চৈত্য

চৈত্য  বৌদ্ধ প্রার্থনালয় যার অভ্যন্তরে স্তূপ সংস্থাপিত থাকে। সংস্কৃত চিতা শব্দটি থেকে চৈত্য শব্দের উৎপত্তি। কোন মানুষের মৃতদেহ পুড়িয়ে ফেলার পর একটা নির্দিষ্ট স্থানে দেহভস্ম স্তূপ আকারে সংরক্ষণ করার স্থানকে চিতা বলা হয়। সাধারণত মৃতদেহ পোড়ানোর স্থানকেই চিতা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। কালক্রমে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের নিকট মৃতের ভষ্ম বা ছাই এবং মৃতের ব্যবহূত জিনিসপত্রের উপর নির্মিত ঢিবি চৈত্যের রূপ পরিগ্রহ করে এবং তা ভক্তি প্রদর্শনের পবিত্র স্থানে পরিণত হয়। ভক্তি প্রদর্শনের জন্য বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের নিকট চৈত্য এবং স্তূপ উভয়ই পবিত্র স্থান হিসেবে পরিগণিত। তবে বৌদ্ধ সূতপ-এর প্রাথমিক স্তর হিসেবে চৈত্যকে চিহ্নিত করা যেতে পারে। ভারতীয় স্থাপত্যকলার আধুনিক সংজ্ঞায় চৈত্যকে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের সূতপ সংস্থাপিত ধর্মীয় সভাগৃহ বা প্রার্থনা গৃহের সমার্থক বলে উপস্থাপিত হয়েছে। এ ক্ষেত্রে চৈত্যকে ‘গৃহ’ বলা হয়েছে। স্থাপত্যিক নকশার ক্ষেত্রে চৈত্যেগৃহে স্তম্ভ এবং খিলান সংযুক্ত থাকে যা রোমান স্থাপত্যকলার সঙ্গে সদৃশ্য। প্রাথমিককালে বৌদ্ধভিক্ষুগণ খালি হাতে হাঁতুরির সাহায্যে সম্পূর্ণ একটি অখন্ড পাহাড় বা পাথর খন্ডকে কেটে চৈত্যগৃহ বানাতো। এ ধরনের চৈত্যগৃহকে ‘গুহা মন্দির’ও বলা হত। সমগ্র ভারতে এ ধরনের প্রায় ১২০০ চৈত্যগৃহ নির্মিত হয়েছিল। এদের মধ্যে অজন্তা ও ইলোরার চৈত্যসমূহ অধিক গুরুত্বপূর্ণ। চৈত্যের অভ্যন্তরেই স্তূপ সংস্থাপিত হত।

ধাতুর তৈরি চৈত্য


খ্রিস্টপূর্ব ২০০ অব্দে পাথর কেটে প্রাচীনতম চৈত্য নির্মাণের প্রমাণ পাওয়া যায়। স্তূপ এর মতো চৈত্যও বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের নিকট পবিত্র সত্ত্বার প্রকৃতি ও জ্ঞানের প্রতীকী উপস্থাপনা। তাদের বিশ্বাসে চৈত্য হলটি বিশ্বব্রহ্মান্ডের একটি ক্ষুদ্র সৃষ্টি এবং এর খিলানযুক্ত প্রবেশ পথটি পৃথিবীতে প্রবেশ করার প্রতীকী পথ হিসেবে বিবেচিত। এ ধরনের গৃহ সাধারণত নদী বা খালের পাড়ে নির্মিত হত। খ্রিস্টপূর্ব তিন শতকে ইট নির্মিত সর্ববৃহৎ চৈত্যগৃহটি বিশাখাপট্টমে খননের ফলে আবিষ্কৃত হয়েছে। অন্ধ্রপ্রদেশের পূর্বাঞ্চলীয় জেলাসমূহে সর্বাধিক সংখ্যক চৈত্যের অস্তিত্বের সন্ধান পাওয়া গেছে। অজন্তা-ইলোরা, ভজ, বাগ প্রভৃতি স্থানে পাথর কেটে বানানো মনোরম বেশ  কয়েকটি চৈত্যের অস্তিত্ব বিদ্যমান। মহারাষ্ট্রের অজন্তায় অবস্থিত ইট ও কাঠের তৈরি চৈত্যসমূহ বৌদ্ধদের প্রাথমিক পর্যায়ের থেরবাদ শাখা কর্তৃক নির্মিত হয়েছিল। চৈত্যসমূহ পাঁচ শতক থেকে নয় শতকের মধ্যে নির্মিত। প্রায় একই ধরনের চৈত্য সম্রাট অশোকের সময়েও নির্মিত হয়েছে। কোন কোনো চৈত্যের প্রবেশদ্বারের খিলানে কাঠ ব্যবহূত হতে দেখা গেছে। বৌদ্ধ স্থাপত্যের দ্বিতীয় পর্যায়ে, বিশেষ করে মহাযান বৌদ্ধ ধারা চলাকালে এ ধরনের চৈত্য গৃহসমূহ নির্মিত হয়েছে। ভজ গুহার চৈত্যসমূহ খ্রিস্টপূর্ব এক শতকে নির্মিত ও স্তূপ সংস্থাপিত অর্ধবৃত্তাকার হলের মতো এবং চৈত্যের দেয়াল ছিল মৌর্য স্টাইলে পলিশ করা।

সম্ভবত এক সঙ্গে অনেক ভক্তদের এক স্থানে সমবেত করার অথবা তাদের আশ্রয় প্রদানের উদ্দেশ্যে চৈত্যগৃহের ধারণার জন্ম হয়েছিল। বাংলাদেশে এ ধরণের কোন চৈত্যের অস্তিত্বের সন্ধান মেলেনি। তবে জাতীয় জাদুঘরে ক্ষুদ্র আকারের ধাতুর তৈরি চৈত্যের নমুনা রয়েছে।  [নাসরীন আক্তার]