ক্লাইভ, রবার্ট
ক্লাইভ, রবার্ট (১৭২৫-১৭৭৪) পলাশী যুদ্ধের বিজেতা এবং বাংলায় ব্রিটিশ শাসনের অন্যতম স্থপতি। আয়ারল্যান্ডের একটি মাঝারি জমিদার পরিবারের সন্তান রবার্ট ক্লাইভ স্কুলে ছাত্র হিসেবে তেমন কৃতিত্ব প্রদর্শন করতে পারেন নি। আঠারো বছর বয়সে তিনি মাদ্রাজে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির চাকরিতে প্রবেশ করেন (১৭৪৩)। কর্নাটের যুদ্ধে ক্লাইভ একবার ফরাসিদের হাতে বন্দি হন এবং পরে একজন স্থানীয় লোকের ছদ্মবেশে পলায়ন করে পন্ডিচেরিতে সেন্ট ডেভিড দুর্গে পৌঁছেন। ফরাসিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে ইংরেজরা যখন পশ্চাদপসরণ করছিল তখনও দুর্গটি তাদের অধিকারে ছিল।
ক্লাইভ কোম্পানির চাকরি ছেড়ে দেন এবং ১৭৪৮ সালে মাদ্রাজ সেনাবাহিনীতে সর্বনিম্ন কমিশন প্রাপ্ত অফিসার হিসেবে যোগদান করেন। তাঁর জীবনী লেখক ম্যালকমের মতে তিনি একজন উচ্ছৃঙ্খল অফিসার ছিলেন। কিন্তু উচ্ছৃঙ্খলতার সাথে শৌর্যের সমন্বয় ঘটায় উগ্রস্বভাববিশিষ্ট হওয়া সত্ত্বেও ওই সময়ে ক্লাইভের পক্ষে সামরিক কর্তৃত্বলাভ কঠিন ছিল না। লেফটেন্যান্ট হিসেবে তিনি একবার এক মারাঠা নেতার বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করেন এবং মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় দেবীকোট দুর্গ অধিকার করেন। ক্লাইভ কর্তৃক দেবীকোট দুর্গ অধিকারের বিবরণ দিতে গিয়ে মিল সেনাবাহিনীর অগ্রভাগে অবস্থান নিয়ে সৈন্যদের থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করার কারণে ক্লাইভের বিরুদ্ধে হঠকারিতার অভিযোগ এনেছেন। ক্লাইভের পরবর্তী সামরিক তৎপরতার নিদর্শন তাঁর আর্কট অভিযান, যাতে তিনি প্রচলিত সামরিক নিয়মনীতি লঙ্ঘন করে নওয়াবের দুর্গে নৈশ অভিযান পরিচালনা করেন এবং কোনো প্রাণহানি না ঘটিয়ে সিপাহিদের পালাতে বাধ্য করেন। ক্লাইভের দেবীকোট ও আর্কট অভিযান তাঁর বেপরোয়া স্বভাবের সাক্ষ্য বহন করে। ১৭৫৩ সালের প্রথম দিকে ক্লাইভ লন্ডনে ফিরে গেলে দাক্ষিণাত্যে তাঁর অব্যাহত বিজয়ের কৃতিত্বের জন্য তাঁকে বীরোচিত সংবর্ধনা দেয়া হয়। কর্নাটের যুদ্ধে তাঁর সাফল্যের জন্য কোর্ট অব ডাইরেক্টর্স তাঁকে সম্মানিত করে এবং ভোজসভায় ‘জেনারেল ক্লাইভ’ নামে আখ্যাত করে তাঁকে রত্নখচিত তরবারি উপহার দেওয়া হয়।
একজন জননেতা হওয়ার আশায় ক্লাইভ সেনাবাহিনীর চাকরি পরিত্যাগ করেন, কিন্তু পার্লামেন্টে আসন লাভে ব্যর্থ হন। সামাজিক ও রাজনৈতিক জীবনে অসংযত আচরণের ফলে ক্লাইভ অতি অল্প সময়ে তাঁর ধনসম্পদের অপচয় করেন। জীবনে বীতশ্রদ্ধ ও হতাশাগ্রস্ত হয়ে ভাগ্যান্বেষণে তিনি মাদ্রাজে প্রত্যাবর্তন করেন (১৭৫৫) এবং ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক ‘শুধু ইস্ট ইন্ডিজের জন্য’ লেফটেন্যান্ট কর্নেল পদে নিযুক্ত হন। তিনি এমন এক সময়ে আসেন যখন ফরাসিগণ নিজামের সাথে অধীনতামূলক মিত্রতায় আবদ্ধ হয়ে দক্ষিণ ভারতে তাঁদের প্রাধান্য বিস্তার করেছে। এ চুক্তি অনুসারে নিজাম ফরাসি সেনাবাহিনীর ভরণপোষণের জন্য উড়িষ্যার পুরি ও কৃষ্ণা নদীর মোহনার মধ্যবর্তী স্থানে অবস্থিত একটা জেলা তাদের হাতে সমর্পণ করেন (ডিসেম্বর ১৭৫৫)। নিজামকে শিক্ষা দেওয়ার জন্য ক্লাইভকে সেনাবাহিনীর দায়িত্ব প্রদান করা হয়। তিনি অতর্কিতে আক্রমণ করে নিজামের শক্তিশালী গেরিয়া দুর্গ অধিকার করেন (ফেব্রুয়ারি, ১৭৫৬) এবং মারাঠাদের সঙ্গে মিত্রতা স্থাপন করেন।
নওয়াব সিরাজউদ্দৌলার হাতে কলকাতার পতনের সংবাদ এমন এক সময়ে মাদ্রাজ পৌঁছে যখন কোম্পানির লোকেরা ক্লাইভ কর্তৃক অর্জিত সামরিক ও কূটনৈতিক বিজয় উপলক্ষে উৎসব উদযাপনে ব্যস্ত ছিল। সংবাদ আসে যে, কলকাতা ও অপরাপর ইংরেজ বসতি থেকে বিতাড়িত সকল ইংরেজ বণিক ও নাগরিক কলকাতার ভাটিতে ফলতায় আশ্রয় গ্রহণ করেছে এবং তারা ‘জ্বরে আক্রান্ত হয়ে, বিশুদ্ধ পানি ও খাদ্যের অভাবে মারা’ যাচ্ছে। এ বিপজ্জনক সময়ে মাদ্রাজ কর্তৃপক্ষ উদ্ধারকার্য পরিচালনার জন্য ক্লাইভকে সর্বাপেক্ষা যোগ্য ব্যক্তি বিবেচনা করেন। ১৭৫৬ সালের ১৬ অক্টোবর ক্লাইভের নেতৃত্বে একটি সেনাবাহিনী নৌপথে মাদ্রাজ থেকে যাত্রা শুরু করে এবং ডিসেম্বর মাসে ফলতায় পৌঁছে। সাহায্যকারী নৌবাহিনীর নেতৃত্বে ছিলেন অঞ্ঝাডমিরাল ওয়াটসন। ক্লাইভ ও ওয়াটসনের যৌথ অভিযানের ফলে ১৭৫৭ সালের ২ জানুয়ারি খুব সহজেই কলকাতা পুনর্দখল করা হয় এবং সিরাজউদ্দৌলার সঙ্গে এক অনুকূল শান্তি চুক্তি সম্পাদিত হয় (আলীনগর চুক্তি, ৯ ফেব্রুয়ারি, ১৭৫৭)।
কলকাতার পতনের পর ফোর্ট উইলিয়মএর সিলেক্ট কমিটি অস্তিত্বহীন হয়ে পড়েছিল। এবার কমিটি পুনর্গঠিত হয় এবং রবার্ট ক্লাইভ এর গভর্নর পদে অধিষ্ঠিত হন। প্রকৃতপক্ষে ক্লাইভ নিজেই নিজেকে উক্ত পদে মনোনীত করেন। এরূপ একটি স্বনিয়োগ অন্যান্য বেসামরিক, সামরিক ও বাণিজ্যিক কর্মকর্তাগণ মেনে নিতে পারলেন না। তাঁরা তাঁকে গভর্নর হিসেবে গ্রহণ করতে রাজি ছিলেন না, কারণ ক্লাইভ বাংলায় কোম্পানির ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে শুধু একজন বহিরাগতই নন, পদে ও মর্যাদায় ছিলেন তাদের চেয়ে অনেক কনিষ্ঠ। রজার ড্রেক ১৭৩৭ সাল থেকে কোম্পানির চাকরিতে ছিলেন এবং সিরাজউদ্দৌলা কর্তৃক কলকাতা বসতি অধিকৃত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত এর গভর্নর পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। অনুরূপভাবে রিচার্ড বেকার ১৭৩৭ সাল থেকে কোম্পানির চাকরিতে নিয়োজিত ছিলেন এবং একজন সিনিয়র বণিক ও কর্মকর্তারূপে ড্রেকের পর ছিল তাঁর অবস্থান। অ্যাডমিরাল ওয়াটসন পদমর্যাদা ও চাকরির জ্যেষ্ঠতা অনুযায়ী ছিলেন ক্লাইভের সিনিয়র। এঁরা সবাই গভর্নরের পদটি পাওয়ার প্রত্যাশায় ছিলেন। যাহোক, ক্লাইভের পক্ষ থেকে সামরিক হুমকি এবং পরবর্তী সময়ে ক্লাইভের অনুকূলে মাদ্রাজ কর্তৃপক্ষের একটি আদেশের ফলে এ বিরোধের অবসান ঘটে।
গভর্নর হিসেবে তাঁর অবস্থান নিশ্চিত করার পর ক্লাইভের পরবর্তী পদক্ষেপ ছিল ফরাসিদের বাংলা থেকে বিতাড়ন এবং পলাশীর যুদ্ধর পথ প্রস্ত্তত করা। শত্রুভাবাপন্ন নওয়াব সিরাজউদ্দৌলাকে পদচ্যুত করে একজন অনুগত ও বশংবদ ব্যক্তিকে নওয়াবি পদ প্রদানের নির্বিকল্প প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে তিনি কোর্ট অব ডাইরেক্টর্সকে বুঝিয়েছিলেন। যুক্তি দেখানো হয়েছিল যে, বাংলার শক্তি কাঠামোতে একটি নিয়ন্ত্রিত বিপ্লব বাণিজ্যিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে কোম্পানি ও ইংরেজ জাতিকে লাভবান করবে। কোর্টের উত্তরের অপেক্ষা না করে তিনি ১৭৫৭ সালের মার্চে চন্দননগরএর ফরাসি উপনিবেশ অধিকার করেন। ফরাসিদের বিতাড়িত করার পর তিনি তাঁর শেষ এবং সবচেয়ে বড় শত্রু নওয়াব সিরাজউদ্দৌলাকে উৎখাত করতে অগ্রসর হন। তিনি শীঘ্রই বুঝতে পারলেন যে, নওয়াবের বিরুদ্ধে দরবারে একটা ষড়যন্ত্র চলছে এবং জগৎ শেঠ এ ষড়যন্ত্রের নেতা। তিনি ফোর্ট উইলিয়ম কাউন্সিল এবং দরবারের অসন্তুষ্ট অমাত্যদের মধ্যে একটি চুক্তি সম্পাদনের জন্য উমিচাঁদকে কাজে লাগালেন। ১৭৫৭ সালের ১৯ মে সম্পাদিত গোপন চুক্তি ছিল এর ফল। ক্লাইভ সুবার মীর বখশী বা প্রধান সেনাপতি মীরজাফরআলী খানকে অভ্যুত্থানের নেতা নির্বাচিত করেন। ষড়যন্ত্রের পরিকল্পনা অনুযায়ী তথাকথিত পলাশীর যুদ্ধ অনুষ্ঠিত হয় (২৩ জুন, ১৭৫৭)। সিরাজউদ্দৌলা সম্পূর্ণরূপে পরাজিত হন এবং পরবর্তীকালে মীরজাফরের পুত্র মীরণ কর্তৃক বন্দি ও নিহত হন।
চন্দননগর থেকে ফরাসিদের বিতাড়ন ও মীরজাফরকে সিরাজউদ্দৌলার স্থলাভিষিক্ত করা এ দুটি ঘটনার মূল্যায়ন করতে গিয়ে ক্লাইভ পলাশী যুদ্ধ শেষ হওয়ামাত্র কোর্ট অব ডাইরেক্টর্সকে লিখেছিলেন যে, ফরাসিদের পরাজিত ও বাংলা থেকে বিতাড়িত করা ছিল তাঁর জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ কৃতিত্ব। ইউরোপ ও পৃথিবীব্যাপী সপ্তবর্ষব্যাপী যুদ্ধের ফলাফলের পরিপ্রেক্ষিতে তাঁর মতামত সম্ভবত সঠিক ছিল। পলাশী যুদ্ধে তাঁর বিজয়কে ক্লাইভ আর্কটের ন্যায় শুধু একজন নওয়াবের পরিবর্তন হিসেবে দেখেছিলেন। কিন্তু ক্লাইভ শীঘ্রই অনুধাবন করেন যে, বস্ত্তত নীরবে তিনি প্রাচ্যে একটি সাম্রাজ্যের ভিত্তি স্থাপন করেছেন।
দক্ষিণ ভারতে ধারাবাহিক বিজয় তাঁকে খ্যাতিমান করেছিল, কিন্তু সম্পদশালী করে নি। কিন্তু বাংলায় তিনি খ্যাতির সঙ্গে পর্যাপ্ত ধনসম্পদ লাভ করেন। পলাশী যুদ্ধের অব্যবহিত পরে মুর্শিদাবাদ কোষাগার লুণ্ঠনে তাঁর অংশগ্রহণের কারণে তাঁকে পার্লামেন্টের একটি তদন্ত কমিটির সম্মুখীন হতে হয়। ক্লাইভকে প্রদত্ত মীর জাফরের ব্যক্তিগত উপহারের পরিমাণ ছিল অবিশ্বাস্যরূপে বিশাল। মীর জাফরের নিকট থেকে তিনি বার্ষিক বিপুল আয়ের জায়গিরও পেয়েছিলেন। ব্যবসায়িক লুণ্ঠনের অর্থে গভর্নর হিসেবে তাঁর প্রাপ্ত অংশের পরিমাণও ছিল উল্লেখযোগ্য। তাঁর জীবনী লেখক ম্যালকমের মতানুসারে, তিনি ১৭৬০ সালে অবসর গ্রহণ করেন এবং তাঁর পূর্বে ও পরে বাংলা থেকে প্রত্যাগত সকল ‘নওয়াব’-এর মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ ‘নওয়াব’ হিসেবে লন্ডনে পৌঁছেন। ১৭৬২ সালে তাঁকে ‘ব্যারন ক্লাইভ অব পলাশী’ উপাধি দিয়ে আইরিশ অভিজাতমন্ডলীতে উন্নীত করা হয়। তা ছাড়াও ১৭৬৪ সালে তাঁকে ‘নাইট অব দি বাথ’ উপাধি দেয়া হয়। সম্রাট শাহ আলম (দ্বিতীয়) তাঁকে একগুচ্ছ উপাধিতে ভূষিত করেন। এগুলি ছিল ‘দিলার জং’ (রণক্ষেত্রে সাহসী), সাইফ জং (যুদ্ধের তরবারি), মামিরুল মামালিক (সাম্রাজ্যের অভিজাত), সাবদাতুল মুলক (রাজ্যের বিশিষ্ট ব্যক্তি) ইত্যাদি।
পলাশীর পট পরিবর্তন কোম্পানিকে ঘটনার পূর্বে ক্লাইভ কর্তৃক অনুমিত বিপুল পরিমাণ আয় দেখাতে পারে নি। বরং কোম্পানি বাংলায় ব্যবসার মাধ্যমে প্রচুর মুনাফা অর্জন করলেও, পলাশীর যুদ্ধের পর ব্যবসায়ে ক্ষতির সম্মুখীন হতে থাকে। প্রতি বছর কোম্পানির দেনা বাড়তে থাকে। কোর্ট অব ডাইরেক্টর্স দেখতে পায় যে, কোম্পানির কর্মকর্তাগণ বাংলাকে তাঁদের ব্যক্তিগত ধনভান্ডারে পরিণত করেছে। কোম্পানির ব্যবসা-বাণিজ্যকে অগ্রাধিকার না দিয়ে তারা সবাই ব্যক্তিগত ব্যবসায়ে আত্মনিয়োগ করেছে। ক্লাইভকে বাংলায় কোম্পানির বিনিয়োগকে লাভজনক করার সর্বাপেক্ষা কঠিন এক দায়িত্ব দিয়ে পুনরায় বাংলায় পাঠান হয়।
ক্লাইভ ১৭৬৫ সালে কলকাতা পৌঁছেন। তিনি সমুদ্রপথে বাংলা অভিমুখে যাত্রাকালেই তাঁর অগ্রাধিকারভিত্তিক কর্মপদ্ধতির পরিকল্পনা প্রণয়ন করেন। তাঁর স্বপ্ন ছিল গভর্নর হিসেবে তাঁর দ্বিতীয় শাসনকালকে যতখানি সম্ভব তাঁর জাতির জন্য অর্থবহ ও ফলপ্রসূ করে তোলা। এ কাজে তিনি প্রত্যাশার অতিরিক্ত সাফল্য অর্জন করেন। তিনি এলাহাবাদ যান এবং খেতাবসার সম্রাটের নিকট থেকে বার্ষিক নিয়মিত ২৬ লক্ষ সিক্কা টাকার বিনিময়ে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির জন্য বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার দীউয়ানি লাভ করেন। কোম্পানির নামে দীউয়ান এর পদ গ্রহণের সময় তিনি সম্পূর্ণরূপে এর রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক গুরুত্ব উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। তিনি অনুধাবন করেছিলেন যে, রাজকীয় ফরমান বলে এদেশে বাণিজ্যরত অন্যান্য সমুদ্রোপকূলীয় কোম্পানি স্বভাবতই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির দীউয়ানি এখতিয়ার মেনে নিতে অস্বীকার করবে; এর পরিণাম হবে যুদ্ধ এবং অবশ্যই তা পরিহার করতে হবে। ক্লাইভ এও বুঝতে পেরেছিলেন যে, দেশের রাজস্ব ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে কোম্পানির কোনো অভিজ্ঞতা নেই এবং বাস্তবিকপক্ষে বাংলার গ্রামগঞ্জ থেকে রাজস্ব সংগ্রহ করার জন্য জনবলও কোম্পানির নেই। এ পরিস্থিতিতে দেশটি সরাসরি শাসন করা থেকে বিরত থেকে ক্লাইভ সর্বোচ্চ রাজনৈতিক দূরদর্শিতা প্রদর্শন করেছেন। তিনি কোম্পানির পক্ষে রাজস্ব ব্যবস্থা পরিচালনার জন্য সৈয়দ মুহম্মদ রেজা খান নামে একজন পারসিক ভাগ্যান্বেষীকে নায়েব দীউয়ান (ডেপুটি দীউয়ান) পদে নিয়োগ করেন। অন্য কথায়, সাধারণভাবে দ্বৈতশাসন (১৭৬৫) ব্যবস্থা নামে পরিচিত ক্লাইভ প্রবর্তিত শাসনব্যবস্থায় অর্থ বা জনবলে কোনো বিনিয়োগ ব্যতিরেকে এবং কোনো প্রকার দায়িত্ব গ্রহণ না করে কোম্পানি দেশের রাজস্ব ভোগ করবে। এটি হচ্ছে বিনিয়োগ ছাড়া আয়ের একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ।
কোম্পানির স্বার্থের দিক থেকে বিবেচনা করলে এ ব্যবস্থা তাত্ত্বিক ও প্রায়োগিক উভয় ক্ষেত্রেই ছিল বিস্ময়কর। এমনকি ক্লাইভ নিজেও কল্পনা করতে পারেন নি যে, তাঁর দীউয়ানি ব্যবস্থা শীঘ্রই একটি সাম্রাজ্যের রূপ পরিগ্রহ করবে। ক্লাইভ একজন জাতীয় বীরে পরিণত হন। তাঁর পূর্ণাবয়ব প্রতিমূর্তি ও আবক্ষ মূর্তিগুলি ইন্ডিয়া অফিস ও পার্লামেন্ট ভবনসহ বিভিন্ন প্রকাশ্য স্থানে স্থাপিত হয়। একজন অদম্য যোদ্ধা ও একটি সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা রবার্ট ক্লাইভ তাঁর জীবনে একটি ক্ষেত্র ব্যতীত অন্য কোনো পরাজয়ের সম্মুখীন হন নি। তিনি কখনও মনের বিষণ্ণতাকে অতিক্রম করতে পারেন নি। তাঁর প্রথম জীবনে আত্মহত্যামূলক প্রবণতার একটি প্রমাণ আছে। বিজয়ের রোমাঞ্চকর ঘটনাবলি, অভিবাদন ও গৌরবগাথা তাঁর ভারতীয় জীবনকে উচ্ছ্বসিত করে রেখেছিল। কিন্তু লন্ডনে শেষ বারের মতো প্রত্যাবর্তনের পর যখন তাঁর জীবন তুলনামূলকভাবে নিঃসঙ্গ ও নীরব হয়ে পড়ে তখনই সমস্যাটি মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে এবং পরিণামে তিনি এর শিকারে পরিণত হন। ১৭৭৪ সালের ২২ নভেম্বর ক্লাইভ নিজেকে গুলি করে আত্মহত্যা করেন। [সিরাজুল ইসলাম]