চন্দ্রাবতী

চন্দ্রাবতী (১৬শ শতক)  মধ্যযুগের তিনজন উল্লেখযোগ্য মহিলা কবির অন্যতম; অপর দুজন হলেন চন্ডীদাসের সাধনসঙ্গিনী রামতারা বা রামী এবং শ্রীচৈতন্যের কৃপাপাত্রী মাধবী। চন্দ্রাবতী ছিলেন মনসামঙ্গলের অন্যতম কবি দ্বিজ বংশীদাসের কন্যা। তাঁদের নিবাস ছিল বৃহত্তর ময়মনসিংহের  কিশোরগঞ্জ জেলার অন্তর্গত পাঠবাড়ী বা পাতুয়ারী গ্রামে।

দীনেশচন্দ্র সেনের মতে কবি চন্দ্রাবতী ১৫৫০ খ্রিস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন। মৈমনসিংহ-গীতিকার ‘জয়-চন্দ্রাবতী’ উপাখ্যানের নায়িকারূপে তিনি অমর হয়ে আছেন।  ময়মনসিংহ অঞ্চলে ‘চন্দ্রাবতীর রামায়ণ’ নামে একটি গাথা প্রচলিত আছে। গাথানুযায়ী রূপসী চন্দ্রাবতী একই এলাকার ব্রাহ্মণ যুবক জয়চন্দ্রের প্রতি আশৈশব প্রণয়াসক্ত ছিলেন এবং পরিণত বয়সে দুপক্ষের অভিভাবকদের সম্মতিক্রমে বিবাহও স্থির হয়। কিন্তু দৈবাৎ কমলা নামের এক মুসলিম যুবতীর প্রেমাসক্ত হয়ে প্রেমিক জয়চন্দ্র  ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে। পরে অবশ্য অনুতপ্ত জয়চন্দ্র চন্দ্রাবতীর নিকট ফিরে এলে করুনভাবে প্রত্যাখ্যাত হয়। তখন অভিমানী জয়চন্দ্র ফুলেশ্বরী নদীতে (মতান্তরে সুনন্দা নদীতে) প্রাণ বিসর্জন দিলে বেদনাহত চন্দ্রাবতী শোক ভুলে থাকার অভিপ্রায়ে পিতার আদেশে রামায়ণকথা  রচনায় প্রবৃত্ত হন। অবশ্য কাব্য রচনা সমাপ্ত হওয়ার পূর্বেই তাঁর প্রাণবিয়োগ ঘটে।

চন্দ্রাবতী প্রেমাস্পদ জয়চন্দ্রের বিচ্ছেদজ্বালা নিবারণের জন্য ফুলেশ্বরী নদীর তীরে পিতৃনির্মিত শিবমন্দিরে শিব-আরাধনায় কুমারী অবস্থায় জীবন অতিবাহিত করেন। ৩৫৪ ছত্র ও ১২ অঙ্কে বিভক্ত নয়ান ঘোষ প্রণীত চন্দ্রাবতী  পালায় কবি চন্দ্রাবতীর জীবনকাহিনী বিধৃত হয়েছে।

১৯৩২ সালে  দীনেশচন্দ্র সেন চন্দ্রাবতীর রামায়ণ প্রকাশ করেন। পূর্ববঙ্গ-গীতিকার চতুর্থ খন্ডের ২য় ভাগে এ রামায়ণ স্থান পেয়েছে। দীর্ঘদিন এ কাব্য পূর্ব ময়মনসিংহে ঘরে ঘরে পঠিত ও গীত হয়েছে। লৌকিক, মানবিক ও অন্যান্য মৌলিক উপাদানসমৃদ্ধ এ কাব্যটি বিশেষ মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত। পশ্চিমবঙ্গের অনেক স্থানে পঠিত ও মহিলাদের দ্বারা গীত হয়েছে তাঁর রামায়ণ গান। দস্যু কেনারামের গাথা  কাহিনীটি ‘দ্বিজ বংশীসুতা’ এ ভণিতায় চন্দ্রাবতীর রচনা বলে চিহ্নিত হয়েছে। এ ছাড়া তিনি পদ্মাপুরাণ ও মলুয়া নামে আরও দুটি কাব্য রচনা করেন।

তাছাড়া চন্দ্রাবতী অজস্র লোকগীতি রচনা করেন। নৌকার মাঝির কণ্ঠে, ব্রতে, বিয়েতে এবং প্রতিদিনের গার্হস্থ্য জীবনে আজও শোনা যায় চন্দ্রাবতীর গান। ষোল শতকের সামাজিক-আর্থনীতিক অবস্থার স্বরূপ প্রতিফলিত হয়েছে তাঁর রচনায়। চন্দ্রাবতীর স্মৃতি, রচনা, জীবন ও সাহিত্য আজও বহমান স্রোতোধারার মতো গবেষক ও পর্যটককে আকর্ষণ করে।  [সমবারু চন্দ্র মহন্ত]