চিড়িয়াখানা

চিড়িয়াখানা (Zoological Garden)  প্রদর্শন, বিনোদন ও গবেষণার জন্য জীবন্ত প্রাণী রাখার সরকারি বা ব্যক্তিগত উদ্যান। প্রাচীনকালে চীন, মিশর ও রোমের বন্যপশু ও পাখির সংগ্রহশালা বিখ্যাত ছিল। মধ্যযুগের শেষে অনেক শাসকের ব্যক্তিগত বন্যপশুপাখির সংগ্রহশালা ছিল, পরবর্তীকালে কয়েকটি সর্বসাধারণের প্রদর্শনী হয়ে ওঠে। বর্তমানে প্রায় সকল বড় বড় শহরে পশুপাখির সংরক্ষণাগার আছে। এক্ষেত্রে আধুনিককালের লক্ষণীয় প্রবণতা বন্দি অবস্থায় বিপন্ন প্রাণীদের প্রজনন ঘটানো; খাঁচাবন্দি করার পরিবর্তে ঘেরের মধ্যে উন্মুক্ত প্রাকৃতিক বাসস্থানের প্রতিরূপ আবাসস্থল সৃষ্টি করে সেখানে প্রাণিপ্রদর্শন; এবং জনগণকে বাস্তব্যবিদ্যার মূলনীতি শিক্ষাদান।

বাংলায় উনিশ শতকের গোড়ার দিকে, ১৮০১ সাল থেকে শুরু করে কলকাতায় চারটি প্রতিষ্ঠান ছিল যেগুলিকে বন্যপশুপাখির সংগ্রহশালা, এমনকি চিড়িয়াখানাও বলা যায়। সেসময় বেশ কিছু ব্যক্তিগত সংগ্রহশালাও ছিল। এমনকি অতিসম্প্রতিকালেও কলকাতায় ৭টি প্রাতিষ্ঠানিক চিড়িয়াখানা রয়েছে। ব্রিটিশের রাজত্বকাল থেকেই কলকাতা পশুব্যবসার সুপরিচিত এবং পশুপাখি বিকিকিনির কেন্দ্র ছিল। ব্রিটিশ শাসনের প্রায় দুশতকের অধিকাংশ সময় কলকাতা ছিল সরকারি প্রশাসনের কেন্দ্র তথা বুদ্ধিবৃত্তি ও সংস্কৃতিক চর্চার কেন্দ্র। ইংল্যান্ডের মতো এদেশে প্রতিনিয়ত নানা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের পরিস্থিতি না থাকায় প্রত্যন্ত অঞ্চলে কার্যরত নিঃসঙ্গ বিদেশিদের জন্য উদ্ভিদ ও প্রাণী গবেষণা উত্তেজনাপূর্ণ অবসরভোগ ও বিনোদনের সুযোগ করে দিয়েছিল। সেসময় বা আগে পশুবিষয়ক সত্যিকার ভারতীয় গবেষকের সংখ্যা ছিল নগণ্য, কিন্তু বিত্তবান রাজন্যবর্গ  বন্যপ্রাণী সংগ্রহ করতেন। কলকাতা ছিল একটি কর্মব্যস্ত বন্দর। এখানে ইউরোপ, আফ্রিকা ও এশিয়া থেকে জাহাজে উপনিবেশিক প্রশাসক ও বিত্তবানদের জন্য বিলাসদ্রব্য ও বিদেশি সামগ্রী আমদানি হতো। উপনিবেশিক, ভারতীয় উভয়কেই তাদের বন্ধু সহকর্মী ও বিদেশি সরকারকে জাহাজে ভারতীয় পশু রপ্তানি এবং বিনিময়ে অদ্ভুত ও চমকপ্রদ প্রাণী আমদানির অনুমতি দেওয়া হতো। ভারতে দীর্ঘকাল পশুব্যবসা চলছিল।

মার্বেল প্রাসাদ চিড়িয়াখানা

মার্বেল প্রাসাদ চিড়িয়াখানা (The Marble Palace Zoo)  (১৮৫৪ থেকে বর্তমানকাল)  রাজা রাজেন্দ্র মল্লিক বাহাদুর ১৮৫৪ সালে কলকাতার চোরবাগানে মার্বেল প্যালেস জু প্রতিষ্ঠা করেন যা আজও কলকাতার কেন্দ্রে রয়েছে। জনসাধারণের শিক্ষা ও বিনোদনের জন্য রাজা সচেতন ও উদ্দেশ্যমূলক ভাবে এটি প্রতিষ্ঠা করেন।

রাজা রাজেন্দ্র মল্লিক জীব-ইতিহাসের ছাত্র ছিলেন এবং তাঁর বাসগৃহের বন্যপ্রাণিশালায় ভারতসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে সংগৃহীত বহু  পাখি ও স্তন্যপায়ী প্রাণী ছিল। সর্বসাধারণের জন্য খুলে দেওয়ার আগেই এ চিড়িয়াখানায় বন্যপশুর একটি বড় সংগ্রহ ছিল। মল্লিক বাহাদুর লন্ডন চিড়িয়াখানাসহ অনেক প্রতিষ্ঠানে অসংখ্য পশু দান করেন। কলকাতা চিড়িয়াখানায়ও তিনি বহু মূল্যবান পশু দান করেন এবং সেজন্য সেখানকার প্রথম পশুশালাটি তাঁরই নামাঙ্কিত হয়ে আছে। পৃথিবীর চমকপ্রদ, সুন্দর ও আকর্ষণীয় প্রাণী সম্পর্কে গভীর আগ্রহী ও যত্নশীল বহু ব্যক্তিই মার্বেল প্যালেস চিড়িয়াখানার পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। সেখানকার প্রাণী সংরক্ষণ ও প্রদর্শনের ব্যাপারে যথেষ্ট চিন্তাভাবনার নিদর্শন রয়েছে।

আলীপুর চিড়িয়াখানা (Alipore Zoological Garden) (১৮৭৫ থেকে অদ্যাবধি)  ব্যারাকপুর বন্যপ্রাণিশালা চালু থাকলেও ১৮৪১ সালের গোড়ার দিকে কেউ কেউ কলকাতায় একটি যথার্থ চিড়িয়াখানার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করতেন। Calcutta Journal of Natural History পত্রিকার জুলাই (১৮৪১) সংখ্যায় র‌্যালে (Raleigh) একটি চিড়িয়াখানা গড়ে তোলার প্রস্তাব উত্থাপন করেন। ১৮৭৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে বেঙ্গল এশিয়াটিক সোসাইটির কাউন্সিল-সদস্য এল. শুয়েন্ডিয়ার (Schwendier) চিড়িয়াখানা প্রতিষ্ঠার জন্য বিশদ পরিকল্পনা প্রণয়ন করেন। এশিয়াটিক সোসাইটি ও অ্যাগ্রোহর্টিক্যালচারাল সোসাইটি পরিকল্পনাটি অনুমোদন করে।

আলীপুর চিড়িয়াখানা

বেঙ্গল গভর্নমেন্ট আলীপুরে ১৪ হেক্টর জমি বরাদ্দ করেন এবং বাংলার তৎকালীন লে. গভর্নর স্যার রিচার্ড টেম্পলের আগ্রহে চিড়িয়াখানার উন্নয়নকাজ শুরু হয়, আসে ৫০০০ টাকার একটি মঞ্জুরি। ১৮৭৫ সালের মধ্যে বেশ কয়জন দাতার স্বতঃস্ফূর্ত অনুদানের কল্যাণে মোটামুটি ধরনের একটি বন্যপ্রাণিশালা গড়ে ওঠে। দাতাদের মধ্যে ছিলেন ময়মনসিংহের রাজা সূর্যকান্ত আচার্য চৌধুরী, ঢাকার নবাব  খাজা আবদুল গণি ও  খাজা আহসানুল্লাহ খান বাহাদুর প্রমুখ। তৎকালীন প্রিন্স অব ওয়েলস, সম্রাট সপ্তম এডওয়ার্ড ১৮৭৫ সালের ২৭ ডিসেম্বর কলকাতার অভিজাতদের উপস্থিতিতে চিড়িয়াখানার মধ্যে দিয়ে বেলভেডর যান এবং ১৮৭৬ সালে ১ জানুয়ারি আনুষ্ঠানিকভাবে চিড়িয়াখানা উদ্বোধন করেন। অবশ্য এটি সর্বসাধারণ্যে উন্মুক্ত হয় ১৮৭৬ সালের ১ মে।

পরবর্তীতে ১৯৫৭ সালে চিড়িয়াখানাটির আধুনিককরণের নিমিত্তে বাঘদের বিচরণের জন্য চারদিকে সীমানাবেষ্টিত একটি পৃথক খোলামেলা স্থান তৈরি করা হয়। ১৯৭৭ সালে আলীপুর চিড়িয়াখানায় মিঠাপানির মাছের এ্যাকুয়ারিয়াম (Aquarium)  নির্মিত হয় যাতে বর্তমানে বিভিন্ন প্রজাতির প্রায় দেড় সহস্রাধিক মাছ রয়েছে। ১৯৭৯ সালে বিভিন্ন প্রকার সরিসৃপ জাতীয় প্রাণী, ঘড়িয়াল ইত্যাদি প্রদর্শনের জন্য আলাদাভাবে একটি অবকাঠামো তৈরি হয়। ১৯৮৫ সালে ভল্লুক এবং ১৯৯৯ সালে হাতিদের জন্য পৃথক দুটি সীমানাবেষ্টিত স্থান নির্মাণ করা হয়, যেখানে তারা স্বাচ্ছন্দে বিচরণ করতে পারে। [মোঃ আনোয়ারুল ইসলাম]

ঢাকা চিড়িয়াখানা

ঢাকা চিড়িয়াখানা (Dhaka Zoo)  ঢাকার মীরপুরে অবস্থিত বাংলাদেশের বৃহত্তম চিড়িয়াখানা। মৎস্য ও পশুসম্পদ মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ এটি বাংলাদেশের জাতীয় চিড়িয়াখানা। ১৯৫০ সালে হাইকোর্ট চত্বরে জীবজন্তুর প্রদর্শনশালা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত এবং ১৯৭৪ সালে বর্তমান অবস্থানে স্থানান্তরিত হয়। ওই  বছরই ২৩ জুন উদ্বোধন ও সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত হয়। প্রায় ৭৫ হেক্টর আয়তনের এ চত্বরে ১৩ হেক্টরের দুটি লেক আছে যেখানে প্রতি বছর শীতে অসংখ্য পরিযায়ী জলজ পাখি ভিড় জমায়। চিড়িয়াখানাটিতে দেড়শ’ প্রজাতির প্রায় ২০৪৯টি মেরুদন্ডী প্রাণী রয়েছে। এর মধ্যে ৫৪ প্রজাতির ৩৭৮টি স্তন্যপায়ী প্রাণী, ৬০ প্রজাতির ১২১৯টি পাখি, দশ প্রজাতির ৩৯০টি মাছ। দর্শকদের আকর্ষণের জন্য বিভিন্ন প্রাণীর মধ্যে রয়েছে ১১টি বাঘ, ১৬টি সিংহ, ৮টি জলহস্তি, ৬৫টি বানর এবং ১৪টি অজগর সাপ। এর পাশাপাশি আরও কিছু বিরল প্রাণী রয়েছে যেমন যেবরা, এমু, গয়াল, কালো ভল্লুক ইত্যাদি যা দর্শকদের মুগ্ধ করে। এখানকার বন্দি প্রাণীর প্রজনন কর্মসূচির আওতায় ইতোমধ্যে  বাঘ, সিংহ, চিতা, নানা জাতের  বানর ও অনেক প্রজাতির পাখির প্রজননে সাফল্য অর্জিত হয়েছে।

পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের চিড়িয়াখানার সঙ্গে প্রাণিবিনিময়ের ব্যবস্থাও আছে। ছাত্রছাত্রীদের জন্য নিয়মিত শিক্ষামূলক কর্মসূচিও রয়েছে। বার্ষিক দর্শকসংখ্যা প্রায় ৩০ লক্ষ। মৎস্য ও পশুসম্পদ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীর নেতৃত্বে সংস্থার একটি উপদেষ্টা পরিষদ রয়েছে।

রংপুর, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, কুমিল্লা ও খুলনা শহরে আরও ৫টি চিড়িয়াখানা আছে। রংপুর ও খুলনার চিড়িয়াখানা যথাক্রমে মৎস্য ও পশুসম্পদ মন্ত্রণালয় ও সামরিক বাহিনী দ্বারা পরিচালিত। অন্য ৩টি স্থানীয় সরকারের অধীন।  [মোঃ শহীদুল্লাহ]