চলচ্চিত্র আর্কাইভ

চলচ্চিত্র আর্কাইভ  চলচ্চিত্রের প্রিন্ট এবং চলচ্চিত্র সংক্রান্ত যাবতীয় নিদর্শনের বৈজ্ঞানিক সংগ্রহশালা ও সংরক্ষণাগার। হেনরি ল্যাংলোয়া ১৯৩৫ সালে ফ্রান্সে পৃথিবীর প্রথম চলচ্চিত্র বা ফিল্ম আর্কাইভ স্থাপন করেন। চলচ্চিত্র আর্কাইভে ছবির প্রিন্ট, চলচ্চিত্রের ইতিহাস, বইপুস্তক, পত্র-পত্রিকা, স্থিরচিত্র, ট্রেলার, সেন্সর সার্টিফিকেট, ডিস্ক, ক্যাসেট, টেপ, চিত্রনাট্য, পোস্টার, ব্যানার ও অন্যান্য নিদর্শন সংরক্ষণ করা হয়। এ ছাড়াও এখানে চলচ্চিত্র প্রদর্শিত হয়; পত্রিকা, বই, ক্যাটালগ ও বুলেটিন প্রকাশ করা হয়; গবেষণা ও জরিপ কার্যক্রম পরিচালিত হয়। চলচ্চিত্র আর্কাইভে অনুষ্ঠিত হয় সেমিনার, উৎসব অনুষ্ঠান। আন্তর্জাতিক ফিল্ম আর্কাইভ ও ইউনেস্কো প্রত্যেক দেশের আর্কাইভকে চলচ্চিত্র, স্থিরচিত্র সংরক্ষণের জন্য সাহায্য করে থাকে।

১৯৭৮-এর জুন মাসে বাংলাদেশে প্রথম চলচ্চিত্র আর্কাইভ স্থাপিত হয়। এটি গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের তথ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন একটি প্রতিষ্ঠান। এর প্রধান নির্বাহীর পদবি মহাপরিচালক (আগে পদবি ছিল কিউরেটর)। প্রতিষ্ঠালগ্নে সংস্থাটির নাম ছিল বাংলাদেশ ফিল্ম ইনস্টিটিউট অ্যান্ড আর্কাইভ (বিফিয়া)। ১৯৮৪-তে ফিল্ম ইনস্টিটিউটের দায়িত্ব ও কার্যক্রমকে জাতীয় গণমাধ্যম ইনস্টিটিউটের সঙ্গে একীভূত করা হয় এবং ফিল্ম আর্কাইভকে আলাদা প্রতিষ্ঠান হিসেবে মর্যাদা দেওয়া হয়। প্রতিষ্ঠাপর্বে কিউরেটর এ.কে.এম আব্দুর রউফের নেতৃত্বে ফিল্ম আর্কাইভের কাজ শুরু হয় রাজধানী ঢাকার ধানমন্ডিতে ভাড়া করা এক বাড়িতে, ১৯৮৬-তে তা প্রথমে শেরে-বাংলা নগরস্থ গণভবন এলাকায় এবং ১৯৯৮-এ লালমাটিয়া এলাকায়, ২০০৮ সালে শাহবাগস্থ বেতার ভবনে স্থানান্তর করা হয়। আগারগাঁও এলাকায় ‘ফিল্ম কমপ্লেক্স’ স্থাপনের একটি সরকারি পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হলে ফিল্ম আর্কাইভের দপ্তর সেখানে স্থায়িভাবে স্থানান্তর করা হবে।

বাংলাদেশ চলচ্চিত্র আর্কাইভের উদ্দেশ্য হচ্ছে: চলচ্চিত্রের প্রিন্ট সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করা; গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক ঘটনা ও অন্যান্য অগ্রগতি রেকর্ড করা; সমাজজীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে ভিজুয়াল টেকনিকের সাহায্যে গবেষণা ও জরিপ চালানো; চলচ্চিত্রের মাধ্যমে জনশিক্ষা; চলচ্চিত্র নিদর্শনাবলি যেমন, চিত্রনাট্য, স্থিরচিত্র, কাহিনী ও গানের বই, বিজ্ঞাপনের ডিজাইন, পোস্টার, ব্যানার, ফেস্টুন, বইপুস্তক, পত্রপত্রিকা ইত্যাদি সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করা। ফিল্ম আর্কাইভে ২০০৯ সালের ১৫ মে পর্যন্ত সংগৃহীত ও সংরক্ষিত চলচ্চিত্র ও নিদর্শনাবলির তালিকায় রয়েছে পূর্ণ চলচ্চিত্রের প্রিন্ট-৫৫১, পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রের নেগেটিভ-১৮০, স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র-১৮২, প্রামাণ্য চলচ্চিত্র-৯৯৫, সংবাদচিত্র-২৪০, বইপুস্তক-৩,১৬৮, স্থিরচিত্র-১৪,৫৭৫, পোস্টার-৬,৬৮১, চিত্রনাট্য-১,৯৮৬, গানের বই-২৮৭, কাহিনী সংক্ষেপ-১,৩৬৫, উৎসব সংক্রান্ত স্থিরচিত্র-৭৬০, পেপারকাটিং-১২,২০০, ম্যাগাজিন-৯,৮৭৩, ডিভিডি-৮৯৭ এবং বিবিধ-৩,২৩৮টি।

সংরক্ষিত সামগ্রীর মধ্যে রয়েছে ঢাকায় নির্মিত প্রথম স্বল্পদৈর্ঘ্য চিত্র সুকুমারী (নির্বাক, ১৯২৭-২৮) ও প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য চিত্র দ্য লাস্ট কিস (নির্বাক, ১৯৩১)-এর স্থিরচিত্র, প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য সবাক বাংলা চলচ্চিত্র মুখ ও মুখোশ (১৯৫৬) ও এফডিসি-র প্রথম ছবি আসিয়া (১৯৫৭-৬০)-এর প্রিন্ট, পঞ্চাশের দশকে প্রকাশিত চলচ্চিত্র ও সাংস্কৃতিক পত্র-পত্রিকা যেমন মাসিক সিনেমা, রূপছায়া, উদয়ন, সন্ধানী, মৃদঙ্গ, চলন্তিকা, সাপ্তাহিক চিত্রালী, রমনা ও চিত্রাকাশ-এর কপি,  কাজী নজরুল ইসলাম অভিনীত, পরিচালিত (যৌথভাবে), সঙ্গীত পরিচালিত ও গীত ধ্রুব (১৯৩১) চিত্রের একটি রিল, প্রমথেশ বড়ুয়া পরিচালিত দেবদাস-এর প্রিন্ট। এ ছাড়াও সংগ্রহের তালিকায় রয়েছে বিশ্বখ্যাত চলচ্চিত্র ব্যাটলশিপ পটেমকিন, অক্টোবর, মাদার, অয়েজেস অব ফিয়ার, রশোমন, পথের পাঁচালী, অপুর সংসার এবং বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ-ভিত্তিক চলচ্চিত্রের প্রিন্ট।

আর্কাইভের উদ্যোগে চলচ্চিত্র সমীক্ষণ কোর্স, প্রদর্শনী, আলোচনা সভা ও সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়। ১৯৮১-এর আগস্টে চালু করা হয় প্রথম চলচ্চিত্র সমীক্ষা কোর্স। পরে আরও কয়েকটি কোর্স অনুষ্ঠিত হয়। স্বল্পমেয়াদি ও তত্ত্বীয় এসব কোর্সের পাঠ্যসূচিতে ছিল চলচ্চিত্রের ইতিহাস, সমালোচনা, নন্দনতত্ত্ব, সম্পাদনা, চিত্রনাট্য, শিল্প নির্দেশনা প্রভৃতি। কোর্সে উত্তীর্ণ শিক্ষার্থী মোরশেদুল ইসলাম (আগামী, ঢাকা, দীপু নাম্বার টু, দুখাই), তানভীর মোকাম্মেল (হুলিয়া, নদীর নাম মধুমতি, চিত্রানদীর পাড়ে), আখতারুজ্জামান (প্রিন্সেস টিনা খান, পোকামাকড়ের ঘরবসতি) এবং তারেক মাসুদ (মুক্তির গান, মুক্তির কথা, মাটির ময়না, আদমসুরত, রানওয়ে) প্রমুখ দেশে বিকল্প ও নব্যধারার চলচ্চিত্র নির্মাণের পথ তৈরি করেন।

ফিল্ম আর্কাইভের উদ্যোগে অনুষ্ঠিত উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্র উৎসবের মধ্যে রয়েছে ভারতীয় চলচ্চিত্র উৎসব (১৯৮৪), সার্ক চলচ্চিত্র উৎসব (১৯৮৫), জার্মান নিরীক্ষাধর্মী চলচ্চিত্র উৎসব (১৯৮৭), সোভিয়েত ইউনিয়ন চলচ্চিত্র উৎসব (১৯৮৮) ও চীনা চলচ্চিত্র উৎসব (১৯৯১)। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের কয়েকশ খ্যাতনামা চলচ্চিত্রিক ব্যক্তিত্ব ফিল্ম আর্কাইভ পরিদর্শন করেছেন এবং তাদের অনেকেই আর্কাইভ আয়োজিত সেমিনার, কর্মশালা, আলোচনা সভা ইত্যাদিতে বক্তব্য দিয়েছেন। ২০০৯ সালে ফিল্ম আর্কাইভ ৬টি গবেষণা গ্রন্থ প্রকাশ করেছে।  [অনুপম হায়াৎ]