বিদেশে পাঠানোর মতো মৌলিক কাহিনী ও শিল্পশোভন ছবি এখন আর তেমন খুঁজে পাওয়া যায় না। ২০০৭ সালে সেন্সর বোর্ড, এফডিসি ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী অশ্লীল ছবির বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করে।

বর্তমানে ছায়াছবির নির্মাণ ব্যয়ও আগেকার তুলনায় অনেকগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। কারিগরি কারণে এখন আর সাদাকালো ছবি তৈরি হয় না। সব ছবিই হয়ে থাকে রঙিন। বর্তমানে ১৪ হাজার ফুট দৈর্ঘ্যবিশিষ্ট একটি রঙিন চলচ্চিত্র নির্মাণের গড় খরচ প্রায় ৬০-৭০ লাখ টাকা। বাংলাদেশে চলচ্চিত্রই অন্যতম সহজলভ্য বিনোদন মাধ্যম। শিক্ষার অভাব,  দারিদ্র্য এবং নিম্নরুচির কারণে বেশিরভাগ দর্শকই সস্তা নাচ-গান, মারপিট, কৌতুক, প্রেম-মিলন-বিরহের ছবি পছন্দ করে। নির্মাতারাও এ ধরনের ছবি তৈরি করে।

উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্র  নির্মাণ শৈলী, কারিগরি উৎকর্ষ, নান্দনিকতা, জীবন ও সমাজ ঘনিষ্ঠতা, গণআন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধ ইত্যাদি কারণে বাংলাদেশে বেশকিছু পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র স্মরণীয় হয়ে আছে। এসব চলচ্চিত্রের মধ্যে রয়েছে  ফতেহ লোহানীর আসিয়া (১৯৫৭-৬০); জহির রায়হানের কখনো আসেনি (১৯৬১), কাঁচের দেয়াল (১৯৬৩), সংগম (১৯৬৪), আনোয়ারা (১৯৬৬), জীবন থেকে নেয়া (১৯৭০), সালাহউদ্দিনের সূর্যস্নান (১৯৬২), যে নদী মরুপথে (১৯৬১), ধারাপাত (১৯৬৪), খান আতাউর রহমানের অনেক দিনের চেনা (১৯৬৪), নবাব সিরাজদ্দৌল্লা (১৯৬৭), সোয়ে নদীয়া জাগে পানি (১৯৬৭), আবার তোরা মানুষ হ (১৯৭৩), এখনো অনেক রাত (১৯৯৭), বেবী ইসলামের তানহা (১৯৬২) ও চরিত্রহীন (১৯৭৬), সাদেক খানের নদী ও নারী (১৯৬৫), এহতেশামের এদেশ তোমার আমার (১৯৫৯), সুভাষ দত্তের সুতরাং (১৯৬৪), কাগজের নৌকা (১৯৬৬), আয়না ও অবশিষ্ট (১৯৬৭), অরুণোদয়ের অগ্নিসাক্ষী (১৯৭২), বসুন্ধরা (১৯৭৭), ডুমুরের ফুল (১৯৭৮), ইবনে মিজানের শহীদ তিতুমীর (১৯৬৮), আলমগীর কবিরের ধীরে বহে মেঘনা (১৯৭৩), সূর্যকন্যা (১৯৭৫), সীমানা পেরিয়ে (১৯৭৭), রূপালী সৈকতে (১৯৭৯), মোহনা (১৯৮২), পরিণীতা (১৯৮৬), চাষী নজরুল ইসলামের ওরা এগারো জন (১৯৭২), সংগ্রাম (১৯৭৩), দেবদাস (১৯৮২), চন্দ্রনাথ (১৯৮৪), শুভদা (১৯৮৬), হাঙর নদী গ্রেনেড (১৯৯৮), আমজাদ হোসেনের নয়নমণি (১৯৭৫), গোলাপী এখন ট্রেনে (১৯৭৯), ভাত দে (১৯৮৩), হারুনর রশীদের মেঘের অনেক রং (১৯৭৬), মিতার আলোর মিছিল (১৯৭৪) ও লাঠিয়াল (১৯৭৬), শেখ নিয়ামত আলী ও মসিহউদ্দিন শাকেরের সূর্য-দীঘল বাড়ী (১৯৭৯), শেখ নিয়ামত আলীর দহন (১৯৮৫) আজিজুর রহমানের অশিক্ষিত (১৯৭৮), ছুটির ঘণ্টা (১৯৮৯), শিবলী সাদিকের নোলক (১৯৭৮), ঋত্বিক ঘটকের তিতাস একটি নদীর নাম (১৯৭৩), রাজেন তরফদারের পালঙ্ক (১৯৭৬), সৈয়দ হাসান ইমামের লালন ফকির (১৯৭৩), লাল সবুজের পালা (১৯৮১), আবদুল্লাহ আল মামুনের সারেং বৌ (১৯৭৮), কবীর আনোয়ারের সুপ্রভাত (১৯৭৬), মতিন রহমানের লাল কাজল (১৯৮৩), রফিকুল বারী চৌধুরীর পেনশন (১৯৮৫), মোস্তাফিজুর রহমানের শঙ্খনীল কারাগার (১৯৭৪), হুমায়ূন আহমেদের আগুনের পরশমণি (১৯৯৫), শ্রাবণ মেঘের দিন (২০০০) ও শ্যামল ছায়া (২০০৪), আখতারুজ্জামানের পোকামাকড়ের ঘর বসতি (১৯৯৬), মোরশেদুল ইসলামের দুখাই (১৯৯৭), তানভীর মোকাম্মেলের চিত্রা নদীর পাড়ে (২০০০), লালনশাহ (২০০২), রাবেয়া (২০০৯), সাইদুল আনাম টুটুলের আধিয়ার (২০০৩), মোস্তফা সারোয়ার ফারুকীর থার্ডপারসন সিঙ্গুলার নাম্বার (২০০৯) প্রভৃতি।

অন্যদিকে বাণিজ্যকভাবে সফল উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্রের মধ্যে রয়েছে এহতেশামের চান্দা (১৯৬২), চাঁদনী (১৯৯১), সালাহউদ্দীনের রূপবান (১৯৯৫), মুস্তাফিজের মালা (১৯৬৫), দিলীপ সোমের সাত ভাই চম্পা (১৯৬৮), খান আতাউর রহমানের অরুণ বরুণ কিরণমালা (১৯৬৮), রহমানের মিলন (১৯৬৪), কাজী জহিরের অবুঝ মন (১৯৭২), ময়নামতি (১৯৬৯), মিতার এতটুকু আশা (১৯৬৮), জহিরুল হকের রংবাজ (১৯৭৩), এ.জে মিন্টুর চ্যালেঞ্জ (১৯৮৩), সোহানুর রহমান সোহানের কেয়ামত থেকে কেয়ামত (১৯৯২), তোজাম্মেল হক বকুলের বেদের মেয়ে জোসনা (১৯৮৯), দেওয়ান নজরুলের দোস্ত দুশমন (১৯৭৭), দেলোয়ার জাহান ঝন্টুর ওমর শরীফ (১৯৮০), এফ কবীর চৌধুরীর সওদাগর (১৯৮১), শিবলী সাদিকের ভেজাচোখ (১৯৮৭), মতিন রহমানের তোমাকে চাই (১৯৯৬), রঙিন নয়নমণি (১৯৯৮), সোহেল রানার গুনাহগার (১৯৭৮), শহীদুল ইসলাম খোকনের বিশ্ব প্রেমিক (১৯৯৬), বাদল খন্দকারের সাগরিকা (১৯৯৮), মোহাম্মদ হোসেনের রাঙ্গা বৌ (১৯৯৮), গিয়াসউদ্দিন সেলিমের মনপুরা (২০০৯) প্রভৃতি।

খ্যাতিমান চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্ব  বাংলদেশের চলচ্চিত্র অনেক নির্মাতা, শিল্পী ও কলাকুশলীদের মেধা ও অবদানে সমৃদ্ধ। এঁদের মধ্যে খ্যাতিমান নির্মাতা হলেন আবদুল জববার খান, ফতেহ লোহানী, এহতেশাম, মুস্তাফিজ, সালাহউদ্দিন, মহিউদ্দিন, জহির রায়হান, খান আতাউর রহমান, বেবী ইসলাম, সাদেক খান, সুভাষ দত্ত, কামাল আহমেদ। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর চলচ্চিত্র নির্মাণে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখেন আলমগীর কবীর, আমজাদ হোসেন, চাষী নজরুল ইসলাম, আবদুল সামাদ, শেখ নিয়ামত আলী, বাদল রহমান, শিবলী সাদিক, কাজী হায়াৎ, মতিন রহমান, ছটকু আহমেদ, মোরশেদুল ইসলাম, তারেক মাসুদ, নার্গিস আখতার, তানভীর মোকাম্মেল প্রমুখ।

খ্যাতিমান অভিনেতা ও অভিনেত্রীদের মধ্যে রয়েছেন ফতেহ লোহানী, খান আতা, পূর্ণিমা সেন, সুমিতা, ইনাম আহমেদ, কাজী খালেক, দাগুবর্ধন, বিনয় বিশ্বাস, নারায়ণ চক্রবর্তী, মেহফুজ, আনোয়ার হোসেন, সাইফুদ্দিন, নাসিমা খান, রহমান, শবনম, রোজী, সুজাতা, আজিম, রওশন আরা, রাজ্জাক, কবরী, শওকত আকবর, আনোয়ারা, শাবানা, সুচন্দা, ববিতা, রোজিনা, খলিল, আশীষ কুমার লোহ, সুচরিতা, শাবনুর, মৌসুমি, রিয়াজ, ফেরদাউস, শাকিব খান প্রমুখ।

চলচ্চিত্র পুরস্কার  সৃজনশীলতা, নান্দনিকতা, জীবন ও সমাজের প্রতিফলন, মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি ইত্যাদি কারণে বেশকিছু চলচ্চিত্র দেশ বিদেশের পুরস্কার এবং সম্মান পেয়েছে। আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে পুরস্কারপ্রাপ্ত প্রথম পূর্ণাঙ্গ ছবি হচ্ছে জাগো হুয়া সাভেরা (উর্দু)। এ.জে কারদার পরিচালিত জেলেদের নিয়ে চিত্রায়িত এ ছবি ১৯৫৯ সালে মস্কো আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে দ্বিতীয় পুরস্কার পায়। ছবিটি ১৯৫৯ সালে লন্ডনের হোমার থিয়েটার ও ফিল্ম ইনস্টিটিউট, যুক্তরাস্ট্রের ফ্লাহার্টি ফাউন্ডেশন ও দক্ষিণ ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সেমিনারেও প্রদর্শিত হয়। ওই বছরে অনুষ্ঠিত অস্কার প্রতিযোগিতায় বিদেশি ভাষা বিভাগেও এ ছবি অংশ গ্রহণের আমন্ত্রণ পায়। জাগো হুয়া সাভেরা সর্বমোট ১১টি আন্তর্জাতিক পুরস্কার পায়। ১৯৬২ সালে বৈরুত চলচ্চিত্র উৎসবে বেবী ইসলাম পরিচালিত তানহা ছবিটি পুরস্কার লাভ করে। ১৯৬৫ সালে ছিল পূর্ব পাকিস্তানি ছবির জন্যে গুরুত্বপূর্ণ বছর। এ বছর ফ্রাঙ্কফুর্ট এশীয় চলচ্চিত্রের উৎসবে সুভাষ দত্ত পরিচালিত সুতরাং দ্বিতীয় শ্রেষ্ঠ ছবি হিসেবে পুরস্কার পায়।

১৯৬৭ সালে মস্কো চলচ্চিত্র উৎসবে সুভাষ দত্তের আয়না ও অবশিষ্ট বেসরকারিভাবে পুরস্কৃত হয়। ১৯৬৮ সালে নমপেনে অনুষ্ঠিত চলচ্চিত্র উৎসবে সুভাষ দত্তের আবির্ভাব কম্বোডিয়ার রানীর পুরস্কার লাভ করে। ১৯৭৯ সালে মস্কো আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে সুভাষ দত্তের ডুমুরের ফুল শিশু বিভাগে বিশেষ পুরস্কার পায়।

১৯৮০ সালে পশ্চিম জার্মানির মেনহেইমে অনুষ্ঠিত ২৯তম আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে মসিহউদ্দিন শাকের ও শেখ নিয়ামত আলী পরিচালিত সূর্য-দীঘল বাড়ী তৃতীয় পুরস্কার অর্জন করে। মেনহেইমের ক্যাথলিক ও প্রোটেস্ট্যান্ট জুরি কমিটি মানবিক আবেদনের জন্যে ছবিটিকে পুরস্কৃত করে। পর্তুগালের আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র সংসদ ফেডারেশনও সুর্য-দীঘল বাড়ী– কে পুরস্কৃত করে। শেখ নিয়ামত আলী পরিচালিত দহন ১৯৮৬ সালে কার্লোভেরি চলচ্চিত্র উৎসবে পুরস্কার অর্জন করে।

অন্যদিকে বাংলাদেশে প্রথম চলচ্চিত্র পুরস্কার চালু হয় বেসরকারি উদ্যোগে ১৯৫৯ সালে ঢাকার সাপ্তাহিক চিত্রাকাশ পত্রিকার উদ্যোগে। সরকারি উদ্যোগে প্রেসিডেন্ট পদক চালু হয় ১৯৬০ সালে। ওই বছর শ্রেষ্ঠ বাংলা ছবি হিসেবে প্রেসিডেন্ট পুরস্কার পায় ফতেহ লোহানী পরিচালিত আসিয়া। এ পুরস্কার মাত্র একবারই প্রদান করা হয়েছিল।

১৯৬৫ সালের আগস্ট মাসে ঢাকায় অনুষ্ঠিত হয় পাকিস্তান চলচ্চিত্র উৎসব। এ উৎসবে শ্রেষ্ঠ প্রযোজনা, পরিচালনা, কাহিনী, চিত্রনাট্য, সংলাপ, সঙ্গীত, আলোকচিত্র, অভিনয়, সম্পাদনা, গান রচনা ইত্যাদি ক্ষেত্রে পুরস্কার দেওয়া হয়। ওই বছর শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র হিসেবে জহির রায়হান রচিত, প্রযোজিত ও পরিচালিত কাঁচের দেয়াল পুরস্কার পায়। এ ছাড়াও ছবিটি সংলাপ (জহির রায়হান), সম্পাদনা (এনামুল হক), শব্দ গ্রহণ (এম.এ জহুর), সঙ্গীত পরিচালনা (খান আতাউর রহমান), প্রধান মহিলা চরিত্রে অভিনয় (সুমিতা) ও বিশেষ মহিলা চরিত্রে অভিনয়ের জন্য (আসিয়া আলী) পুরস্কৃত হয়। অন্যান্য পুরস্কার হলো: গীতিকার খান আতাউর রহমান (সূর্যস্নান), চিত্রনাট্যকার সালাহউদ্দীন (সূর্যস্নান), অভিনেতা সৈয়দ হাসান ইমাম (অনেক দিনের চেনা), সহঅভিনেতা সুভাষ দত্ত (তালাশ ও মিলন), বিশেষ সম্মাননা সনদ রহমান (মিলন)।

বাংলাদেশের স্বাধীন হওয়ার পর প্রথম পুরস্কার প্রবর্তন করে বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সাংবাদিক সমিতি (বাচসাস)। ‘সামাজিক অঙ্গীকার ‘সৃজনশীল চলচ্চিত্রের মাধ্যমে’ এ শ্নোগানভিত্তিক পুরস্কারের প্রতীক রয়েল বেঙ্গল টাইগার। ১৯৭২ ও ১৯৭৩ এ দুবছরকে একক ধরে প্রথম পুরস্কার প্রদান করা হয়। শ্রেষ্ঠ প্রযোজনা, পরিচালনা, কাহিনী, চিত্রনাট্য, সংলাপ, গান, অভিনয় (প্রধান পুরুষ ও মহিলা চরিত্র), অভিনয় (পার্শ্ব পুরুষ ও মহিলা চরিত্র), চিত্রগ্রহণ, সঙ্গীত, নেপথ্য কণ্ঠ (পুরুষ ও মহিলা), সম্পাদনা, শব্দগ্রহণ, প্রামাণ্য বা বিকল্প চলচ্চিত্র ও বিশেষ ক্ষেত্রে কৃতিত্বের জন্য এ পুরস্কার প্রদান করা হয়। বাচসাস পুরস্কার ১৯৮৮ সাল পর্যন্ত নিয়মিতভাবে প্রদান করা হয়। মাঝখানে বিরতির পর ১৯৯৫ সালে আবার তা চালু হয়। কিন্তু পরে আবার তাও অনিয়মিত হয়ে পড়ে। ১৯৭৮ সাল থেকে চিত্রালী সম্পাদক ও বাচসাস এবং অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সৈয়দ মোহাম্মদ পারভেজ স্মরণে অন্য একটি পুরস্কার চালু করা হয়। চলচ্চিত্র সাংবাদিকতা ও লেখালেখিতে বিশেষ অবদান রাখার জন্য এ পুরস্কার প্রদান করা হয়।

সরকারিভাবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার প্রদান শুরু হয় ১৯৭৫ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত চলচ্চিত্র থেকে। চলচ্চিত্রের মান ও গুণগত উন্নয়ন, ভালো চলচ্চিত্র নির্মাণে উৎসাহ দান এবং সৃজনশীল ক্ষেত্রে অবদানকে স্বীকৃতি প্রদানের জন্যে এ পুরস্কার চালু হয়। পুরস্কারের মধ্যে রয়েছে নগদ অর্থ, প্রশংসাপত্র ও ধাতব পদার্থে নির্মিত ভাস্কর্য ‘কলসি কাঁখে রমণী’। প্রাথমিক পর্যায়ে ১৯টি শাখায় কৃতিত্বের জন্যে পুরস্কার প্রদান করা হতো। ১৯৯২ সালে তা বাড়িয়ে ২১টি করা হয়। শ্রেষ্ঠত্বের জন্যে পুরস্কার দেওয়া হয় চলচ্চিত্র, পরিচালনা, কাহিনী, চিত্রনাট্য, সংলাপ, গান, প্রধান অভিনেতা, প্রধান অভিনেত্রী, পার্শ্ব অভিনেতা, পার্শ্ব অভিনেত্রী, সঙ্গীত পরিচালক, গায়ক, গায়িকা, সাদাকালো চিত্রগ্রাহক, রঙিন চিত্রগ্রাহক, সম্পাদক, শব্দগ্রাহক, শিল্প নির্দেশক, শিশু শিল্পী, বিশেষ শিশু শিল্পী ও স্বল্পদৈর্ঘ্য চিত্র।

বাংলাদেশ চলচ্চিত্র প্রযোজক সমিতি ১৯৯১ সাল থেকে চলচ্চিত্র পুরস্কার চালু করেছে। এ ছাড়া আরও বিভিন্ন বেসরকারি সংগঠন, সমিতি-সংস্থা চলচ্চিত্রের বিভিন্ন শাখায় পুরস্কার প্রদান করে থাকে।  [অনুপম হায়াৎ]