পরিসংখ্যান
পরিসংখ্যান গণিত শাস্ত্রের একটি ফলিত শাখা; এক বা একাধিক ঘটনা বা বিষয়ের মধ্যকার পারস্পরিক সম্পর্ক ও বৈশিষ্ট্য নির্ণয়ের লক্ষ্যে সংগৃহীত উপাত্তের গাণিতিক শ্রেণীবিন্যাসকরণ, প্রক্রিয়াজাতকরণ এবং ব্যাখ্যা প্রদানের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। ল্যাটিন শব্দ status অথবা ইতালীয় শব্দ statista কিংবা জার্মান statistik শব্দ থেকে পরিসংখ্যান শব্দটির ইংরেজি প্রতিশব্দ statistics এর উৎপত্তি যাদের প্রতিটির অর্থ রাজনৈতিক ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রব্যবস্থা। জার্মান অধ্যাপক Gottfried Ackenwall (১৭১৯-১৭৭২) সর্বপ্রথম পরিসংখ্যানকে ‘রাষ্ট্রসমূহের রাষ্ট্রনীতি’ হিসেবে সংজ্ঞায়িত করেছেন। ১৭৭০ সালে Baron JF Von Bieldfeld প্রণীত এবং W Hooper MD কর্তৃক অনূদিত Elements of Universal Erudition নামক বিখ্যাত গ্রন্থে (৩য় খন্ড, ১৭৭০) পরিসংখ্যানের অন্য একটি সংজ্ঞায় বলা হয়েছে ‘পরিসংখ্যান হচ্ছে সেই বিজ্ঞান যা পৃথিবীর সকল আধুনিক রাষ্ট্রের রাজনৈতিক সজ্জাবিন্যাস শিক্ষা দেয়।’
ভারতীয় উপমহাদেশের অংশ হিসেবে বাংলা নামক ভূখন্ডে পরিসংখ্যান শাস্ত্রের চর্চার ইতিহাস অনেক পুরানো। বর্তমান সময়কাল থেকে ২ হাজার বছরেরও অধিক পূর্বে, বিশেষ করে, চন্দ্র গুপ্ত মৌর্যের (খ্রিস্টপূর্ব ৩২৪-৩০০) শাসনামলে এ অঞ্চলে সরকারি ও প্রশাসনিক কাজকর্মের প্রয়োজনে পরিসংখ্যানগত তথ্য সংগ্রহের একটি দক্ষতাপূর্ণ ব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল। কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র থেকে জানা যায়, বাংলায় খ্রিস্টপূর্ব ৩০০ অব্দেও জৈব পরিসংখ্যানগত তথ্য সংগ্রহ এবং জন্ম-মৃত্যু নিবন্ধীকরণের সুষ্ঠু ব্যবস্থা প্রচলিত ছিল। মুগল শাসনামলেও বাংলায় পরিসংখ্যান উপাত্ত সংগ্রহ করা হতো এবং তা প্রশাসনিক প্রয়োজনে ব্যবহার করা হতো। মুগল আমলের পরিসংখ্যানগত তথ্যের দুটি প্রধান দলিল হচ্ছে তুজকে-বাবরী এবং আইন-ই-আকবরী। সম্রাট আকবরের শাসনামলে (১৫৫৬-১৬০৫) তাঁর ভূমি ও রাজস্ব মন্ত্রী রাজা তোদারমাল সাম্রাজ্যের ভূমি ও কৃষি পরিসংখ্যান সম্পর্কিত তথ্যাদি অত্যন্ত চমৎকারভাবে সংরক্ষণ ও নথিভুক্ত করতেন। ১৫৯৬ সালে আবুল ফজলের লেখা আইন-ই-আকবরী-কে সম্রাট আকবরের শাসনামলে সংঘটিত বিভিন্ন ঘটনাবলী সম্পর্কিত তথ্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ ও প্রামাণ্য দলিল হিসেবে বিবেচনা করা হয়ে থাকে।
ব্রিটিশদের ক্ষমতা দখলের মধ্য দিয়ে এতদঞ্চলে মুগল শাসনের অবসান ঘটে, শুরু হয় ইংরেজদের শাসনামল। অষ্টাদশ শতাব্দীতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ভূমি রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যে রায়ত ব্যবস্থা প্রবর্তন করে। জমিদারি ব্যবস্থা উচ্ছেদ না হওয়া পর্যন্ত এই পদ্ধতি বহাল থাকে। ১৮৬৩ সালে কোম্পানি কর্মকর্তা স্যার উইলিয়ম উইলসন হান্টার (William Wilson Hunter) বঙ্গ ও আসাম প্রদেশের একটি রীতিবদ্ধ গেজেটিয়ার প্রণয়নের কর্মপরিকল্পনা সরকারের কাছে উপস্থাপন করেন। ১৯৬৭ সাল থেকে এই গেজেটিয়ারের জন্য ছয়টি শিরোনামে গঠিত পরিসংখ্যান নির্দেশনাপত্রের মাধ্যমে প্রদেশ দুটির ৫৯টি জেলার বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ শুরু হয়। শিরোনামগুলো ছিল- ভূ-প্রকৃতি, জনসংখ্যাগত বর্ণনা, কৃষি, শিল্প, প্রশাসনিক বর্ণনা এবং চিকিৎসা। ১৮৭১ সালে হান্টার কৃষি, রাজস্ব ও বাণিজ্য অধিদপ্তরের পরিসংখ্যান বিভাগের মহাপরিচালক নিযুক্ত হন। বঙ্গ প্রদেশের গেজেটিয়ার A Statistical Account of Bengal প্রকাশিত হয় ১৮৭৭ সালে এবং ১৮৮১ সালে ইম্পেরিয়াল গেজেটিয়ার-এর প্রথম সংখ্যা প্রকাশিত হয়।
তখন থেকেই বেশ কিছু সরকারি বিভাগ এই প্রক্রিয়া অনুসরণ করে তাদের নিজ নিজ দপ্তরের পরিসংখ্যান প্রতিবেদন প্রকাশ করতে আরম্ভ করে। ১৮৮০ সালে অর্থ দপ্তর এবং স্বরাষ্ট্র দপ্তর, ১৮৭৪ থেকে ১৮৭৫ সাল পর্যন্ত যথাক্রমে তাদের অর্থ ও রাজস্ব বিবরণ এবং বিচার ও প্রশাসনিক কার্যালয়সমূহের কর্মকান্ডের তথ্য সম্বলিত Statistics of British India প্রকাশ করে।
১৮৮১ সালে বঙ্গীয় প্রদেশসহ ভারতীয় উপমহাদেশের প্রথম আদমশুমারি পরিচালিত হয়। তখন থেকেই প্রতি দশ বছর অন্তর অন্তর এই অঞ্চলে আদমশুমারি অনুষ্ঠান একটি সাধারণ রীতি হিসেবে পরিচালিত হয়ে আসছে। রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে বিভিন্নমুখী তথ্য ও উপাত্ত সংগ্রহ ও সম্পাদনার উদ্দেশ্যে ১৮৯৫ সালে একটি পরিসংখ্যান ব্যুরো প্রতিষ্ঠিত হয় যার প্রধান কার্যালয় স্থাপিত হয় কলকাতায়। একই বছর পরিসংখ্যান অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের পদ সৃষ্টি করা হয় এবং ১৯০৬ সালে এই পদের পুনর্বিন্যাস করে নামকরণ করা হয় বাণিজ্যিক গোয়েন্দা বিভাগের মহাপরিচালক। এই বিভাগের দায়িত্ব ছিল কৃষি, বৈদেশিক, উপকূলীয় ও আভ্যন্তরীণ বাণিজ্য, পণ্যমূল্য প্রভৃতি সংক্রান্ত পরিসংখ্যানগত তথ্য সংগ্রহ, সম্পাদনা ও প্রকাশ করা। ১৯১০ সালে মেসার্স দত্ত, শিরাস ও গুপ্ত সমন্বয়ে গঠিত দল পণ্যসামগ্রীর মূল্য সংক্রান্ত একটি জরিপকার্য পরিচালনা করে এবং ১৯১৩ সালে তারা একটি প্রতিবেদন দাখিল করে। ১৯১৪ সালে প্রকাশিত এই পরিসংখ্যান সারণিগুলো ছিল পরিসংখ্যান শাস্ত্রের ইতিহাস এবং ঔপনিবেশিক ভারতের প্রাথমিক অগ্রগতিতে মূল্যবান অবদানস্বরূপ।
বিংশ শতাব্দীর প্রথমভাগে একটি স্বতন্ত্র শাস্ত্র হিসেবে পরিসংখ্যান স্বীকৃতি লাভ করে। তবে বঙ্গীয় প্রদেশসহ ভারতীয় উপমহাদেশে এই শাস্ত্রের বিকাশ ছিল অত্যন্ত ধীর। ১৯৩০ সালের প্রথম দিকে অধ্যাপক পি.সি মহলানবীশ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক পি.এন ব্যানার্জি এবং অধ্যাপক এন.আর সেন সহযোগে পরিসংখ্যান বিষয়ে উচ্চতর অধ্যয়নের লক্ষ্যে একটি এসোসিয়েশন গড়ার প্রস্তাব নিয়ে একটি সভা আহবান করেন। সভায় সর্বসম্মতিক্রমে অধ্যাপক আর.এন মুখার্জিকে সভাপতি এবং অধ্যাপক মহলানবীশকে সম্মানীয় সাধারণ সম্পাদক করে ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিসটিক্যাল ইনস্টিটিউট গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। একটি বেসরকারি ও অলাভজনক জ্ঞান বিতরণকারী সোসাইটি হিসেবে ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিসটিক্যাল ইনস্টিটিউট ১৯৩১ সালের ২৮ এপ্রিল তারিখে সরকারের নিবন্ধন পরিদপ্তরে নিবন্ধিত হয়। ১৯৩১ সালে কলকাতায় ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিসটিক্যাল ইনস্টিটিউট (আই.এস.আই) প্রতিষ্ঠা ছিল ভারতীয় উপমহাদেশে পরিসংখ্যান শাস্ত্রের বিকাশ ও উন্নয়নের ইতিহাসে একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ।
এই ইনস্টিটিউট পরিসংখ্যান গবেষণা ও প্রশিক্ষণ কার্যক্রমকে উৎসাহিত করা এবং অধিকতর সুসংগঠিত উপায়ে বৃহৎ নমুনা জরিপ পরিচালনার জন্য প্রচেষ্টা চালাতে থাকে। ইনস্টিটিউট ১৯৩৩ সাল থেকে সংখ্যা নামে একটি জার্নাল প্রকাশ শুরু করে। এ সময় অধ্যাপক মহলানবীশ দেশের উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে পরিসংখ্যান বিষয়ে পূর্ণাঙ্গ কোর্স চালু করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে পরিসংখ্যান বিষয়ে স্নাতকোত্তর বিভাগ খুলতে রাজি করান। ১৯৪১ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে নবগঠিত পরিসংখ্যান বিভাগের কার্যক্রম শুরু হয়। ১৯৪৪ সালে প্রেসিডেন্সি কলেজেও পরিসংখ্যান বিষয়ে সম্মান কোর্সে শিক্ষা দেওয়ার জন্য পৃথক বিভাগ চালু করা হয়। অনেকের মতে, এশিয়ায় পরিসংখ্যান বিষয়ে সম্মান কোর্স এটিই প্রথম।
প্রাথমিক পর্যায়ে উভয় বিভাগই প্রেসিডেন্সি কলেজে অবস্থিত স্ট্যাটিসটিক্যাল ল্যাবরেটরিতে অবস্থিত ছিল। অধ্যাপক মহলানবীশ ছিলেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় পরিসংখ্যান বিভাগের প্রধান, অন্যদিকে স্ট্যাটিসটিক্যাল ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক কে. মাধব ছিলেন প্রেসিডেন্সি কলেজের পরিসংখ্যান বিভাগের প্রধান। এই বিভাগের প্রথম দিকের কয়েকজন খ্যাতনামা শিক্ষক হলেন অধ্যাপক পি.কে বসু, অধ্যাপক মনি মুখার্জী, অধ্যাপক বি.এন ঘোষ, অধ্যাপক সুনীত গুপ্ত, অধ্যাপক অমলেন্দু নারায়ণ গাঙ্গুলী এবং অধ্যাপক পূর্ণেন্দু মোহন রায় যাঁদের জ্ঞান এবং ঐকান্তিক প্রচেষ্টা পরিসংখ্যান পঠন ও গবেষণাকে এগিয়ে নিতে সাহায্য করেছে।
ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিসটিক্যাল ইনস্টিটিউট শুরু থেকেই অধ্যাপক মহলানবীশের যোগ্য পরিচালনায় ভারত সরকারের অধীনে একটি নিখিল ভারতীয় প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়। ইনস্টিটিউটের কর্মকান্ডের পরিধি পরিসংখ্যানগত জ্ঞানের বিস্তার, গবেষণা, পরিসংখ্যানিক তত্ত্বসমূহের উন্নয়ন এবং প্রাকৃতিক ও সামাজিক বিজ্ঞানের বিভিন্ন ক্ষেত্রে এসকল তত্ত্বের প্রয়োগ পদ্ধতি নির্ণয়, জাতীয় পর্যায়ে উৎপাদন ও ব্যবস্থাপনায় দক্ষতা আনয়ন এবং পরিকল্পনা ও উন্নয়নের লক্ষ্যে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ ও বিশ্লেষণ এবং এ সংক্রান্ত বিভিন্ন প্রকল্প গ্রহণ প্রভৃতি ক্ষেত্রে বিস্তৃতি লাভ করে।
১৯৪৬ সাল পর্যন্ত কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ই ছিল এতদঞ্চলে পরিসংখ্যান শাস্ত্রে স্নাতকোত্তর অধ্যয়নের সুবিধা প্রদানকারী একমাত্র প্রতিষ্ঠান। ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু কর্তৃক ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিসটিক্যাল ইনস্টিটিউট (আই.এস.আই) অ্যাক্ট অব ১৯৫৯ অনুমোদনের মধ্য দিয়ে আই.এস.আই একটি জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে। সেই সঙ্গে ইনস্টিটিউট পরিসংখ্যান শাস্ত্রে ডিপ্লোমা ও উচ্চতর ডিগ্রি প্রদানের ক্ষমতা লাভ করে। এর পর থেকেই আই.এস.আই ভারতে পরিসংখ্যান তত্ত্বের উন্নয়ন ও চর্চায় একের পর এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে থাকে। এই ইনস্টিটিউটের মৌলিক অবদানসমূহের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে- নমুনা জরিপ, বহুচলক বিশ্লেষণ (multivariate analysis), পরীক্ষণ পরিকল্পনা (design of experiments) এবং অনুমিতির প্রচুরক (modes of inferences) ইত্যাদি বিষয়ের উন্নয়ন সাধন। তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান হচ্ছে ক্ষুদ্র এলাকা পরিসংখ্যান, পরিবেশগত পরিসংখ্যান এবং বায়েজিয়ান বিশ্লেষণ (Bayesian analysis)। ভারতের ‘ন্যাশনাল স্যাম্পল সার্ভে অর্গানাইজেশন’ (এন.এস.এস.ও) প্রতিষ্ঠায় এই ইনস্টিটিউটের ভূমিকা অগ্রগণ্য।
১৯৪৮ সালে পরিসংখ্যানগত গুণাগুণ নিয়ন্ত্রণ (Statistical Quality Control) আন্দোলনের জনক ডব্লিউ.এ শিউহার্ট (WA Shewhart) এর ভারত সফরের মধ্য দিয়ে ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিসটিক্যাল ইনস্টিটিউটও ভারতে এই আন্দোলন শুরু করে। পরিসংখ্যানগত গুণাগুণ নিয়ন্ত্রণ ভারতের সকল গুরুত্বপূর্ণ শিল্পকেন্দ্রে সম্প্রসারিত হয় এবং এ লক্ষ্যে শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ, ফলিত সেবা ও পরামর্শ বিষয়ে নিবিড় কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়।
অধ্যাপক পি.সি মহলানবীশের আগ্রহ ও উদ্যোগের ফলে ভারত বিশেষত বৃহত্তর বঙ্গে পরিসংখ্যান শাস্ত্র প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পায় এবং এর বিকাশ ও উন্নয়ন ঘটতে থাকে। সাম্রাজ্যের প্রয়োজন থেকে শুরু করে জাতীয় প্রয়োজন পূরণে পরিসংখ্যান শাস্ত্র বাংলায় তথা সমগ্র ভারতে সহায়ক ভূমিকা রাখে এবং একটি নবপ্রবর্তিত বিজ্ঞান শাস্ত্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়।
উপমহাদেশে পরিসংখ্যান শাস্ত্রের এই অগ্রযাত্রার ঢেউ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এসেও লাগে। ১৯৩৭-৩৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক এস.এন বোস একই বিভাগের কাজী মোতাহার হোসেনকে খ্যাতনামা অধ্যাপক পিসি মহলানবীশের তত্ত্বাবধানে পরিসংখ্যান সম্পর্কে জ্ঞান লাভের জন্য ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিসটিক্যাল ইনস্টিটিউটে প্রেরণ করেন। কাজী মোতাহার হোসেন ১৯৩৮ সালে আই.এস.আই থেকে পরিসংখ্যানে ডিপ্লোমা অর্জন করেন। একই সঙ্গে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গণিত শাস্ত্রে এম.এ ডিগ্রিও লাভ করেন। ১৯৩৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত ঢাকা কৃষি ইনস্টিটিউটে স্নাতকপূর্ব পর্যায়ে ছাত্রদের পরিসংখ্যান জ্ঞান প্রদান করার জন্য পরিসংখ্যান শাস্ত্রে প্রথম একটি নিয়মিত কোর্স চালু করা হয়। কাজী মোতাহার হোসেন এই কোর্সের শিক্ষক নিযুক্ত হন। মোতাহার হোসেন ১৯৫১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পরিসংখ্যান শাস্ত্রে ‘ডিজাইন অব এক্সপেরিমেন্টস’ শীর্ষক অভিসন্দর্ভের জন্য পিএইচ.ডি ডিগ্রি অর্জন করেন। প্রকৃতপক্ষে কাজী মোতাহার হোসেনই ছিলেন পূর্ব বঙ্গ তথা বাংলাদেশের প্রথম শিক্ষাগত পরিসংখ্যানবিদ। পরিসংখ্যান বিষয়ের ওপর তিনি বাংলা ভাষায় প্রথম তথ্য গণিত নামে একটি গ্রন্থ রচনা করেন যেটি পরিসংখা্যন শাস্ত্রের বিভিন্ন শব্দের অনুধাবনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ১৯৪০ সালে বি.এসসি সম্মান পর্যায়ে ঐচ্ছিক বিষয় হিসেবে পরিসংখ্যান কোর্স চালু করে। পরবর্তীতে ১৯৪১ সালে এম.এ ও এম.এসসি পর্যায়ে তা সম্প্রসারণ করা হয় এবং ১৯৪৪ সালে বি.এ পাস কোর্সে তা অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর পূর্ব পাকিস্তানে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত পরিসংখ্যানবিদের সংকট দেখা দেয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এ সংকট মোকাবেলায় এবং পূর্ব পাকিস্তানে পরিসংখ্যান শাস্ত্রের উন্নয়নে কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করে। ১৯৪৯ সালে পরিসংখ্যান শাস্ত্রকে গণিত বিভাগ থেকে পৃথক করা হয় এবং একটি পূর্ণাঙ্গ বিভাগ হিসেবে বি.এ/বি.এসসি পাস ও অনার্স কোর্সে এবং এম.এ/এম.এসসি কোর্সে পরিসংখ্যান শিক্ষা দেওয়া হতে থাকে। ১৯৫১ সালে পরিসংখ্যান বিভাগ থেকে এম.এ/এম.এসসি-র প্রথম ব্যাচ বের হয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ১৯৫২ সালের প্রথম দিকে একটি পরিসংখ্যান ইনস্টিটিউটের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে। এই ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠার প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্বাহী পরিষদ (বর্তমানে সিন্ডিকেট) কর্তৃক স্বতন্ত্র গঠনতন্ত্রসহ একটি পরিসংখ্যানগত জরিপ ও গবেষণা ইউনিট-এস.এস.আর.ইউ (Statistical Survey Research Unit-SSRU) প্রতিষ্ঠা করা হয়। অধ্যাপক কাজী মোতাহার হোসেন ছিলেন এই ইউনিটের পরিচালক এবং আ.ন.ম মনিরুজ্জামান ছিলেন এর সহকারী পরিচালক। জাতীয় পর্যায়ে বিভিন্ন জরিপকার্য যেমন- জনসংখ্যাগত জরিপ, জনসংখ্যা বৃদ্ধি প্রাক্কলন প্রভৃতি এই গবেষণা ইউনিটের মাধ্যমে সফলভাবে সম্পন্ন করা হয় এবং এসকল কর্মকান্ডের মধ্য দিয়ে এস.এস.আর.ইউ একটি পূর্ণাঙ্গ ইনস্টিটিউট হিসেবে প্রতিষ্ঠার দিকে এগিয়ে যায়। ১৯৬৪ সালে এস.এস.আর.ইউ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আওতায় পরিসংখ্যান গবেষণা ও প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট-আই.এস.আর.টি (Institute of Statistical Research and Training Institute) হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। অধ্যাপক কাজী মোতাহার হোসেন ছিলেন এই ইনস্টিটিউটের প্রথম পরিচালক। এই ইনস্টিটিউটের প্রধান লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ছিল পরিসংখ্যান বিষয়ে প্রশিক্ষণ ও উচ্চতর শিক্ষা প্রদান করা এবং পরিসংখ্যান পদ্ধতিতে জরিপ ও গবেষণাকার্য পরিচালনা করা। ১৯৬৭ সালের মার্চ মাসে অনুষ্ঠিত ইনস্টিটিউটের প্রথম সমাবর্তন অনুষ্ঠান উপলক্ষ্যে প্রকাশিত জার্নাল Bulletin of the Institute of Statistical Research and Training ছিল পরিসংখ্যান বিষয়ে প্রথম জার্নাল। বর্তমানে এটি Journal of Statistical Research নামে প্রকাশিত হচ্ছে। Journal of Demography নামে আরেকটি জার্নাল এই ইনস্টিটিউট থেকে প্রকাশিত হচ্ছে। আই.এস.আর.টি বর্তমানে ফলিত পরিসংখ্যানে বি.এসসি (সম্মান) এবং জনসংখ্যাতত্ত্বে (Demography) এম.এসসি কোর্সসহ পরিসংখ্যান শাস্ত্রে বিভিন্ন সংক্ষিপ্ত কোর্স পরিচালনা করছে।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ১৯৬১ সালে একটি পূর্ণাঙ্গ পরিসংখ্যান বিভাগ প্রতিষ্ঠা করে। ১৯৭০ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ও পরিসংখ্যান বিভাগ প্রতিষ্ঠা করে। দক্ষ কৃষি পরিসংখ্যানবিদ তৈরির লক্ষ্যে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ১৯৬৩ সালে কৃষি পরিসংখ্যান বিভাগ চালু করে।
স্বাধীনতার পর সীমিত সম্পদ এবং সীমাহীন চাহিদার প্রেক্ষাপটে দেশের উন্নয়ন করতে গিয়ে পরিসংখ্যানের গুরুত্ব তীব্রভাবে অনুভূত হয়। এই লক্ষ্যে সরকার ১৯৭৪ সালের আগস্ট মাসে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো-বিবিএস (Bangladesh Statistical Bureau- BBS) প্রতিষ্ঠা করে এবং সেইসঙ্গে ১৯৭৫ সালে সাধারণভাবে মন্ত্রণালয় পর্যায়ে পরিসংখ্যানগত তথ্য ও উপাত্ত সরবরাহ করার উদ্দেশ্যে অর্থ ও পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের অধীনে একটি পরিসংখ্যান বিভাগ খোলা হয়। জাতীয় পর্যায়ে নীতি নির্ধারণকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে সরকার ১৯৭৭ সালে জাতীয় পরিসংখ্যান পরিষদ (National Statistical Council) গঠন করে। অর্থ ও পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে নিয়োজিত মন্ত্রী জাতীয় পরিসংখ্যান পরিষদের সভাপতি এবং সরকারের পরিসংখ্যান বিভাগের সচিব সহ-সভাপতির দায়িত্ব পালন করে থাকে। শিক্ষা সংক্রান্ত উপাত্ত সংগ্রহ, সম্পাদনা, সংরক্ষণ এবং বিতরণের লক্ষ্যে ১৯৭৭ সালে বাংলাদেশ ব্যুরো অব এডুকেশন ইনফরমেশন এন্ড স্ট্যাটিসটিকস (Bangladesh Bureau of Education Information and Statistics) প্রতিষ্ঠা করা হয়।
স্বাধীনতা পরবর্তীকালে ব্যাপক সংখ্যক পরিসংখ্যান প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠার প্রেক্ষাপটে দেশে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত পরিসংখ্যানবিদের প্রয়োজনীয়তা সৃষ্টি হয়। এ প্রয়োজন মোকাবেলায় ১৯৭১ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় পূর্ণাঙ্গ পরিসংখ্যান বিভাগ প্রতিষ্ঠা করে এবং পরবর্তীতে ১৯৯২ সালে সিলেটে অবস্থিত শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় পরিসংখ্যান বিভাগ খোলে। বর্তমানে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ, চট্টগ্রাম সরকারি কলেজ এবং রাজশাহী সরকারি কলেজে পূর্ণাঙ্গ পরিসংখ্যান বিভাগ রয়েছে। উল্লিখিত বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজসমূহ, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়, বিভিন্ন বিআইটি পরিসংখ্যান বিষয়ে বি.এসসি (সম্মান), বি.এসসি (পাস) এবং এম.এসসি ডিগ্রি প্রদান করছে। এছাড়াও বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজের বিজ্ঞান, বাণিজ্য, সামাজিক বিজ্ঞান এবং কলা অনুষদের বিভিন্ন বিভাগসমূহ তাদের বিষয়ের প্রয়োজনে শিক্ষার্থীদের পরিসংখ্যান কোর্স প্রদান করে থাকে। দেশের উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা পাঠ্যক্রমে পরিসংখ্যান বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
দেশের পরিসংখ্যানবিদগণ ১৯৭০ সালের প্রথমার্ধে বাংলাদেশ স্ট্যাটিসটিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন গঠন করে। প্রতি বছর এই অ্যাসোসিয়েশন বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিসংখ্যান বিষয়ে সেমিনার, সিম্পোজিয়াম, ওয়ার্কশপ প্রভৃতির আয়োজন করে থাকে। প্রতি দুই বছর অন্তর অন্তর অ্যাসোসিয়েশন পরিসংখ্যান সংক্রান্ত জাতীয় সম্মেলনের আয়োজন করে আসছে। [মণীন্দ্র কুমার রায়, মধুমিতা মজুমদার এবং মতিউর রহমান]