শোলাশিল্প

শোলাশিল্প  বাংলার অন্যতম লোকজ শিল্প। শোলা বা শোলা জাতীয় উদ্ভিদ থেকে এগুলি তৈরি হয়। শোলাগাছ জলাশয়ে বিশেষত ধানক্ষেতে জন্মে। এর বৈজ্ঞানিক নাম Aeschymene aspera. বাংলাদেশের প্রাকৃতিক ও সামাজিক পরিবেশে শোলাগাছের গুরুত্ব অনেক।

শোলা তৈরি মুকুট

শোলাশিল্পের ব্যবহার সম্পর্কে একটি কিংবদন্তি প্রচলিত আছে। কথিত হয় যে, স্বয়ং  শিব হিমালয়কন্যা পার্বতীকে বিবাহ করার সময় শ্বেত মুকুট পরার ইচ্ছা পোষণ করেন। দেবশিল্পী  বিশ্বকর্মা তখন মুকুট তৈরির উপাদানের কথা ভাবতেই শিবের ইচ্ছায় জলাশয়ে এক ধরণের উদ্ভিদ জন্মে, সেটাই শোলাগাছ। কিন্তু বিশ্বকর্মা শুধুমাত্র পাথর বা কাঠের মতো শক্ত দ্রব্যে কাজ করতে পারদর্শী, শোলার মতো নরম দ্রব্যে নয়। তখন শিবের ইচ্ছায় জলাশয়ে এক সুকুমার যুবকের আবির্ভাব ঘটে, যাকে আখ্যাত করা হয় মালাকার নামে। এখন যারা শোলাশিল্পের সঙ্গে জড়িত তারা মালাকার নামেই পরিচিত এবং হিন্দু সমাজভুক্ত। মালাকাররা বংশানুক্রমে শোলা দিয়ে বৈচিত্র্যময় টোপর, দেবদেবীর অলঙ্কার,  চালচিত্র, পূজামন্ডপের অঙ্গসজ্জার দ্রব্যাদি, মালা, গহনা, খেলনা ও গৃহসজ্জার নানা দ্রব্য তৈরি করে।  সূত্রধর ও  কর্মকাররা বিশ্বকর্মার উপাসক হলেও মালাকাররা শিবের উপাসক। এদের ধারণা শিবের ইচ্ছায় তাদের আবির্ভাব ঘটেছে, তাই শিবই তাদের উপাস্য দেবতা।

শোলা একটি কান্ডসর্বস্ব গাছ। কান্ডের বাইরের আবরণটা মেটে রঙের, কিন্তু ভেতরটা সাদা। শোলাগাছ সাধারণত ৫-৬ ফুট লম্বা হয় এবং কান্ডের ব্যাস হয় দুই থেকে তিন ইঞ্চি। বাংলাদেশে দুই প্রকার শোলা জন্মে: কাঠ (kath) শোলা ও ভাট (bhat) শোলা। কাঠশোলা অপেক্ষাকৃত শক্ত, কিন্তু ভাটশোলা হালকা ও নরম।

বাংলাদেশের মানিকগঞ্জ, কেরানীগঞ্জ (ঢাকা), মুন্সিগঞ্জ, কুমিল্লা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনা, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, জামালপুর, শেরপুর, যশোর, রংপুর, দিনাজপুর ও বরিশাল অঞ্চল শোলাশিল্পের জন্য প্রসিদ্ধ। এক সময় পুরান ঢাকার মালিটোলা এলাকায় এ শিল্পের কারিগর মালাকারদের বসবাস ছিল বিধায় ওই এলাকার নাম হয়েছে মালিটোলা। অবশ্য বর্তমানে সেখানে শোলার কাজ তেমন হয় না। বরং শাঁখারি বাজার এলাকায় এখনও অনেকে শোলার কাজ করেন। তাঁরা হলেন প্রকাশ সুর, অভি সুর, তপন নন্দী প্রমুখ। প্রকাশ সুর ও তপন নন্দীর কাজে সূক্ষ্মতা আছে। এঁরা সমাজের চাহিদা অনুসারে শোলা দিয়ে বিচিত্র ধরণের জিনিস তৈরি করেন। তপন নন্দী দেবদেবীর গহনা, তাঁদের চালচিত্র ও পোশাক তৈরিতে অত্যন্ত দক্ষ। শাঁখারি বাজারের বেশির ভাগ পূজামন্ডপের চালচিত্র ও মন্ডপ সজ্জার কাজ তপন নন্দীই করে থাকেন। মাগুরা জেলার শতপাড়ার হাজরাহাটি গ্রামের মহাদেব মালাকার এবং শঙ্কর মালাকারের শোলার তৈরি টোপর ও বিয়ের মালা সূক্ষ্মতা ও নিপুণতায় অপূর্ব। এঁরা বংশপরম্পরায় এ শিল্পের সঙ্গে জড়িত। কুষ্টিয়ার আড়পাড়া গ্রামের গোপেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীও একজন দক্ষ শোলাশিল্পী।

শোলার শিল্পকর্ম সৃষ্টিতে তেমন কোনো যন্ত্রপাতির প্রয়োজন হয় না। একটি ধারাল ছুরি ও এক খন্ড পাথর বা কাঠই যথেষ্ট। প্রথমে ধারাল ছুরির সাহায্যে শোলাকে প্রয়োজনমতো টুকরা করা হয়। পরে ছুরি দিয়ে পাতলা করে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে একটি লম্বা পাতের মতো করা হয়। এই পাতকে জড়িয়ে জড়িয়ে পুনরায় কান্ডের মতো করে দড়ি দিয়ে বেঁধে এবং ছুরির সাহায্যে নানা আকারের পাপড়ি কেটে বেলি, কদম ইত্যাদি ফুল তৈরি করা হয়। টোপর, পশুপাখি, অলঙ্কার, চালচিত্র, পটচিত্র প্রভৃতি তৈরিতে পাতলা করে কাটা শোলাকে আঠার সাহায্যে সংযুক্ত করা হয়। পরে প্রয়োজন অনুসারে তাকে বিভিন্ন আকার দেওয়া হয়। শোলাকে সংযুক্ত করতে সাধারণত নিজেরাই তেঁতুলবিচির আঠা তৈরি করে নেয়। বর্তমানে অবশ্য বাজারের আঠাও ব্যবহার করা হয়।

শোলার শিল্পকর্মকে আকর্ষণীয় করে তোলার জন্য মালাকাররা রং, জরির সুতা, চুমকি ইত্যাদি ব্যবহার করে। শাঁখারি বাজারে সম্পূর্ণ শোলা দিয়ে তৈরি একটি বিয়ের টোপর চারশ থেকে পাঁচশ টাকায় বিক্রয় হয়। এ ধরণের টোপর সাধারণত উচ্চমধ্যবিত্ত হিন্দুরা ব্যবহার করেন। এ ছাড়া শোলার তৈরি কুচিমালাও হিন্দু বিয়েতে প্রয়োজন হয়। ধর্মীয় উৎসবে শোলা দিয়ে ক্যানভাসের মতো তৈরি করে তাতে বিভিন্ন দেবদেবীর চিত্র অংকিত হয়। এ ধরণের চিত্র ঘটচিত্র, করন্ডিচিত্র, মুখচিত্র ইত্যাদি নামে পরিচিত। এ ছাড়া অনেক সময়  গণেশশীতলামনসা, কার্তিক ও চামুন্ডার চিত্রও অংকিত হয়।

বর্তমানে মালাকাররা বিয়ের টোপর ও মালা ছাড়াও সমাজের চাহিদা অনুযায়ী নানা ধরণের খেলনা, পাখি, ফুল, পুতুল ইত্যাদিও তৈরি করে। শোলাশিল্প সংরক্ষণ করা কষ্টকর, কারণ শোলার স্থায়িত্ব কম।  [জিনাত মাহরুখ বানু]