রহমান, শহীদ জিয়াউর

শহীদ জিয়াউর রহমান

রহমান, শহীদ জিয়াউর (১৯৩৬-১৯৮১)  বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি, বীর মুক্তিযোদ্ধা, সেনাবাহিনী প্রধান। ১৯৩৬ সালের ১৯ জানুয়ারি বগুড়া জেলার বাগবাড়িতে জিয়াউর রহমানের জন্ম। তাঁর পিতা মনসুর রহমান ছিলেন কলকাতায় এক সরকারি দফতরে কর্মরত কেমিস্ট। জিয়াউর রহমান শৈশবে কিছুকাল বগুড়ার গ্রামাঞ্চলে এবং কিছুকাল কলকাতায় অতিবাহিত করেন। ভারত বিভাগের (১৯৪৭) পর তাঁর পিতা করাচীতে বদলি হলে জিয়াউর রহমান কলকাতার হেয়ার স্কুল ছেড়ে করাচীর একাডেমী স্কুলে ভর্তি হন। ঐ স্কুল থেকে তিনি ১৯৫২ সালে মাধ্যমিক শিক্ষা সমাপ্ত করেন। ১৯৫৩ সালে তিনি করাচীর ডি.জে কলেজে ভর্তি হন। একই বছর তিনি কাকুল মিলিটারি একাডেমীতে অফিসার ক্যাডেট হিসেবে যোগ দেন।

জিয়াউর রহমান ১৯৫৫ সালে সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট হিসেবে কমিশন লাভ করেন। এ পদে তিনি দুই বছর চাকরি করেন এবং ১৯৫৭ সালে তাঁকে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে বদলি করা হয়। তিনি ১৯৫৯ থেকে ১৯৬৪ সাল পর্যন্ত সামরিক গোয়েন্দা বাহিনীতেও কর্মরত ছিলেন। ১৯৬৫ সালে পাক-ভারত যুদ্ধে একটি কোম্পানির অধিনায়ক হিসেবে খেমকারান সেক্টরে তিনি যুদ্ধ করেন। যুদ্ধে সাহসিকতা প্রদর্শনের জন্য তাঁর কোম্পানি সর্বাধিক বীরত্বসূচক পুরস্কার লাভ করে। ১৯৬৬ সালে তিনি পাকিস্তান মিলিটারি একাডেমীতে ইনস্ট্রাক্টর পদে নিয়োগ লাভ করেন। ঐ বছরই একটি ‘কমান্ড’ কোর্সে যোগদানের জন্য তাঁকে কোয়েটার স্টাফ কলেজে পাঠানো হয়। ১৯৬৯ সালে তিনি জয়দেবপুরে দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে দ্বিতীয়-অধিনায়ক পদে দায়িত্ব লাভ করেন। তিনি পশ্চিম জার্মানি থেকে উচ্চতর প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। ১৯৭০ সালে দেশে ফিরে আসার পর জিয়াউর রহমানকে (তদানীন্তন মেজর) অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের দ্বিতীয়-অধিনায়ক হিসেবে চট্টগ্রামে বদলি করা হয়। স্বভাবতই জনসাধারণের কাছে জিয়াউর রহমান নামটি অপরিচিত ছিল। কিন্তু তিনি একজন তাৎক্ষণিক জাতীয় ব্যক্তিত্বে রূপান্তরিত হলেন যখন তিনি ২৭ মার্চ চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতারকেন্দ্র থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করলেন। তাঁর ঘোষণাটি ছিল:

‘‘আমি মেজর জিয়া, বাংলাদেশ লিবারেশন আর্মির অস্থায়ী সর্বাধিনায়ক, এতদ্বারা শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করছি।

‘‘আমি আরও ঘোষণা করছি, আমরা ইতিমধ্যে শেখ মুজিবুর রহমানের অধীনে একটি সার্বভৌম ও বৈধ সরকার গঠন করেছি। এই সরকার রাষ্ট্র পরিচালনায় আইন এবং শাসনতন্ত্র মেনে চলায় অঙ্গীকারাবদ্ধ। নতুন গণতান্ত্রিক সরকার আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে জোট নিরপেক্ষ নীতির প্রতি অঙ্গীকারাবদ্ধ। এ সরকার সকল দেশের সাথে বন্ধুত্বের প্রত্যাশী এবং আন্তর্জাতিক শান্তির জন্য চেষ্টা করবে। আমি সকল সরকারের কাছে আবেদন করছি তারা যেন বাংলাদেশে নৃশংস গণহত্যার বিরুদ্ধে তাদের নিজ নিজ দেশে জনমত গড়ে তোলেন।

‘‘শেখ মুজিবুর রহমানের অধীনে গঠিত সরকার বাংলাদেশের সার্বভৌম ও বৈধ সরকার এবং এই সরকার পৃথিবীর সকল গণতান্ত্রিক দেশের স্বীকৃতি লাভের অধিকার সংরক্ষণ করে।’’

জিয়াউর রহমান এবং তাঁর সেনাবাহিনী এভাবেই স্বাধীনতা যুদ্ধের একেবারে পুরোভাগে চলে আসে। মেজর জিয়া এবং তাঁর সশস্ত্রবাহিনী বেশ কয়েকদিন চট্টগ্রাম ও নোয়াখালী অঞ্চল নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে সক্ষম হয়। পরবর্তী সময়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অভিযানের মুখে কৌশলগত কারণে তারা সীমান্ত অতিক্রম করে।

মুক্তিযুদ্ধের পরিকল্পনা গ্রহণ এবং যুদ্ধ পরিচালনায় জিয়াউর রহমান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। ১৯৭১ সালের জুন মাস পর্যন্ত ১ নং সেক্টরের অধিনায়ক হিসেবে এবং পরে ‘জেড’ ফোর্সের প্রধান হিসেবে জিয়াউর রহমান নিজেকে অসম সাহসী যোদ্ধা হিসেবে পরিচিত করে তোলেন এবং সাহসিকতার জন্য তাঁকে ‘বীরউত্তম’ খেতাবে ভূষিত করা হয়।

নয় মাস যুদ্ধে কৃতিত্বপূর্ণ ভূমিকার পর জিয়াকে কুমিল্লায় সেনাবাহিনীর ব্রিগেড কমান্ডার নিয়োগ করা হয়। ১৯৭২ সালের জুন মাসে তাঁকে বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর ডেপুটি চীফ অফ স্টাফ পদে উন্নীত করা হয়। ১৯৭৩ সালের মাঝামাঝি তিনি ব্রিগেডিয়ার পদে এবং বছরের শেষ নাগাদ মেজর জেনারেল পদে পদোন্নতি লাভ করেন। ১৯৭৫ সালের ২৫ আগস্ট জিয়াউর রহমান চীফ অফ আর্মি স্টাফ নিযুক্ত হন। ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর শাফায়াত জামিলের নেতৃত্বাধীন ঢাকা ব্রিগেডের সহায়তায় খালেদ মোশাররফ যখন এক সামরিক অভ্যুত্থান ঘটান, তখন জিয়াউর রহমানকে পদত্যাগে বাধ্য করা হয় এবং গৃহবন্দী করে রাখা হয়। ৭ নভেম্বরের সিপাহী-জনতা বিপ্লব তাঁকে রাজনৈতিক ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে নিয়ে আসে।

১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর জিয়াউর রহমানকে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক ঘোষণা করা হয়। একই দিনে সেনাসদরে এক বৈঠকে অন্তবর্তীকালীন সরকার পরিচালনার জন্য একটি প্রশাসনিক কাঠামো গঠন করা হয়। রাষ্ট্রপতি জাস্টিস সায়েমকে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক এবং তিন বাহিনীর প্রধান, মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান, এয়ার ভাইস মার্শাল এম.জি তাওয়াব ও রিয়ার অ্যাডমিরাল এম. এইচ খানকে উপ-প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক করা হয়। ১৯৭৬ সালের ১৯ নভেম্বর জাস্টিস সায়েম প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের দায়িত্ব থেকে সরে দাঁড়ালে জিয়াউর রহমান এ দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। অবশেষে ১৯৭৭ সালের ২১ এপ্রিল রাষ্ট্রপতি সায়েম পদত্যাগ করলে জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রপতি পদে অধিষ্ঠিত হন।

রাষ্ট্র প্রধানের পদে অধিষ্ঠিত হওয়ার পর জিয়াউর রহমান এক সরকারি ঘোষণা দ্বারা সংবিধানে সংশোধনী এনে সংবিধানের প্রস্তাবনায় ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম’ (পরম দয়ালু, দয়াময় আল্লাহর নামে) সংযোজন করেন। সংবিধানের ৮(১) এবং ৮ (১ক) অনুচ্ছেদে ‘সর্বশক্তিমান আল্লাহর উপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস’ কথাটি যোগ করা হয়। ৮(১) অনুচ্ছেদে সমাজতন্ত্রকে ‘অর্থনৈতিক ও সামাজিক সুবিচার রূপে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে। সংবিধানের ২৫(২) অনুচ্ছেদে যোগ করা হয়, ‘রাষ্ট্র ইসলামী সংহতির ভিত্তিতে মুসলিম দেশসমূহের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব সম্পর্ক সংহত, সংরক্ষণ এবং জোরদার করিতে সচেষ্ট হইবেন।’

জিয়াউর রহমান বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ নামে একটি নতুন ধারণার প্রবর্তন করেন। তিনি বিশ্বাস করতেন যে, বাংলাদেশে বহু সংখ্যক বিভিন্ন মতের ও ধর্মের জাতিগোষ্ঠী বাস করে। তাদের সংস্কৃতি ও জীবনযাত্রার মাত্রা ও ধরণ বিভিন্ন। তাই জিয়া মনে করেন যে, শুধুমাত্র ভাষা বা সংস্কৃতির ভিত্তিতে নয়, বরং ভূখন্ডের ভিত্তিতেই জাতীয়তাবাদকে গ্রহণ করা উচিত। তিনি বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদে ধর্ম-বর্ণ-লিঙ্গ-সংস্কৃতি নির্বিশেষে সকল নাগরিকের ঐক্য ও সংহতির উপর গুরুত্ব আরোপ করেন এবং এই ধারণায় জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠার শক্তি হিসেবে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদকে বাংলাদেশে শক্তিশালী ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত করার প্রয়াস পান।

রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা গ্রহণের পরপরই জিয়াউর রহমান দেশে শান্তি শৃঙ্খলা পুনরুদ্ধারে আত্মনিয়োগ করেন। তদুদ্দেশ্যে তিনি পুলিশ বাহিনীকে শক্তিশালী করেন। পুলিশের সংখ্যা আগের চাইতে প্রায় দ্বিগুণ করে (৪০,০০০ থেকে ৭০,০০০) তিনি তাদের যথাযথ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেন। সশস্ত্র বাহিনীতেও তিনি শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনেন। এতদুদ্দেশ্যে তিনি কঠোর প্রশিক্ষণ ব্যবস্থার মাধ্যমে সশস্ত্র বাহিনীর মধ্যে পেশাগত শৃঙ্খলা উন্নয়নের কয়েকটি পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। তিনি তাদের সংখ্যা ১৯৭৪-৭৫ সালের পঞ্চাশ হাজারেরও কম থেকে ১৯৭৬-৭৭ সালে প্রায় নববই হাজারে উন্নীত করেন। সশস্ত্র বাহিনীর মধ্যে শৃঙ্খলা পুনরুদ্ধারে যথেষ্ট সফল হলেও জিয়াউর রহমানকে বেশ কয়েকটি সেনা বিদ্রোহ ও সামরিক অভ্যুত্থান প্রচেষ্টার মোকাবিলা করতে হয়। এসব বিদ্রোহ দমনে বাধ্য হয়ে তাঁকে সেনাবাহিনীর শৃঙ্খলা ভেঙ্গে যারা অভ্যুত্থানে অংশগ্রহণ করে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হয়। একটি বিশৃঙ্খল সেনাবাহিনীতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রে জিয়াউর রহমান কঠোর ও দৃঢ় অবস্থান নেন। তাঁর মধ্যে এ বিশ্বাস জন্মে যে, যত দ্রুত দেশে গণতান্ত্রিক পদ্ধতি প্রবর্তিত হবে ততই তা হবে তাঁর নিজের ও দেশের জন্য মঙ্গলজনক। এতদুদ্দেশ্যে তিনি দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য যত দ্রুত সম্ভব নির্বাচন ব্যবস্থার পুনর্বহাল করেন এবং এভাবে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের ব্যবস্থা সহজতর করেন। এ লক্ষ্য অর্জনের প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে তিনি নিষিদ্ধ ও ছত্রভঙ্গ রাজনৈতিক দলগুলোকে পুনরুজ্জীবনের সুযোগ করে দেন এবং শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক কর্মকান্ড পরিচালনার অনুমতি প্রদান করেন। এ লক্ষ্যকে সামনে রেখে জিয়া সংবাদপত্রের উপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করেন এবং সংবাদ মাধ্যমকে স্বাধীন এবং হস্তক্ষেপহীন করে সংবাদ মাধ্যমে তথ্যের অবাধ প্রবাহ পুনঃ প্রতিষ্ঠা করেন। বিদ্যমান পরিস্থিতি তাঁকে সক্রিয় রাজনীতিতে অংশ গ্রহণে উদ্বুদ্ধ করে। তিনি বিশ্বাস করেন যে, দেশে স্বাভাবিক রাজনৈতিক কর্মকান্ড পুনরুজ্জীবিত করলে এবং রাজনৈতিক দলগুলোকে তাদের কার্যক্রম স্বাধীনভাবে পরিচালিত করার সুযোগ দিলে দেশে গণতান্ত্রিক পরিবেশ প্রতিষ্ঠা করা যেতে পারে।

১৯৭৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে তিনি উপ-রাষ্ট্রপতি জাস্টিস আবদুস সাত্তারকে প্রধান করে জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক দল (জাগদল) প্রতিষ্ঠা করেন। ছয়টি রাজনৈতিক দলের সমন্বয়ে গঠিত ফ্রন্টের মনোনীত প্রার্থী হিসেবে জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। এ নির্বাচনে তিনি ৭৬.৬৭% ভোট পেয়ে বিজয়ী হন।

জিয়ার মনে আরও সংস্কারের পরিকল্পনা ছিল। তিনি জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক দল নিয়ে পুরোপুরি সন্তুষ্ট ছিলেন না। ১৯৭৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট পার্টি নামে (বিএনপি) একটি নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করেন, এবং নিজে এ দলের চেয়ারম্যান হন। ১৯৭৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি সংসদের ৩০০ আসনের মধ্যে ২০৭টি আসনে জয়যুক্ত হয়। ১৯৭৯ সালের ১ এপ্রিল জাতীয় সংসদের প্রথম অধিবেশন বসে। শাসনতন্ত্রের পঞ্চম সংশোধনী গৃহীত হলে ১৯৭৯ সালের ৯ এপ্রিল সামরিক আইন প্রত্যাহার করা হয়। জিয়াউর রহমানের জন্য এটি একটি বিরাট সাফল্য যে তিনি নির্বাচনী রাজনীতি পুনর্বহাল করে দেশকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হন।

প্রেসিডেন্ট হিসেবে জিয়াউর রহমান অন্য একটি সেক্টরে বিশেষ অবদান রেখেছেন বলে দাবি করতে পারেন, সেটি হলো জাতীয় অর্থনৈতিক সেক্টর। জিয়ার অর্থনৈতিক নীতিমালা বেসরকারি সেক্টর উন্নয়নের উপর গুরুত্ব আরোপ করে যা এতদিন অবহেলিত ছিল। জিয়া একটি বিশেষজ্ঞ দল নিয়োগ করেন যাদের দায়িত্ব ছিল এমন পরিকল্পনা প্রণয়ন করা যার দ্বারা বেসরকারি খাতকে উৎসাহ দানের মাধ্যমে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন করা যেত এবং কৃষকদের ও কৃষি বাজারকে ভর্তুকি প্রদানের মাধ্যমে কৃষি খাতে প্রবৃদ্ধি আনয়ন করা সম্ভব। রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্প কারখানাগুলোকে যে যে ক্ষেত্রে সম্ভব ভূতপূর্ব মালিকদের ফেরত দেয়ার জন্য তিনি বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। রফতানি খাতে প্রবৃদ্ধির জন্য তিনি প্রচলিত ও অপ্রচলিত পণ্য রপ্তানির প্রবৃদ্ধিসহ অন্যান্য পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। জিয়ার অর্থনৈতিক নীতি তাঁর অনেক সাফল্য এনে দেয়। খাদ্য উৎপাদন একটা নতুন শিখরে পৌঁছে এবং অদূর ভবিষ্যতে বাংলাদেশ একটি খাদ্য উদ্ধৃত্ত দেশে পরিণত হওয়ার স্বপ্ন দেখে।

জিয়াউর রহমানের কর্ম পরিকল্পনার অন্তর্ভুক্ত ছিল তাঁর ১৯ দফা কর্মসূচি। এই কর্মপরিকল্পনা দেশে দ্রুত আর্থসামাজিক পরিবর্তনের উপর গুরুত্ব আরোপ করে। এ কর্মসূচির মূল লক্ষ্য ছিল আর্থ-সামাজিক পরিবর্তন আনা এবং প্রবৃদ্ধির প্রচেষ্টায় জনগণের অংশ গ্রহণের মাধ্যমে স্বনির্ভরতা ও গ্রামীণ উন্নয়ন সাধন করা। এ কর্মসূচির প্রাথমিক লক্ষ্য ছিল কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি, জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ, খাদ্যে স্বয়ং সম্পূর্ণতা অর্জন, প্রশাসনের বিকেন্দ্রীকরণ এবং ব্যক্তিখাতে শিল্প প্রতিষ্ঠানের বিকাশে অধিকতর উৎসাহ দান। জনসাধারণের মৌলিক চাহিদা পূরণ এবং নারী, যুবক ও শ্রমজীবীদের বিশেষ প্রয়োজন মেটানোর উপযোগী করেই এ কর্মসূচি প্রণীত হয়। এর লক্ষ্য ছিল সামাজিক ন্যায়বিচারের ভিত্তিতে একটি রাজনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে তোলা।

জিয়া তাঁর অর্থনৈতিক লক্ষ্য অর্জনের জন্য দেশের রাজনীতিকে উন্নয়নমুখী রাজনীতিতে রূপান্তরিত করার চেষ্টা করেন যদিও তত্ত্বগতভাবে এ ধরণের স্বপ্ন ছিল নিঃসন্দেহে খুবই দুর্বল। সামাজিক প্রবৃদ্ধির ক্ষেত্র শুধুমাত্র উৎপাদনকেই অন্তর্ভুক্ত করে না। এর অন্যান্য বহু শাখা রয়েছে। অবশ্য, তিনি যে কর্মসূচি গ্রহণ করেন সেটিকে তিনি আখ্যায়িত করেন একটি বিপ্লবরূপে এবং প্রবৃদ্ধির অভিযানে জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণের মাধ্যমে এসব কার্যক্রম বাস্তবায়নে দলের লোকদের উদ্বুদ্ধ করেন। এসব কার্যক্রমের মধ্যে প্রথম ছিল খাল খনন, যার মাধ্যমে তিনি বিশেষ করে খরা মৌসুমে কৃষকদের জন্য পর্যাপ্ত সেচের পানি সরবরাহের উদ্যোগ নেন। দ্বিতীয় কার্যক্রম ছিল সমাজ থেকে নিরক্ষরতা দূর করা, যাতে প্রাতিষ্ঠানিক ও অপ্রাতিষ্ঠানিক উভয় প্রকার শিক্ষার মাধ্যমে সমাজের সর্বত্র এক আলোকিত পরিবেশ সৃষ্টি হয়। এ ছাড়া কারখানা ও ক্ষেত-খামারে উৎপাদন বাড়ানোর জন্য উদ্বুদ্ধকরণ কার্যক্রমও গৃহীত হয়। অর্থনৈতিক দিক থেকে অত্যানুকূল আয়তনে জনসংখ্যা স্থিতিশীল রাখতে পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচি হাতে নেয়া হয়। বাংলাদেশকে স্বনির্ভর করার লক্ষ্যে জনগণের সমর্থন আদায়ের জন্য জিয়া ঐ সময়ের প্রেক্ষিতে একটি সাহসী উদ্যোগ হিসেবে গ্রাম সরকার প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা গ্রহণ করেন যেটা জিয়ার জন্য একটি সস্তা রাজনৈতিক ধারণাতে পরিণত হয়। জিয়ার কর্মসূচির একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক ছিল এই যে, তার কর্মসূচি শুধুমাত্র ভোট পাওয়ার একটা শ্লোগান ছিল না। তিনি আন্তরিকতার সাথেই তাঁর কর্মসূচি বাস্তবায়নের চেষ্টা করেন। দেড় বছরের মধ্যে দেড় হাজারেরও অধিক খাল খনন ও পুনর্খনন, পরপর দুই বছর (১৯৭৬-৭৭ ও ১৯৭৭-৭৮) খাদ্য শস্যের রেকর্ড পরিমাণ উৎপাদন, ১৯৭৬-৭৮ সালে বার্ষিক গড় প্রবৃদ্ধির হার ৬.৪% অর্জন, ব্যাপক গণশিক্ষা কার্যক্রম, গ্রাম সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনী গঠন জনমনে গভীর রেখাপাত করে। দাতা গোষ্ঠীও তাঁর সরকারের উন্নয়ন পরিকল্পনার অগ্রগতিতে সন্তোষ প্রকাশ করেন।

ভারতসহ দক্ষিণ এশিয়ার সকল দেশের সঙ্গে সমতা-ভিত্তিক ও সুপ্রতিবেশী সুলভ সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে জিয়া পররাষ্ট্রনীতিতে পরিবর্তন আনতে শুরু করেন। প্রথম তিনি জনগণের জাতীয়তাবাদী আশা-আকাঙ্খা পুনরুজ্জীবিত করে দেশের অভ্যন্তরীণ ঐক্য পুনর্গঠনের ব্যবস্থা করেন। অতঃপর আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে প্রতিযোগী শক্তিসমূহের মধ্যে ভারসাম্যপূর্ণ স্থিতিশীল সম্পর্ক প্রতিষ্ঠায় উদ্যোগ গ্রহণ করেন। পররাষ্ট্র নীতির উদ্দেশ্যসমূহকে পুনঃনির্ধারিত করা হয় এবং পারস্পরিক সমঝোতা ও বিশ্বাসের উপর ভিত্তি করে শান্তি এবং অগ্রগতি অর্জন করার লক্ষ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক সম্পর্ক সৃষ্টির প্রচেষ্টা নেয়া হয়। আঞ্চলিক পর্যায়ে পাকিস্তান, নেপাল, ভূটান, শ্রীলঙ্কা, মালদ্বীপ ও ভারতের সাথে বাংলাদেশের পারস্পরিক সম্পর্কের যথেষ্ট উন্নতি ঘটে এবং ফলশ্রুতিতে এ অঞ্চলে আঞ্চলিক সহযোগিতা প্রতিষ্ঠার পথ সুগম হয়, যে প্রচেষ্টা আঞ্চলিক এবং আন্তর্জাতিক উভয় ক্ষেত্র থেকে প্রশংসা অর্জন করে। জিয়ার নেতৃত্বাধীনে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে সব ধরণের অর্থাৎ দক্ষিণ, মধ্য ও বামপন্থী রাষ্ট্রের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ এবং সুসম্পর্ক প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করে। বাংলাদেশের সাথে মুসলিম বিশ্বের সম্পর্ক ঘনিষ্ট হয়। ফলশ্রুতিতে মুসলিম বিশ্ব বাংলাদেশ এবং এর সমস্যার দিকে নতুনভাবে দৃষ্টিপাত করে। চীন ও আমেরিকার সাথে বাংলাদেশের একটি সুসম্পর্ক গড়ে ওঠে। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো বাংলাদেশের সাথে সুসম্পর্ক স্থাপন করে। নানা দেশের সাথে বাংলাদেশের দ্বিপাক্ষিক ও বহুপাক্ষিক সম্পর্কের উন্নয়নের জন্য তিনি বহু আন্তর্জাতিক সম্মেলনে যোগদান করেন এবং অনেক দেশ ভ্রমণ করেন। তাঁর এ উদ্যোগের ফলাফল ছিল আশাব্যাঞ্জক। ১৯৭৮ সালে বাংলাদেশ নিরাপত্তা পরিষদের একটি অস্থায়ী আসনে সদস্য নির্বাচিত হয় এবং জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্রগুলোর কার্যক্রমের সাথে সক্রিয়ভাবে সম্পৃক্ত হয়। রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানই দক্ষিণ এশিয়ায় আঞ্চলিক সহযোগিতার ধারণা উদ্ভাবন করেন এবং এ সহযোগিতা গড়ে তোলার উদ্যোগ গ্রহণ করেন। এতদুদ্দেশ্যে তিনি ১৯৭৯-৮০ সালে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো সফর করে পারস্পরিক সহযোগিতার একটি সংগঠন গড়ে তোলার প্রয়োজনীয়তার কথা তুলে ধরেন। ১৯৮৫ সালে ঢাকায় আনুষ্ঠানিকভাবে গঠিত  দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা (সার্ক) তাঁরই প্রচেষ্টার ফসল। জিয়াউর রহমান তাঁর স্বপ্নের বাস্তবায়ন দেখে যেতে পারেন নি। ১৯৮১ সালের ৩০ মে চট্টগ্রামে সংঘটিত এক ব্যর্থ সামরিক অভ্যুত্থানে তিনি নিহত হন। তাঁকে ঢাকার শেরেবাংলানগরে সমাহিত করা হয়।  [এমাজউদ্দীন আহমদ]