শ্রীরামপুর

শ্রীরামপুর  পশ্চিমবাংলার হুগলি নদীর ডানতীরে অবস্থিত হুগলি জেলার একটি বিখ্যাত জনপদ। কয়েকশত বছরের পুরানো এই শহরটি ২২°৪৫´ উত্তর অক্ষাংশে ও ৮৮°২৯´ পূর্ব দ্রাঘিমায় অবস্থিত। শ্রীরামপুর প্রত্যক্ষ করেছে সামন্ত প্রথার উত্থান-পতন, দিনেমার বণিকদের আগমন ও বসতি স্থাপন, ইস্ট ইন্ডিয়া রেলপথ যোগাযোগ আর শিল্পায়নের অব্যবহিত পরই সাংস্কৃতিক নবজাগরণ। শ্রীরামপুরে নগরায়ণের তিনটি ধারা পরিলক্ষিত হয় (১) প্রাক-নগরায়ণকাল (১৭৫৫ খ্রি পূর্ববর্তী অবস্থা); (২) নগরায়ণকাল (১৭৫৫-১৮৪৫ খ্রি) এবং (৩) শিল্পায়নকাল (১৮৪৫-১৯৪৭ খ্রি)।

প্রাক-নগরায়ণকাল  মুগল আমলের বহু আগে থেকেই সরস্বতী ও হুগলি নদীর মধ্যবর্তী অঞ্চলটি ছিল বর্ধিষ্ণু জনপদ। পনেরো শতকে লেখা বিপ্রদাস পিপিলাই-এর মনসামঙ্গল কাব্যে আকনা ও মাহেশ নামের উল্লেখ রয়েছে। শ্রী চৈতন্যের সমকালীন পুঁথিতে এই দুটি নাম ছাড়াও চাতরার উল্লেখ পাওয়া যায়। টেভার্নিয়ার-এর ভ্রমণবৃত্তান্তে মাহেশের রথযাত্রার বিবরণ রয়েছে। হিন্দু দেব-দেবীর মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ এখনও শ্রীরামপুরে পরিলক্ষিত হয়- যথা: বল্লভপুরের পরিত্যক্ত হেনরী মার্টিন প্যাগোডা, রাধাবল­ভজীউর মন্দির (আঠারো শতক), চাতরার গৌরাঙ্গ মন্দির, শ্রীপুরের রামসীতার মন্দির, মাহেশের জগন্নাথ মন্দির (১৭৫৫ খ্রি), গোস্বামীপাড়ার শিব মন্দির প্রভৃতি। আবুল ফজলের  আইন-ই-আকবরী গ্রন্থে রাজা  মানসিংহের পূর্ব-ভারতে আগমন (১৫৮৯-৯০ খ্রি) এবং শ্রীপুরে শিবির স্থাপনের বৃত্তান্ত থেকে এবং আবদুল হামিদ লাহোরির বাদশাহনামায় শ্রীপুরকে শ্রীরামপুর নামে চিহ্নিতকরণ থেকেও অনুমান করা যায় যে, মুগল আমলের আগে থেকেই উল্লিখিত স্থানগুলির প্রসিদ্ধি ছিল। পনেরো শতকে চৈতন্যের বৈষ্ণববাদের প্রভাবে এখানকার কয়েকটি স্থান হিন্দুদের তীর্থকেন্দ্র হয়ে ওঠে। শেওড়াফুলির রাজা মনোহরচন্দ্র রায় ১৭৫২ সালে শ্রীপুরে রামসীতার মন্দির স্থাপন করার পর তাঁর পুত্র রামচন্দ্র দেবসেবার জন্য শ্রীপুর, গোপীনাথপুর ও মনোহরপুর নামক ৩টি মৌজা গাঙ্গুলীদের নামে দেবোত্তর করে দেন। এভাবে ‘শ্রীপুর’, ‘শ্রীরাম’ ইত্যাদি নাম থেকে ‘শ্রীরামপুর’ নামটির উৎপত্তি হয়ে থাকতে পারে। এখানে বিভিন্ন গোষ্ঠী ও শ্রেণির ব্রাহ্মণ সমন্বয়ে গড়ে ওঠে কিছু সম্ভ্রান্ত পল্লী, যেমন- গোস্বামীপাড়া, লাহিড়ীপাড়া, মুখার্জীপাড়া, ভট্টাচার্যপাড়া, চক্রবর্তীপাড়া প্রভৃতি। দেবপূজা ও মন্দিরের নানাবিধ কাজেকর্মে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষজনের প্রয়োজন হওয়ায় চাকরান জমিতে এসে তারা বসতি স্থাপন করতে শুরু করে। এভাবে সৃষ্টি হয় পটুয়াপাড়া, কুমোরপাড়া, ঢুলিপাড়া, গোয়ালপাড়া ইত্যাদি। শেওড়াফুলি গড়ে উঠেছিল বাণিজ্যকেন্দ্র হিসেবে এবং সেখানে ১৭৫৫-র আগে থেকেই বরুজীবী, দত্ত ও দে’রা বসতি স্থাপন করেছিল। চাষিরা গড়ে তোলে সদগোপপাড়া, মান্নাপাড়া, লঙ্কাবাগান প্রভৃতি অঞ্চল। জেলে-কৈবর্ত, শানি মুচিরা এসে স্ব স্ব পল্লী গড়ে তোলে। মল্লিকপাড়ায় সুন্নি সম্প্রদায়ের মুসলমানরা বসবাস শুরু করেন। এরা মুগল সৈন্যদের বংশধর। এখানে একটি মসজিদ আজও তাদের অবস্থিতির সাক্ষ্য বহন করছে।

মুগল আমলে আকনা ও মাহেশে ঘন জনবসতি ছিল। এখানকার জলবায়ু ছিল উষ্ণ ও আর্দ্র, যা বয়ন শিল্পের পক্ষে ছিল বেশ অনুকূল। এ কারণে এসব অঞ্চলে সুতিবস্ত্র ও রেশমবস্ত্র তৈরি হতো। হিন্দু তাঁতিরা বুনত উন্নত মানের সুতিবস্ত্র আর, মুসলমান তাঁতিদের প্রাধান্য ছিল রেশমবস্ত্রে। উর্বর অঞ্চলে ফলত ধান, পাট ও পান। জেলে-কৈবর্তরা খাল-বিলে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করত।

প্রাক-নগরায়ণকালে যোগাযোগের মাধ্যম ছিল প্রধানত নদীপথ। এছাড়া বাদশাহী সড়ক বা গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক রোডও ব্যবহূত হতো।  দিনেমারদের আসার আগেই এ অঞ্চলের প্রধান অভ্যন্তরীণ বাজার ছিল শেওড়াফুলি হাট। পূর্ববাংলার (বর্তমান বাংলাদেশ) বরিশাল, খুলনা, ঢাকা, ময়মনসিংহ, রাজশাহী প্রভৃতি জেলার সঙ্গে এর বাণিজ্যিক সংযোগ ছিল। চৌদ্দ থেকে আঠারো শতক পর্যন্ত  ফরাসিপর্তুগিজওলন্দাজ প্রভৃতি বিদেশী বণিকদল এ অঞ্চলে  বাণিজ্যকুঠি স্থাপন করে ব্যবসা-বাণিজ্যে লিপ্ত হয়। সে সময় হুগলি ও সরস্বতী নদীর মধ্যবর্তী অঞ্চল ছিল শেওড়াফুলি ও অন্যান্য জমিদারদের অধীন। এই সকল সামন্ত-প্রভুগণ প্রজাদের কাছ থেকে খাজনা পেতেন। তারা ছিলেন একাধারে প্রজাপীড়ক ও দন্ডমুন্ডের মালিক। কিন্তু ইউরোপীয় বণিকদের আগমন ও ক্রমশ এই সব অঞ্চলে প্রভাব বিস্তারে জমিদারদের প্রতাপ ম্লান হয়। যে সকল স্থান হিন্দুতীর্থ হিসেবে প্রসিদ্ধ ছিল, সেখানে নগরায়ণের প্রাথমিক লক্ষণগুলি পরিস্ফুট হয়ে ওঠে।

নগরায়ণকাল  প্রায় একশত বছরের এই পর্যায়কাল শুরু হয় দিনেমারদের ভূমি অধিগ্রহণের মধ্য দিয়ে। দিনেমার কোম্পানি আঠারো শতকের মাঝামাঝিতে দক্ষিণ ভারতের ট্যাঙ্কোবার কুঠি থেকে সোয়েটম্যান নামে একজন প্রতিনিধিকে বাংলার নওয়াবের কাছে প্রেরণ করে। তাদের উদ্দেশ্য ছিল বাংলায় বাণিজ্য করার অধিকার সম্পর্কিত ফরমান লাভ। নওয়াব আলীবর্দী খানকে নগদ ৫০ হাজার মুদ্রা ও প্রচুর উপঢৌকন প্রদানের বিনিময়ে সোয়েটম্যান বাণিজ্য করার ফরমান লাভ করেন। ১৭৫৫ সালে সোয়েটম্যান এক লক্ষ আশি হাজার টাকায় শ্রীপুরে তিন বিঘা ও আকনায় সাতান্ন বিঘা জমি কিনে কুঠি-বন্দর স্থাপন করেন। এরপরই দিনেমারগণ শ্রীরামপুর, আকনা ও পিয়ারাপুর মহল বার্ষিক ১৬০১ টাকা খাজনায় শেওড়াফুলির জমিদারের কাছ থেকে অধিগ্রহণ করে। এইভাবে মোট ১৬৮০ বিঘা জমি সংগ্রহ করে তাদের কারখানাকে খড়ের ছাউনি দেওয়া একটি বিশাল মাটির পাঁচিল দিয়ে ঘিরে দেয়। উত্তর সীমানা বরাবর পিয়ারাপুর অবধি খাল খনন করে। ডেনমার্কের পঞ্চম ফ্রেডারিকের নাম অনুসারে সদ্য কেনা জায়গার নাম দেন ফ্রেডরিক্সনগর। এভাবে শ্রীরামপুরে দিনেমার কুঠির পত্তন হয়। তবে এটি ছিল একান্তভাবেই পণ্য আমদানি-রপ্তানির একটি কেন্দ্র।

প্রথম দশ-পনেরো বছর দিনেমার বণিকরা নানা ধরনের প্রতিকূলতার সম্মুখীন হয়। ১৭৭০ সালের পর থেকে বাণিজ্য ক্ষেত্রে তাদের উন্নতি শুরু হয়। প্রধানত দুটি উপায়ে এ উন্নতি আসে, যথা- (১) অন্যান্য ইউরোপীয় বণিকদের পণ্য সামগ্রী রপ্তানির মাধ্যমে এবং (২) কর্নেল ওলেবাই কর্তৃক সুদক্ষরূপে প্রশাসন পরিচালনার মাধ্যমে। ১৭৭৬ সালে কর্নেল ওলেবাই প্রশাসক হিসেবে শ্রীরামপুরের দায়িত্বভার গ্রহণের পর তাঁর দূরদর্শিতা, দক্ষ পরিচালনা ও কূটবুদ্ধি দিনেমার ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রভূত উন্নতি ঘটায়। তিনি শ্রীরামপুরে নগরায়ণের ধারাকে বেগবান করে তোলেন। ক্রমেই এ নগরের শ্রীবৃদ্ধি ঘটে এবং কিছু বিদেশী বণিক ও দেশী ব্যবসায়ী এখানে এসে বসবাস শুরু করেন।

গোড়ারদিকে দিনেমার বণিকগণ শেওড়াফুলি হাট থেকেই পণ্য-সামগ্রী কিনতেন ও সেগুলি ট্যাঙ্কোবার হয়ে ইউরোপের বাজারে রপ্তানি করতেন। পরেরদিকে তাঁরা পণ্য সংগ্রহের উদ্দেশ্যে প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে তাঁদের নিজস্ব প্রতিনিধি পাঠাতে শুরু করেন। দিনেমারদের প্রথম প্রতিনিধি হিসেবে শোভারাম বসাক ও আনন্দরাম ধোবা নামে স্থানীয় দুই ব্যক্তি নিযুক্ত হন। নন্দলাল চক্রবর্তী ছিলেন প্রথম এজেন্ট যিনি পরে দিনেমারদের দেওয়ান পদে উন্নীত হন। বাঁকুড়ার কোতুলপুর নিবাসী পতিত পাবন রায় ছিলেন অপর একজন এজেন্ট। এই সময় বিখ্যাত বণিক সফলিরামদে শোরা সরবরাহ করতেন। আঠারো শতকের শেষের দিকে বর্ধমানের পাটুলী থেকে হরিনারায়ণ এবং রামনারায়ণ গোস্বামী নামে দুই সহোদর তাদের ভাগ্য পরিবর্তনের আশায় হাজির হন শ্রীরামপুরে। হরিনারায়ণ দিনেমার কোম্পানির অধীনে চাকরি নেন এবং রামনারায়ণ শুরু করেন মহাজনি ব্যবসা। এতে খুব কম সময়ের মধ্যেই এই দুই গোস্বামী প্রচুর অর্থ উপার্জন করে বিশাল ভূ-সম্পত্তির মালিক হন। তারা শ্রীরামপুরের পশ্চিমাঞ্চলে নিজেদের আত্মীয়-স্বজন সমন্বয়ে একটি অভিজাত পল্লী স্থাপন করেন। এঁদের দেখাদেখি অন্যান্য মাঝারি ও বড় ব্যবসায়ীরাও বিভিন্ন স্থান থেকে এখানে এসে ব্যবসা-বাণিজ্য ও বসতি স্থাপন করতে শুরু করেন। ১৮০৪ সালে শ্রীরামপুরে অন্যূন ১০,২৫৮ ব্যক্তি ৩১টি বিভিন্ন অকৃষিজনিত পেশায় নিযুক্ত ছিলেন।

দিনেমার কোম্পানি প্রথমদিকে এজেন্ট, দালাল ও বানিয়াদের কাছ থেকে পণ্য সংগ্রহ করে ব্যবসা চালাত। পরেরদিকে কোম্পানি সরাসরি উৎপাদকের কাছ থেকে পণ্য-সামগ্রী কেনা শুরু করে। উৎপাদককে দাদন দিয়ে উৎকৃষ্ট পণ্য তৈরিতে তারা উৎসাহিত করত। তারা আকনা ও মোহনপুরের তাঁতীদের আগাম অর্থ দিয়ে সংগ্রহ করতো কোরা কাপড় ও উৎকৃষ্ট রেশমবস্ত্র। এছাড়া জাহাজের ‘হামারকাতা’ ও ‘লাকলাইন’ কাছি, বিভিন্ন ধরনের দড়ি এবং কৃষিজ পণ্যও সংগ্রহ করা হতো। পিয়ারাপুর মৌজায় চাষিদের দিয়ে ধান ছাড়াও নীল চাষ করানো হতো। প্রিন্সেফ সাহেব ছিলেন নীলের এজেন্ট। তাছাড়া দিনেমার বণিকরা নিজেরাই কাপড়ের কারখানা স্থাপন করে উৎকৃষ্ট বস্ত্র তৈরি করতে শুরু করেন। দিনেমারদের আয়ের অপর প্রধান উৎস ছিল হুন্ডি ব্যবসা। অন্যান্য ইউরোপীয় বণিকদের পণ্য নিজেদের জাহাজে করে রপ্তানির মাধ্যমে অর্থ উপার্জন, স্থানীয় ব্যবসায়ী ও জনসাধারণের উপর বিভিন্ন প্রকার কর ও খাজনা আরোপ ইত্যাদিও তাদের আয়ের উৎস ছিল।

কর্নেল ওলেবাই যেমন আইন-শৃঙ্খলা, শাসন-ব্যবস্থা, ব্যবসা-বাণিজ্যের দিকে যত্নবান ছিলেন, তেমনই শ্রীরামপুর নগরকে মনোরম ও চিত্তাকর্ষক করার দিকেও তাঁর দৃষ্টি ছিল। তিনি গঙ্গা নদীর কূল ঘেঁষে পিচ ঢালা পথ, আকর্ষণীয় দালান-বাড়ি, পান্থ-নিবাস এবং স্থানে  স্থানে পার্ক, বসবার জায়গা প্রভৃতি নির্মাণ করেন।

ঊনিশ শতকের প্রাক্কালে তিনজন ইউরোপীয় ব্যাপটিস্ট মিশনারি উইলিয়ম কেরী, যশুয়া মার্শম্যান ও উইলিয়ম ওয়ার্ডের শ্রীরামপুরে আগমন এক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। একথা বলা যেতে পারে যে, এঁরাই শ্রীরামপুরে নবজাগরণের স্রষ্টা। এই তিন মিশনারি খ্রিস্টধর্ম প্রচারের পাশাপাশি শ্রীরামপুর ও আশপাশের পীড়িত ও আর্ত মানুষজনের সেবা, স্বাস্থ্য এবং সর্বোপরি সমাজ সংস্কার ও শিক্ষা বিস্তারে আত্মনিয়োগ করেন। শ্রীরামপুরের পার্শ্ববর্তী বিস্তৃর্ণ অঞ্চলে শতাধিক মিশনারি প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপন করেন। হ্যানা মার্শম্যান স্থাপন করেন প্রথম বালিকা বিদ্যালয়। কিন্তু উইলিয়ম কেরী ১৮০০ সালে শ্রীরামপুর মিশন প্রেস স্থাপন করে তাঁর সর্বশ্রেষ্ঠ কীর্তির স্বাক্ষর রাখেন, যেখানে পঞ্চানন কর্মকারের তৈরি কাঠের হরফ ব্যবহূত হতো। ১৮১৮ সালে কেরী ও তাঁর দুই সহকর্মী তাঁদের সারা জীবনের সঞ্চিত অর্থ ব্যয়ে নির্মাণ করেন শ্রীরামপুর কলেজ। এটি এশিয়ার মধ্যে প্রথম ডিগ্রি কলেজ। কেরী বাংলা গদ্যের জনক হিসেবে প্রসিদ্ধি লাভ করেন। বাইবেলের বাংলা অনুবাদ, হিতোপদেশ ও কথোপকথন নামে তিনখানা পুস্তক ছাপা হয় মিশন প্রেস থেকে। কেরীর মুন্সী রামরাম বসু প্রকাশ করেন প্রতাপাদিত্য চরিত, রামায়ণ ও মহাভারতের বাংলা অনুবাদ। কেরীর সম্পাদনায় ১৮১৮ সালে প্রকাশিত হয় বাংলা ভাষায় রচিত দ্বিতীয় সাপ্তাহিক সংবাদপত্র  সমাচার দর্পণ। একই সময়ে ফ্রেন্ডস অব ইন্ডিয়া নামে আর একটি সংবাদপত্র ইংরেজিতে প্রকাশিত হয় শ্রীরামপুর মিশন প্রেস থেকে। মিশনারিদের আর একটি অবদান হলো শ্রীরামপুরে ভারতে প্রথম বাষ্পীয় কাগজ কল স্থাপন করা। ১৮০১-১৮৩২ সালের মধ্যে শ্রীরামপুর প্রেস থেকে ৪০টি ভাষায় মোট ২,১২,০০০ গ্রন্থ প্রকাশিত হয়। এই সকল উন্নয়নে শ্রীরামপুরের স্থানীয় জনসাধারণ প্রায়শই নিষ্ক্রিয় ভূমিকা পালন করতেন। মিশনারিদের জনশিক্ষা বিস্তার, প্রকাশনা সংক্রান্ত কাজকর্ম বা সমাজ সংস্কারমূলক যেকোন ধরনের কাজে শ্রীরামপুরের অভিজাত-অনভিজাত নির্বিশেষে প্রায় সকলেই দর্শকের ভূমিকা পালন করতেন। অবশ্য কিছু কিছু ভূস্বামী, অনাবাসী জমিদার ও ব্যবসায়ী গোষ্ঠী খুবই আগ্রহী ছিলেন নিজ নিজ সন্তানদের ইংরেজি শিক্ষায় পারদর্শী করতে। তারা মিশনারিদের প্রবর্তিত এই উচ্চ শিক্ষার সুযোগ গ্রহণ করেন। নিম্নবিত্তের মানুষজনেরাও মিশনারি স্কুলে তাদের সন্তানদের পাঠিয়ে বুনিয়াদি শিক্ষায় শিক্ষিত করে তোলেন। এভাবে মিশনারিদের প্রতি একটি সন্তুষ্ট শ্রেণিও সমাজে গড়ে ওঠে।

১৮০১ থেকে ১৮৩৯ সালের মধ্যে দিনেমারদের ব্যবসা-বাণিজ্য ও শ্রীরামপুরের নাগরিক জীবনযাত্রায় নেমে আসে চরম বিপর্যয়। ১৮০৩ সালে যেখানে ১১৩টি জাহাজ শ্রীরামপুর বন্দরে মাল বোঝাই ও খালাস করে, সেখানে ১৮১৫ সালে গিয়ে এ সংখ্যা দাঁড়ায় মাত্র একটিতে। কলকাতায় অবস্থিত ইংরেজ কোম্পানির বণিকদের ক্রমাগত অত্যাচার ও আগ্রাসী মনোভাব দিনেমার কোম্পানির মূলে আঘাত হানে। অবস্থা এমনই দাঁড়ায় যে, ১৮৩৫ সালের ১১ অক্টোবর গভর্নর পীটার হ্যানসেন ইংরেজদের কাছে তাঁদের কেনা সমুদয় সম্পত্তি মাত্র সাড়ে বারো লক্ষ টাকায় বিক্রি করতে বাধ্য হন।

শিল্পায়নকাল  দিনেমার শাসনের অন্তিমলগ্নে শ্রীরামপুরের পরিচালন ব্যবস্থা সম্পূর্ণ ভেঙ্গে পড়ে। ইংরেজ কোম্পানি শ্রীরামপুরের মালিকানা করায়ত্ত করেই নাগরিক সুখ-সুবিধার দিকে দৃষ্টি দেয়। অবশ্য এ সংক্রান্ত একটি ‘ভিলেজ কমিটি’ আগে থেকেই ছিল। এ প্রক্রিয়াতেই শ্রীরামপুর পৌরসভা স্থাপিত হয় ১৮৬৫ সালে। রিষড়া এবং কোন্নগরও এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হয়।

সে সময় শ্রীরামপুরের সমাজের শিরোমণি ছিলেন উচ্চবর্ণ ও বিত্তশালী শ্রেণির মানুষজন। তাঁদের জীবনধারায় না ছিল কোন আধুনিকতার ছাপ, না ছিল বিন্দুমাত্র নগর মনস্কতার চিহ্ন। এঁরা ছিলেন প্রাচীন সংস্কৃতির ধারক ও বাহক এবং এই সংস্কৃতির প্রতি গভীরভাবে আস্থাবান।

এ সময় সর্বভারতীয় অর্থনীতিতে চলছিল দারুণ দুর্দশা। শ্রীরামপুরেও কাজের সন্ধানে এসে উপস্থিত হয়েছিলেন উত্তরপ্রদেশ, অন্ধ্রপ্রদেশ, বিহার ও উড়িষ্যা রাজ্যের কৃষি-শ্রমিকরা। ব্রিটিশ মালিকানায় যখন রিষড়ায় প্রথম চটকল (১৮৫৫) এবং শ্রীরামপুরে দ্বিতীয় চটকল (১৮৬৬) স্থাপিত হলো তখন থেকেই বাণিজ্যনগর শ্রীরামপুর রূপান্তরিত হয় শিল্পনগরে। অবশ্য এর মূলে ছিল ১৮৫৪ সালে হাওড়া থেকে বর্ধমান পর্যন্ত ইস্ট ইন্ডিয়া রেলপথ স্থাপন এবং ১৮৬৬ থেকে ১৯১৫ সালের মধ্যে রিষড়া, শ্রীরামপুর ও গোন্দলপাড়ায় পরপর ছ’টি চটকল স্থাপন। এই সময় চটকলের সঙ্গে এ অঞ্চলে অন্যান্য কলকারখানাও গড়ে উঠতে থাকে। স্থানীয় ভূস্বামী, ঠিকাদার ও কারখানা মালিকগণ বাইরে থেকে আসা অবাঙালি শ্রমিকদের বসবাসের জন্য স্থান বরাদ্দ করেন। এভাবে শ্রীরামপুরে গঙ্গার কাছাকাছি মাহেশ ও তারাপুকুর অঞ্চলে গড়ে ওঠে উড়িয়াবস্তী, গয়াপাড়াবস্তী, ছাপড়াবস্তী, তেলেঙ্গীপাড়াবস্তী প্রভৃতি। এ সকল বহিরাগত শ্রমিকের আগমনে ১৮৭২ সাল থেকে ১৯০১ সালের মধ্যে শ্রীরামপুরের লোকসংখ্যা ২৪,৪৪০ থেকে ৪৪,৪৫১-তে উন্নীত হয়। শ্রমিকরা বসবাস করার মতো ঠাঁই পেলেও তাদের বাসস্থান ছিল অস্বাস্থ্যকর, ঘিঞ্জি, আলো-বাতাসহীন এবং পূঁতি-গন্ধময়। সামান্যতম নাগরিক সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের ব্যবস্থাও সেখানে ছিল না।

১৯১৪ সালে পৌর প্রতিষ্ঠান থেকে পরিশ্রুত পানীয় জল সরবরাহের ব্যবস্থা করা হয়। ১৯২৭ সালে স্থাপিত হয় কিশোরী লাল গোস্বামীর স্মৃতিকল্পে টাউন হল। ত্রিশের দশকে সরকারি উদ্যোগে স্থাপিত হয় উইভিং স্কুল। পৌর প্রতিষ্ঠান থেকে বৈদ্যুতিক পরিষেবা চালু হয় ১৯৩৮ সালে। ব্রিটিশ রাজের শাসনের পঞ্চাশ বছর পর শ্রীরামপুরে বাঙালি সংস্কৃতি ও জাতীয় আন্দোলনের ঢেউ এসে পড়ে। স্বদেশী মন্ত্রে দীক্ষিত হন বহু মধ্যবিত্ত পরিবারের যুব সম্প্রদায়। নতুন ভাবধারায় উদ্বুদ্ধ হয়ে অনেকে এ আন্দোলনে যোগ দেন। স্বভাবতই বিদেশী শিল্পক্ষেত্রে বিনিয়োগে ভাটা পড়ে ও স্বদেশী বিনিয়োগ বৃদ্ধি পায়। স্বদেশী উদ্যোগে প্রথম কাপড়ের কল বঙ্গলক্ষ্মী কটন মিল স্থাপিত হয়। বিশ শতকের গোড়া থেকেই শ্রীরামপুরে বহু পাঠশালা, স্কুল ইত্যাদি প্রতিষ্ঠিত হতে থাকে। প্রাচীন বনেদি বংশের কেউ কেউ জনকল্যাণে তাঁদের বসতবাটিও দান করেন।

১৯৪৭-এর পর শ্রীরামপুরের ভৌত অবকাঠামো ও জন-জীবনে ব্যাপক পরিবর্তন সাধিত হয়। পূর্ববঙ্গ থেকে দলে দলে উদ্বাস্ত্ত আসায় এখানে অপরিকল্পিতভাবে কয়েকটি কলোনি গড়ে ওঠে। পয়ঃপ্রণালী ও অন্যান্য নাগরিক সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের অবনতি ঘটে। উদ্বাস্ত্তদের পরপরই হুগলি জেলার বিভিন্ন গ্রামাঞ্চল থেকে মানুষজন এসে শ্রীরামপুরে বসতি স্থাপন করে। ফলে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পায়। ১৯৯১ সালে এই সংখ্যা হয় ১,৩৭,০২৮। শ্রীরামপুর এখন কলকাতার উপনগর। এখনও এর নগরায়ণ সমাপ্ত হয় নি।  [প্রফুল্ল চক্রবর্তী]