মারাঠা হামলা
মারাঠা হামলা আঠারো শতকে বাংলায় মারাঠারা এক অভিশাপরূপে আবির্ভূত হয়। তারা সারাদেশে ধ্বংসযজ্ঞ চালায় এবং জনজীবনে নেমে আসে অবর্ণনীয় দুঃখদুর্দশা। বাংলায় মারাঠা হামলা মুগলদের সঙ্গে মারাঠাদের প্রতিদ্বন্দ্বিতারই ফলশ্রুতি। মুগল সম্রাট আওরঙ্গজেব সমগ্র দাক্ষিণাত্য স্বীয় সাম্রাজ্যভুক্ত করার জন্য অভিযান পরিচালনা করেন এবং দাক্ষিণাত্যে তাঁর যুদ্ধবিগ্রহের বিস্তৃতি মারাঠাদের আবাসভূমিকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। ‘মনসব’ পদমর্যাদা প্রদানের মাধ্যমে মারাঠা নেতাদের পক্ষে আনার জন্য আওরঙ্গজেবের চেষ্টা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। কিছুসংখ্যক মারাঠা নেতা তাঁর বশীভূত হলেও অন্যরা মুগল জেলাগুলিতে লুণ্ঠন চালিয়ে বিত্তশালী হওয়ার চেষ্টায় নিয়োজিত হয়। বাংলায় মারাঠা আক্রমণকারীরা ‘বর্গী’ নামে পরিচিত ছিল। এই বর্গী শব্দটি ‘বরগি’র শব্দের অপভ্রংশ। মারাঠা বাহিনীর সাধারণ সৈন্যদের সর্বনিম্ন পদধারীদের বলা হতো বরগির। রাষ্ট্র কর্তৃক এদের অস্ত্র ও ঘোড়া সরবরাহ করা হতো। যেসব সৈন্যের নিজেদের ঘোড়া ও যুদ্ধ সামগ্রী থাকত তারা ছিল এদের থেকে আলাদা।
পরবর্তী মুগল শাসনামলে শাসকদের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ আসে মারাঠাদের কাছ থেকে। মারাঠা সৈন্যরা পেশোয়া বাজিরাওয়ের (১৭৪০-১৭৬১) শাসনামলে সমগ্র ভারতবর্ষে হামলা করে। ১৭৪২ থেকে ১৭৫১ সাল পর্যন্ত বাংলায় বার বার বর্গীদের আক্রমণ হয় এবং ১৭৫১ সালে বাংলার নওয়াব মারাঠাদের কাছে উড়িষ্যা ছেড়ে দিতে বাধ্য হন।
১৭৪২ সালের এপ্রিলের প্রথম দিকে একটি মারাঠা বাহিনী নাগপুর থেকে অগ্রসর হয়ে বর্ধমান আক্রমণ করে। মারাঠা অভিযানের খবর পেয়ে ১৫ এপ্রিল (১৭৪২) নওয়াব আলীবর্দী খান কটক থেকে বর্ধমান উপস্থিত হন। ভাস্কর পন্ডিতের নেতৃত্বে মারাঠা বাহিনী তাঁর রসদ সরবরাহ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন করে দেয়। তাদের অপর একটি দল বর্ধমানের আশে পাশে প্রায় ২৫ কি.মি. এলাকা জুড়ে লুণ্ঠন ও ধ্বংসযজ্ঞ চালায়। ২৬ এপ্রিল আলীবর্দী বাহিনী মারাঠা সৈন্যদের বেষ্টনী ভেঙে ফেলেন এবং কাটোয়া পৌঁছতে সমর্থ হন। এ সময় মীর হাবিব নামক নওয়াবের এক পারস্যদেশীয় অভিজাত বিশ্বাসঘাতকতা করে মারাঠা দলে যোগ দেন। এই মীর হাবিব স্থানীয় বিষয়ে তাঁর সকল জ্ঞান দিয়ে মারাঠাদের অভিযানে সহায়তা করেন। বাংলার নওয়াবের সঙ্গে তাঁর শত্রুতার কারণে তিনি তাঁর অসাধারণ যোগ্যতাকে মারাঠাদের স্বার্থ চরিতার্থ করার কাজে ব্যবহার করেন। ফলে বাংলায় মারাঠা বর্গীদের লুণ্ঠন ও ধ্বংসযজ্ঞ অব্যাহত থাকে।
নওয়াবের কাটোয়া অবস্থানকালে তাঁর রাজধানী মুর্শিদাবাদ আক্রমণ এবং অঢেল সম্পদ লুণ্ঠনে মীর হাবিব ভাস্কর পন্ডিতকে প্রলুব্ধ করেন। ১৭৪২ সালের ৬ মে ভাস্কর পন্ডিতের মারাঠা বাহিনী মুর্শিদাবাদের উপকণ্ঠ দহিপাড়ায় উপস্থিত হয় এবং বাজারগুলি পুড়িয়ে দেয়। এরপর তারা মুর্শিদাবাদে পৌঁছে লুণ্ঠন ও ধ্বংসলীলা চালাতে থাকে। তারা জগৎ শেঠ পরিবারের কাছ থেকেই তিন লক্ষ টাকা আদায় করে নেয়। মারাঠাদের হাত থেকে রাজধানী রক্ষার জন্য আলীবর্দী ৭ মে মুর্শিদাবাদে উপস্থিত হন। মারাঠা হামলাকারীরা ঘরবাড়িতে অগ্নি সংযোগ করে কাটোয়ায় সরে আসে এবং জুন মাস থেকে কাটোয়া মারাঠা দখলদার বাহিনীর সদরদপ্তর রূপে পরিগণিত হয়। মীর হাবিব তাদের প্রধান উপদেষ্টা ও এজেন্ট মনোনীত হন।
জুলাই মাসের প্রথম দিকে মীর হাবিব হুগলি জেলার এক বন্ধুর সহযোগিতায় হুগলির ফৌজদার মুহম্মদ রেজাকে বন্দি করেন এবং সেখানে শিশ রায়ের অধীনে মারাঠা বাহিনীর একটি ঘাঁটি স্থাপন করেন। ক্রমে রাজমহল থেকে মেদিনীপুর ও যশোর পর্যন্ত গঙ্গার পশ্চিমাঞ্চল মারাঠাদের নিয়ন্ত্রণে চলে যায় এবং শিশ রায় এই অঞ্চলের শাসনকর্তা নিযুক্ত হন। মীর হাবিব মারাঠাদের পক্ষে দীউয়ানের দায়িত্ব পালন করেন। তিনি জমিদারদের ডেকে পাঠান এবং মারাঠা প্রশাসনকে চৌথ প্রদানের নির্দেশ দেন। অনেকেই মারাঠা বর্গীদের হাত থেকে তাদের জানমাল রক্ষার তাগিদে ঘরবাড়ি ছেড়ে গঙ্গার পূর্বাঞ্চলের দিকে পালিয়ে যায়।
নওয়াবের শাসনাধীন গঙ্গার পূর্বাঞ্চলও হঠাৎ মারাঠা বর্গীদের আক্রমণ ও লুণ্ঠনের শিকার হয়। যে সকল অঞ্চলে নওয়াবের নিয়ন্ত্রণ কমে যায়, সে সকল এলাকায় মারাঠা বর্গীদের সীমাহীন নিপীড়ন, লুণ্ঠন ও ধ্বংসযজ্ঞ চলতে থাকে। মারাঠা লুণ্ঠনের হাত থেকে রেহাই পেতে বীরভূম থেকে ব্যবসায়ী ও তাঁতিরা পালিয়ে যায়। মারাঠাদের ধ্বংসলীলায় ভীত হয়ে অন্যান্য অঞ্চলের সিল্ক শিল্পের সঙ্গে জড়িত তাঁতিরা এলাকা ছেড়ে চলে যায়। সিল্ক ও কাপড়ের আড়ংগুলি জনমানবশূন্য হয়ে পড়ে। খাদ্যশস্যের অভাব দেখা দেয়, ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ হয়ে যায়।
বর্ষা মৌসুমের শেষে পথঘাট শুকিয়ে যাওয়ার আগেই আলীবর্দী মারাঠা বাহিনীকে আক্রমণের সিদ্ধান্ত নেন, যাতে বর্ষার পিচ্ছিল ও কর্দমাক্ত পরিবেশে মারাঠা সৈনিকরা তাদের স্বাভাবিক ক্ষিপ্রগতি হারিয়ে সহজে পর্যুদস্ত হয়। ১৭৪২ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর নওয়াব কাটোয়াস্থ ভাস্কর পন্ডিতের ক্যাম্পে ঘুমন্ত মারাঠাদের উপর অতর্কিত আক্রমণ চালান। মারাঠা সৈন্যরা তাদের মালামাল ফেলে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। ভাস্কর পন্ডিত বাংলার বিভিন্ন প্রত্যন্ত অঞ্চলে ছড়িয়ে থাকা মারাঠা দলগুলিকে একত্রিত করে মেদিনীপুর জেলার দিকে অগ্রসর হন এবং রেশম উৎপাদনের কেন্দ্র রাধানগরে লুণ্ঠন ও অগ্নিসংযোগ করে নারায়ণগড়ে এসে ঘাঁটি স্থাপন করেন। আলীবর্দী তাদের বিরুদ্ধে অভিযানে নিজেই সেনাবাহিনীর নেতৃত্ব দেন। ১৭৪২ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে তিনি মারাঠাদের হাত থেকে কটক পুনরুদ্ধার করেন এবং তাদের চিল্কা হ্রদের ওপারে বিতাড়িত করেন। ১৭৪৩ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি তিনি বিজয়ী বেশে মুর্শিদাবাদ ফিরে আসেন।
দুর্বল মুগল সম্রাট বাধ্য হয়ে মারাঠা নেতা রাজা শাহুকে বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার চৌথ (কর) দিতে সম্মত হন। কথিত আছে, রাজা শাহু নাগপুরের রাজা রঘুজী ভোঁসলেকে এসকল অঞ্চলের কর সংগ্রহের অধিকার প্রদান করেন। ইত্যবসরে তখনকার মুগল বাদশাহ রাজা শাহুর এ সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে রঘুজীর প্রতিদ্বন্দ্বী ও ব্যক্তিগত শত্রু পেশোয়া বালাজি বাজিরাওয়ের শরণাপন্ন হন। ১৭৪২ সালের নভেম্বরে পেশোয়া শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে রঘুজীকে বাংলা থেকে উচ্ছেদ করার সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু রঘুজী উল্লিখিত অঞ্চলের চৌথ আদায়ের জন্য বদ্ধপরিকর হন এবং সে উদ্দেশ্যে ১৭৪৩ সালের মার্চ মাসের প্রথম দিকে ভাস্কর পন্ডিতকে নিয়ে কাটোয়ায় পৌঁছেন।
১৭৪৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথম দিকে রঘুজী এক শক্তিশালী বাহিনী নিয়ে দক্ষিণ দিক থেকে বিহারে প্রবেশ করেন। বেনারস থেকে বিহারের সমতলভূমি পাহাড় ও বনজঙ্গল অতিক্রম করে তিনি মুর্শিদাবাদের পথে অগ্রসর হন। এসময় নওয়াবও পেশোয়ার সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলেন। ভবিষ্যতে রঘুজীকে আর কখনও বাংলায় লুণ্ঠন ও ধ্বংসলীলা চালাতে দেওয়া হবে না এই শর্তে নওয়াব বাংলার চৌথ রাজা শাহুকে প্রদান করবেন এবং পেশোয়ার সেনাবাহিনীর ব্যয়ভার নির্বাহের জন্য বাইশ লক্ষ টাকা প্রদান করবেন এই মর্মে ১৭৪৩ সালের ৩০ মার্চ পেশোয়া ও বাংলার নওয়াবের মধ্যে সমঝোতা হয়।
পেশোয়া ও বাংলার নওয়াবের মিলিত বাহিনীর অগ্রসর হওয়ার খবর পেয়ে রঘুজী কাটোয়া থেকে বীরভূমে তাঁর ঘাঁটি স্থানান্তর করেন। অপেক্ষাকৃত শ্লথগতি বাংলার সেনাবাহিনীকে পেছনে রেখেই পেশোয়া তাঁর দ্রুতগামী অশ্বারোহী বাহিনী নিয়ে ১৭৪৩ সালের ১০ এপ্রিল রঘুজীর সেনাবাহিনীর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েন এবং পশ্চিমাঞ্চলের পাহাড়ী এলাকায় তাঁকে তাড়িয়ে নিয়ে যান। এতে রঘুজীর বহু সৈন্য নিহত হয় এবং তাঁর সৈন্যদের ফেলে যাওয়া প্রচুর সম্পদ পেশোয়ার হস্তগত হয়। রঘুজী সম্বলপুরের পথ ধরে পশ্চাদপসরণ করে পুনরায় ফিরে আসেন। ১৭৪৩ সালের জুন থেকে ১৭৪৪ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত নয় মাসকাল বাংলা কিছুটা শান্ত ছিল। কিন্তু বিগত দুবছর ব্যাপী মারাঠা আগ্রাসন আলীবর্দীর সেনাবাহিনী পোষণের ব্যয় দ্বিগুণ করে দেয়। এছাড়াও পেশোয়াকে ভর্তুকি প্রদান করতে গিয়ে তাঁর রাজকোষ প্রায় শূন্য হওয়ার উপক্রম হয়। বর্গীদের লুণ্ঠন ও ধ্বংসলীলা থেকে বাংলাকে রক্ষা করার জন্য পেশোয়াকে ২২ লক্ষ টাকা প্রদান করেও নওয়াব আলীবর্দী প্রতিশ্রুত শান্তি দেখতে পাননি। ১৭৪৪ সালের মার্চের শুরুতে ভাস্কর পন্ডিত কর্তৃক উড়িষ্যা ও মেদিনীপুরের দিক হতে বাংলা আক্রান্ত হওয়ায় আলীবর্দী হতবাক হন। ওদিকে ১৭৪৩ সালের ৩১ অক্টোবর শাহুজীর মধ্যস্থতায় মারাঠা নেতা পেশোয়া ও রঘুজীর মধ্যে সমঝোতার ফলে শাহাবাদ এবং টিকরীসহ পাটনার পশ্চিমাঞ্চলে বিস্তৃত বিহারের একটি অংশ পেশোয়ার শাসনাধীনে আসে। বাংলা, উড়িষ্যা এবং পাটনার পূর্বাঞ্চলে বিহারের বাকি অংশ রঘুজী ভোঁসলের নিয়ন্ত্রণে থাকে।
মারাঠাদের লুণ্ঠন ও ধ্বংসলীলা থেকে পরিত্রাণ এবং তাদের মধ্যে ত্রাস সৃষ্টি করে বাংলা থেকে বিতাড়নের লক্ষ্যে আলীবর্দী খান বিশ্বাসঘাতকতা ও হঠকারিতার কৌশল অবলম্বন করেন। বাংলার চৌথ প্রদানের বিষয়ে শান্তিপূর্ণভাবে সমঝোতায় উপনীত হতে ভাস্কর পন্ডিত এবং তাঁর সহযোগীদের একটি বৈঠকে উপস্থিত হওয়ার জন্য তিনি আমন্ত্রণ জানান। ১৭৪৪ সালের ৩১ মার্চ মানকাড়া নামক স্থানে উক্ত বৈঠক অনুষ্ঠানের সিদ্ধান্ত হয়। ২১ জন সহযোগীসহ ভাস্কর পন্ডিত তাঁবুতে উপস্থিত হলে তাঁবুর পর্দার আড়ালে লুকিয়ে থাকা ঘাতকদল তাদের হত্যা করে। এ ঘটনার অব্যবহিত পরেই বাংলা ও উড়িষ্যা থেকে সকল মারাঠা ঘাঁটি গুটিয়ে ফেলা হয়। এই ঘটনার পর বিহার ও উড়িষ্যা অঞ্চলে প্রায় ১৫ মাস শান্তি ও সমৃদ্ধি বিরাজ করে।
মীর হাবিবের কবল থেকে উড়িষ্যা পুনর্দখলের জন্য আলীবর্দী ১৭৪৬ সালের শেষের দিকে উড়িষ্যা অভিযান করেন। আলীবর্দীর সেনাপতি মীরজাফর, মীর হাবিবের সৈন্যাধ্যক্ষ সাইয়ীদ নূরকে মেদিনীপুর শহরের কাছে একটি যুদ্ধে চূড়ান্তভাবে পরাজিত করেন। এমতাবস্থায় রঘুজী ভোঁসলের পুত্র জানোজী ভোঁসলে বালাশোরের দক্ষিণ দিক থেকে আগত মীর হাবিবের সেনাবাহিনীর সাথে মিলিত হয়। এ সংবাদ পাওয়ামাত্রই মীরজাফর মেদিনীপুর জেলা ছেড়ে দিয়ে বর্ধমানে পালিয়ে যান। ১৭৪৭ সালের মার্চ মাসে এক যুদ্ধে আলীবর্দী জানোজীকে পরাজিত করেন। পরাজিত মারাঠা হানাদাররা মেদিনীপুরে পালিয়ে গেলে মুর্শিদাবাদ ও বর্ধমান জেলা মারাঠা হানাদার মুক্ত হয়। নওয়াব তাঁর রাজধানীতে ফিরে আসেন এবং বর্ষাকাল সেখানে কাটান। ১৭৪৮ সালের পুরো বছরটিতে মারাঠারা সম্পূর্ণ উড়িষ্যা এবং মেদিনীপুর পর্যন্ত এলাকায় তাদের নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখে। ১৭৪৯ সালের মার্চ মাসে আলীবর্দী উড়িষ্যা পুনর্দখলে যাত্রা করেন। কয়েকটি খন্ড যুদ্ধের পরই মারাঠারা পেছনে হঠতে থাকে। ১৯৪৯ সালের জুনের মাঝামাঝি সময়ে নওয়াব আলীবর্দী উড়িষ্যা পুনর্দখল করেন। কিন্তু উড়িষ্যা দখলের পর কটক থেকে ফিরে যাওয়ার এক সপ্তাহের মধ্যেই মীর হাবিবের নেতৃত্বে মারাঠা বাহিনী আলীবর্দীর প্রতিনিধিকে পরাজিত ও বন্দি করে। বৃদ্ধ ও রণক্লান্ত আলীবর্দী উড়িষ্যা থেকে মারাঠাদের বাংলা গমনের পথ রোধ করতে মেদিনীপুরে ফিরে আসেন।
১৭৫০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের শেষ দিকে মারাঠা বর্গীরা পুনরায় বাংলায় হানা দিতে শুরু করে। ঐ বছর ৬ মার্চ মীর হাবিব মুর্শিদাবাদের প্রায় কাছাকাছি এসে পৌঁছেন এবং পার্শ্ববর্তী অঞ্চল লুণ্ঠন করেন। ফলে আলীবর্দী মেদিনীপুর থেকে বর্ধমানে পশ্চাদপসরণ করেন। হানাদার মারাঠারা জঙ্গলে পালিয়ে গেলে এপ্রিল মাসে আলীবর্দী সীমান্ত ঘাঁটি মেদিনীপুর রক্ষার জন্য ফিরে আসেন। মীর হাবিব উড়িষ্যা থেকে তার এতকালের শাসনামলে তেমন একটা লাভবান হতে পারেন নি এবং তার বাংলা অভিযানগুলি আলীবর্দীর সতর্কতা ও দৃঢ়তার কারণে বার বার ব্যর্থ হয়েছে। এসব বিবেচনা করে মীর হাবিব আলীবর্দীর সাথে এক শান্তি চুক্তিতে উপনীত হন। চুক্তির শর্তানুসারে মীর হাবিব নওয়াবের কর্মকর্তা হিসেবে পরিগণিত হবেন এবং উড়িষ্যায় নওয়াবের নায়েব নাজিম বা ডেপুটি গভর্নরের দায়িত্ব পালন করবেন; আলীবর্দী মীর হাবিবের জন্য উড়িষ্যায় ১২ লক্ষ টাকা চৌথ পাঠাবেন এবং প্রদেশের রাজস্বের উদ্বৃত্ত টাকা রঘুজীকে পাঠাবেন। এ চুক্তি অনুসারে ভবিষ্যতে আর কখনও যেন আলীবর্দীর এলাকায় হানাদার মারাঠাদের পদার্পণ না ঘটে মারাঠা সরকার সেই অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন। কিন্তু ১৭৫২ সালের ২৪ আগস্ট মারাঠা সৈন্যদের হাতে মীর হাবিব নিহত হলে আলীবর্দী উড়িষ্যায় তাঁর নিয়ন্ত্রণ হারান এবং প্রদেশটিতে পুনরায় মারাঠাদের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়।
ঘন ঘন মারাঠা হামলা বাংলাকে মহাবিপর্যয়ে নিপতিত করে। বাংলার জনগণের জন্য এটা এতই ধ্বংস আর দুঃখ বয়ে আনে যে, মারাঠা বর্গীদের হামলার ভীতিকর গল্প বাংলার শিশুদের ঘুমপাড়ানি গানে বিশেষ স্থান অধিকার করে। এর সাথে অজন্মা ও খরা মিলে বাংলার অবস্থা আরও ভয়াবহ আকার ধারণ করে। মারাঠা হানাদাররা লুণ্ঠন, অগ্নি সংযোগ ও হত্যাযজ্ঞের মাধ্যমে বাংলার জনগণের মনে এমনি ত্রাসের সঞ্চার করেছিল যে, বহুলোক তাদের ঘরবাড়ি ছেড়ে গঙ্গার পূর্বদিকের জেলাগুলিতে পালিয়ে যায়। এতে উক্ত এলাকায় জনসংখ্যার চাপ বৃদ্ধি পেয়ে মারাত্মক অর্থনৈতিক সংকট সৃষ্টি করে। মূলত এই অর্থনৈতিক সংকটই পরবর্তী সময়ে বাংলার নওয়াবকে বিপর্যস্ত ও পর্যুদস্ত করে। [মোহাম্মদ শাহ]