গম: সংশোধিত সংস্করণের মধ্যে পার্থক্য
সম্পাদনা সারাংশ নেই |
সম্পাদনা সারাংশ নেই |
||
(একই ব্যবহারকারী দ্বারা সম্পাদিত একটি মধ্যবর্তী সংশোধন দেখানো হচ্ছে না) | |||
২ নং লাইন: | ২ নং লাইন: | ||
'''গম''' (Wheat) Graminae গোত্রের Triticum গণভুক্ত দানাশস্য, বিশেষত ''T. aestivum'' প্রজাতি। গম বাংলাদেশসহ বিশ্বের অন্যতম প্রধান খাদ্যশস্য। [[বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট|বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট]] গমের প্রায় ২১টি ভ্যারাইটি উদ্ভাবন করেছে। এর মধ্যে ‘কাঞ্চন’ গমক্ষেতের ৮০ ভাগের বেশি এলাকায় দেখা যায়। | '''গম''' (Wheat) Graminae গোত্রের Triticum গণভুক্ত দানাশস্য, বিশেষত ''T. aestivum'' প্রজাতি। গম বাংলাদেশসহ বিশ্বের অন্যতম প্রধান খাদ্যশস্য। [[বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট|বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট]] গমের প্রায় ২১টি ভ্যারাইটি উদ্ভাবন করেছে। এর মধ্যে ‘কাঞ্চন’ গমক্ষেতের ৮০ ভাগের বেশি এলাকায় দেখা যায়। | ||
[[Image:Wheat.jpg|thumb|400px|right|গম ক্ষেত]] | |||
বাংলাদেশের কৃষকরা তাদের নিবিড় ধানভিত্তিক চাষপদ্ধতির সঙ্গে খাপ-খাইয়ে গম ফলাচ্ছে। গমক্ষেতের প্রায় ৮০ ভাগই তিন-ফসলি পর্যায়ে লাগানো ৬০ ভাগ আউশ-রোপা আমন-গম এবং ২০ ভাগ পাট-রোপা আমন-গম। একটি মূল্যায়ন থেকে দেখা যায় যে প্রায় ২০ লক্ষ কৃষক গমচাষ থেকে লাভবান হয়েছে। গম মরসুমে ৬ লক্ষ লোকের ১২০ দিনের কাজ জুটেছে এবং গত বিশ বছরে (১৯৭৫-১৯৯৫/৯৬) ৩০০ কোটি ৪০ লক্ষ ডলার মূল্যের প্রায় ২ কোটি মে টন গম উৎপন্ন হয়েছে। গম উৎপাদন কর্মসূচি না থাকলে দেশে বছরে আরও ৯ লক্ষ মে টন খাদ্য আমদানি করতে হতো। ১৯৩৬ সালে বঙ্গীয় সরকার প্রথম গম নিয়ে গবেষণা শুরু করলেও বাণিজ্যিক ফসল হিসেবে এ অঞ্চলে গমচাষ তেমন গুরুত্ব পায় নি। | বাংলাদেশের কৃষকরা তাদের নিবিড় ধানভিত্তিক চাষপদ্ধতির সঙ্গে খাপ-খাইয়ে গম ফলাচ্ছে। গমক্ষেতের প্রায় ৮০ ভাগই তিন-ফসলি পর্যায়ে লাগানো ৬০ ভাগ আউশ-রোপা আমন-গম এবং ২০ ভাগ পাট-রোপা আমন-গম। একটি মূল্যায়ন থেকে দেখা যায় যে প্রায় ২০ লক্ষ কৃষক গমচাষ থেকে লাভবান হয়েছে। গম মরসুমে ৬ লক্ষ লোকের ১২০ দিনের কাজ জুটেছে এবং গত বিশ বছরে (১৯৭৫-১৯৯৫/৯৬) ৩০০ কোটি ৪০ লক্ষ ডলার মূল্যের প্রায় ২ কোটি মে টন গম উৎপন্ন হয়েছে। গম উৎপাদন কর্মসূচি না থাকলে দেশে বছরে আরও ৯ লক্ষ মে টন খাদ্য আমদানি করতে হতো। ১৯৩৬ সালে বঙ্গীয় সরকার প্রথম গম নিয়ে গবেষণা শুরু করলেও বাণিজ্যিক ফসল হিসেবে এ অঞ্চলে গমচাষ তেমন গুরুত্ব পায় নি। | ||
১৯৪৩ সালের মন্বন্তর পরবর্তী চরম খাদ্যাভাবের সময় ‘অধিক ফসল ফলাও’ আন্দোলন শুরু হলে গমচাষ গুরুত্ব লাভ করে। ১৯৬৫ সালে পশ্চিম পাকিস্তানের তান্দেজান কৃষি গবেষণা স্টেশনে মেক্সিকো থেকে Penjamo 62 ও Sonora 64 এ দু জাতের গমের সামান্য পরিমাণ বীজ | ১৯৪৩ সালের মন্বন্তর পরবর্তী চরম খাদ্যাভাবের সময় ‘অধিক ফসল ফলাও’ আন্দোলন শুরু হলে গমচাষ গুরুত্ব লাভ করে। ১৯৬৫ সালে পশ্চিম পাকিস্তানের তান্দেজান কৃষি গবেষণা স্টেশনে মেক্সিকো থেকে Penjamo 62 ও Sonora 64 এ দু জাতের গমের সামান্য পরিমাণ বীজ পৌঁছলে সেখানে গমের আধুনিক ভ্যারাইটির গবেষণার সূচনা ঘটে। আন্তর্জাতিক ভূট্টা ও গম উন্নয়ন কেন্দ্রের গম কর্মসূচির তৎকালীন পরিচালক নরম্যান ই. বোরলগ (Norman E Borlaug) ১৯৬৫ ও ১৯৬৮ সালে ঢাকায় তাঁর এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করেন যে প্রধান ফসলগুলির অসুবিধা না ঘটিয়ে বাংলাদেশে ১৫ লক্ষ হেক্টর জমি গমের জন্য বরাদ্দ করা সম্ভব। বোরলগের আগমন থেকেই বাংলাদেশে গম গবেষণা কর্মসূচির সূত্রপাত। | ||
১৯৭৫-১৯৭৬ সালের আগে সামান্য পরিমাণ গম বিক্ষিপ্তভাবে উৎপন্ন হতো এবং ফসলটি বাংলাদেশের মানুষের কাছে প্রায় অচেনা ছিল। বাংলাদেশে বর্তমানে গম দানাশস্য হিসেবে ধানের পর দ্বিতীয় স্থানে পৌঁছেছে; মোট ক্ষেতজমির ৪ ভাগ ও রবি ফসলের জমির ১১ ভাগ দখল করে আছে। দানাশস্যের মোট উৎপন্নের ৭ শতাংশ এখন গম। বর্তমানে গমচাষাধীন জমি ৭,৪১,৮৩০ হেক্টর এবং বার্ষিক উৎপাদন প্রায় ১৬,০৫,৭৬০ মে টন। দেশে গম বীজের বার্ষিক চাহিদা প্রায় ১ লক্ষ মে টন; সরকারি খাত যোগায় প্রায় ২০,০০০ মে টন আর বাকিটা দেশের কৃষকরা। | ১৯৭৫-১৯৭৬ সালের আগে সামান্য পরিমাণ গম বিক্ষিপ্তভাবে উৎপন্ন হতো এবং ফসলটি বাংলাদেশের মানুষের কাছে প্রায় অচেনা ছিল। বাংলাদেশে বর্তমানে গম দানাশস্য হিসেবে ধানের পর দ্বিতীয় স্থানে পৌঁছেছে; মোট ক্ষেতজমির ৪ ভাগ ও রবি ফসলের জমির ১১ ভাগ দখল করে আছে। দানাশস্যের মোট উৎপন্নের ৭ শতাংশ এখন গম। বর্তমানে গমচাষাধীন জমি ৭,৪১,৮৩০ হেক্টর এবং বার্ষিক উৎপাদন প্রায় ১৬,০৫,৭৬০ মে টন। দেশে গম বীজের বার্ষিক চাহিদা প্রায় ১ লক্ষ মে টন; সরকারি খাত যোগায় প্রায় ২০,০০০ মে টন আর বাকিটা দেশের কৃষকরা। | ||
'''''রোগবালাই''''' পাতাফড়িং-এর কয়েকটি প্রজাতিসহ অনেক ধরনের কীটপতঙ্গ গম ফসলের ক্ষতি করে। গুদামে অরক্ষিত থাকলে ''Sitophilus oryzae'', ''S. zeamais'' ও ''Rhizopertha dominica'''' যথেষ্ট ক্ষতি ঘটায়। গমের অধিকাংশ রোগই ব্যাকটেরিয়া, ছত্রাক ও ভাইরাসঘটিত। গম ফসলে ''Puccinia graminis'' ছত্রাকের আক্রমণে কান্ডের মরিচা রোগ বা কালো মরিচা রোগ হয়। জীবাণুটি ফসলের পরিপক্ব পর্যায়ে এ রোগ সৃষ্টি করে। প্রাথমিক লক্ষণ হিসেবে গমের পাতা, পত্রখোল ও কান্ডে বিচিত্র রঙের ফুষ্কুড়ি দেখা দেয়। সংক্রমিত স্থান থেকে লালচে রঙের আয়ত-ডিম্বাকার ফুস্কুড়ি উৎপন্ন হয়। খুব শীঘ্রই এসব ফুস্কুড়ি ফেটে যাওয়ায় বাদামি রঙের দলা আকারে দৃশ্যমান হয়। লাইম সালফার, হাইড্রোফোবিক কলয়ডীয় সালফার, নিকেল সালফেট ও ডাই-থায়োকার্বামেট প্রয়োগ করে গমের মরিচা রোগ দমন করা যায়। জিঙ্ক সালফেট নামক ছত্রাকনাশকের সাথে জাইনেব নামক ছত্রাকনাশক মিশ্রিত করে প্রয়োগ করা হলে কালো ও বাদামি মরিচা রোগ কার্যকরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যায়। ''Puccinia rocondite'' নামক ছত্রাক সৃষ্ট রোগের লক্ষণ হিসেবে ক্ষুদ্র ও বৈশিষ্ট্যপূর্ণ কমলা রঙের গোলাকার সোরি দেখা দেয়। | |||
বাংলাদেশে গম চাষাধীন এলাকায় ''Ustilago tritici'' ছত্রাক সৃষ্ট আলগা ঝুল রোগ বেশি হয়। ''Helminthosporium sativum'' ছত্রাকের কারণে পাতায় দাগ রোগ হয়। এ রোগ বাংলাদেশসহ বিশ্বজুড়ে বিস্তৃত। গম গাছের প্রায় সব পর্যায়েই এ রোগের সংক্রমণ দেখা যেতে পারে। | বাংলাদেশে গম চাষাধীন এলাকায় ''Ustilago tritici'' ছত্রাক সৃষ্ট আলগা ঝুল রোগ বেশি হয়। ''Helminthosporium sativum'' ছত্রাকের কারণে পাতায় দাগ রোগ হয়। এ রোগ বাংলাদেশসহ বিশ্বজুড়ে বিস্তৃত। গম গাছের প্রায় সব পর্যায়েই এ রোগের সংক্রমণ দেখা যেতে পারে। | ||
১৫ নং লাইন: | ১৫ নং লাইন: | ||
টুন্ডু বা হলুদ কর্ণপচা রোগ ছত্রাক, একপ্রকার নিমাটোড ও ''Corynebacterium tritici'' নামক ব্যাকটেরিয়ার সম্মিলিত প্রভাবে হয়ে থাকে। এ রোগের বৈশিষ্ট্যমূলক লক্ষণ হলো গম গাছের কান্ড ও শীষে হলুদ রঙের পিচ্ছিল পদার্থ দেখা দেয়। পিচ্ছিল পদার্থগুলি শুকিয়ে গেলে আঠালো হলুদ রঙের আস্তরে পরিণত হয়। শীর্ষস্থ গম দানায় কৃমির আক্রমণে গল দেখা দেয়। [গোলাম কবির এবং আবুল খায়ের] | টুন্ডু বা হলুদ কর্ণপচা রোগ ছত্রাক, একপ্রকার নিমাটোড ও ''Corynebacterium tritici'' নামক ব্যাকটেরিয়ার সম্মিলিত প্রভাবে হয়ে থাকে। এ রোগের বৈশিষ্ট্যমূলক লক্ষণ হলো গম গাছের কান্ড ও শীষে হলুদ রঙের পিচ্ছিল পদার্থ দেখা দেয়। পিচ্ছিল পদার্থগুলি শুকিয়ে গেলে আঠালো হলুদ রঙের আস্তরে পরিণত হয়। শীর্ষস্থ গম দানায় কৃমির আক্রমণে গল দেখা দেয়। [গোলাম কবির এবং আবুল খায়ের] | ||
ক্ষতিকর | ''ক্ষতিকর কীটপতঙ্গ'' মাঠে গম ফসলের সব পর্যায়েই বিভিন্ন ধরনের কীটপতঙ্গ দ্বারা গম গাছ আক্রান্ত হয়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েক প্রজাতির পাতাফড়িং (Leafhoppers), উইপোকা, ''Microtermes anandi'' গমের জাবপোকা, ''Rhopalosiphum rufiabdominalis''। পাতাফড়িং এবং জাপপোকা পাতা থেকে রস আহরণের কারণে গম গাছের কচি পাতা ক্রমে শুকিয়ে হলুদ রঙ ধারণ করে এবং নিয়ন্ত্রণ না করলে ফসলের অনেক ক্ষতি হয়। গুদামজাত গম কীটপতঙ্গ দ্বারা আক্রান্ত হয়। সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করে ''Sitophilus oryzae, S. zeamais এবং Rhizopertha dominica''। সঠিকভাবে গুদামজাত গম সংরক্ষণ না করলে এসব মুখ্য ক্ষতিকর পোকা শস্যের শতকরা ৮০ ভাগ পর্যন্ত ক্ষতি করতে পারে। প্রাপ্ত বয়স্ক পোকা এবং লার্ভা এমনভাবে শস্যদানা খায় যে কেবল উপরের খোসাই অবশিষ্ট থাকে। এ প্রধান ক্ষতিকর পোকাগুলি ছাড়াও আরো কয়েকটি পোকা গম, ময়দা, আটা এবং অন্যান্য গমজাত দ্রব্যের অনেক সময় ব্যাপক ক্ষতি করে। এদের মধ্যে ''Tribolium confusum, T. castaneum, Latheticus oryzae, Alphitobius diaperium, Sitotroga cerealella এবং Plodia interpunctella'' উল্লেখযোগ্য। আটা-ময়দা আক্রমণকারী একটি মাইট প্রজাতি Acarus siro দেশের সর্বত্রই বিস্তৃত এবং গম গমজাত দ্রব্যে আপত্তিকর গন্ধ ছড়ায়। [এস.এম হুমায়ুন কবির] | ||
''আরও দেখুন'' [[গম গবেষণা কেন্দ্র|গম গবেষণা কেন্দ্র]]; [[দানাশস্য|দানাশস্য]],[[সবুজ বিপ্লব|সবুজ বিপ্লব]]। | ''আরও দেখুন'' [[গম গবেষণা কেন্দ্র|গম গবেষণা কেন্দ্র]]; [[দানাশস্য|দানাশস্য]],[[সবুজ বিপ্লব|সবুজ বিপ্লব]]। | ||
[[en:Wheat]] | [[en:Wheat]] |
০৭:৪৭, ১২ ডিসেম্বর ২০২৪ তারিখে সম্পাদিত সর্বশেষ সংস্করণ
গম (Wheat) Graminae গোত্রের Triticum গণভুক্ত দানাশস্য, বিশেষত T. aestivum প্রজাতি। গম বাংলাদেশসহ বিশ্বের অন্যতম প্রধান খাদ্যশস্য। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট গমের প্রায় ২১টি ভ্যারাইটি উদ্ভাবন করেছে। এর মধ্যে ‘কাঞ্চন’ গমক্ষেতের ৮০ ভাগের বেশি এলাকায় দেখা যায়।
বাংলাদেশের কৃষকরা তাদের নিবিড় ধানভিত্তিক চাষপদ্ধতির সঙ্গে খাপ-খাইয়ে গম ফলাচ্ছে। গমক্ষেতের প্রায় ৮০ ভাগই তিন-ফসলি পর্যায়ে লাগানো ৬০ ভাগ আউশ-রোপা আমন-গম এবং ২০ ভাগ পাট-রোপা আমন-গম। একটি মূল্যায়ন থেকে দেখা যায় যে প্রায় ২০ লক্ষ কৃষক গমচাষ থেকে লাভবান হয়েছে। গম মরসুমে ৬ লক্ষ লোকের ১২০ দিনের কাজ জুটেছে এবং গত বিশ বছরে (১৯৭৫-১৯৯৫/৯৬) ৩০০ কোটি ৪০ লক্ষ ডলার মূল্যের প্রায় ২ কোটি মে টন গম উৎপন্ন হয়েছে। গম উৎপাদন কর্মসূচি না থাকলে দেশে বছরে আরও ৯ লক্ষ মে টন খাদ্য আমদানি করতে হতো। ১৯৩৬ সালে বঙ্গীয় সরকার প্রথম গম নিয়ে গবেষণা শুরু করলেও বাণিজ্যিক ফসল হিসেবে এ অঞ্চলে গমচাষ তেমন গুরুত্ব পায় নি।
১৯৪৩ সালের মন্বন্তর পরবর্তী চরম খাদ্যাভাবের সময় ‘অধিক ফসল ফলাও’ আন্দোলন শুরু হলে গমচাষ গুরুত্ব লাভ করে। ১৯৬৫ সালে পশ্চিম পাকিস্তানের তান্দেজান কৃষি গবেষণা স্টেশনে মেক্সিকো থেকে Penjamo 62 ও Sonora 64 এ দু জাতের গমের সামান্য পরিমাণ বীজ পৌঁছলে সেখানে গমের আধুনিক ভ্যারাইটির গবেষণার সূচনা ঘটে। আন্তর্জাতিক ভূট্টা ও গম উন্নয়ন কেন্দ্রের গম কর্মসূচির তৎকালীন পরিচালক নরম্যান ই. বোরলগ (Norman E Borlaug) ১৯৬৫ ও ১৯৬৮ সালে ঢাকায় তাঁর এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করেন যে প্রধান ফসলগুলির অসুবিধা না ঘটিয়ে বাংলাদেশে ১৫ লক্ষ হেক্টর জমি গমের জন্য বরাদ্দ করা সম্ভব। বোরলগের আগমন থেকেই বাংলাদেশে গম গবেষণা কর্মসূচির সূত্রপাত।
১৯৭৫-১৯৭৬ সালের আগে সামান্য পরিমাণ গম বিক্ষিপ্তভাবে উৎপন্ন হতো এবং ফসলটি বাংলাদেশের মানুষের কাছে প্রায় অচেনা ছিল। বাংলাদেশে বর্তমানে গম দানাশস্য হিসেবে ধানের পর দ্বিতীয় স্থানে পৌঁছেছে; মোট ক্ষেতজমির ৪ ভাগ ও রবি ফসলের জমির ১১ ভাগ দখল করে আছে। দানাশস্যের মোট উৎপন্নের ৭ শতাংশ এখন গম। বর্তমানে গমচাষাধীন জমি ৭,৪১,৮৩০ হেক্টর এবং বার্ষিক উৎপাদন প্রায় ১৬,০৫,৭৬০ মে টন। দেশে গম বীজের বার্ষিক চাহিদা প্রায় ১ লক্ষ মে টন; সরকারি খাত যোগায় প্রায় ২০,০০০ মে টন আর বাকিটা দেশের কৃষকরা।
রোগবালাই পাতাফড়িং-এর কয়েকটি প্রজাতিসহ অনেক ধরনের কীটপতঙ্গ গম ফসলের ক্ষতি করে। গুদামে অরক্ষিত থাকলে Sitophilus oryzae, S. zeamais ও Rhizopertha dominica'' যথেষ্ট ক্ষতি ঘটায়। গমের অধিকাংশ রোগই ব্যাকটেরিয়া, ছত্রাক ও ভাইরাসঘটিত। গম ফসলে Puccinia graminis ছত্রাকের আক্রমণে কান্ডের মরিচা রোগ বা কালো মরিচা রোগ হয়। জীবাণুটি ফসলের পরিপক্ব পর্যায়ে এ রোগ সৃষ্টি করে। প্রাথমিক লক্ষণ হিসেবে গমের পাতা, পত্রখোল ও কান্ডে বিচিত্র রঙের ফুষ্কুড়ি দেখা দেয়। সংক্রমিত স্থান থেকে লালচে রঙের আয়ত-ডিম্বাকার ফুস্কুড়ি উৎপন্ন হয়। খুব শীঘ্রই এসব ফুস্কুড়ি ফেটে যাওয়ায় বাদামি রঙের দলা আকারে দৃশ্যমান হয়। লাইম সালফার, হাইড্রোফোবিক কলয়ডীয় সালফার, নিকেল সালফেট ও ডাই-থায়োকার্বামেট প্রয়োগ করে গমের মরিচা রোগ দমন করা যায়। জিঙ্ক সালফেট নামক ছত্রাকনাশকের সাথে জাইনেব নামক ছত্রাকনাশক মিশ্রিত করে প্রয়োগ করা হলে কালো ও বাদামি মরিচা রোগ কার্যকরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যায়। Puccinia rocondite নামক ছত্রাক সৃষ্ট রোগের লক্ষণ হিসেবে ক্ষুদ্র ও বৈশিষ্ট্যপূর্ণ কমলা রঙের গোলাকার সোরি দেখা দেয়।
বাংলাদেশে গম চাষাধীন এলাকায় Ustilago tritici ছত্রাক সৃষ্ট আলগা ঝুল রোগ বেশি হয়। Helminthosporium sativum ছত্রাকের কারণে পাতায় দাগ রোগ হয়। এ রোগ বাংলাদেশসহ বিশ্বজুড়ে বিস্তৃত। গম গাছের প্রায় সব পর্যায়েই এ রোগের সংক্রমণ দেখা যেতে পারে।
টুন্ডু বা হলুদ কর্ণপচা রোগ ছত্রাক, একপ্রকার নিমাটোড ও Corynebacterium tritici নামক ব্যাকটেরিয়ার সম্মিলিত প্রভাবে হয়ে থাকে। এ রোগের বৈশিষ্ট্যমূলক লক্ষণ হলো গম গাছের কান্ড ও শীষে হলুদ রঙের পিচ্ছিল পদার্থ দেখা দেয়। পিচ্ছিল পদার্থগুলি শুকিয়ে গেলে আঠালো হলুদ রঙের আস্তরে পরিণত হয়। শীর্ষস্থ গম দানায় কৃমির আক্রমণে গল দেখা দেয়। [গোলাম কবির এবং আবুল খায়ের]
ক্ষতিকর কীটপতঙ্গ মাঠে গম ফসলের সব পর্যায়েই বিভিন্ন ধরনের কীটপতঙ্গ দ্বারা গম গাছ আক্রান্ত হয়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েক প্রজাতির পাতাফড়িং (Leafhoppers), উইপোকা, Microtermes anandi গমের জাবপোকা, Rhopalosiphum rufiabdominalis। পাতাফড়িং এবং জাপপোকা পাতা থেকে রস আহরণের কারণে গম গাছের কচি পাতা ক্রমে শুকিয়ে হলুদ রঙ ধারণ করে এবং নিয়ন্ত্রণ না করলে ফসলের অনেক ক্ষতি হয়। গুদামজাত গম কীটপতঙ্গ দ্বারা আক্রান্ত হয়। সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করে Sitophilus oryzae, S. zeamais এবং Rhizopertha dominica। সঠিকভাবে গুদামজাত গম সংরক্ষণ না করলে এসব মুখ্য ক্ষতিকর পোকা শস্যের শতকরা ৮০ ভাগ পর্যন্ত ক্ষতি করতে পারে। প্রাপ্ত বয়স্ক পোকা এবং লার্ভা এমনভাবে শস্যদানা খায় যে কেবল উপরের খোসাই অবশিষ্ট থাকে। এ প্রধান ক্ষতিকর পোকাগুলি ছাড়াও আরো কয়েকটি পোকা গম, ময়দা, আটা এবং অন্যান্য গমজাত দ্রব্যের অনেক সময় ব্যাপক ক্ষতি করে। এদের মধ্যে Tribolium confusum, T. castaneum, Latheticus oryzae, Alphitobius diaperium, Sitotroga cerealella এবং Plodia interpunctella উল্লেখযোগ্য। আটা-ময়দা আক্রমণকারী একটি মাইট প্রজাতি Acarus siro দেশের সর্বত্রই বিস্তৃত এবং গম গমজাত দ্রব্যে আপত্তিকর গন্ধ ছড়ায়। [এস.এম হুমায়ুন কবির]
আরও দেখুন গম গবেষণা কেন্দ্র; দানাশস্য,সবুজ বিপ্লব।