মাৎস্যন্যায়
মাৎস্যন্যায় রাজা শশাঙ্ক এর মৃত্যুর পর থেকে পাল রাজবংশের অভ্যুদয়ের পূর্ব পর্যন্ত সময়ে বাংলার রাজনীতিতে চরম বিশৃঙ্খলাপূর্ণ অবস্থা বিরাজ করে। প্রায় সমসাময়িক লিপি, খালিমপুর তাম্রশাসন এবং সন্ধ্যাকর নন্দীর রামচরিতম কাব্যে পাল বংশের অব্যবহিত পূর্ববর্তী সময়ের বাংলার নৈরাজ্যকর অবস্থাকে ‘মাৎস্যন্যায়ম্’ বলে উল্লেখ করা হয়।
শশাঙ্কের (৬০০-৬২৫ খ্রি) মৃত্যুর পর বঙ্গে (গৌড়-বাংলায়) বিশৃঙ্খলা ও অরাজকতা দেখা দেয়। হর্ষবর্ধনের মৃত্যুর (৬৪৬/ ৬৪৭ খ্রিস্টাব্দ) পর তাঁর সাম্রাজ্যেও নৈরাজ্য ও সংশয় দেখা দিলে, মন্ত্রীরা বলপূর্বক রাজ্য দখল করে নেয়। আনুমানিক ৬৫০ খ্রিস্টাব্দ থেকে ৭৫০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত এক শতক কালেরও বেশি সময় ধরে গৌড়ের ইতিহাস অস্পষ্ট ছিলো। চৈনিক দূত ওয়াং-হিউয়েন্-সের হঠকারিতায় তিববতের ক্ষমতাধর রাজা শ্রং-ছান-গেমপো বাংলায় পরপর কয়েকটি অভিযান পরিচালনা করেন। সাত শতকের দ্বিতীয়ার্ধে বাংলায় দুটি নতুন রাজবংশ আত্মপ্রকাশ করে:গৌড় ও মগধে (পশ্চিম বাংলা ও দক্ষিণ বিহার) পরবর্তী গুপ্তগণ এবং বঙ্গ ও সমতট (দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব বাংলা) খড়গ রাজবংশ। কিন্তু এ রাজবংশের কোনোটিই বাংলায় ঐক্যবদ্ধ ও শক্তিশালী শাসন প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়নি বলে ধারনা করা হয়।
খ্রিস্টীয় আট শতকের প্রথমার্ধে পুনঃপুনঃ বৈদেশিক আক্রমণে বাংলা বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। এর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ছিল কনৌজ রাজ যশোবর্মণের (৭২৫-৭৫২ খ্রি.) আক্রমণ। কাশ্মীরের ললিতাদিত্য যশোবর্মণের গৌরবকে ম্লান করে দেন। গৌড়ের পাঁচ জন রাজা ললিতাদিত্য কর্তৃক পরাজিত হয়েছিলেন বলে কলহন (কাশ্মীরের ঐতিহাসিক) উল্লেখ করেন। এ থেকে গৌড়ের রাজনৈতিক বিচ্ছিন্নতা সম্পর্কে সুস্পষ্ট ইঙ্গিত পাওয়া যায়। কেন্দ্রীয় শক্তির অভাবে স্থানীয় প্রধানগণ স্বাধীন হয়ে ওঠেন এবং নিজেদের মধ্যে প্রাধান্য প্রতিষ্ঠার লড়াই-এ লিপ্ত হন। পুনঃপুনঃ বৈদেশিক আক্রমণ রাজনৈতিক ভারসাম্য বিনষ্ট করে এবং তাতে বিচ্ছিন্নতার প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত হয়। তাই শশাঙ্কের মৃত্যুর পরবর্তী একশ বছর বাংলায় কোনো স্থায়ী সরকার ব্যবস্থা গড়ে উঠতে পারেনি বলা চলে। গোপালের উত্থানের আগে খ্রিস্টীয় আট শতকের মাঝামাঝি সময়ের রাজনৈতিক অবস্থাকে খালিমপুর তাম্রশাসনে (পাল আমলের লিপি) মাৎস্যন্যায়ম বলে উল্লেখ করা হয়। তিববতি সন্ন্যাসী তারনাথ ১৬০৮ খ্রিস্টাব্দে ’ভারতে বৌদ্ধ ধর্মের ইতিহাস’ নামক একটি গ্রন্থ রচনা করেন। তিনি এ মত সমর্থন করে লিখেন: ‘প্রত্যেক ক্ষত্রিয়, সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি, ব্রাহ্মণ ও বণিক স্ব স্ব গৃহে (অথবা প্রভাবাধীন এলাকায়) ছিলেন এক এক জন রাজা, কিন্তু সমগ্র দেশে কোনো রাজা ছিলেন না’।
সংস্কৃত শব্দ মাৎস্যন্যায়ম বিশেষ অর্থবহ। কৌটিল্য এর অর্থশাস্ত্র এ (১.৪.১৩-১৪) শব্দটির নিম্নরূপ ব্যাখ্যা করা হয়েছে: যখন দন্ডদানের আইন স্থগিত বা অকার্যকর থাকে তখন এমন অরাজক অবস্থার সৃষ্টি হয় যা মাছের রাজ্য সম্পর্কে প্রচলিত প্রবচনের মধ্যে পরিস্ফুট। অর্থাৎ অপেক্ষাকৃত বড় মাছ ছোটটিকে গ্রাস করে, কারণ আইন প্রয়োগকারী সংস্থার অবর্তমানে সবল দুর্বলকে গ্রাস করবেই। সমসাময়িক পাল লিপিতে এ অর্থবহ শব্দটির প্রয়োগ করে বাংলার তৎকালীন রাজনৈতিক অবস্থা বর্ণনা করা হয়েছে। আইন-শৃঙ্খলা বজায় রাখার মতো শক্তিশালী শাসন ক্ষমতার অভাবে সম্পূর্ণ অরাজক অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল।
উপরোক্ত বিবরণ থেকে এটা স্পষ্ট প্রতীয়মান হয় যে, শশাঙ্কের রাজত্বের পরবর্তী শতকে বাংলায় শাসন খুব অল্পই স্থিতিশীল ছিল। দেশটি অনেক ছোট ছোট রাজ্যে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে এবং তাদের পারস্পরিক যুদ্ধবিগ্রহের ফলে অস্থিতিশীল অবস্থার সৃষ্টি হয়। আইন-শৃঙ্খলা বিধানে সক্ষম কোন শক্তির অনুপস্থিতির ফলে যে পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়, তাই মাৎস্যন্যায়ম্। সে সময়ে দৈহিক শক্তির প্রাধান্যে দেশ জুড়ে চলছিল অবাধ্য শক্তির উত্তেজনা। পাল বংশের প্রতিষ্ঠাতা গোপাল এ বিশৃঙ্খল অবস্থায় রাজ ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন এবং মাৎস্যন্যায়মের অবসান ঘটান।
গোপাল কিভাবে ক্ষমতায় আসেন তা নিয়ে পন্ডিতদের মধ্যে মতভেদ আছে। কেউ কেউ যুক্তি দেখান যে, জনগণই গোপালকে রাজা নির্বাচিত করেন। তিনি কিছু সংখ্যক প্রভাবশালী ব্যক্তি বা নেতার সমর্থন লাভ করেই রাজা হন ও মাৎস্যন্যায়মের অবসান ঘটিয়ে জনসমর্থন লাভ করেন। পাল লিপিতে দাবি করা হয়েছে যে, গোপাল ‘বেপরোয়া ও স্বেচ্ছাচারী লোকদের পরাভূত করে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠা করেন’। অন্য কথায় বলা যায়, যারা বাংলায় মাৎস্যন্যায় অবস্থার সৃষ্টি করেছিল তাদের তিনি সমূলে উৎপাটন করেন। এই নৈরাজ্যকর অবস্থার সামাজিক দিকগুলি নিরূপণের সহায়ক কোন প্রত্যক্ষ সাক্ষ্য পাওয়া যায় না। তবে পরোক্ষ তথ্য থেকে এটা স্পষ্ট যে, শান্তি ও শৃঙ্খলার অভাবে ব্যবসায়-বাণিজ্যে অধোগতি দেখা দেয়। আট শতকের পর থেকে তাম্রলিপ্তি বন্দরের প্রাধান্য হ্রাস ব্যবসা-বাণিজ্যের এ অবনতির ইঙ্গিত বহন করে। মহাস্থানের ধ্বংসস্তূপ থেকে বোঝা যায় যে, পাল আমলের মন্দির ও আশ্রমগুলি নির্মিত হয়েছিল গুপ্ত যুগ পূর্ববর্তী ও গুপ্তোত্তর যুগের ধ্বংসসূতপগুলির উপর। এতে ধারণা করা যায় যে, নৈরাজ্যের যুগেই ওই ধ্বংসযজ্ঞ ঘটেছিল। সেই নৈরাজ্যের সঙ্গে সম্ভবত পূর্ববর্তী ভয়াবহ রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার একটা সম্পর্ক ছিল। শক্তিশালী কোন রাজার অনুপস্থিতিতে সামন্ত প্রভুরা প্রত্যেকে ছিল স্বাধীন ও সার্বভৌম। তারা নৈরাজ্য সৃষ্টিতে মুখ্য ভূমিকা পালন করে। সম্ভবত তাদের মধ্যকার কয়েকজনের বিচক্ষণতার ফলে আইন-কানুনহীন নৈরাজ্য পরিস্থিতির অবসান ঘটে। তারা একত্রিত হয়ে গোপালকে শাসন ক্ষমতায় বসায় ও মাৎস্যন্যায়ম এর বিলুপ্তি ঘটে। [আবদুল মমিন চৌধুরী]