স্তূপ

স্তূপ মূলত পালি শব্দ। পরে সংস্কৃত শব্দে একীভূত হয়। স্তূপ এর বুৎপত্তিগত অর্থ গাদা বা ঢিবি। দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশে একে ‘চেদী’ও বলা হয় (এটি পালি শব্দ, চৈত্য এর সমার্থক)। শ্রীলংকায় বলা হয় ‘দাগোবা’ (সংস্কৃত শব্দ ধাতু এর সমার্থক) বা ‘টপে’(হিন্দি টপ বা চূড়া শব্দের সমার্থক)। সংস্কৃত স্তূপা বা স্তূপ থেকে এর উৎপত্তি। চীনা ভাষায় একে প্যাগোডা বলা হয়। কখন, কী উদ্দেশ্যে এ ধরনের ঢিবি বা স্তূপ নির্মাণ শুরু হয় তা নিশ্চিত করে বলার মতো কোন উৎসের সন্ধান মেলেনি। তবে প্রাথমিকভাবে জৈনধর্মে স্তূপ নির্মাণের রেওয়াজ ছিল। বৈদিক যুগেও দেহাবশেষ বা দেহাস্থি চাপা দেয়ার উদ্দেশ্যে শ্মশানের উপর মাটির  স্তূপ নির্মিত হতো। বৌদ্ধ স্তূপই সর্বপ্রাচীন ধর্মীয় স্থাপত্যিক নিদর্শন হিসেবে স্বীকৃত এবং এটি বুদ্ধের আলোকিত মন এবং তা বোধগম্য হওয়ার পথ হিসেবে চিহ্নিত। বৌদ্ধ ধর্মে স্তূপ গৌতম বুদ্ধের দেহ, তাঁর বাণী এবং তাঁর আত্মাকে প্রতিনিধিত্ব করে। বৌদ্ধ সাহিত্য দীর্ঘনিকায়ের অন্তর্গত মহাপরিনির্বাণ সূত্র নামক সংকলন থেকে জানা যায় যে, মহাপরিনির্বাণের (মৃত্যুর) সময় গৌতম বুদ্ধ শিষ্য আনন্দকে তাঁর দেহভষ্মের উপর স্তূপ নির্মাণের ইঙ্গিত দিয়েছিলেন।

কুটিলা মুড়া ত্রিরত্ন স্তূপ, ময়নামতী

বুদ্ধের দেহাবশেষ সৎকার ও সংরক্ষণ সম্পর্কিত এক প্রশ্নের উত্তরে বুদ্ধ বলেছিলেন যে, চারবুদ্ধের অর্থাৎ বুদ্ধ, পচ্চেক বুদ্ধ, অর্হৎ ও চক্রবর্তী রাজার সমাধির উপর স্তূপ নির্মাণ করা যেতে পারে। আরও বলেছিলেন, সূতপগুলি চার পথের সংযোগস্থলে হওয়াই বাঞ্ছনীয়। গৌতম বুদ্ধের দেহভষ্ম আট ভাগে বিভক্ত করে আটটি জনপদের প্রতিনিধিদের কাছে বিলিয়ে দেয়া হয়েছিল এবং দেহভস্মের প্রতিটি ভাগের উপর প্রতিটি জনপদে একটি করে স্তূপ নির্মিত হয়েছিল বলে প্রাচীন বৌদ্ধ ধর্মগ্রন্থ সমূহ সাক্ষ্য দেয়। প্রাথমিক পর্যায়ের সূতপের নিদর্শন কোনটি তা এখনো চিহ্নিত করা সম্ভব হয় নি।

তবে এ পর্যন্ত আবিষ্কৃত স্তূপগুলির মধ্যে সম্রাট অশোকের সময়ে নির্মিত স্তূপগুলিকেই সময়ের দিক থেকে সর্বপ্রাচীন বলে মনে করা হয়। বলা হয় যে, বৌদ্ধ ধর্মের শ্রীবৃদ্ধি ও তার স্থায়ী ভিত্তি রচনার উদ্দেশ্যে সম্রাট অশোক খ্রিস্টপূর্ব তিন শতকে বুদ্ধের দেহভস্মের মূল স্তূপসমূহ উন্মোচন করে তাকে বিভক্ত করে সমগ্র উপমহাদেশব্যাপী কয়েক হাজার স্তূপ নির্মাণ করেছিলেন।

বাংলার বিভিন্ন অংশে নির্মিত এ ধরনের স্তূপ স্থাপত্য ও স্তম্ভের বিবরণ চৈনিক পরিব্রাজক  হিউয়েন সাং তাঁর ভ্রমণ বিবরণীতে লিপিবদ্ধ করেছেন। তা ছাড়াও বুদ্ধের দেহভস্মের মূল  স্তূপসমূহের আটটি স্থান বৌদ্ধ অনুসারীদের কাছে বিশেষ পবিত্র ও গুরুত্বপূর্ণ স্থান হিসেবে পরিগণিত হতে থাকে। সময়ের বিবর্তনে স্তূপসমূহ অন্ত্যেষ্টিক স্থান থেকে ভক্তি বা শ্রদ্ধা প্রদর্শনের স্থানে পরিণত হয়। ফলে একই সাথে বৌদ্ধদের ধর্মীয় আচার পালনেও পরিবর্তন হতে থাকে। খ্রিস্টপূর্ব এক শতক থেকে শুরু করে পরবর্তী সময়ে স্তূপসমূহ চৈত্য গৃহ হলের সঙ্গে একীভূত হয়ে যায়। এখন পর্যন্ত প্রাপ্ত স্তূপসমূহের মধ্যে মুম্বাই-এর সপুরা নামক এক প্রচীন বন্দরের নিকটে আবিষ্কৃত সাঁচী নামক সূতপটি উপমহাদেশের সর্বপ্রাচীন হিসেবে সনাক্ত করা হয়েছে।

বৌদ্ধ ঐতিহ্যে স্তূপকে তিন শ্রেণিতে বিভক্ত করা হয়েছে-

১. শরীর ধাতু স্তূপ বা শারীরিক স্তূপ। এ শ্রেণির স্তূপে বুদ্ধদেবের এবং তাঁর অনুগামী ও শিষ্যবর্গের শরীরাবশেষ রক্ষিত ও পূজিত হতো।

২. পারিভৌগিক ধাতু স্তূপ বা পারিভৌগিক স্তূপ। এ শ্রেণির স্তূপে বুদ্ধদেব কর্তৃক ব্যবহূত দ্রব্যাদি রক্ষিত ও পূজিত হতো।

৩. নির্দেশিক বা উদ্দেশিক স্তূপ। বুদ্ধ ও বুদ্ধধর্মের সঙ্গে সম্পৃক্ত কোন স্থান বা ঘটনাকে উদ্দেশ্য করে বা চিহ্নিত করার জন্য নির্মিত স্তূপ।

কালের বিবর্তনে স্তূপ কেবলমাত্র বুদ্ধ ও বৌদ্ধ ধর্মের প্রতীক হয়ে দাঁড়ায় এবং বৌদ্ধ সমাজে পূজিত হতে থাকে। এর পাশাপাশি বৌদ্ধ তীর্থস্থানগুলোতে পূজা দিতে এসে ভক্তবৃন্দ ভক্তি প্রদর্শনের উদ্দেশ্যে নৈবেদ্য বা নিবেদনরূপে ছোট-বড় স্তূপ নির্মাণ করতো। এ ধরনের স্তূপকে বলা হতো নিবেদন স্তূপ।

উত্তর ভারতের সারনাথের ধর্মরাজিক স্তূপটির আস্তরণের অভ্যন্তরে যে কেন্দ্রীয় স্তূপটি রয়েছে তা মূলত অশোক নির্মিত সহস্র স্তূপের মধ্যে অন্যতম। ইট দিয়ে নির্মিত হয়েছিল এই স্তূপ। শুঙ্গ রাজবংশের শাসনামলে (খ্রিস্টপূর্ব ১৮৫-৭৫ অব্দ) স্তূপ নির্মাণের প্রধান উপকরণ ছিল পাথর। খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতকে ভারতের মধ্যপ্রদেশে নির্মিত চন্দ্রাকৃতির অর্ধগোলাকার শুঙ্গ রাজবংশীয় সাঁচী স্তূপটি পাথরের তৈরি এবং অত্যন্ত সুরক্ষিত। এটি এখন পর্যন্ত ভালো অবস্থায় টিকে থাকা স্তূপসমূহের মধ্যে সর্ব প্রাচীন বলে পরিগণিত। এই সময় সন্ধিক্ষণেই বৌদ্ধ ধর্মে সশ্রদ্ধ পূজা প্রথার আবির্ভাব ঘটে এবং ভক্তিপূর্ণ আচার-অনুষ্ঠান এর সঙ্গে যুক্ত হয়।

ইতিহাসের প্রাথমিক পর্যায়ের স্তূপগুলি ছিল অর্ধচন্দ্রাকৃতির মাটির গাদা বা ঢিবির মতো। এ অংশকে ‘অন্ড’ বলা হতো। কিন্তু শুঙ্গ রাজবংশের শাসনামলে স্তূপ নির্মাণে শুধু পাথরের ব্যবহারই হয়নি, স্তূপ স্থাপত্যের অঙ্গ বিন্যাসে পূর্ণাঙ্গ রূপ লাভ করে এবং অন্ডের আকৃতি পরিবর্তিত হয়ে একটি আদর্শ অর্ধবৃত্তে পরিণত হয়। তার নিচে স্বল্প উচ্চতা বিশিষ্ট একটি মেধি জুড়ে দেয়া হয়। অন্ডের উপরের অংশেও স্থাপন করা হয় ছোট বেদী। এর মধ্যবর্তী স্থানে ‘ইয়ুস্থি’ নামের একটি দন্ড পুঁতে দেয়া হত। ইয়ুস্থিতে উলম্বভাবে থরে থরে ক্রমে ছোট হয়ে আসা চাকতি সাজানো হতো যাকে বলা হতো ছত্রাবলী। দূর থেকে একে সূচাগ্র শিখরের মতো দেখাত। সময়ের ব্যবধানে মেধি ও অন্ডের উচ্চতাসহ ছত্রাবলীতে চাকতির সংখ্যা ক্রমেই বৃদ্ধি পায়। খ্রিস্টিয় আট-নয় শতকের দিকে নির্মিত স্তূপগুলো দেখতে অনেকটা ক্রমে সরু হয়ে উঠা স্তম্ভের সঙ্গে তুলনীয় হয়ে উঠে।

প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কার ও সাক্ষ্যের ভিত্তিতে বলা হয় যে, বাংলায় বৌদ্ধ স্থাপত্য শিল্পের প্রাথমিক নিদর্শন হিসেবে স্তূপ, মৌর্য যুগেই বিস্তার লাভ করে। বাংলায় প্রাপ্ত স্তূপগুলো সাধারণত ক্ষুদ্রাকৃতির। নরসিংদী জেলার আসরাফপুর গ্রামে প্রাপ্ত রাজা দেবখড়গের তাম্রশাসনের সঙ্গে যে ব্রোঞ্জ বা অষ্টধাতুনির্মিত স্তূপ পাওয়া গিয়েছে, সম্ভবত তাই বাংলায় সর্বপ্রাচীন স্তূপের নির্দশন। এটি একটি নিবেদন স্তূপ। স্তূপটির মেধ ও অন্ডের আকৃতি ঘণ্টার মতো। পাহাড়পুর ও চট্টগ্রামের ঝেওয়ারিতে আরও দুটি ধাতুর স্তূপের সন্ধান পাওয়া গিয়েছে। ১০১৫ অব্দে লিখিত একটি বৌদ্ধগ্রন্থের পুঁথিতে (কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে রক্ষিত) বরেন্দ্র ভূমির মৃগস্থাপন স্তূপের একটি চিত্র আছে। চীনা পরিব্রাজক ইৎসিঙ সম্ভবত এই স্তূপের কথাই সাত শতকে লিপিবদ্ধ করেছিলেন।

রাজশাহী জেলার পাহাড়পুরে, বিশেষভাবে সত্যপীরের ভিটায় এবং বাঁকুড়া জেলার বহুলাড়ায় খননের ফলে দশ-বার শতকের ইটের তৈরি নিবেদন স্তূপ আবিষ্কৃত হয়েছে। যার অধিকাংশই এখন ধ্বংসপ্রাপ্ত। কুমিল্লা জেলার শালবন ও আনন্দ বিহারে, বগুড়ার ভাসুবিহারেও উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ক্ষুদ্রাকার নিবেদন স্তূপ আবিষ্কৃত হয়েছে। বরেন্দ্র গবেষণা জাদুঘর, বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর, মহাস্থানগড় জাদুঘর এবং দিনাজপুর জাদুঘরে সংরক্ষিত হয়েছে বেশ কয়েকটি নিবেদন স্তূপ। যদিও সময়ের ব্যবধানে স্তূপগুলির আকার ও নির্মাণ কৌশলে ভিন্নতা পরিলক্ষিত হয়। স্তূপসমূহের মেধির আকৃতি কখনো গোলাকার কখনো চৌকো। অন্ডের অংশ ঘণ্টা এবং ছত্রাবলীর অংশ আমলকি আকৃতি ধারণ করেছে। পরবর্তী পর্যায়ের স্তূপসমূহের মধ্যে ‘স্তূপ স্থাপত্যের’ সব কয়টি বৈশিষ্ট্য খুঁজে পাওয়া যায় না। বিবর্তনের ধারায় বুদ্ধের আলোকিত আত্মার প্রতীক স্তূপ, বৌদ্ধ ধর্ম চর্চার কাঠামোতে পরিণত হয়। বৌদ্ধ মন্দির বা প্যাগোডা বা কেয়াং তার উদাহরণ।  [নাসরীন আক্তার]

গ্রন্থপঞ্জি মোঃ মোশারফ হোসেন, প্রত্নতত্ত্ব-উদ্ভব ও বিকাশ; নীহাররঞ্জন রায়, বাঙ্গালীর ইতিহাস, আদিপর্ব; রমেশচন্দ্র মজুমদার, বাংলাদেশের ইতিহাস, প্রাচীন যুগ, কলকাতা; S. Beal, The life of Hiuen Tsang, Delhi, 1973; Jhunu Bagchi, The History and Culture of the Palas of Bengal and Bihar, cir-750 A.D cir1200 A.D, New Delhi, 1993.