ঢাকা কলেজ

ঢাকা কলেজ  বাংলাদেশের অন্যতম প্রাচীন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। ১৮৩৫ সালের ১৫ জুলাই  ‘ঢাকা গভর্নমেন্ট স্কুল’ নামে  এটি যাত্রা শুরু করে। এর মাধ্যমে ঢাকাতেই বাংলার প্রথম সরকারি ইংরেজি স্কুল স্থাপিত হয়। স্কুলের জন্য সদরঘাটের কাছে  ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির পুরানো দোতলা বাণিজ্য কুঠিটি ভাড়া নেওয়া হয়। সরকারের এই উদ্যোগের সঙ্গে স্থানীয়রা গভীর উৎসাহের সাথে সাহায্য ও সহযোগিতা নিয়ে এগিয়ে আসে। ঢাকার খুব কাছেই অবস্থিত বৈরাগিদী গ্রামের অধিবাসী ও কলকাতার সদর বোর্ড অব রেভেনিউ এর সেরেস্তাদার বা অফিস প্রধান রামলোচন ঘোষ স্কুলটির জন্য এক হাজার টাকা অনুদান দেন এবং ঢাকার অন্যান্য সুধীজনও সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন। এই অনুদান খুব শিগগিরই ৫ হাজার টাকায় উন্নীত হয়। স্কুলটির প্রশাসনিক ও অন্যান্য দায়িত্ব পালন করার জন্য একটি স্থানীয় কমিটি বা লোকাল পাবলিক ইনস্ট্রাকশন কমিটি গঠন করা হয়।  

প্রথম ঢাকা কলেজ ভবন

ঢাকাতে নতুন ইংরেজি শিক্ষার প্রবর্তনে প্রথমে এগিয়ে আসেন শ্রীরামপুরের ব্যাপটিস্ট মিশনারিরা। ১৮১৫ সালে তারা মূলত গরিব ইউরোপিয়ান এবং ইউরোশিয়ান সন্তানদের শিক্ষার জন্য ক্যালকাটা বেনেভোলেন্ট ইনস্টিটিউশন-এর একটি শাখা খোলার নিমিত্তে রেভারেন্ড ওয়েন লিওনার্দ নামে একজন আয়ারল্যান্ডবাসীকে ঢাকাতে পাঠান। ১৮১৬ সালের এপ্রিল মাসে লিওনার্দ চকবাজারের কাছে ছোট কাটরা ভবনে ঢাকার প্রথম ইংরেজি স্কুল খোলেন। ঐ বছরই গ্রিক ও আর্মেনিয়ানসহ ৩৯ জন শিক্ষার্থী নিয়ে এই স্কুলটি যাত্রা শুরু করে। শিক্ষার্থীদের ইংরেজি, ব্যাকরণ, গণিত, বাইবেল ওয়াট্সের হিম অর্থাৎ ধর্ম সংগীত আর ক্যাটেসিজমের (প্রশ্নোত্তর) মাধ্যমে ধর্ম শিক্ষা দেওয়া হত। এ স্কুল প্রতিষ্ঠার প্রধান উদ্দেশ্য ছিল স্থানীয়দের খ্রিস্টান ধর্মে দীক্ষিত করা। ১৮১৭ সালে মুসলমান ছাত্রদের আকর্ষণ করার জন্য লিওনার্দ ৭টি বাংলা স্কুল খোলেন। এ সময় ইংরেজি স্কুলটিকেও অখ্রিস্টান ছাত্রছাত্রীদের জন্য খুলে দেন। উজ্জ্বল সম্ভাবনা নিয়ে এ স্কুলটি যাত্রা শুরু করলেও লিওনার্দের মৃত্যুর পর স্কুলটি বন্ধ হয়ে যায়।

সে সময় দেশের শিক্ষাব্যবস্থা সম্পর্কিত দায়িত্বশীল কর্তৃপক্ষ ‘জেনারেল কমিটি অব পাবলিক ইনস্ট্রাকশন’ লর্ড বেন্টিং-এর কাছে ১৮৩৫ সালের ২০ এপ্রিল পেশকৃত এক প্রতিবেদনে সরকারের বরাদ্দকৃত অর্থ দিয়ে বাংলা প্রেসিডেন্সির প্রধান প্রধান জনবহুল শহরে ইংরেজি সাহিত্য ও বিজ্ঞান শিক্ষা দেওয়ার জন্য যতগুলি সম্ভব স্কুল খোলার প্রস্তাব করেন। এ কার্যক্রম ঢাকা এবং পাটনা দিয়ে শুরু করার সুপারিশও করেন। কমিটি ঢাকায় স্কুল খোলার সম্ভাবনা এবং প্রয়োজনে আর্থিক সহায়তা মিলবে কিনা জানতে চান। উত্তরে ঢাকার সিভিল সার্জন ডাঃ জেমস টেইলর কমিটিকে জানান যে, এ ধরণের স্কুলের জন্য ঢাকা শুধু উপযুক্ত জায়গাই নয় বরং এটিকে ঢাকার জনগণ দারুণভাবে স্বাগত জানাবে এবং প্রয়োজনে অর্থ সহায়তাও দিবে। এই উৎসাহব্যঞ্জক সংবাদ প্রাপ্তির পর জেনারেল কমিটি ভারত সরকারকে অবিলম্বে ঢাকায় একটি সরকারি স্কুল প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব দেন এবং ব্যয় বাবদ বার্ষিক ৬ হাজার টাকা বরাদ্দ দেন। ১৮৩৫ সালের ২৪ জুন ভারত সরকার এই প্রস্তাব গ্রহণ করে। এ উদ্দেশ্যে কমিটি কলকাতা থেকে দু’জন শিক্ষক জে. রিজ  এবং পার্বতী চরণ সরকারকে স্কুল প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে ঢাকায় প্রেরণ করেন। ১৮৩৫ সালের ১৫ জুলাই সদরঘাটের কাছে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির পুরানো দোতলা বাণিজ্য কুঠিতে স্কুলটি আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করে এবং নাম দেওয়া হয় ‘ঢাকা গভর্নমেন্ট স্কুল’। স্কুলটির প্রশাসনিক ও অন্যান্য দায়িত্ব পালন করার জন্য একটি লোকাল কমিটি অব পাবলিক ইনস্ট্রাকশন বা স্থানীয় কমিটি গঠন করা হয়।

ঢাকা গভর্নমেন্ট স্কুল প্রতিষ্ঠা ঢাকা শহরের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিমন্ডলে এক নবযুগের সূচনা করে। এ বিদ্যালয়ের মাধ্যমে পাশ্চাত্যের আধুনিক কলাবিদ্যা, বিজ্ঞান এবং দর্শনের সঙ্গে এ অঞ্চলের শিক্ষার্থীদের প্রথম পরিচয় ঘটে। এই নতুন শিক্ষার আলোকে শিক্ষার্থীরা দেশ ও সমাজকে নবরূপে গড়তে প্রয়াসী হয়। ইংরেজি শিক্ষার চাহিদা বৃদ্ধির সাথে সাথে ছাত্রসংখ্যাও দিন দিন বৃদ্ধি পেতে থাকে।

১৮৩৮-৩৯ শিক্ষাবর্ষে ঢাকা গভর্নমেন্ট স্কুলে ৮টি ক্লাস ছিলো এবং ছাত্র সংখ্যা ছিল ৩৪০। শিক্ষকদের মধ্যে ছিলেন ৭ জন ইংরেজ এবং ৪ জন বাঙালি। ১৮৪১ সালে স্কুলটি কলেজের মর্যাদায় উন্নীত হয় এবং এর নাম হয় ‘ঢাকা সেন্ট্রাল কলেজ’। ১৮৪১ সালের ২০ নভেম্বর কলকাতার বিশপ রেভারেন্ড ড্যানিয়েল সদরঘাটে কলেজের মূল ভবনের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন এবং ভবনটির নির্মাণ কাজ শেষ হয় ১৮৪৪ সালে। প্রথম ব্যাচের ছাত্রদের মধ্যে ছিল প্রধানত মুসলমান, হিন্দু, আর্মেনীয় এবং পর্তুগিজ। ব্যবসায়িক কারণে তখন ঢাকায় অনেক আর্মেনীয় ও পর্তুগিজ বাস করতেন। ১৮৭৩ সালে স্থান সঙ্কুলানের অভাবে ভিক্টোরিয়া পার্কের পূর্বে একটি প্রশস্ত দালানে কলেজটি সরিয়ে নেওয়া হয়। সেখান থেকে আবার ১৯০৮ সালে বর্তমান কার্জন হলে স্থানান্তরিত করা হয়।

১৯১৪ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে তার প্রভাব ঢাকা কলেজের উপরও এসে পড়ে। শিক্ষা-দীক্ষার কাজে এবং অন্যান্য নানাবিধ উন্নয়ন কর্মকান্ডে তাই ভাটা পড়ে এমনকি কলেজ ভবনগুলি সামরিক বাহিনীর দখলে চলে যাওয়ারও নানা রকম সম্ভাবনা দেখা দেয়। কৌশলগত কারণে ১৯২০ সালের জুলাই মাস থেকে ঢাকা কলেজের ইন্টারমিডিয়েট অর্থাৎ এফ.এ ক্লাসকে কলেজের বি.এ, বি.এস.সি এবং এম.এ, এম.এস.সি ক্লাস থেকে পৃথক করে নতুন একটি ঢাকা ইন্টারমিডিয়েট কলেজ গঠন করা হয়। এই নব গঠিত ইন্টারমিডিয়েট কলেজকে ২০ আগস্ট কার্জন হল থেকে সরিয়ে তদানীন্তন ইঞ্জিনিয়ারিং স্কুলে প্রতিষ্ঠা করা হয়। ১৯২১ সালের ১ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শুভ উদ্বোধনকে নির্ঝঞ্ঝাট করার উদ্দেশ্যে কলেজের অপর অংশটিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে একীভূত করে নেয়া হয়। একই সাথে প্রাক্তন ঢাকা কলেজের শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ বহু পুস্তক, বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি ইত্যাদি নতুন বিশ্ববিদ্যালয়কে সরবরাহ করে এবং এর যাত্রাকে সুগম করে দেয়। নতুন আদেশ বাস্তবায়নের ঠিক আগে, ১৯২১ সালের ৩১ মার্চ ঢাকা কলেজের মোট ছাত্র সংখ্যা ছিল ৭২৯। এদের মধ্যে ৫৫০ জন হিন্দু এবং ১৭৯ জন ছিল মুসলমান। ১৯২১ সাল থেকে  ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কার্যক্রম আরম্ভ করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় এবং এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে ঢাকা কলেজটিকে অন্য ভবনে অর্থাৎ সে সময়কার প্রকৌশল বিদ্যালয়ে স্থানান্তর করা হয়। ১৯২১ সালের ১ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হলে ঢাকা কলেজকে ছোটলাটের  বাস ভবনে (বর্তমান ল’কমিশন এবং বিচার প্রশাসন প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট) স্থানান্তর করা হয়। ইঞ্জিনিয়ারিং স্কুলকে কলেজের হোস্টেলে রূপান্তরিত করা হয় এবং ইঞ্জিনিয়ারিং স্কুলটি সেক্রেটারিয়েট বিল্ডিংয়ে স্থানান্তর করা হয়। এছাড়া কলেজের অন্যান্য অবকাঠামোও সদ্য প্রতিষ্ঠিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে ভাগাভাগি করতে হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে আহত সৈন্যদের পুনর্বাসনের জন্য ভবনটি ছেড়ে দিতে হয় এবং আবার ঢাকা কলেজ লক্ষ্মীবাজারে স্থানান্তরিত হয়। ১৯৫৫ সালে কলেজটি বর্তমান জায়গায় স্থানান্তরিত হয়। বর্তমানে কলেজটি ১৮ একর জমির উপর প্রতিষ্ঠিত।

ঢাকা কলেজে ড. টি ওয়াইজ, ডব্লিউ ব্রেনাড, ডব্লিউ বুথ, এফ.সি টার্নার, এ.জে আর্চিবল্ড এবং ড. পি.কে রায়ের মতো বহু প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। এছাড়া  শওকত ওসমান, আশরাফ সিদ্দিকী, আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদ, আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের মত খ্যাতিমান ব্যক্তিরাও এ কলেজে অধ্যাপনা করেছেন। ঢাকা কলেজের প্রথম দিকের স্নাতকদের তালিকায় ছিলেন খান বাহাদুর বজলুর রহিম, চট্টগ্রাম বিভাগের স্কুল পরিদর্শক আবদুল আজিজ, কলকাতার অতিরিক্ত প্রধান প্রেসিডেন্সি ম্যাজিস্ট্রেট জাহেদুর রহমান জাহেদ, ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম নিবন্ধক  নাজিরউদ্দীন আহমদ এবং বিদেশি ছাত্রদের মধ্যে ছিলেন মালদ্বীপের প্রেসিডেন্ট ড. মামুন আব্দুল গাইউম। ১৮৫৮ সালের পর কলেজটি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত হয়। ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর কলেজটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত হয়। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত থাকাকালীন এ কলেজে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর কোর্স চালু ছিল। পরবর্তীকালে ১৯৭৪ সালে কলেজে পুনরায় স্নাতক ও স্নাতকোত্তর কোর্স প্রবর্তন করা হয়। ১৯৯২ সালে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর কলেজটিকে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত করা হয়। বর্তমানে একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণির পাশাপাশি কলা, সামাজিক বিজ্ঞান, ব্যবসায় শিক্ষা এবং বিজ্ঞান অনুষদের অধীনে ১৯টি বিভাগে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর কোর্স রয়েছে। এই কলেজের আবাসিক ছাত্রদের সুবিধার্থে তিনটি ছাত্রাবাস আছে। বর্তমানে (২০১০) কলেজে শিক্ষার্থী সংখ্যা প্রায় ১৮ হাজার এবং শিক্ষক-শিক্ষিকার সংখ্যা ২৪০।  [শরীফ উদ্দিন আহমেদ]