রাজনৈতিক দল

রাজনৈতিক দল উনিশ শতকের শেষপর্বে ঔপনিবেশিক শাসনবিরোধী জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় ভারতবর্ষে প্রথম রাজনৈতিক দলের উত্থান ঘটে।

১৮৮৫ পরবর্তী রাজনৈতিক দল একটি আনুষ্ঠানিক রাজনৈতিক দল হিসেবে নিখিল ভারত জাতীয় কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠার পর স্বল্প সময়ে অনুরূপ কোন সংগঠন গড়ে ওঠেনি। এ সময় মুসলমানদের স্বতন্ত্র রাজনীতির ক্ষেত্র তৈরি হতে থাকে। কংগ্রেসে যোগদান অথবা পৃথক রাজনৈতিক দল গঠন করার পরিবর্তে মুসলিম নেতৃবৃন্দ সমিতি ভিত্তিক রাজনীতির পুরনো ধারা অব্যাহত রাখেন। নওয়াব আব্দুল লতিফের মোহামেডান লিটারেরি সোসাইটি (১৮৬৩) এবং সৈয়দ আমীর আলীর সেন্ট্রাল ন্যাশনাল মোহামেডান অ্যাসোসিয়েশন (১৮৭৭) এই পদ্ধতি অনুসরণ করে। মুসলিম নেতৃবৃন্দের প্রবণতা ছিল ব্রিটিশ শাসনের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন। বঙ্গভঙ্গ (১৯০৫) পরবর্তী রাজনীতির আলোকে ১৯০৬ সালে ৩০ ডিসেম্বর নিখিল ভারত মুসলিম লীগ গঠন করা হয়। ঢাকার নওবাব সলিমুল্লাহ মুসলিম লীগ গঠনের উদ্যোগ নেন।

জাতীয় কংগ্রেস এবং মুসলিম লীগ ছাড়াও কিছু কিছু বিপ্লবী গোষ্ঠী বিশ শতকের গোড়ার দিক থেকে তাদের কর্মকাণ্ড শুরু করে। এদের মধ্যে প্রধান দুটি সংগঠন ছিল অনুশীলন সমিতি এবং যুগান্তর দল। অনুশীলন সমিতির কেন্দ্রীয় সংগঠন ১৯০৬ সাল থেকে ঢাকায় তাদের কর্মকাণ্ড শুরু করে বলে জানা যায়। অপর তিনটি স্বতন্ত্র সমিতি বরিশাল, ফরিদপুর ও ময়মনসিংহে তাদের সদর দপ্তর স্থাপন করে সাংগঠনিক কার্যক্রম শুরু করে। ১৯০৮ সাল পর্যন্ত কেন্দ্রীয় অনুশীলন সমিতি একটি সাংস্কৃতিক সংগঠন হিসেবে প্রকাশ্যেই তাদের কর্মকাণ্ড চালিয়ে যেতে থাকে। তবে পূর্ববঙ্গের বিভিন্ন স্থানে সক্রিয় এদের গোপন শাখাসমূহের সদস্য পদ হিন্দুদের জন্যই সংরক্ষিত ছিল। যুগান্তর গ্রুপ ১৯০৬ সালে কলকাতায়ও প্রতিষ্ঠিত হয় এবং এটিরও লক্ষ্য ছিল সন্ত্রাসমূলক কর্মকাণ্ড পরিচালনার মাধ্যমে ভারতে ব্রিটিশ শাসনের অবসান ঘটানো। বিশ শতকের বিশের দশক এবং ত্রিশের দশকের প্রথম দিকে বিপ্লবী রাজনৈতিক দলগুলোর অবক্ষয় শুরু হয় এবং এদের স্থলে নতুন সাম্যবাদী দল গড়ে উঠতে থাকে। এগুলোর মধ্যে সর্বপ্রথম দল ছিল ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি। ১৯২৫ সালে এ সংগঠনটি গঠিত হয়।

কৃষক দলসমূহ বিশ শতকের বিশের দশকে নির্বাচনী রাজনীতি শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কৃষক রাজনীতির সূচনা ঘটে। প্রতিটি প্রধান রাজনৈতিক দল কৃষক সংগঠন হিসেবে সহযোগী সংগঠন গড়ে তোলে। কংগ্রেস প্রতিষ্ঠিত কৃষক দল ছিল বঙ্গীয় প্রাদেশিক কৃষক সভা এবং কলকাতাভিত্তিক মুসলিম নেতৃবৃন্দ কর্তৃক গঠিত হয় নিখিল বঙ্গ প্রজা পার্টি ও প্রজাপার্টি। কিছুসংখ্যক আইনজীবী এবং সাংবাদিকের সমর্থন নিয়ে এ.কে ফজলুল হক ক্যালকাটা এগ্রিকালচারাল অ্যাসোসিয়েশন গঠন করেন। ১৯৩৫ সালে ফজলুল হক কৃষক প্রজা পার্টি গঠন করেন। তিনি অপরাপর কৃষক উপদলগুলোকে তার দলে নিয়ে আসতে সক্ষম হন। চিত্তরঞ্জন দাশ| ১৯২২ সালে স্বরাজ্য পার্টি গঠন করেছিলেন কংগ্রেসের একটি শাখা সংগঠন হিসেবে। পরবর্তী দুই দশকে হিন্দু মহাসভা, আঞ্জুমান-ই-উলামা, ফরওয়ার্ড ব্লক (১৯৩৯), রেভলুশন্যারী সোশালিস্ট পার্টি (১৯৪০), র‌্যাডিক্যাল ডেমোক্রাটিক পার্টি (১৯৪০), জামায়াত-ই-ইসলামী হিন্দ (১৯৪১)-এর মতো কয়েকটি সাম্প্রদায়িক ও বামপন্থী দল আত্মপ্রকাশ করে।

১৯৪৭ পরবর্তী দলসমূহ ১৯৪৭ সালের ডিসেম্বর মাসে নিখিল ভারত মুসলিম লীগের পরিবর্তিত নামকরণ হয় পাকিস্তান মুসলিম লীগ। ১৯৪৮ সাল থেকে মুসলিম লীগের অতি দ্রুত অবক্ষয় রাজনৈতিক দলের ইতিহাসে সর্বাধিক লক্ষণীয়। মুসলিম লীগের সাথে ভিন্নমত পোষণকারী ব্যক্তিবর্গ আওয়ামী মুসলিম লীগ, নেজামে ইসলাম, খিলাফত-ই-রব্বানী পার্টি, কৃষক শ্রমিক পার্টি ইত্যাদির মতো সংগঠন গড়ে তোলেন। মূল দল মুসলিম লীগের ভাঙনের মধ্য দিয়েই এ সকল দল গড়ে ওঠে। ১৯৫৪ সালে অনুষ্ঠিত পূর্ববঙ্গ আইন পরিষদ নির্বাচনে মুসলিম লীগের ভরাডুবি হয়েছিল। এ নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট একচেটিয়া বিজয় অর্জন করে।

পাকিস্তানে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা ১৯৫৮ সালের ৭ অক্টোবর সামরিক আইন জারির সুযোগ করে দেয় এবং এ আইনের বলে সব ধরনের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়। সামরিক একনায়ক আইয়ুব খান তাঁর সামরিক শাসনকে বেসামরিক রূপ দেয়ার উদ্দেশ্যে ১৯৬২ সালে রাজনৈতিক দলগুলিকে পুনরায় তাদের কর্মতৎপরতা চালানোর অনুমতি দেন। আইয়ুব খান মুসলিম লীগে ভাঙন সৃষ্টি করেন এবং এর এক অংশ নিয়ে পাকিস্তান মুসলিম লীগ (কনভেনশন) নামে নিজস্ব একটি রাজনৈতিক দল গঠন করেন। ১৯৬৩ সালে তিনি এই দলটির সভাপতি হন। কাউন্সিল মুসলিম লীগ বা মুসলিম লীগ (কাউন্সিল) নামে পরিচিত মুসলিম লীগের অপর অংশটি মূলত কেবল পশ্চিম পাকিস্তান ভিত্তিক একটি রাজনৈতিক দলে পরিণত হয় এবং তখন থেকেই এই দলটির ক্রমাগত ক্ষয়িষ্ণু দশা শুরু হয়। আইয়ুব খানের নেতৃত্বাধীন পাকিস্তান মুসলিম লীগ ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত পাকিস্তানের শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ছিল; তবে এ বৎসরেই পাকিস্তানের উভয় অংশে সংঘটিত ব্যাপক গণ অভ্যুত্থান আইয়ুব খানকে ক্ষমতা থেকে সরে দাঁড়াতে বাধ্য করে।

স্বাধীনতা পরবর্তী রাজনৈতিক দল ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ-এর সময় পাকিস্তান মুসলিম লীগের উভয় অংশ পাকিস্তানকে সমর্থন করেছিল এবং একারণেই বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর মুসলিম লীগের উভয় অংশই নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়। ১৯৭৬ সালের জুলাই মাসে বাংলাদেশ মুসলিম লীগ নামে ঐ দলকে পুনরুজ্জীবিত করা হয়। মুসলিম লীগ বর্তমানে বহুধা বিভক্ত এবং এর পক্ষে জনসমর্থন খুবই কম।

জামায়াতে ইসলামী ১৯৪১ সালের ২৬ আগস্ট সৈয়দ আবুল আ’লা মওদুদী কর্তৃক জামায়াতে ইসলামী হিন্দ প্রতিষ্ঠিত হয়। ভারত বিভক্তির পরবর্তীতে পাকিস্তানে একটি ইসলামী শাসনতন্ত্র প্রণয়নের দাবি জানিয়ে জামায়াত জনসমর্থন লাভের প্রচেষ্টা চালায়। জামায়াত পূর্ব পাকিস্তানে তেমন সাড়া জাগাতে বা আবেদন সৃষ্টি করতে পারে নি এবং ১৯৭০ সালে অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে সবগুলো ইসলামী দল মিলিতভাবে পূর্ব পাকিস্তান থেকে পাকিস্তান গণপরিষদের মাত্র একটি আসন লাভ করতে সক্ষম হয়। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে জামায়াতে ইসলামী রাজনৈতিকভাবে শুধু বিরোধিতা করেই ক্ষান্ত থাকেনি বরং এই দলের নেতা-কর্মীরা প্রত্যক্ষভাবে বাঙালি নিধনে ভূমিকা পালন করে। স্বাধীনতা পর ১৯৭২ সালে ধর্মভিত্তিক সকল দল নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়। তবে ১৯৭৬ সালে অন্যান্য অনেক রাজনৈতিক দলের সঙ্গে এই দলকেও পুনরুজ্জীবিত করার অনুমতি দেয়া হয়। নব্বই দশকে এ দলটি এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে যোগ দেয় এবং কিছুটা জনপ্রিয়তা অর্জন করে। দেশের বিভিন্ন স্থানে এ দলের সমর্থন রয়েছে। বিএনপির পৃষ্ঠপোষকতায় দলটি রাজনৈতিকভাবে শক্তি অর্জন করতে সক্ষম হয়। ২০০১ সালের নির্বাচনে দলটি ১৯টি আসনে জয়ী হয়ে বিএনপির সাথে ঐক্যবদ্ধ হয়ে সরকার গঠন করে। ২০০৮ সালের নির্বাচনে দলটির ৪.৭০% ভোট পেয়ে দুটি আসনে জয়ী হয়। ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠন করে এবং যুদ্ধাপরাধী জামায়াতে ইসলামী সিনিয়র নেতৃবৃন্দকে বিচারের মুখোমুখি দাঁড় করায়। ট্রাইব্যুনালের বিচারে দলটির প্রধান ও প্রভাবশালী নেতৃবৃন্দ বিভিন্ন মেয়াদে দোষী সাব্যস্ত হয়। এদের মধ্যে দলটির তাত্ত্বিক গোলাম আযমের আমৃত্যু কারাদণ্ড এবং দলটির আমীর এবং সেক্রেটারি জেনারেল যথাক্রমে মওলানা মতিউর রহমান নিজামী এবং আলী আহসান মুহম্মদ মুজাহিদের মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়। গোলাম আযম দণ্ডাদেশ মাথায় নিয়ে ২০১৬ সালে জেলাখানায় মৃত্যুবরণ করেন। এ দলের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মুহম্মদ কামারুজ্জামান, প্রভাবশালী নেতা আব্দুল কাদের মোল্লা, মীর কাসেম আলী সর্বোচ্চ বিচারালয়ের আদেশে যুদ্ধাপরাধে দোষী সাব্যস্ত হয়ে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হন।

১লা আগস্ট ২০১৩ সালে বাংলাদেশ হাইকোর্ট জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন বাতিল করে রায় দেন। হাইকোর্টের রুলে এই সংগঠনের নিবন্ধন অবৈধ এবং সংগঠনকে নির্বাচনের অযোগ্য ঘোষণা করেন একই বছর ৫ আগস্ট আপিল বিভাগ এই রায় বহাল রাখে।

আওয়ামী লীগ ১৯৪৮ সালের মার্চ মাসে হোসেন শহীদ সোহ্‌রাওয়ার্দী পাকিস্তান ন্যাশনাল লীগ নামে নতুন একটি রাজনৈতিক দল গঠন করার সিদ্ধান্ত নেন। ১৯৪৯ সালের গোড়ার দিকে দলের ভেতরেই রক্ষণশীল এবং প্রগতিশীলদের মধ্যে বিরোধ চরম আকার ধারণ করে। প্রগতিশীল অংশ ১৯৪৯ সালের জুন মাসের ২৩-২৪ তারিখে অনুষ্ঠিত এক সম্মেলনে মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর নেতৃত্বে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ (ইপিএএল) গঠন করেন। শেখ মুজিবুর রহমান এই দলের একজন সক্রিয় নেতা ছিলেন এবং খোন্দকার মোশতাক আহমদের সঙ্গে যৌথভাবে দলের যুগ্ম সম্পাদক হন। ১৯৫০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ (এপিএএল) প্রতিষ্ঠা লাভ করে। ১৯৫৫ সালের অক্টোবর মাসে অনুষ্ঠিত এ দলের কাউন্সিল অধিবেশনে দলের নাম থেকে মুসলিম শব্দটি বাদ দেয়া হয়। শুরু থেকেই এ দলটির ভেতর দুটি সুনির্দিষ্ট মতধারার অনুসারীদের উপদল ছিল; এর একটি ছিল হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে মার্কিনপন্থী ধারা এবং অপরটি ছিল মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে গণমুখী বামপন্থী ধারা। এই মতপার্থক্যগত বিরোধ ১৯৫৭ সালের জুলাই মাসে দলটিকে আরও একটি ভাঙনের দিকে ঠেলে দেয়, যখন মওলানা ভাসানী আওয়ামী লীগের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) গঠন করেন।

১৯৬২ সালের ৪ অক্টোবর গঠিত ন্যাশনাল ডেমোক্র্যাটিক ফ্রন্টের (এন.ডি.এফ) একটি অংশ হিসেবে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ পূর্ব পাকিস্তানে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতে থাকে। তবে ১৯৬৪ সালের ২৫-২৬ জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিত দলের কার্যনির্বাহী কমিটির সভায় গৃহীত এক সিদ্ধান্ত অনুযায়ী পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগকে পূর্ব পাকিস্তানে একটি পূর্ণাঙ্গ রাজনৈতিক দল হিসেবে আনুষ্ঠানিকভাবে পুনরুজ্জীবিত করা হয়। অবশ্য পশ্চিম পাকিস্তান আওয়ামী লীগের পুনরুজ্জীবন ঘটে এর কিছু দিন আগেই। একই বছর মার্চ মাসে নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগ পুনর্গঠিত হলেও এটি একটি দলীয় ইশতেহার প্রণয়নে ব্যর্থ হয় এবং কার্যত পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ একটি স্বাধীন সত্তা সম্পন্ন রাজনৈতিক দল হিসেবে এর কর্মকাণ্ড শুরু করে। পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যকার বৈষম্যের বিষয়টি ইতোমধ্যে বেশ কিছুসংখ্যক বুদ্ধিজীবী, বেসামরিক সরকারি কর্মকর্তা এবং ব্যবসায়ী/শিল্পপতিদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুর পর তেমন কোনো নেতার আবির্ভাব ঘটেনি যিনি নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগের দুই প্রাদেশিক অংশের মধ্যে যোগসূত্র রক্ষা করতে পারতেন। এই পটভূমিতে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমান পূর্ব পাকিস্তানের ভবিষ্যৎ মতাদর্শিক ও রাজনৈতিক গতিধারা অনুধাবন করে ছয় দফা কর্মসূচির ভিত্তিতে স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে আন্দোলন গড়ে তোলেন।

ছয় দফা কর্মসূচি ব্যাপক জনসমর্থন লাভ করে। কিন্তু শেখ মুজিবকে গ্রেফতার করা হয় এবং রাষ্ট্রদ্রোহীতার অভিযোগে আগরতলা মামলায় (১৯৬৮) অভিযুক্ত করা হয়। এই পর্যায়ে মূখ্যত ছাত্রদের নেতৃত্বে সংঘটিত একটি গণঅভ্যুত্থান-এর (১৯৬৯) মুখে সরকার মামলা প্রত্যাহার করে শেখ মুজিবুর রহমানসহ মামলার অন্যান্য অভিযুক্তদের মুক্তি দিতে বাধ্য হয়।

১৯৭০ সালে অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ বিপুল বিজয় অর্জন করে। কিন্তু পাকিস্তানের সামরিক কর্তৃপক্ষ এবং পাকিস্তান পিপলস পার্টির প্রধান জুলফিকার আলী ভুট্টো নির্বাচনের এই ফলাফল মেনে নিতে অস্বীকার করেন। পাকিস্তান সেনাবাহিনী ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ থেকে বাংলাদেশে সুপরিকল্পিতভাবে গণহত্যা শুরু করে। শেখ মুজিবকে গ্রেফতার করা হয় এবং বন্দি হিসেবে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া হয়। আওয়ামী লীগের অধিকাংশ নেতাই দেশত্যাগ করে ভারতে চলে যান এবং ১৯৭১ সালের ৫-৬ জুলাই তারিখে দলের নাম পরিবর্তন করে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ রাখা হয়। তাঁরা ইতোমধ্যে ১০ এপ্রিল মুজিবনগরে স্বাধীন বাংলাদেশের একটি অস্থায়ী সরকার গঠন করেন এবং মুক্তিযুদ্ধ শেষে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর নতুন রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ১৯৭৩ সালে অনুষ্ঠিত দেশের প্রথম সাধারণ নির্বাচনে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ বিপুল বিজয় অর্জন করে। কিন্তু দেশের ক্রমাবনতিশীল অর্থনৈতিক পরিস্থিতি এবং ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষের পটভূমিতে আওয়ামী লীগ ১৯৭৫ সালে দেশে রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার পদ্ধতি এবং বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ (বাকশাল) নামের একটি দল গঠনের মাধ্যমে একদলীয় রাজনৈতিক ব্যবস্থা প্রবর্তন করে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সংঘটিত এক অভ্যুত্থানে শেখ মুজিবুর রহমান এবং তাঁর পরিবারের অধিকাংশ সদস্যের নির্মম হত্যাকাণ্ডের সাথে সাথে আওয়ামী লীগের এ অধ্যায়টির অবসান ঘটে।

১৯৭৬ সালে আওয়ামী লীগ নামে এ দলটি এর কর্মকাণ্ড পুনরায় শুরু করে। কিন্তু ১৯৭০ সাল থেকে ১৯৮১ সালের মধ্যে বহু ব্যক্তি এবং অনেকগুলো উপদল আওয়ামী লীগ ত্যাগ করে পৃৃথক পৃথক দল গঠন করে, যেগুলোর মধ্যে রয়েছে আতাউর রহমান খান কর্তৃক গঠিত জাতীয় লীগ (১৯৭০); জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ, ১৯৭২); জেনারেল এম.এ.জি ওসমানী কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত জাতীয় জনতা পার্টি (১৯৭৬); আব্দুর রশীদ তর্কবাগীশের নেতৃত্বাধীন গণ আজাদী লীগ (১৯৭৬) এবং খোন্দকার মোশতাক আহমদের নেতৃত্বাধীন গঠিত বাংলাদেশ ডেমোক্র্যাটিক লীগ (১৯৭৬)।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পর আওয়ামী লীগ চরম বিপর্যয়ের মুখোমুখি হয়। আওয়ামী লীগের অবশিষ্ট নেতৃবৃন্দ দলত্যাগী গ্রুপ ও উপদলসমূহকে পুনরায় একত্রীকরণের মাধ্যমে এবং এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে দলটিকে চাঙ্গা করে তোলেন। ১৯৯১ সালে অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে জাতীয় সংসদে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) ১৪০টি আসনের বিপরীতে এই দল ৮৮টি আসন লাভ করে। ১৯৯৬ সালে অনুষ্ঠিত সংসদ নির্বাচনে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের ১১৬টি আসনের বিপরীতে আওয়ামী লীগ ১৪৬টি আসনে জয়লাভ করে এবং এরশাদের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টি ও জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল আওয়ামী লীগকে সরকার গঠনে সমর্থন দেয়।

এই নির্বাচনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের ২১ বছর পর ক্ষমতায় ফিরে আসে। শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রীর পদ গ্রহণ করেন। এই সময় আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক পদ অলংকৃত করেন জিল্লুর রহমান। ১৯৯২ সালে দলের শক্তিশালী নেতা ও বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহচর ড. কামাল হোসেন আওয়ামী লীগ ত্যাগ করেন এবং গণফোরাম নামে অপর একটি নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করেন। ২০০১ সালের সংসদ নির্চাচনে আওয়ামী লীগ পরাজিত হয়। আবার দলটি বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করে। শেখ হাসিনা সভাপতি আর ২০০২ সালের ডিসেম্বর থেকে নতুন সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বে আসেন রাজনীতিবিদ আব্দুল জলিল। ২০০৫-২০০৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি আদায়ে দলটি প্রবল জনমত গড়ে তোলে। অবশেষে ২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়। কিন্তু সেটি ছিল সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার। ২০০৮ সালের নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ব্যাপক সাফল্য অর্জন করে। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে গড়ে ওঠে মহাজোট। মহাজোট মোট ২৬২টি আসন লাভ করে। তার মধ্যে আওয়ামী লীগ দলগতভাবে ২৩০টি আসনে ব্যাপক জনপ্রিয়তা নিয়ে বিজয়ী হয়।

১৯৮১ সাল থেকে বর্তমান পর্যন্ত আওয়ামী লীগের সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন শেখ হাসিনা। ২০০৯ সাল থেকে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বে ছিলেন সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম। ২০১৬-এর শেষার্ধে আওয়ামী লীগের বার্ষিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় ঢাকার সোহ্্রাওয়ার্দী উদ্যানে। সে সম্মেলনে আওয়ামী লীগের সভাপতি পুনরায় নির্বাচিত হন শেখ হাসিনা। আর সাধারণ সম্পাদক পদে নির্বাচিত হন ওবায়দুল কাদের। ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত কাউন্সিল অধিবেশনে আবার শেখ হাসিনা সভাপতি ও ওবায়দুল কাদের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ২০২২ সালের কাউন্সিলের মাধ্যমে শেখ হাসিনা সভাপতি এবং ওবায়দুল কাদের তৃতীয়বারের মতো সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন।

ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি পঞ্চাশের দশকের মাঝামাঝি সময় থেকেই দেশের পররাষ্ট্র নীতি এবং আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের মতো বিষয়কে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগের দুই নেতা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী এবং মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর মধ্যে বিরোধ ক্রমাগত বৃদ্ধি পেতে থাকে। কৃষক ও শ্রমিকদের উপর প্রভাব বিস্তারকারী জননেতা ভাসানী এ সময় এইচ.এম সোহরাওয়ার্দীকে তাঁর আমেরিকাপন্থী পররাষ্ট্র নীতি এবং পূর্ববঙ্গের স্বায়ত্তশাসনের দাবির প্রতি সমর্থন দানের ক্ষেত্রে উদাসীনতার জন্য দায়ী করেন। এই মতবিরোধ অবশেষে আওয়ামী লীগের মধ্যে একটি ভাঙন সৃষ্টি করে এবং ১৯৫৭ সালের ২৫-২৬ জুলাই অনুষ্ঠিত সম্মেলনে আওয়ামী লীগের মধ্যকার বামধারার মনোভাবসম্পন্ন নেতা-কর্মীদের সমর্থন নিয়ে মওলানা ভাসানী ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) গঠন করেন। ভাসানী নবগঠিত এই দলটির সভাপতি নির্বাচিত হন। দলটি গঠন করার অব্যবহিত পরে এবং এরপর ১৯৬৪ সালের মার্চ মাসে পুনরুজ্জীবনের পর ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বাম রাজনৈতিক দল হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিল। তবে চীন-সোভিয়েত বিরোধের কারণে ১৯৬৭ সালে দলটি ন্যাপ (ভাসানী) এবং মস্কোপন্থী ন্যাপ (ওয়ালী) এ দুভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে। মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বাধীন চীনপন্থী দলের বিপরীতে মস্কোপন্থী ন্যাপ সাবেক পশ্চিম পাকিস্তানে শক্তিশালী ছিল। মওলানা ভাসানী একজন জনপ্রিয় নেতা ছিলেন এবং ১৯৬৯ সালের গণআন্দোলনে তাঁর দল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ১৯৭২ সালে আওয়ামী লীগের বিরোধিতাকারী সর্বপ্রথম দলও ছিল এটি। কিন্তু ১৯৮৮ সালে এ দলটি ১৩টি পৃথক পৃথক দল এবং উপদলে বিভক্ত হয়ে পড়ে। মস্কোপন্থী ন্যাপও অনুরূপভাবে ১৯৭০ এবং ১৯৮০-এর দশক জুড়ে একটি ভাঙন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে কমপক্ষে ৫টি দল এবং উপদলে বিভক্ত হয়।

কমিউনিস্ট পার্টি ১৯৪৮ সালে ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিআই) দ্বিতীয় কংগ্রেস অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিপি) গঠিত হয়। পূর্ব পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টিও (ইপিসিপি) ঢাকায় দপ্তর স্থাপনের মধ্য দিয়ে একই সময়ে গঠিত হয়। পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে এর তেমন একটা সংযোগ ছিল না। দলটি অনেকটা গোপন সংগঠনের মতোই এর কর্মকাণ্ড চালিয়ে যায়, যদিও ১৯৪৫ সালের পূর্ব পর্যন্ত দলটিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয় নি। পূর্ব পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টি (ইপিসিপি) ১৯৬৬ সালে মার্কসবাদী-লেলিনবাদী (এম.এল) বা চীনপন্থী এবং সোভিয়েত পন্থী এ দু ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। আবার ১৯৭০ সাল নাগাদ এম.এল মোট চারটি দলে বিভক্ত হয়ে পড়ে: ইপিসিপি (এমএল), পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টি (ইবিসিপি), কোঅরডিনেশন কমিটি অফ কমিউনিস্ট রেভলুশন্যারীজ (সিসিসিআর) এবং পূর্ব বাংলার শ্রমিক আন্দোলন (ইবিডব্লিউএম)। সময়ের বিবর্তনে এই দলসমূহ মূলত ছোট ছোট অনেকগুলো সশস্ত্র সংগঠন অথবা ক্ষুদ্র দলে বিভক্ত হয়ে যায় এবং বর্তমানে এ ধরনের সর্বমোট ১৮টি দলের পরিচয় পাওয়া যায়।

বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) ১৯৭৮ সালের ১ ফেব্রুয়ারি প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান-এর নেতৃত্বে রাষ্ট্রীয় আনুকূল্য প্রাপ্ত একটি দল হিসেবে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৭৯ সালে অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এই দল দুই-তৃতীয়াংশেরও অধিক আসনে জয়ী হয়। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল থেকে বেশ কিছুসংখ্যক নেতা এতে যোগ দিলে দলটি আরও শক্তিশালী হয়ে ওঠে। ১৯৮১ সালের ৩০ মে এক ব্যর্থ সামরিক অভ্যুত্থানে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান নিহত হন। এরপর ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের নেতৃত্বে সংঘটিত অপর একটি সেনা অভ্যুত্থানে জিয়াউর রহমানের উত্তরসূরী প্রেসিডেন্ট আবদুস সাত্তারও ক্ষমতাচ্যুত হন।

নেতৃত্বের প্রশ্নে ১৯৮৩ সালে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল যখন বিএনপি (সাত্তার), বিএনপি (হুদা) এবং বিএনপি (দুদু) এই তিন ভাগে বিভক্ত হয়ে যায় তখন এটি সংকটের মুখে পড়ে। পরবর্তীকালে বিএনপি দুদু গ্রুপ প্রগতিশীল জাতীয়তাবাদী দল নামে পৃথক একটি রাজনৈতিক দলরূপে আবির্ভূত হয়। জেনারেল এরশাদ রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড অবারিত রেখে নিজস্ব রাজনৈতিক দল গঠন করলে বিএনপি হুদা গ্রুপের নেতা শামসুল হুদা চৌধুরী তাঁর অনুসারীদের নিয়ে জনদলে যোগ দেন। অপরদিকে বিএনপি সাত্তার গ্রুপ বেগম খালেদা জিয়া-র নেতৃত্বে নিজেদের সংগঠিত করার প্রচেষ্টা চালাতে থাকে। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণের প্রশ্নে মতপার্থক্যের কারণে শাহ আজিজুর রহমানের নেতৃত্বে অপর একটি ক্ষুদ্র অংশ এ দলটি ত্যাগ করে। বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি সুসংহত হয় এবং আশির দশকের শেষদিকে এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের মাধ্যমে শক্তি সঞ্চয় করে। ১৯৯১ সালে অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ৮৮টি আসনের বিপরীতে এই দল ১৪০টি আসন লাভ করে। ১৯৯৬ সালে অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে বিএনপি ১১৬টি আসন লাভ করেছিল। ২০০১ সালে অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি’র নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সংসদের দুই তৃতীয়াংশ আসনে জয়লাভ করে সরকার গঠন করে। ২০০১ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে সংসদ নির্বাচনে অনুষ্ঠিত হয়। এ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার জন্য কিছু ধর্মভিত্তিক ইসলামি দলের সঙ্গে রাজনৈতিক জোট গঠন করে বিএনপি। এ জোট ছিল চারদলীয় জোট এবং জোটে অংশগ্রহণকারী দলগুলি ছিল জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী ঐক্যজোট, জাতীয় পার্টির একাংশ জাতীয় পার্টি (নাজিউর) আর প্রধান নেতৃত্ব দানকারী বিএনপি।

২০০১ থেকে ২০০৬ পর্যন্ত সময়ে বিএনপির নেতৃত্বে সরকার দেশ পরিচালনায় নানাক্ষেত্রে সফল হতে পারেনি। বিশেষত দলীয় দুর্নীতি, আইন-শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতা, উগ্রবাদী জঙ্গি নির্মূলে ব্যর্থতা ছিল বিএনপির জন্যে ভবিষ্যৎ বিপর্যয়ের অশনিসংকেত। ফলে ২০০৭ সালে মিলিটারি সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে দলটি চরম বিপর্যস্ত হয়। দলের নেতাকর্মীকে দুর্নীতির দায়ে জেলে যেতে হয়। স্বয়ং বেগম খালেদা জিয়া এবং তাঁর পুত্রদ্বয় তারেক রহমান ও আরাফাত রহমান দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত হন এবং কারাবাস লাভ করেন। মাঠ পর্যায়ে দলটির সাংগঠনিক দুর্বলতা দেখা দেয়। এ অবস্থায় বিএনপির নেতৃত্বেও দেখা দেয় সংকট। ২০০৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পূর্বে দলটিতে নেতৃত্বের পরিবর্তনের কথা ওঠে। বিশেষ করে জিয়া পরিবারের নেতৃত্ব প্রশ্নে দলটির দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে। সংস্কারপন্থি বলে বিএনপির মহাসচিব আবদুল মান্নান ভূঁইয়ার নেতৃত্বে প্রবীণ কতিপয় নেতা আলাদা হয়ে যান। এ অবস্থায় ২০০৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি মাত্র ৩০টি আসনে বিজয়ী হয়। প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের জ্যেষ্ঠ পুত্র দলের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট তাদের রহমান দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত হন এবং চিকিৎসার জন্য বিদেশ গমন করে আর দেশে ফেরেননি। ২০১৪ সালের সংসদ নির্বাচনে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি পূরণ না হওয়ায় দলটি নির্বাচন বর্জন করে। ২০১৮ সালের নির্বাচনে বিএনপি অংশ নিলেও খুব অল্প সংখ্যক আসন পায়। দলের মহাসচিব শপথ না নিলেও অন্যান্য সদস্য শপথ নিয়ে সংসদে যোগ দেয়। বেগম খালেদা জিয়া দুর্নীতির মামলায় কারাগারে বন্দি থাকায় মাঠপর্যায়ে নেতাকর্মীদের মধ্যে বিরাজ করে হতাশা। বর্তমানে দলে রয়েছে চরম নেতৃত্ব সংকট। দলটির মহাসচিবের দায়িত্ব পালন করছেন মির্জা ফকরুল ইসলাম আলমগীর।

জাতীয় পার্টি (জে.পি) ১৯৮৬ সালের ১ জানুয়ারি লে. জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ-কে চেয়ারম্যান করে গঠিত রাষ্ট্রীয় আনুকূল্য প্রাপ্ত একটি মধ্যপন্থী দল। ১৯৮৬ সালের মে মাসে এবং এরপর ১৯৮৮ সালের মার্চ মাসে অনুষ্ঠিত সংসদ নির্বাচনে এ দল সহজেই বিজয় অর্জন করে, যদিও বলা হয় যে, দুটি নির্বাচনেই ব্যাপক ভোট কারচুপি হয়েছিল। গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের জন্য বিরোধী রাজনৈতিক দলসমূহ এবং ছাত্রদের দ্বারা পরিচালিত আন্দোলনের মুখে ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর এরশাদ পদত্যাগ করতে বাধ্য হন এবং তাঁকে কারারুদ্ধ করা হয়। ১৯৯১ সালে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত দেশের পঞ্চম সংসদ নির্বাচনে জাতীয় পার্টি ৩৫টি আসনে জয়ী হয়ে তৃতীয় বৃহত্তম দল হিসেবে আবির্ভূত হয়। জাতীয় পার্টি এখন নেতৃত্বের প্রশ্নে জাতীয় পার্টি (এরশাদ), জাতীয় পার্টি (আনোয়ার হোসেন মঞ্জু) এবং জাতীয় পার্টি (নাজিউর রহমান মঞ্জু) এই তিন ভাগে বিভক্ত।

বাংলাদেশের রাজনৈতিক দল ব্যবস্থায় জাতীয় পার্টির একটি বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। ১৯৮৬ সালে জাতীয় পার্টি প্রতিষ্ঠিত হয়। রাজনৈতিক দল ব্যবস্থার ইতিহাসে জাতীয় পার্টিকে নবীন রাজনৈতিক দলই বলা যায়। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে (১৯৮৬-২০১৯) জাতীয় পার্টি হুসেই মুহম্মদ এরশাদের নেতৃত্বেই পরিচালিত হয়। ২০১৯ সালের জুলাই মাসে এরশাদের মৃত্যুর পর বাংলাদেশের অন্যতম রাজনৈতিক দল জাতীয় পার্টির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান জি এম কাদেরকে দলের নতুন চেয়ারম্যান হিসেবে ঘোষণা করা হয়। জাতীয় পার্টি একাদশ জাতীয় সংসদে বিরোধী দলের দায়িত্ব পালন করে।

জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পর একটি বামপন্থী দল হিসেবে আবির্ভূত হয়। আওয়ামী লীগের ছাত্র সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগের ভাঙন থেকেই এর উৎপত্তি। সিরাজুল আলম খান এবং আ.স.ম আব্দুর রবের নেতৃত্বাধীন ছাত্রলীগের বামপন্থী অংশটির হাতেই ১৯৭২ সালের ৩১ অক্টোবর জাসদের গোড়াপত্তন হয় এবং মেজর (অব) এম.এ জলিল ও আব্দুর রব দলের যুগ্ম-আহ্বায়ক হন। দলটির লক্ষ্য ছিল বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র এবং কৃষক-শ্রমিকদের নেতৃত্বে বিপ্লব সংঘটিত করার মাধ্যমে একটি শোষণমুক্ত শ্রেণীহীন সমাজ প্রতিষ্ঠা করা। এ দলটি ১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের তীব্র বিরোধিতা করে। আওয়ামী লীগ সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করার লক্ষ্যে এটি একটি গণবাহিনী গঠন করে। ১৯৭৪ থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত সময়কালে এ দল সরকার বিরোধী প্রচণ্ড আন্দোলন গড়ে তোলে। জাসদ জনগণের বিপ্লবী সেনাবাহিনী নামের আড়ালে সেনাবাহিনীর মধ্যে নিজস্ব কিছু গোপন সেল গঠন করে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের অভ্যুত্থান এবং একটি পাল্টা অভ্যুত্থানের পর এই দলের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে সংশ্লিষ্ট লে. কর্নেল (অব) আবু তাহেরের নেতৃত্বে একটি ‘বিপ্লব’ সংঘটিত করারও প্রচেষ্টা নেয়া হয়। সরকার দলটির বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করে এবং এর বহু নেতা ও কর্মীকে গ্রেফতার করা হয়।

খালেকুজ্জামান ভূইয়ার নেতৃত্বে জাসদের একটি অংশ দলত্যাগ করে বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ) নামে একটি নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করে। দলটি নিজেদের প্রকৃত মার্কসবাদী-লেলিনবাদী রাজনৈতিক দল বলে দাবি করে। ১৯৮২ সালে বাসদও দ্বিধা বিভক্ত হয়ে যায়। এর একটি অংশের নেতৃত্বে থাকেন খালেকুজ্জামান ভূইয়া এবং অপর অংশের নেতৃত্ব দেন আ.ফ.ম মাহবুবুল হক। ১৯৮৪ সালে অনুষ্ঠিত উপজেলা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা বা না করার সিদ্ধান্তে জাসদও তিন ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে। শাহজাহান সিরাজের নেতৃত্বাধীন জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল ১৯৮৬ সালে জাসদ (সিরাজ) এবং জাসদ (ইনু) এই দু ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। আরও এক দফা ভাঙনের মধ্য দিয়ে জাসদ (রাজা) নামে আরও একটি পৃথক রাজনৈতিক দল জন্ম নেয় এবং এটি ১৯৯১ সালে আওয়ামী লীগের সাথে একীভূত হয়ে যায়। ২০০৮ সালে জাসদের হাসানুল হক ইনুর অংশ আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪-দল ও মহাজোট সরকারে অন্তর্ভুক্ত হয়। অন্যান্য অংশ প্রায় অস্তিত্বহীন।

ইসলামী ঐক্যজোট (আই.ও.জে) ১৯৯০ সালে খেলাফত মজলিস, নেজাম-ই-ইসলাম, ফারায়জি জামাত, ইসলামী মোর্চা, উলেমা কমিটি, ন্যাপের (ভাসানী) ক্ষুদ্র একটি অংশ এবং ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলন, এই সাতটি রাজনৈতিক দলের সমন্বয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়। এর মূল লক্ষ্য হচ্ছে খেলাফতের আদর্শে একটি ইসলামী রাষ্ট্রব্যবস্থা কায়েমের উদ্দেশ্যে একটি ঐক্যবদ্ধ রাজনৈতিক আন্দোলন গড়ে তোলা। ইসলামী ঐক্যজোটের সাংগঠনিক কাঠামোর মধ্যে রয়েছে জোটভুক্ত প্রতিটি দল থেকে পাঁচ জন করে সদস্যের সমন্বয়ে গঠিত একটি মজলিশ-ই-শুরা এবং একটি উপদেষ্টা পরিষদ। ১৯৯৬ সালে অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে ইসলামী ঐক্যজোট একটি মাত্র সংসদীয় আসন লাভ করে।

গণ ফোরাম প্রখ্যাত আইনজীবী এবং আওয়ামী লীগের সাবেক নেতা কামাল হোসেন ১৯৯২ সালে গণ ফোরাম গঠন করেন। ১৯৯৩ সালের আগস্ট মাসে এটি একটি পূর্ণাঙ্গ রাজনৈতিক দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। এটি একটি উদারনৈতিক রাজনৈতিক দল। দলটি একটি শক্তিশালী সিভিল সমাজ এবং সমতার ভিত্তিতে সুশৃঙ্খল সমাজব্যবস্থা গড়ে তুলতে আগ্রহী।

বিবল্পধারা বাংলাদেশের একটি রাজনৈতিক দল যেটি সাবেক সাবেক প্রেসিডেন্ট ও বিএনপি নেতা ডা. এ.কিউ.এম বদরুদ্দোজা চৌধুরীর নেতৃত্বে ২০০৪ সালে গঠিত হয়। ডা. বদরুদ্দোজা চৌধুরী ছিলেন বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। পরবর্তীকালে তিনি বিএনপি থেকে বহিস্কৃত হয়েছিলেন। এই দলটির নির্বাচনী প্রতীক হচ্ছে কুলা, একটি হাতে বানানো ধান ঝাড়–নি পাখা। উদারনৈতিক গণতন্ত্রে বিশ্বাসী এই দলটি রাজনীতিতে বিকল্পধারা তৈরি করতে অঙ্গীকারবদ্ধ।

বাংলাদেশ গণঅধিকার পরিষদ ২০২১ সালের ২৬ অক্টোবর এই দলটি আত্মপ্রকাশ করে। ড. রেজা কিবরিয়া এর আহ্বায়ক এবং নুরুল হক নূরু এই দলটির সদস্য সচিব। [এস. আমিনুল ইসলাম]