আকবরনামা

আকবরনামা  আবুল ফজল আল্লামী বিরচিত ঐতিহাসিক ঘটনাপঞ্জি সম্বলিত ফার্সি গ্রন্থ। ভারত উপমহাদেশে ইতিহাস সম্পর্কিত রচনার সামগ্রিক প্রেক্ষাপটে আকবরনামা সর্বোত্তম বলে গণ্য। আবুল ফজল ছিলেন সম্রাট আকবর এর (১৫৫৬-১৬০৫) দরবারের ইতিহাস লেখক। আকবরনামা তিন খন্ডে বিভক্ত। প্রথম খন্ডে রয়েছে তিমুর বংশের ইতিহাস, বাবুর ও হুমায়ুনের রাজত্বকাল এবং দিল্লির শূর বংশের সুলতানদের বিবরণ; দ্বিতীয় খন্ডে আকবরের রাজত্বের ছেচল্লিশতম বছর পর্যন্ত ঘটনাবলির বিস্তৃত বিবরণ; এবং তৃতীয় খন্ডে আকবরের সাম্রাজ্যে প্রচলিত বিধিবিধান ও সংশ্লিষ্ট বিষয়াবলি বর্ণিত আছে। এ শেষ খন্ডের নাম আইন-ই-আকবরী

আকবরের রাজত্বকালে বাংলায় মুগল অভিযানের ইতিহাস পুননির্মানের জন্য আকবরনামা প্রধান আকর গ্রন্থ। গ্রন্থকার আবুল ফজল কখনও বাংলা মুলুকে আসেন নি, তবে রাজ-ঐতিহাসিক হওয়ার সুবাদে বাংলা বিষয়ক খবরাদি সংগ্রহে তাঁর অনেক সুযোগ-সুবিধা ছিল। বাংলাকে পদানত করার জন্য আকবরের বিভিন্ন প্রচেষ্টার বর্ণনা, এবং বাংলা জয়ের জন্য প্রেরিত মুগল সেনাপতিদের কার্যক্রম, আবার তাদের প্রচেষ্টা প্রতিহত করার জন্য বাংলার ভুঁইয়া ও রাজন্যবর্গের প্রতিরোধ প্রভৃতির সুন্দর বিবরণ আকবরনামায় সন্নিবেশিত আছে। তদুপরি বাংলায় মুগল সামরিক কর্মকর্তাদের বিদ্রোহের বিবরণও এখানে পাওয়া যায়।

বাংলার ঘটনাবলি বর্ণনায় আবুল ফজল এক বিশেষ রীতি অনুসরণ করেন, যেমন শুরুতে ‘ঘটনাবলির একটি’, ‘বাংলা থেকে প্রাপ্ত খবর,’ ‘বাংলা থেকে আসা শুভ-সংবাদ’ ইত্যাদি। এর দ্বারা প্রতীয়মান হয় যে, তিনি বিভিন্ন উৎস থেকে পাওয়া তথ্যাদির উপর ভিত্তি করে তাঁর বিবরণ লিপিবদ্ধ করেন। সুবাদার, সেনাপ্রধান ও অন্যান্য রাজকর্মচারীরা এ সকল বিবরণ পাঠাতেন। আকবরের সময়ে প্রতি প্রদেশে  ওয়াকিয়ানবিস নামে একজন বার্তা প্রেরক নিয়োজিত ছিলেন। গুরুত্বপূর্ণ খবরাদি রাজধানীতে পাঠানো ছিল তার দায়িত্ব। এসব সংগৃহীত তথ্য আকবরনামার মূল উৎস রূপে ব্যবহূত হয়েছে।

আবুল ফজল নিজে সম্রাটের বন্ধু ছিলেন বিধায় আকবরের বিভিন্ন বিজয় ও কৃতিত্বের বর্ণনা দিতে গিয়ে তিনি পক্ষপাতদুষ্ট হয়ে পড়েন। তাঁর চোখে আকবর একজন ‘খেদিব’ ছিলেন এবং আকবরের সকল সাফল্য ছিল ‘সৌভাগ্যপ্রসূত’।

গ্রন্থকার নিজে কখনও বাংলায় আসেন নি এবং বাংলার ভৌগোলিক বিষয়াদি সম্পর্কে তাঁর কোনো ব্যক্তিগত পরিচিতি ছিল না। তাই মাঝে মধ্যে বিভিন্ন স্থান নির্দিষ্টকরণে আবুল ফজল বিভ্রান্তির শিকার হয়েছেন। বাংলায় মুগল যুদ্ধবিগ্রহের বিবরণ দিতে গিয়ে তিনি মুগল কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সাফল্য ও ব্যর্থতার কারণ এবং তাদের মধ্যকার ষড়যন্ত্র ও সংঘাতের বর্ণনা দিতে ভুলেন নি। তাছাড়া মুগল বিজয়ের প্রাক্কালে বাংলার রাজনৈতিক পরিস্থিতি, এবং মুগল আক্রমন প্রতিহতকারী ভুঁইয়া ও জমিদারদের পরিচয় জানার জন্য আকবরনামা এক মূল্যবান উৎস-গ্রন্থ। এ গ্রন্থে বাংলার ঈসা খান, কেদার রায়, খাজা উসমান প্রমুখ ভুঁইয়ার প্রাথমিক জীবন ও উত্থান বিষয়ে জানা যায়। এ সময়কার কালক্রম নির্দেশনায়ও আকবরনামা  সর্বাধিক নির্ভরযোগ্য উৎস।

দাক্ষিণাত্য থেকে ফেরার পথে যুবরাজ সেলিমের প্ররোচনায় বীর সিং বুন্দেলা ১৬০২ খ্রিস্টাব্দে আবুল ফজলকে হত্যা করে। অতএব ওই বছরেই আবুল ফজলের বর্ণনা শেষ হয়। পরবর্তী সময়ে ইনায়েতউল্ল্যা আকবরনামার বিবরণ আকবরের মৃত্যুর বছর ১৬০৫ পর্যন্ত সম্প্রসারিত করেন।  [আবদুল করিম]

গ্রন্থপঞ্জি Abul Fazl, Akbarnamah, Bibliotheca Indica, Calcutta; H Beveridge (tr) Akbarnamah, III, Calcutta Reprint 1973; A Karim, History of Bengal, Mughal Period, I, Rajshahi, 1992.