হোসেন, কাজী মোতাহার
হোসেন, কাজী মোতাহার (১৮৯৭-১৯৮১) শিক্ষাবিদ, বিজ্ঞানী এবং সাহিত্যিক। কুষ্টিয়া জেলার কুমারখালী উপজেলার লক্ষ্মীপুর গ্রামে জন্ম, পৈতৃক নিবাস ফরিদপুর জেলার পাংশা উপজেলার বাগমারা গ্রাম। কাজী মোতাহার হোসেন কুষ্টিয়া হাই স্কুল থেকে ১৯১৫ সালে ডিস্টিংশনসহ প্রথম বিভাগে এনট্রান্স এবং রাজশাহী কলেজ থেকে ১৯১৭ সালে প্রথম বিভাগে ইন্টারমিডিয়েট পাস করেন। তিনি ঢাকা কলেজ থেকে ১৯১৯ সালে দ্বিতীয় শ্রেণীতে প্রথম স্থান অধিকার করে পদার্থবিজ্ঞানে অনার্সসহ বি.এ এবং একই শাস্ত্রে ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দ্বিতীয় শ্রেণীতে প্রথম স্থান অধিকার করে এম.এ ডিগ্রি লাভ করেন। ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিসটিক্যাল ইনস্টিটিউট থেকে ১৯৩৮ সালে পরিসংখ্যান বিষয়ে ডিপোমা এবং একই সঙ্গে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গণিত শাস্ত্রে এম.এ ডিগ্রি লাভ করেন। ‘পরীক্ষণ প্রকল্প’ (Design of Experiments) শীর্ষক অভিসন্দর্ভের জন্য তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৫১ সালে পরিসংখ্যান শাস্ত্রে পিএইচ.ডি ডিগ্রি অর্জন করেন। কাজী মোতাহার হোসেনের ‘পরীক্ষণ প্রকল্প’ শীর্ষক অভিসন্দর্ভ পরিসংখ্যান গবেষণায় এক নতুন পদ্ধতির প্রবর্তন করে, যা ‘হোসেনের শৃঙ্খল নিয়ম’ (Husain’s Chain Rule) নামে পরিচিত।
ছাত্রাবস্থায়ই ১৯২১ সালে মোতাহার হোসেন নব প্রতিষ্ঠিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে ডেমোনেস্ট্রেটর হিসেবে তাঁর কর্মজীবন শুরু করেন। ১৯২৩ সালে তিনি এ বিভাগের সহকারী প্রভাষকের পদ লাভ করেন। ১৯৪৮ সালে তিনি নিজস্ব উদ্যোগে এ বিশ্ববিদ্যালয়ে সংখ্যাতত্ত্ব ও তথ্যগণিত বিষয়ে এম.এ কোর্স চালু করেন। তিনি এ নতুন বিভাগে যোগদান করেন এবং ১৯৫৪ সালে প্রফেসর পদে উন্নীত হন। তিনি বিজ্ঞান অনুষদের ডিন হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। অধ্যাপক মোতাহার হোসেন ১৯৬১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অবসর গ্রহণ করলেও ১৯৬৪ সাল পর্যন্ত পরিসংখ্যান বিভাগের ‘সুপারনিউমেরারি প্রফেসর’ হিসেবে বিভাগের সঙ্গে তাঁর কর্মকান্ড অব্যাহত রাখেন। ১৯৬৪ সালে পরিসংখ্যান গবেষণা ও প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠিত হলে অধ্যাপক মোতাহার হোসেন এর প্রথম পরিচালক হিসেবে যোগদান করেন এবং ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত সেখানে দায়িত্ব পালন করেন। অধ্যাপক হোসেন ১৯৬৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ইমেরিটাস প্রফেসর’ পদে নিযুক্তি লাভ করেন। স্বাধীনতা পরবর্তীকালে ১৯৭৫ সালে ড. হোসেন ‘জাতীয় অধ্যাপক’ পদে সম্মানিত হন।
অধ্যাপক হোসেন শিক্ষা ও গবেষণা ক্ষেত্রে তাঁর অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ১৯৬০ সালে তৎকালীন পাকিস্তান সরকার কর্তৃক ‘সিতারা-ই-ইমতিয়াজ’ খেতাবে ভূষিত হন। কাজী আবদুল ওদুদ, সৈয়দ আবুল হুসেন, আবুল ফজল প্রমুখের সহযোগিতায় ১৯২৬ সালে তিনি ‘মুসলিম সাহিত্য সমাজ’ প্রতিষ্ঠা করেন। কাজী মোতাহার হোসেন অল্প কিছুকাল উক্ত সংগঠনের মুখপত্র শিখা পত্রিকা সম্পাদনা করেন। যদিও পত্রিকাটি অল্পকালব্যাপী প্রকাশিত হয়েছে, তথাপি এটি মুসলিম সমাজে মুক্ত চিন্তার প্রসার ঘটাতে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছিল। কাজী মোতাহার হোসেন ছিলেন বাংলা একাডেমী প্রতিষ্ঠার স্বপ্নদ্রষ্টাদের মধ্যে একজন। তিনি বাংলা বানান ও লিপি সংস্কার কমিটিরও অন্যতম সদস্য ছিলেন। শক্তিশালী লেখনীর মাধ্যমে তিনি ভাষা আন্দোলন এবং মুক্তিযুদ্ধে প্রেরণা যুগিয়েছিলেন।
কাজী মোতাহার হোসেন বিজ্ঞান, সাহিত্য, সংস্কৃতি প্রভৃতি বিষয়ে অসংখ্য প্রবন্ধ ও পুস্তক রচনা করেছেন। তাঁর উলেখযোগ্য প্রকাশনাসমূহ হচ্ছে: সঞ্চয়ন (১৯৩৭), নজরুল কাব্য পরিচিতি (১৯৫৫), সে পথ লক্ষ্য করে (১৯৫৮), সিম্পোজিয়াম (১৯৬৫), গণিত শাস্ত্রের ইতিহাস (১৯৭০) এবং আলোক বিজ্ঞান (১৯৭৪)। তাঁর রচনাসমূহে সুস্থ মনন ও পরিচ্ছন্ন জীবনবোধের পরিচয় পাওয়া যায়।
বাংলা সাহিত্যে অসামান্য অবদানের জন্য কাজী মোতাহার হোসেন ১৯৬৬ সালে ‘বাংলা একাডেমী পুরষ্কার’ এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিদ্যায় বিশেষ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ১৯৭৯ সালে ‘স্বাধীনতা পুরষ্কার’ লাভ করেন। বিজ্ঞান ও কলাশাস্ত্রে কাজী মোতাহার হোসেনের গুরুত্বপূর্ণ অবদানের জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে সম্মানসূচক ডি.এসসি ডিগ্রি প্রদান করে। কাজী মোতাহার হোসেন একজন খ্যাতিমান দাবাড়ু এবং দাবা সংগঠকও ছিলেন। তিনি ১৯৮১ সালের ৯ই অক্টোবর ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন। [মোঃ মাহবুব মোর্শেদ]