মুসলিম সাহিত্য-সমাজ
মুসলিম সাহিত্য-সমাজ ঢাকা ইন্টারমিডিয়েট কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন যুক্তিবাদী ও প্রগতিশীল শিক্ষক ও ছাত্রের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক সংগঠন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মুসলিম হল ইউনিয়ন কক্ষে বাংলা ও সংস্কৃতি বিভাগের অধ্যাপক ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর সভাপতিত্বে ১৯২৬ সালের ১৯ জানুয়ারি মুসলিম সাহিত্য-সমাজ প্রতিষ্ঠিত হয়। সংগঠনটির পরিচালনার দায়িত্ব অর্পণ করা হয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি ও বাণিজ্য বিভাগের অধ্যাপক আবুল হুসেন, মুসলিম হলের ছাত্র এ.এফ.এম আবদুল হক, ঢাকা ইন্টারমিডিয়েট কলেজের ছাত্র আবদুল কাদির প্রমুখের ওপর। এরাই ছিলেন প্রথম কার্যনির্বাহী সংসদের সদস্য। নেপথ্যে থেকে দায়িত্ব পালন করতেন ঢাকা ইন্টারমিডিয়েট কলেজের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক কাজী আবদুল ওদুদ ও যুক্তিবিদ্যার অধ্যাপক কাজী আনোয়ারুল কাদীর।
মুসলিম সাহিত্য-সমাজের মূলমন্ত্র ছিল বুদ্ধির মুক্তি। বুদ্ধির মুক্তি বলতে তাঁরা বুঝতেন অন্ধ সংস্কার ও শাস্ত্রানুগত্য থেকে মানুষের বিচারবুদ্ধিকে মুক্তি দান। সংগঠনটি যে নবজাগরণের আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে সমাজকর্ম ও সাহিত্যচর্চায় ব্রতী হয় তার মূলে ছিল তুর্কি জাতি প্রতিষ্ঠায় মুস্তফা কামাল পাশার উদ্যম, ভারতের নবজাগরণে বিভিন্ন মণিষীর প্রয়াস এবং মানবতার উদ্বোধনে সর্বকালের চিন্তাচেতনার সংযোগ। এ সংগঠনের লেখকগণ তাঁদের চিন্তাধারাকে বাঙালি সমাজের কাছে পৌঁছে দেবার জন্য তিনটি পথ অবলম্বন করেন: পত্রপত্রিকা প্রকাশ, সাময়িক অধিবেশন ও বার্ষিক সম্মেলনের ব্যবস্থা এবং গ্রন্থরচনা ও প্রকাশ। মুসলিম সাহিত্য-সমাজ প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য সম্পর্কে প্রতিষ্ঠানের সম্পাদক আবুল হুসেন প্রথম বর্ষের বার্ষিক বিবরণীতে ঘোষণা করেন, চিন্তাচর্চা ও জ্ঞানের জন্য আকাঙ্ক্ষা সৃষ্টি এবং আবহমানকালের চিন্তা ও জ্ঞানের সঙ্গে সংযোগ সাধনই তাদের প্রধান লক্ষ।
মুসলিম সাহিত্য-সমাজের বার্ষিক মুখপত্র শিখা প্রথম প্রকাশিত হয় ১৩৩৩ বঙ্গাব্দের চৈত্র মাসে। শিখার মোট পাঁচটি সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছিল। প্রথম সংখ্যা আবুল হুসেন, দ্বিতীয় ও তৃতীয় সংখ্যা কাজী মোতাহার হোসেন, চতুর্থ সংখ্যা মোহাম্মদ আবদুর রশিদ এবং পঞ্চম সংখ্যা আবুল ফজল সম্পাদনা করেন। শিখার প্রতিটি সংখ্যায় মুসলিম সাহিত্য-সমাজের সাময়িক অধিবেশন ও বার্ষিক সম্মেলনের বিবরণ এবং সাহিত্য-সভায় পঠিত রচনা প্রকাশিত হত। শিখার মুখবাণী ছিল -‘জ্ঞান যেখানে সীমাবদ্ধ, বুদ্ধি সেখানে আড়ষ্ট, মুক্তি সেখানে অসম্ভব’।
মুসলিম সাহিত্য-সমাজের কার্যক্রম দশ বছর (১৯২৬-১৯৩৬) সক্রিয়ভাবে চালু ছিল। দ্বাদশ বর্ষের দ্বিতীয় অধিবেশনের (২৯ ডিসেম্বর, ১৯৩৮) কার্যবিবরণী থেকে জানা যায়, প্রায় ১০/১১ মাস পূর্বে কাজী আবদুল ওদুদের সেগুন বাগানের বাসায় মাহবুব-উল আলমের সভাপতিত্বে দ্বাদশ বর্ষের প্রথম অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। দ্বাদশ বর্ষের দ্বিতীয় অধিবেশনের সভাপতি ছিলেন সমিতির তৎকালীন সম্পাদক আজহারুল ইসলাম। এটিই ছিল মুসলিম সাহিত্য-সমাজের শেষ অধিবেশন। একাদশ বর্ষের কোনো কার্যবিবরণী পাওয়া যায়নি। এ থেকে অনুমিত হয় যে, একাদশ বর্ষে মুসলিম সাহিত্য-সমাজ স্থবির ছিল। এ সময় কিছু উৎসাহী ব্যক্তি কাজী আবদুল ওদুদ ও কাজী মোতাহার হোসেনকে সামনে রেখে ১৯৩৮ সালের জানুয়ারি মাসে মুসলিম সাহিত্য-সমাজকে পুনরুজ্জীবিত করার চেষ্টা করেন। কিন্তু ওই বছরের শুরুতে ও শেষে প্রথম ও দ্বিতীয় অধিবেশনের ব্যবস্থা করা গেলেও মুসলিম সাহিত্য-সমাজকে আর সক্রিয় করে তোলা সম্ভব হয়নি।
মুসলিম সাহিত্য-সমাজের সদস্যবৃন্দ তাঁদের প্রতিষ্ঠানের নামের সঙ্গে মুসলিম শব্দটি ব্যবহার করলেও তাঁরা সাম্প্রদায়িক ছিলেন না। এ প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন অধিবেশনে অভ্যাগতজনের উপস্থিতির তালিকা পরীক্ষা করলেই এ কথার সত্যতা প্রমাণিত হবে। এ প্রতিষ্ঠানের প্রথম অধিবেশনের সভাপতি ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা ও সংস্কৃত বিভাগের অধ্যাপক ও সাহিত্য সমালোচক চারু বন্দোপাধ্যায়। প্রথম বার্ষিক সম্মেলনে (১৯২৭ সালের ২৭ ও ২৮ ফেব্রুয়ারি) সভাপতি ছিলেন ঢাকা কলেজিয়েট স্কুলের প্রধান শিক্ষক খানবাহাদুর তসদ্দক আহমদ। সম্মেলনের কার্যসূচিতে প্রতিষ্ঠাতাদের নাম ছাড়াও কাজী নজরুল ইসলাম, রমেশচন্দ্র মজুমদার, মোহাম্মদ কাসেম, সুশীলকুমার দে, সৈয়দ এমদাদ আলী, অধ্যাপক চারু বন্দোপাধ্যায়, খান বাহাদুর আবদুর রহমান খান, বীরেন্দ্রনাথ গাঙ্গুলী প্রমুখের নাম মুদ্রিত আছে।
মুসলিম সাহিত্য-সমাজের সংগঠকদের লক্ষ্য ছিল সাহিত্যচর্চার মধ্য দিয়ে তাঁদের চিন্তাভাবনা বাঙালি সমাজের কাছে তুলে ধরা। বাঙালি সমাজ বলতে হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে সকল বাংলা ভাষাভাষী অধিবাসীকেই বুঝায়। কিন্তু রাজনীতি, অর্থনীতি ও সংস্কৃতির দিক থেকে এ সময়ের বাঙালি মুসলমান সমাজ হিন্দু সমাজ থেকে অনেক পেছনে পড়েছিল। মুসলিম সাহিত্য-সমাজকে তাই পশ্চাৎপদ মুসলমান সমাজের কথা বিশেষভাবে ভাবতে হয়েছে। তাই তাঁরা মুসলিম সাহিত্য-সমাজের বিভিন্ন অধিবেশনে প্রবন্ধপাঠ, আলোচনা ও ভাষণের মাধ্যমে মাতৃভাষা, শিক্ষাব্যবস্থা, অর্থনৈতিক অবস্থা, রাজনৈতিক সমস্যা, ললিতকলার চর্চা, ধর্মীয় রীতিনীতির ব্যাখ্যা প্রভৃতি বিষয়ে বাঙালি মুসলমান সমাজকে সচেতন করে তুলতে চেষ্টা করেন।
মুসলিম সাহিত্য-সমাজের লেখকগণ কখনও প্রত্যক্ষ রাজনীতির সঙ্গে নিজেদের যুক্ত করতে চাননি। সাহিত্য, সংস্কৃতি ও মানবতার শাশ্বত আদর্শকে সামনে রেখেই তাঁরা রাজনীতি, অর্থনীতি, শিক্ষা, ললিতকলা ও ধর্ম সম্পর্কে তাঁদের অভিমত ব্যক্ত করেছেন। মুসলিম সাহিত্য-সমাজের লেখকগণ ছিলেন রেনেসাঁর সাধক। তাই তাঁদের চিন্তাধারা ও জীবনাদর্শ স্বল্পসংখ্যক চিন্তাশীল মানুষের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকা অস্বাভাবিক নয়। মুসলিম সাহিত্য-সমাজের সাফল্য এখানে যে, তাঁদের প্রদর্শিত পথে অগ্রসর হয়ে বাঙালি মুসলমান সমাজ মাত্র কয়েক দশকের মধ্যেই প্রগতির পক্ষে অগ্রসর হতে পেরেছে। [খোন্দকার সিরাজুল হক]
গ্রন্থপঞ্জি আবদুল হক, সাহিত্য ঐতিহ্য মূল্যবোধ, ঢাকা, ১৯৬৮; খোন্দকার সিরাজুল হক, মুসলিম সাহিত্য-সমাজ : সমাজচিন্তা ও সাহিত্যকর্ম, ঢাকা ১৯৮৪ ও ২০০৬; Sibnaryan Ray, A New Renaissance and Allied Essays, Calcutta, 1998; হাবিব রহমান সম্পাদিত, মুসলিম সাহিত্য-সমাজ-এর বার্ষিক অধিবেশন: সভাপতির অভিভাষণ, ঢাকা, ২০০২; মুস্তাফা নূর-উল ইসলাম সম্পাদিত শিখা সমগ্র, ঢাকা, ২০০৩।