কামতা-কোচ বিহার
কামতা-কোচ বিহার আলাউদ্দীন হোসেন শাহ (১৪৯৩-১৫১৯ খ্রি.) কর্তৃক খেন রাজবংশের ধ্বংসের পর থেকে কামতা-কোচ রাজ্য সম্পর্কে ধারাবাহিক বর্ণনা পাওয়া যায়। কোচ প্রধান বিশ্বসিংহ হোসেন শাহের উত্তরসূরিদের বিতাড়িত করে কামতা-কোচ রাজ্য (ষোল শতক) প্রতিষ্ঠা করেন। এর ফলে পূর্ব ভারতে একটি উপজাতীয় রাষ্ট্রের উদ্ভব হয়। এ শতকে রাজ্যটি করতোয়া থেকে বড়নদী পর্যন্ত সমগ্র অঞ্চলে শক্তি সুদৃঢ় করে।
১৫৬২ খ্রিস্টাব্দে বিশ্বসিংহের পুত্র এবং উত্তরাধিকারী নরনারায়ণের ভাই চিলারায়ের নেতৃত্বে একটি কোচ বাহিনী অহোম রাজ্যের রাজধানী গোড়গাঁও আক্রমণ করে এবং এটি লুণ্ঠন ও ধ্বংস করে। এরপর সাম্রাজ্যের পূর্ব সীমা সঙ্কোষ থেকে কোচহাজো পর্যন্ত বিস্তৃত হয়ে কামরূপ (বর্তমান নাম আসাম) নামে পরিচিত হয়। পরবর্তীকালে চিলারায়ের পুত্র এবং নরনারায়ণের ভ্রাতুষ্পুত্র রঘুদেব এ অঞ্চলের শাসনকর্তা হন এবং স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। অতঃপর কামরূপ মুগল সাম্রাজ্যর অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত হয়, আরও পরে এটি অহোম রাজ্যের এবং অবশেষে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যভুক্ত হয়। সঙ্কোষ নদীর পশ্চিমে পূর্ববর্তী কামতা-কোচ (কুচবিহার নামেও পরিচিত) রাজ্যের পশ্চিমাংশে রাজত্বকারী মূল রাজবংশ অবশ্য আরও কয়েক শতক ধরে এর অস্তিত্ব বজায় রাখে।
পুন্ড্রবর্ধন (পুন্ড্রনগর) থেকে উত্তরে অবস্থিত অঞ্চলটি জনসাধারণ কর্তৃক উপেক্ষিত হলেও এটি তাদের কাছে একেবারে অপরিচিত ছিল না। দামোদরপুর তাম্রশাসনে (আনু. পাঁচ শতক) হিমালয়ে অবস্থিত শ্বেত-বরাহস্বামী ও কোকামুখস্বামী মন্দিরের উল্লেখ রয়েছে। খ্রিস্টীয় দশ শতকের প্রথমার্ধে উত্তর বাংলার রাজনৈতিক মঞ্চে কম্বোজদের উপস্থিতি পরিলক্ষিত হয়। কম্বোজদের পরিচিত নিয়ে বিতর্কের অবকাশ রয়েছে। ভাষাতত্ত্বের বিচারে বলা হয়েছে যে, ‘কোচ’ শব্দটি ‘কম্বোজ’ (কমোচ> কওচ> কোচ) শব্দ থেকে এসেছে। তবকাত-ই-নাসিরী (তেরো শতক) গ্রন্থে কোচ-মেচ-থারু নামে পরিচিত একদল লোকের (তিববতি-বর্মি) উল্লেখ আছে। লখনৌতি বিজয়ের পর উত্তর দিকে অগ্রসর হওয়ার সময় বখতিয়ার খলজীর সঙ্গে তাদের সাক্ষাৎ হয়। সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় এর মতে, তিববতি-চীনা গোত্রের শাখা তিববতি-বর্মিগণ হিমালয় পর্বতের ভারতীয় পাশে নেপাল, উত্তর বিহার-বাংলা এবং আসামে আগমন করে। সম্ভবত তারা এসকল অঞ্চলে পূর্ব থেকেই বসবাসকারী কোল এবং দ্রাবিড় জনসমষ্টির সঙ্গে মিশে যায়। তাদের এ সংমিশ্রণ গাঙ্গেয় সংস্কৃতির সংস্পর্শে এসে দ্রুত আর্যভাবাপন্ন হয়ে পড়ে।
খেন রাজারা কামতাপুরে (গোসানিমারি) তাঁদের রাজধানী স্থাপন করেন। তাঁদের রাজধানী প্রতিষ্ঠার বিস্তারিত বিবরণ পাওয়া যায় ‘গোসানি মঙ্গল’ (Gosani-Mangal) কাব্যে। তবে এর অনেক আগেই গৌড়ের সুলতান আলাউদ্দীন হোসেন শাহ এ রাজ্যের রাজধানী ধ্বংস করেন এবং এ ভূ-খন্ড দখল করে নেন। তিনি নিজেকে কামরূপ এবং কামতার বিজয়ী রূপে মুদ্রা জারি করেন। ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার পশ্চিমাংশ থেকে করতোয়া পর্যন্ত যে ভূভাগ পূর্বে কামরূপ হিসেবে পরিচিত ছিল তা কামতা নামে পরিচিত হয়।
ষোল শতকের কামতা-কোচ বিহার রাজ্যটি একটি সার্বভৌম ভূ-খন্ড হিসেবে প্রতিষ্ঠালাভ করে। এটি সঙ্কোষ-এর পূর্বে কামরূপ নামক রাজ্যের অধিকারমুক্ত থাকে। পরবর্তীকালে এটি মুগল এবং ভুটানের সঙ্গে যুদ্ধে স্বীয় অস্তিত্ব বজায় রাখে এবং ১৭৭২-৭৩ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এর সঙ্গে চুক্তি সম্পাদন করে। অবশেষে রাজবংশের শেষ রাজা মহারাজা জগদ্বীপেন্দ্রনারায়ণ ভূপবাহাদুর (মৃত্যু ১৯৭২)-এর আমলে এটি ভারতীয় ইউনিয়ন (১৯৪৯)-এর সঙ্গে একত্রিত হয়ে নতুন রূপ লাভ করে। যাহোক, এটি বলা যায় যে, প্রতিবেশী ভূ-খন্ড থেকে অভিবাসী লোকদের প্রতি সরকারের উদারতা ও অপরদিকে তাদের প্রতি স্থানীয় জনসাধারণের উপেক্ষা প্রদর্শন রাজ্যটিকে অনেক দিন বাঁচিয়ে রেখেছিল।
মহারাজা বিশ্বসিংহ এবং নবগঠিত কামতা-কোচ বিহার রাজ্যের অভিজাতগণ প্রতিবেশী ভূ-খন্ডের ব্রাহ্মণদের আমন্ত্রণ করেন। কিন্তু শুধু ব্রাহ্মণদের ব্যাপক উপস্থিতিই মানুষের মনোভাবের পরিবর্তন ঘটাতে পারে নি। রাজসম্মান বৃদ্ধির জন্য তত্ত্ব প্রতিষ্ঠায় ব্রাহ্মণদের নিয়োজিত করা হয়েছিল। তাঁরা উপলব্ধি করেন যে, রাজ্যের জনগণের সঙ্গে শিবের সম্পর্ক অত্যন্ত গভীর এবং পুরানো। শিবকে এখানে ভূমির উর্বরতা এবং কৃষির সঙ্গে সম্পৃক্ত মনে করা হয়। তারা তাই একটি তত্ত্ব চালু করে। তত্ত্বটি হলো যদিও হরিদাস নামক একজন নশ্বর মানুষ বিশ্বসিংহের পিতা ছিলেন, তথাপি তিনি প্রকৃতপক্ষে স্বয়ং মহাদেবের ঔরসে হরিদাসের প্রথম স্ত্রী হীরার গর্ভে জন্মগ্রহণ করেন। কোচ বিহারের সরকারি দলিল পত্রে এর স্বীকৃতি পাওয়া যায়। এগুলির মধ্যে রাজোপাখ্যান, দরং রাজবংশাবলি, রামচরণ ঠাকুরের শংকরচরিত এবং আকবরনামা উল্লেখযোগ্য। তত্ত্বটি কামতা কোচ বিহারে ঈশ্বর প্রদত্ত রাজক্ষমতার ইঙ্গিত বহন করে। রাজ্যের শাসকদের ‘নারায়ণ’ উপাধি ধারণ থেকে রাজ্যের মুদ্রা ’নারায়ণীমুদ্রা’ নামে পরিচিত ছিল। এ মুদ্রাগুলি ’শিবতঙ্কা’ নামেও অভিহিত হতো।
এভাবে কামতা-কোচ বিহার রাজ্য শিবের ভূ-খন্ডে পরিণত হয়েছিল। এমনকি ব্রহ্মপুত্র উপত্যকা এবং কামতা-কোচ বিহার রাজ্যে শ্রেণিহীন এবং বর্ণহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে শংকরদেবের নব বৈষ্ণববাদ প্রচারও সাধারণ মানুষের হূদয়ে রেখাপাত করতে পারে নি। কামরূপের বিক্রমাদিত্য নামে পরিচিত শক্তিশালী শাসক নরনারায়ণ এবং লক্ষ্মীনারায়ণ, বীরনারায়ণ, প্রাণনারায়ণ প্রমুখ শংকর দেবের নববৈষ্ণববাদ গ্রহণ করলেও এ ধর্মমত প্রজা সাধারণের মনে তেমন রেখাপাত করতে পারে নি। প্রজাকুলের মনোভাবের প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর জন্য রাজাগণ শিব ও শক্তি মন্দির প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। ফলে কামতা-কোচ বিহারে শেষ পর্যন্ত নব বৈষ্ণববাদের প্রভাব হ্রাস পায়।
অনুরূপভাবে অ্যাংলো-কোচ চুক্তি (১৭৭৩) সম্পাদনের পর ব্রাহ্মধর্ম এ রাজ্যে প্রবেশ করেছিল। এটি সম্ভব হয়েছিল ব্রাহ্মধর্ম প্রচারক কেশবচন্দ্র সেন-এর কন্যা সুনীতি দেবীর সঙ্গে নৃপেন্দ্র নারায়ণের বিবাহের মাধ্যমে। তবে ব্রাহ্মধর্ম কুচবিহারে কোনো শেকড় গাড়তে পারে নি। সাবিত্রীদেবীর কুমার গজেন্দ্রনারায়ণ-এ কুচবিহারে ব্রাহ্মধর্মের পতনের বিশদ বিবরণ পাওয়া যায়।
কুচবিহার নগরী ছিল কামতা-কোচ বিহারের রাজধানী। মুগল সেনাপতি মীরজুমলা স্বল্পকালের জন্য এটি দখল করেছিলেন এবং এর নাম দিয়েছিলেন আলমগীর নগর। নগরীর ইমারত ‘ভিক্টর জুবিলি প্যালেস’ মহারাজা নৃপেন্দ্রনারায়ণের শাসনকালে ১৮৮৭ সালে লন্ডনের বাকিংহাম প্রাসাদের আদলে নির্মাণ করা হয়। প্রাসাদটি শুধু রাজকীয় আবাসিক ভবনই নয়, একটি রাজ্যের অতীত ইতিহাসের সংস্কৃতির প্রতীকও বটে। [পি.কে. ভট্টাচার্য]
গ্রন্থপঞ্জি BN Mukherjee and PK Bhattacharyya (ed), Kamta Kock Behar in Historical Perspective, Darjeeling, 2000; Amanatulla Ahmed, Koch Beharer Itihas (Bangla), Cooch Behar, 1936; NG Rhodes and Bose, The Coinage of Cooch Behar, Calcutta, 1999.