সরস্বতী, সরসীকুমার
সরস্বতী, সরসীকুমার (১৯০৬-১৯৮০) ভারতীয় শিল্পকলা ও স্থাপত্য শিল্পের ঐতিহাসিক। তিনি রাজশাহীতে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৩০ সালে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রাচীন ভারতীয় ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিষয়ে এম.এ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। আদি ভারতীয় চারুকলা, বিশেষত ভাস্কর্য, মূর্তিতত্ত্ব এবং স্থাপত্যশিল্প, অধ্যয়নের ব্যাপারে তিনি দুজন অদম্য ও স্থিরসঙ্কল্প ব্যক্তি, রমাপ্রসাদ চন্দ ও অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়র নিকট থেকে উৎসাহ লাভ করেন। তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ও বিশ্ব-ভারতী উভয় প্রতিষ্ঠানে শিক্ষাদানকারী প্রসিদ্ধ শিল্পকলা ইতিহাসবিদ অধ্যাপক স্টেলা ক্রামরিশ কর্তৃকও প্রভাবান্বিত হয়েছিলেন।
তিনি বরেন্দ্র রিসার্চ সোসাইটিতে গবেষক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। এ প্রতিষ্ঠান বাংলার ইতিহাসের ওপর অনেক পথিকৃৎমূলক গবেষণা প্রকল্প চালু করে। বাংলার আদি শিল্পকলা ও স্থাপত্যশিল্পের নমুনা সম্পর্কে তথ্য আহরণের উদ্দেশ্যে এবং এতদ্সম্পর্কে নতুন কিছু আবিষ্কারের লক্ষ্যে তিনি উত্তরবঙ্গে বেশ কয়েকটি অনুসন্ধাণমূলক ভ্রমণ করেন। এ ভ্রমণের মাধ্যমে তিনি যা কিছু আবিষ্কারে সফল হন সে বিষয়াবলি সম্বলিত রিপোর্টসমূহ ১৯৩২-৩৪ সালের মধ্যে Journal and Proceedings of the Asiatic Society of Bengal -এ প্রকাশিত হয় এবং এগুলি পন্ডিতদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে।
এস.কে সরস্বতী কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাচীন ভারতীয় ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগে প্রভাষক হিসেবে যোগদান করেন এবং অতঃপর রীডার পদে উন্নীত হন। ১৯৬৩ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ খোলা হলে তিনি এর প্রথম অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান নিয়োজিত হন। তিনি ১৯৬৫ থেকে ১৯৭২ সাল পর্যন্ত সাত বছর বারাণসীর বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রাচীন ভারতীয় ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান ছিলেন। কিছুকালের জন্য তিনি কলকাতার এশিয়াটিক সোসাইটির গ্রন্থাগারিক এবং ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের তত্ত্বাবধায়কও ছিলেন।
রমেশচন্দ্র মজুমদার কর্তৃক সম্পাদিত History of Bengal-এর ১ম খন্ডে ( ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ১৯৪৩) স্থাপত্যশিল্পের ওপর একটি পরিচ্ছেদ লিখে দেওয়ার দায়িত্ব তাঁর ওপর অর্পিত হয়। তিনি ১২০০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত বাংলার স্থাপত্যশিল্পের ওপর নির্ভরযোগ্য, তথ্যসমৃদ্ধ একটি জরিপ উপস্থাপন করেন, যদিও এ গবেষণাকর্ম পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় উপাদান ছিল অত্যন্ত স্বল্প। বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ ছিল উত্তরবঙ্গের পাহাড়পুর বৌদ্ধ বিহারের কেন্দ্রীয় মন্দির সম্পর্কে তাঁর গবেষণা। এর পরিকল্পনাকে তিনি স্থাপত্যশিল্পের ‘সর্বতোভদ্র’ নমুনা হিসেবে সাফল্যজনকভাবে শনাক্ত করেন যা মায়ানমারের পাগানে (বাগানে) অবস্থিত মন্দিরের গঠন প্রণালীকেও প্রভাবান্বিত করেছিল। শুরু থেকে তিনি বলিষ্ঠ প্রত্নতাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে স্থাপত্যশিল্প অধ্যয়ন করেন। ভারতীয় স্থাপত্যশিল্পের ওপর গবেষণা পরিচালনা করতে গিয়ে তিনি তাঁর পূর্ববর্তী পন্ডিতদের অনুসৃত দার্শনিক ও অতীন্দ্রিয়বাদী দৃষ্টিকোণ পরিহার করে চলেন।
১৯৫০-এর দশকে আর.সি মজুমদারের সম্পাদনায় যখন The History and Culture of the Indian People লেখার কাজ শুরু হয় তখন এর বিভিন্ন খন্ডের জন্য স্থাপত্যশিল্পের ওপর অনেকগুলি অনুচ্ছেদ লিখে দেওয়ার ব্যাপারে এস.কে সরস্বতীকে মনোনীত করা হয়। মূল্যবান অভিজ্ঞতালব্ধ পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে বর্ণনা সহযোগে ভারতীয় স্থাপত্যশিল্পের বিভিন্ন দিকের ওপর তিনি যে একটি ব্যাপক জরিপ সরবরাহ করেছেন শুধু তাই নয়, স্থাপত্যশিল্পের ইতিহাসকে তিনি বিশিষ্ট ও চমৎকার রচনাশৈলী সম্পন্ন দৃষ্টিভঙ্গি থেকেও উপস্থাপন করেছেন। এভাবে তিনি স্তূপ, চৈত্য এবং মন্দির স্থাপত্য সমূহের গঠনরীতির ক্রমবিকাশকে জনসমক্ষে প্রকাশ করেন।
তিনি যে উত্তর ভারত, দাক্ষিণাত্য ও দক্ষিণের মন্দিরের স্থাপত্যশিল্পের বিভিন্ন আঞ্চলিক গঠন-সংক্রান্ত পার্থক্যের ওপর নিবিড় গবেষণা চালিয়েছেন তা মধ্যযুগের গোড়ার দিককার মন্দির স্থাপত্যশিল্পের ক্রমোন্নতির সর্বভারতীয় কারুকার্যের নকশা সম্পর্কে পাঠককে একটি ভাল ধারণা প্রদান করে। তিনি Comprehensive History of India, ২য় খন্ড (কে.এ নীলকান্ত শাস্ত্রী কর্তৃক সম্পাদিত) ও ৩য় খন্ড (আর.সি মজুমদার কর্তৃক সম্পাদিত) এবং Jaina Art and Architecture (এ ঘোষ কর্তৃক সম্পাদিত) গ্রন্থসমূহে স্থাপত্যশিল্পের ওপর গুরুত্বপূর্ণ অনুচ্ছেদসমূহ লিখেও সেগুলিকে সমৃদ্ধ করেছেন। রচনাশৈলীর দিক থেকে ভারতীয় শিল্পকলার ইতিহাসের ওপর বিশেষজ্ঞগণ ভারতীয় স্থাপত্যশিল্পের ওপর গবেষণার ক্ষেত্রে তাঁর স্বকীয় পদ্ধতি অনুসরণ করেছেন। বঙ্গে স্থাপত্যশিল্পের ওপর পূর্ণদৈর্ঘ্য প্রবন্ধ রচনার কৃতিত্বও তাঁর।
এস.কে সরস্বতী প্রধানত ভারতীয় স্থাপত্যশিল্পের ইতিহাসে একজন বিশেষজ্ঞ হিসেবে পরিচিত হলেও তাঁর Early Sculptures of Bengal এবং A Survey of Indian Sculpture গ্রন্থদ্বয়ে তিনি ভাস্কর্যশিল্প সম্পর্কেও তাঁর গভীর পান্ডিত্যের ছাপ রেখেছেন। স্থাপত্যশিল্পের মতো ভাস্কর্যশিল্পের ইতিহাসের উপরও তাঁর প্রধান গুরুত্ব ছিল রচনাশৈলী ও প্রকাশভঙ্গির ওপর। শিল্পকলার ইতিহাসের ওপর তাঁর রচনাসমূহের আরেকটি উৎকর্ষ নির্দেশক ছাপ ছিল মূর্তিতত্ত্বের মতো জটিল বিষয়ে (ব্রাহ্মণ, বৌদ্ধ ও জৈন সম্পর্কিত) তাঁর অসাধারণ দখল। এটি বিশেষভাবে প্রতীয়মান হয় তাঁর Tantrayana Art, an Album গ্রন্থে, যা ছিল জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান (ইউনেস্কো)-এর একটি প্রকল্পের ফল। এটি কলকাতার এশিয়াটিক সোসাইটি কর্তৃক প্রকাশিত হয়।
তাঁর জীবনের শেষ অধ্যায়ে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান হলো পাল যুগের চিত্রকলা গ্রন্থখানি, যেখানে তিনি বাংলার ইতিহাসে পাল যুগের হস্তাঙ্কিত রঙিন চিত্রের বিশ্লেষণ করেছেন। স্বাভাবিকভাবেই তিনি হস্তাঙ্কিত রঙিন চিত্রের ক্রমোন্নতিকে রচনাশৈলীর দৃষ্টিকোণ থেকে আলোচনা করেছেন এবং ভারতীয় মূর্তিতত্ত্বে তাঁর বিচক্ষণ বোধশক্তি দ্বারা তিনি এ সকল রঙিন চিত্রে অনেক অর্ধস্ফুট বৌদ্ধ দেবতাকে শনাক্ত করেছেন। অক্লান্ত প্রচেষ্টার মাধ্যমে, এমনকি তাঁর মৃত্যুশয্যায়ও, তিনি আসামের স্থাপত্যশিল্পের ইতিহাসের ওপর একটি অনুচ্ছেদ রচনার কাজ সমাপ্ত করেন (Comprehensive History of Assam-এর জন্য)। [রনবীর চক্রবর্তী]