এগারসিন্ধুর
এগারসিন্ধুর একটি ঐতিহ্যমন্ডিত গ্রাম। গ্রামটি কিশোরগঞ্জ জেলায়, ব্রহ্মপুত্র নদের পূর্ব তীরে এবং পাকুন্দিয়া উপজেলা সদর থেকে সাড়ে নয় মাইল পশ্চিমে অবস্থিত। আবুল ফজলের আকবরনামা গ্রন্থে ’এগারসিন্ধুর’ নামের উল্লেখ পাওয়া যায়। স্থানটির নামকরণ নিয়ে মতভেদ আছে।
এগারসিন্ধুরের প্রাচীন ইতিহাস কখন থেকে শুরু হয়েছে তা নিশ্চিত করে বলা যায় না। ১৯৩৩ সালে খননের ফলে এখানে কয়েকটি ছাপাঙ্কিত রৌপ্য মুদ্রা এবং সম্প্রতি এর অনতিদূরে লালমাটির উচ্চভূমিতে ব্রহ্মপুত্র নদের একটি গভীর খাদের পাশে আকরিক লোহার তৈরি হাত কুঠার, বর্শা ফলক ও ধনুকে ব্যবহার উপযোগী পাথরের
গুটি. আবিষ্কৃত হয়েছে। গবেষকগণ মুদ্রাগুলিকে ছয় খ্রিস্টপূর্বাব্দের এবং প্রত্নসম্পদগুলিকে দশ খ্রিস্টপূর্বাব্দের বলে মনে করেন। তাই ঐতিহাসিকগণ ধারণা করেন যে, লোকালয় হিসেবে এগারসিন্ধুর অবস্থান কমপক্ষে এক হাজার বছরের প্রাচীন। এ অঞ্চলের আদি বাসিন্দা হিসেবে কোচ ও হাজং জনগোষ্ঠীর পরিচয় পাওয়া যায়। ছয় খ্রিস্টপূর্বাব্দের মুদ্রা থেকে প্রতীয়মান হয় যে, এগারসিন্ধুর ব্যবসা বাণিজ্যের কেন্দ্র হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেছিল। মৌর্য যুগে এ এলাকার মানুষ সর্বপ্রথম উত্তর ভারতের সঙ্গে সাংস্কৃতিক সম্পর্ক স্থাপন করতে শুরু করে। এ যুগেই এ স্থানের লোকদের সঙ্গে পুন্ড্রনগর ও মগধের ব্যবসায়ীদের বাণিজ্যিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে। গুপ্ত যুগে ৩৮০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত এগারসিন্ধুর ডবাক রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। এরপর সম্ভবত এ অঞ্চল কামরূপ রাজ্যের অধীনে চলে যায়। আট শতকের আরব ভৌগোলিকগণের বিবরণে দেখা যায় যে, দুটি নদীর সঙ্গমস্থলে অবস্থিত একটি বাণিজ্য বন্দর থেকে মুসলমান বণিকরা সূক্ষ্ম মসলিন বস্ত্র ও অন্যান্য সামগ্রী পারস্য ও রোমে নিয়ে যেত। ঐতিহাসিকদের অনুমান, দুটি নদীর সঙ্গমস্থল বলতে প্রাচীন বাংলার বাণিজ্য বন্দর এগারসিন্ধুরকেই বোঝানো হয়েছে।
দশ শতকের প্রথম দিকে কামরূপ রাজাদের দুর্বলতার সুযোগে কামরূপের নিম্নাঞ্চলে বহু সামন্তরাজ্যের সৃষ্টি হয়। এ সময় হাজরাদি অঞ্চলের সামন্তরাজা আজহাবা কোচ সামন্তরাজা বটংকে পরাজিত করে এগারসিন্ধুর অধিকার করেন। কিন্তু কয়েক বছর পরেই আজহাবাকে পরাজিত করে বেবুধ নামে একজন স্বাধীন রাজা এগারসিন্ধুরে ক্ষমতাসীন হন। এ বেবুধের সময় থেকেই এগারসিন্ধুরের উত্থান শুরু হয়। রাজা বেবুধ এগারসিন্ধুর অঞ্চলে দুর্গ, রাজপ্রাসাদ, মন্দির ইত্যাদি নির্মাণ করেন এবং একটি বিরাট দিঘি ও পরিখা খনন করেন। দশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে এগারসিন্ধুর চন্দ্রবংশীর রাজা শ্রীচন্দ্র এর শাসনাধীনে আসে। সম্ভবত রামপাল এর রাজত্বকালে এগারসিন্ধুর অঞ্চলে বর্মণরাজাদের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয় এবং আনুমানিক বারো শতকের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত তাদের শাসন অব্যাহত থাকে। এরপর এগারসিন্ধুর সম্ভবত সেন শাসনাধীনে চলে আসে এবং সেন শাসনের অবসানের পর কামরূপ রাজার রাজ্যভুক্ত হয়। চক্রপানি দত্তের লেখা থেকে জানা যায় যে, চৌদ্দ শতকের প্রথম দিকে গৌড়ের সুলতান শামসুদ্দীন ফিরুজ শাহ এগারসিন্ধুরসহ বৃহত্তর ময়মনসিংহ ও সিলেট অঞ্চল অধিকার করেন। ১৩৩৮ খ্রিস্টাব্দে এগারসিন্ধুরসহ বাংলার এ অঞ্চলের শাসন ক্ষমতা গ্রহণ করেন সোনারগাঁও এর স্বাধীন সুলতান ফখরউদ্দীন মুবারক শাহ। এখানে তখন একটি দুর্ভেদ্য দুর্গও ছিল। সম্ভবত ফখরউদ্দীন মুবারক শাহ তার ভাগ্য বিপর্যয়ের সময়ে এগারসিন্ধুরে অবস্থান নিয়েছিলেন এবং এখান থেকেই আবার সোনারগাঁয়ের সিংহাসন অধিকার করেন। আদি ইলিয়াস শাহী আমলে এগারসিন্ধুর বাংলার সুলতানের অধীন ছিল। ১৩৫৭ খ্রিস্টাব্দে সুলতান সিকান্দর শাহ এগারসিন্ধুর দুর্গ এর সংস্কার করেছিলেন। তাঁর সময়ে এগারসিন্ধুর একটি গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য কেন্দ্র হিসেবেও খ্যাতিলাভ করে।
পনেরো শতকের দ্বিতীয় দশক হতে নবম দশক পর্যন্ত (১৪১৫-১৪৮৬ খ্রি.) এগারসিন্ধুর কাদের নিয়ন্ত্রণে ছিল তা যথার্থভাবে বলা যায়। তবে মনে হয় যে, এ সময়ে এখানে বারো ভূঁইয়াদের প্রাধান্যই বিদ্যমান ছিল। হাবশী সুলতানদের আমলে (১৪৮৬/ ৮৭-১৪৯৩ খ্রি.) এগারসিন্ধুর পুনরায় মুসলমান র্তৃত্বে আসে বলে জানা যায়। হোসেন শাহী বংশের গিয়াসউদ্দীন মাহমুদ শাহ এর সময় পর্তুগিজ বণিকরা এগারসিন্ধুরে বাণিজ্যকুঠিসহ শুল্ক ঘাটি নির্মাণ করে। গিয়াসউদ্দীন মাহমুদ শাহের পর এগারসিন্ধুর শেরশাহ এর শাসনাধীনে চলে আসে। কিন্তু তাঁর মৃত্যুর পর এগারসিন্ধুরের শাসনকর্তৃত্ব চলে যায় স্থানীয় জমিদারদের হাতে। ১৫৭৭ খ্রিস্টাব্দে ঈসা খান মসনদ-ই-আলা এগারসিন্ধুরকে রাজনৈতিক ও গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক কেন্দ্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেন। ঈসা খানের সঙ্গে মুগলদের যুদ্ধের প্রাথমিক পর্যায়ে মুগল সেনানায়ক মুহম্মদ কুলি ও শাহ বরদী এগারসিন্ধুর দখল করে নিয়েছিলেন। কিন্তু ঈসা খানের সৈন্যরা পাল্টা আক্রমণ চালিয়ে মুগল বাহিনীকে ভীষণভাবে পর্যুদস্থ করে এগারসিন্ধুর পুনর্দখল করে নেয় এবং এরপর থেকে ঈসা খান এখানেই অবস্থান করতে থাকেন। ১৫৯৭ খ্রিস্টাব্দে এগারসিন্ধুর দুর্গদ্বারে ঈসা খানের সঙ্গে যুদ্ধে মুগল সেনাপতি মানসিংহের পুত্র দুর্জনসিংহ নিহত হন। মানসিংহের সঙ্গেও ঈসা খানের যুদ্ধ হয় এবং অবশেষে উভয়পক্ষে সন্ধি সাক্ষরিত হয়। ঈসা খানের মৃত্যুর পর এগারসিন্ধুর মুসা খান এর কর্তৃত্বাধীন হয়। এ সময় পর্যন্ত এগারসিন্ধুর একটি দুর্গ ও সমৃদ্ধ বাণিজ্যকেন্দ্র ছিল। মুগল সম্রাট জাহাঙ্গীর এর আমলে উসমান খান লোহানীর নিয়ন্ত্রণে ছিল এগারসিন্ধুর।
বাহারিস্তান-ই-গায়েবী অনুসারে মুগলদের হাতে এগারসিন্ধুরের পতন ঘটে ১৬০৮ খ্রিস্টাব্দের শেষের দিকে। এরপর এগারসিন্ধুরকে কেন্দ্র করে মুগলগণ উসমান খানের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করে। সম্রাট শাহজাহান এর সময় ১৬৩৮ খ্রিস্টাব্দে আসাম রাজ ৫০০ নৌযানসহ এগারসিন্ধুর আক্রমণ করেন। বাংলার সুবাহদার আসাম রাজকে প্রতিহত করার জন্য অগ্রসর হলে উভয় পক্ষে প্রচন্ড যুদ্ধ হয় এবং যুদ্ধের ফলে এগারসিন্ধুর প্রচন্ডভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এরপর থেকে অঞ্চলটি ধীরে ধীরে ঐতিহ্য হারাতে থাকে এবং এক সময় শুধু বাণিজ্য কেন্দ্র হিসেবেই এটি টিকে থাকে। [এ.বি.এম. শামসুদ্দীন আহমদ]