শাশ্বত বঙ্গ
শাশ্বত বঙ্গ বাংলা ভাষা ও সাহিত্য এবং বাঙালির সাংস্কৃতিক ইতিহাসের বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য একটি গ্রন্থ। একটি কবিতাসহ ৭৫টি প্রবন্ধ নিয়ে সঙ্কলিত হয় এ গ্রন্থ। গ্রন্থের লেখক কাজী আবদুল ওদুদ (১৮৯৪-১৯৭০)। গ্রন্থটি প্রথম প্রকাশিত হয় বাংলা ১৩৫৮ সনে, কলকাতা থেকে। তাঁর নবর্পয্যায় (১ম ও ২য় খন্ড, ১৩৩৩ ও ১৩৩৬), রবীন্দ্রকাব্য পাঠ (১৩৩৪), সমাজ ও সাহিত্য (১৩৪১), হিন্দু-মুসলমানের বিরোধ (১৩৪৩), আজকার কথা (১৩৪৮), নজরুল প্রতিভা (১৩৫৫), স্বাধীনতা-দিনের উপহার (১৯৫১) প্রভৃতি গ্রন্থের নির্বাচিত প্রবন্ধ এবং অপ্রকাশিত কিছু প্রবন্ধ নিয়ে গ্রন্থ আকারে শাশ্বত বঙ্গ সঙ্কলিত হয়।
শাশ্বত বঙ্গ গ্রন্থটি একাধিক কারণে গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমত গ্রন্থটির ঐতিহাসিক মূল্য। বিশ শতকের তৃতীয় দশকে ঢাকায় বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলন সংঘটিত হয়। এ আন্দোলনকারী সংগঠনের নাম ছিল মুসলিম সাহিত্য সমাজ (১৯২৬)। সংগঠনের নামে এ আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ পরিচিত ছিলেন। কাজী আবদুল ওদুদ ছিলেন এ আন্দোলনের প্রধান উদ্যোগী ও উদ্যমশীল ব্যক্তিত্ব। শুধু তাই নয়, তাঁকে বলা হয়েছে বিশ শতকের মুসলিম সমাজের সর্বশ্রেষ্ঠ ভাবুক ও চিন্তাবিদ। বিচার-বুদ্ধিকে সংস্কারমুক্ত ও গতিশীল করার প্রচেষ্টায় যে-সকল চিন্তা ও বক্তব্য নিয়ে কাজী আবদুল ওদুদ ও তাঁর সহকর্মীদের অগ্রসর হতে দেখা যায়, শাশ্বত বঙ্গ তার একটি মূল্যবান দলিল।
শাশ্বত বঙ্গ গ্রন্থের বক্তব্যে লক্ষ করা যায়, ভারতবর্ষে সুদীর্ঘ কাল ধরে শাস্ত্রীয় মননের একটা ধারা সবেগে প্রবাহিত। আধুনিককালেও এ অঞ্চলের মানুষ যুক্তিভীত এবং কুসংস্কারে আচ্ছন্ন ও ভাববাদী চিন্তাভাবনায় অভ্যস্ত। এ মানসপ্রবণতা হিন্দু-মুসলিম উভয় সমাজকে সম্মোহিত করে রেখেছে। জন্ম আর মৃত্যু দিয়ে তো মানুষের জীবন পরিবেষ্টিত নয়। মানুষের জীবন অনন্ত সম্ভাবনাময়। অনন্ত সুখ-স্বপ্ন-স্বাদে মানুষের জাগতিক জীবন অপরূপ হয়ে দেখা দিয়েছে। একালের মানুষের চোখের সামনে খুলে গেছে বিশ্বব্রহ্মান্ডের অপূর্ব সৌন্দর্য আর অভাবিত সব তত্ত্ব ও তথ্যপঞ্জি। মানুষের জীবনের এ অপরূপতা, ব্যাপকতা, জটিলতা ইত্যাদির ব্যাখ্যায় ও বিশ্লেষণে নিয়োজিত আজ তার বিজ্ঞান, দর্শন, সাহিত্য, ইতিহাস, সমাজতত্ত্ব, মনস্তত্ত্ব, নৃতত্ত্ব, রাজনীতি সব বিদ্যা। শাশ্বত বঙ্গ এসবের আলোচনায় প্রাণবন্ত।
কাজী আবদুল ওদুদের উদারনৈতিক মনোভাব এবং নিজের সমাজ ও সম্প্রদায়ের দৈন্যের জন্য আক্ষেপ এ গ্রন্থের উল্লেখযোগ্য দিক। পরিবেশের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক গভীর ভালোবাসার, প্রেম তাঁর বক্তব্যের এক প্রধান কেন্দ্রবিন্দু। শাশ্বত বঙ্গ তাই সাজাত্যবোধের (Sense of homogeneity) দিক থেকেও এক অবিস্মরণীয় গ্রন্থ। গ্রন্থটির নামকরণেও তাঁর এ মনোভাব ব্যক্ত হয়েছে। কাজী আবদুল ওদুদের শাশ্বত বঙ্গ অনৈতিহাসিক বাংলার জনপদ এবং আদর্শায়িত রূপকথার কাহিনী নয়। প্রকৃতপক্ষে এ বঙ্গে মানুষের জীবন দীনহীন ও নানা সংস্কারে পীড়িত। অনগ্রসরতার গ্লানি তাঁর নিত্য সঙ্গী। কিন্তু তিনি সে দীনতাকে চিরস্থায়ী বলে মনে করেননি। তাঁর বঙ্গ সম্ভাবনাময় ও সৃষ্টিশীল এবং প্রাণপদার্থে ঐশ্বর্যশালী ও অঢেল সম্পদে ঊর্বর।
শাশ্বত বঙ্গ গ্রন্থের বক্তব্যে লক্ষ করা যায়, উনিশ শতকের বাংলায় একটি রেনেসাঁস হয়, যার প্রধান নেতা ছিলেন রামমোহন রায়। রামমোহন রায়ের আদর্শ এবং তাঁর অনুত্তেজিত সাহসী যুক্তিবাদিতাকে অত্যন্ত উচ্চমূল্য দেওয়া হয়েছে এ গ্রন্থে। আলোচনা করে দেখাবার চেষ্টা করা হয়েছে রামমোহন থেকে ঢাকার বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলন পর্যন্ত যে সৃষ্টিশীল প্রয়াস, সেটা এ নবজাগরণের প্রেরণার ফল। ব্রাহ্মসমাজ তথা রামমোহন রায়ের পরে ইয়ংবেঙ্গল দলের মুখপাত্র ডিরোজিও, তত্ত্ববোধিনী সভার নেতৃবৃন্দ দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, অক্ষয়কুমার দত্ত, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, রাজনারায়ণ বসু, কেশবচন্দ্র সেন এবং মাইকেল মধুসূদন দত্ত, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, দীনবন্ধু মিত্র, রামকৃষ্ণ, স্বামী বিবেকানন্দ, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, বেগম রোকেয়া, কাজী ইমদাদুল হক, মোহাম্মদ লুৎফর রহমান, মোহাম্মদ এয়াকুব আলী চৌধুরী, কাজী নজরুল ইসলাম-সহ বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলনের আবুল হুসেন, কাজী মোতাহার হোসেন, মোতাহের হোসেন চৌধুরী প্রমুখের চিন্তাভাবনা ও কর্মপ্রয়াস বাংলার নবজাগরণে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। শাশ্বত বঙ্গ গ্রন্থে বাংলার জাগরণবিষয়ক আলোচনায় ইউরোপের উন্নত চিন্তাকে তাই গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা হয়েছে। ব্রিটিশ শাসনের সংঘর্ষে সাংস্কৃতিক আন্দোলন, রাষ্ট্র, রাজনীতি, শিক্ষা, নানা বিষয়ের চিন্তাভাবনা এবং বাংলা ভাষা ও সাহিত্য সৃষ্টিতে এ অঞ্চলের মুক্তিপ্রয়াসী মানুষের একটি অভাবিত প্রেরণা ও উজ্জীবনের কথা এ গ্রন্থে উচ্চারিত। কাজী আবদুল ওদুদ মনে করেন, এ জাগরণ আমাদের শিখিয়েছে স্বদেশপ্রেমে দোষ নেই যতক্ষণ স্বাদেশিকতা না হয় বিশ্ববিমুখ। চিন্তার স্বাধীনতা, যুক্তিবাদিতা, বিবেক এবং বিচার-বুদ্ধির অনুশীলনে অনুপ্রাণিত ও শ্রদ্ধাশীল হতে শিক্ষা দেয় এ নবজাগরণ। ফরাসি বিপ্লবের সাম্য মৈত্রী ও স্বাধীনতার বাণী, বলিষ্ঠ বুদ্ধি ও মনুষ্যত্বের আকাঙ্ক্ষা উনিশ শতকের বাঙালি মানসকে আকৃষ্ট করে; তাকে আলোড়িত করে তোলে মহৎ জীবন ও উন্নত জাতি গঠনের আকাঙ্ক্ষায়। তাই ভারতীয় প্রাচীন পান্ডিত্যের সঙ্গে ইউরোপীয় বিচার-পদ্ধতি ও উদার মানবতাবাদের শিক্ষা গ্রহণ করে এ শতকের শ্রেষ্ঠ মনীষীবৃন্দ, যে শিক্ষা ছিল বাংলার নবজাগরণের মৌল ভিত্তি। এ গ্রন্থে কাজী আবদুল ওদুদ এ মহৎ শিক্ষার কথাই স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন।
শাশ্বত বঙ্গ গ্রন্থের অপর একটি বক্তব্যও বিবেচনাযোগ্য। সমকালের হিন্দু-মুসলমান বিরোধ নিরসনে কাজী আবদুল ওদুদ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ভারতবাসী হওয়া সত্ত্বেও মুসলিম সমাজ যখন কোনো কোনো ব্রিটিশ ঐতিহাসিক এবং ব্রিটিশ শাসকদের প্ররোচনায় নিজেদের আলাদা জাতি ভাবতে শুরু করে, কেননা তারা মনে করে যে, তারা আরব ও ইরানি রক্তের উত্তরাধিকার বহন করছে, তখন তিনি এ ধারণার বিরুদ্ধে কলম ধরেন। তিনি দেখাবার চেষ্টা করেন, ভারতবর্ষে হিন্দু আর মুসলমানের স্বাতন্ত্র্য নিশ্চিহ্ন হয়নি কোনোদিন, কিন্তু উভয় সমাজের শ্রেষ্ঠ চিন্তাভাবনা এবং সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড মধ্যযুগে প্রায় একমুখী হয়ে পড়ে। এটা হবার কারণ, সাংস্কৃতিক আবহে তারা সাধারণভাবে ভারতবর্ষীয়। নৃতত্ত্বগত রক্তের বিতর্কের চেয়েও এটা বড় সত্য। এর প্রমাণ রয়েছে বাউল-সাহিত্য ও মুসলমান-বৈষ্ণব কবিদের রচনায়। ইতিহাসের এ বাস্তবতা স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয়েছে শাশ্বত বঙ্গে, যেমন গবেষণা করে দেখিয়েছেন ক্ষিতিমোহন সেন তাঁর মধ্যযুগে ভারতীয় সাধনার ধারা (১৯৩০) গ্রন্থে। কাজী আবদুল ওদুদের এ মহৎপ্রয়াস সম্বন্ধে রবীন্দ্রনাথ বলেন, এদেশে হিন্দু-মুসলমান-বিরোধের বিভীষিকায় মন যখন হতাশ্বাস হয়ে পড়ে, এই বর্বরতার অন্ত কোথায় ভেবে পায় না, তখন মাঝে মাঝে দূরে দূরে সহসা দেখতে পাই দুই বিপরীত কূলকে দুই বাহু দিয়ে আপন করে আছে এমন এক-একটি সেতু। আবদুল ওদুদ সাহেবের চিত্তবৃত্তির ঔদার্য সেই মিলনের একটি প্রশস্ত পথ রূপে যখন আমার কাছে প্রতিভাত হয়েছে তখনি আশান্বিত মনে আমি তাঁকে নমস্কার করেছি। সেই সঙ্গে দেখেছি তাঁর মননশীলতা, তাঁর পক্ষপাতহীন সূক্ষ্ম বিচারশক্তি, বাংলাভাষায় তাঁর প্রকাশশক্তির বিশিষ্টতা। তাই একদিন সমাদরপূর্বক তাঁকে শান্তিনিকেতন আশ্রমে আহবান করেছি, অনুরোধ করেছি বিশ্ব-ভারতীর বিদ্যাভবনে বক্তৃতা করবার জন্যে।
কাজী আবদুল ওদুদ অর্থনীতির ছাত্র ছিলেন, কিন্তু তাঁর অনুরাগ ছিল সাহিত্যে। তাঁর সাহিত্যবিষয়ক অনেকগুলি রচনা এ গ্রন্থে সঙ্কলিত হয়েছে। রচনাগুলিতে দেখা যায়, সাহিত্য তাঁর কাছে বিচ্ছিন্ন কোনো সৃষ্টি নয়। সাহিত্য সম্বন্ধে তাঁর বক্তব্য: মানুষের জীবন অসম্পূর্ণ। মানুষ পূর্ণ জীবনের স্বপ্ন দেখে সাহিত্যে। সাহিত্যবিচারে তাই নান্দনিকতার গুরুত্ব স্বীকার করেও তিনি প্রধানত তার উপযোগিতা ও বক্তব্যের ওপর জোর দিতে আগ্রহী।
রামমোহন রায় ছিলেন কাজী আবদুল ওদুদের প্রিয় ব্যক্তিত্ব। হয়তো এ কারণে তিনি তাঁর বক্তব্যে সংহতি এবং চিন্তার পরিচ্ছন্নতায় রামমোহন রায়ের বিচারধারায় অনুপ্রাণিত ছিলেন। শুধু তাই নয়, রামমোহনের রচনারীতির প্রতিফলনও পরিলক্ষিত হয় কাজী আবদুল ওদুদের রচনায়। তবে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য এবং উনিশ ও বিশ শতকের চিন্তাভাবনা, বুদ্ধিবৃত্তিক ঐতিহ্যে তাঁর রচনার স্থান সম্পর্কে অবহিত হবার জন্য শাশ্বত বঙ্গ পড়তে হয়। [মুহম্মদ সাইফুল ইসলাম]