হেস্টিংস, ওয়ারেন

হেস্টিংস, ওয়ারেন (১৭৩২-১৮১৮)  প্রথমে  ফোর্ট উইলিয়মএর গভর্নর (১৭৭২-১৭৭৪) এবং পরে গভর্নর জেনারেল (১৭৭৪-১৭৮৫)। ওয়ারেন হেস্টিংস ভারতে রাজনৈতিক প্রাধান্য স্থাপনের ব্যাপারে তাঁর পূর্বসূরিদের অনুসৃত দ্বিধাগ্রস্ত নীতি পরিহার করেন। তার রাজ্যবিস্তার নীতির প্রতিপক্ষ শক্তিসমূহের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণে তিনি কোন প্রকার শৈথিল্য প্রদর্শন না করে নব নব এলাকা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যভুক্ত করেন। বস্ত্তত ভারতে ব্রিটিশ আধিপত্য বিস্তারের কৃতিত্ব তাঁর। এতদসত্ত্বেও ব্রিটিশ পার্লামেন্ট তাঁর বিরুদ্ধে কতগুলি অভিযোগ উত্থাপন করে তাকে বিচার করার প্রয়াস পায়। এসকল অভিযোগের মধ্যে ছিল দূর্নীতি, অত্যাচার এবং অননুমোদিত যুদ্ধ ঘোষণা। ১৭৮৫ সালে তাঁকে দেশে ডেকে পাঠিয়ে পার্লামেন্টে তাঁর বিচার করা হয়, তবে তিনি শেষ পর্যন্ত নিষ্কৃতিলাভ করেন।

ওয়ারেন হেস্টিংস

১৭৩২ সালের ৬ ডিসেম্বর ওয়ারেন হেস্টিংস অক্সফোর্ডসায়ারের চার্চিলে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পরিবার এই সময়ে অর্থসঙ্কটোকার কারণে তাঁর এক পিতৃব্য তাঁর ভরণ-পোষণের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এই পিতৃব্য তাঁকে লন্ডনে নিয়ে আসেন এবং ওয়েস্টমিনিস্টারের একটি স্কুলে ভর্তি করে দেন। স্কুলে তিনি অসাধারণ মেধার পরিচয় দেন। স্কুলের পাঠ সমাপনান্তে তিনি   ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অধীনে একটি সামান্য চাকরিতে যোগদান করে বাংলায় আসেন। ১৭৫০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে তিনি কলকাতা পৌঁছেন। এই সময়  কাসিমবাজার ছিল রেশমিবস্ত্র সংগ্রহের অন্যতম প্রধান কেন্দ্র। তাঁর প্রথম কর্মস্থল হিসেবে হেস্টিংসকে সেখানে পাঠানো হয়। ১৭৫৬ সালে  সিরাজউদ্দৌলা যখন কলকাতা আক্রমণের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন তখন হেস্টিংস কাশিমবাজারে ছিলেন। সিরাজ পথিমধ্যে কাশিমবাজার দখল করেন এবং সেখানকার ব্রিটিশদের বন্দি করেন। সিরাজের কলকাতা দখলের পর সেখান থেকে পলায়ন করে যে সকল ব্রিটিশ ফলতায় আশ্রয় নিয়েছিল বন্দিদশা থেকে মুক্ত হয়ে হেস্টিংস তাদের সাথে মিলিত হন। সেখানে তিনি মেরী নাম্নী এক বিধবাকে বিয়ে করেন। মেরীর প্রাক্তন স্বামী সিরাজের কলকাতা অবরোধের সময় নিহত হয়েছিলেন। মেরীর গর্ভে হেস্টিংসের যে দুটি সন্তান জন্মায় তারা অচিরেই মারা যায়।

১৭৫৮ সাল থেকে হেস্টিংস মুর্শিদাবাদে নতুন নওয়াব  মীরজাফর-এর দরবারে কোম্পানির রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৭৬০ সালে কোম্পানি মীর জাফরকে সরিয়ে তাঁর জামাতা  মীর কাসিম-কে নওয়াবী দান করে। কিয়ৎকাল পরেই হেস্টিংস কলকাতা গিয়ে গভর্নর হৈনরী ভ্যান্সিটার্ট-এর কাউন্সিল সদস্য হন। ব্যক্তিগত ব্যবসা-বাণিজ্য নিয়ন্ত্রনের ক্ষেত্রে নওয়াবকে কতটুকু ক্ষমতা দেওয়া হবে এ ব্যাপারে কাউন্সিল ছিল দ্বিধাবিভক্ত। হেস্টিংস গভর্নরের পক্ষাবলম্বন করেন। হেস্টিংস ও ভ্যান্সিটার্ট এ বিষয়ে ছিলেন নমনীয়। নওয়াবের সাথে কোম্পানির বিরোধ শেষ পর্যন্ত যুদ্ধে পর্যবসিত হয় এবং পরিণামে নওয়াব বাংলা থেকে বিতাড়িত হন। ভ্যান্সিটার্ট পদত্যাগ করে দেশে চলে যান এবং ১৭৬৫ সালে হেস্টিংসও তাঁকে অনুসরণ করেন।

বিলেতে হেস্টিংস কোম্পানির ভবিষ্যৎ ভারত নীতি প্রভাবিত করার এবং একটা সম্মাজনক পদে অধিষ্ঠিত হয়ে উপমহাদেশে প্রত্যাবর্তনের চেষ্টা করেন। ১৭৬৮ সালে মাদ্রাজের ফোর্ট সেন্ট কাউন্সিলের দ্বিতীয় ক্ষমতাধর ব্যক্তি হিসেবে হেস্টিংস নিয়োগ লাভ করেন।

১৭৬৯ সালের ২৬ মার্চ হেস্টিংস মাদ্রাজের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন। একই জাহাজে তাঁর সহযাত্রী ছিলেন এক মহিলা যিনি পরবর্তীকালে তার দ্বিতীয় স্ত্রীর মর্যাদা পান। ফরাসি বংশোদ্ভূত এই জার্মান মহিলার নাম ছিল আনা মেরিয়া অ্যাপোলোনিয়া চ্যাপুস্টেইন (হেস্টিংসের কাছে সদাই মেরিয়ান)। তিনি তাঁর স্বামীর সাথে ভারতে আসছিলেন। স্বামীটি শেষ পর্যন্ত ইউরোপে ফিরে যান। আনা মেরিয়ান রয়ে গেলেন হেস্টিংসের সাথে। ১৭৭৭ সালের আগস্ট মাসে হেস্টিংস তাকে বিয়ে করেন। তাঁদের কোন সন্তান সন্ততি হয় নি, কিন্তু বিয়েটা ছিল জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত হেস্টিংসের জন্য পরম সুখের।

মাদ্রাজে হেস্টিংস দুটি সফল বছর অতিবাহিত করেন। কোম্পানির ব্যবসার দিকটা দেখা ছিল হেস্টিংসের দায়িত্ব, আর এ ব্যাপারে তিনি যথেষ্ট প্রশংসিত হন। ১৭৭১ সালে কোম্পানির ডাইরেক্টর সভা বাংলার জন্য একজন নতুন গভর্নরের সন্ধানে ছিলেন। হেস্টিংস তাদের দৃষ্টি আকর্ষণে সক্ষম হন। ১৭৭২ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি হেস্টিংস কলকাতায় ফিরে এলেন গভর্নর হিসেবে।

১৭৭২ সালে হেস্টিংস নিজেকে এমন একটা প্রদেশের গভর্নর হিসেবে পেলেন যেটিকে তিনি ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের একটা অংশ হিসেবেই বিবেচনা করতেন। বাংলার উপর মুগল অধিকার তিনি অস্বীকার করলেন। প্রশাসনে ভারতীয় কর্মকর্তাদের পরিবর্তে সরাসরি কোম্পানির একাধিপত্য স্থাপন করার নির্দেশ ছিল তাঁর ওপর। তিনি অত্যন্ত তৎপরতার সাথে এই অনুজ্ঞা পালন করেন। নওয়াবকে প্রদত্ত অধিকারে হানা দিতেও তিনি বিবেকের কোন দংশন বোধ করেন নি। তিনি প্রায়শই সার্বভৌমত্বের দোহাই দিতেন এবং বিশ্বাস করতেন যে, ব্রিটিশগণ বাংলার সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী। তিনি আরও বিশ্বাস করতেন যে এ ব্যাপারে কোন সংশয় থাকার কথা নয়।

সমসাময়িক ইউরোপীয়দের মতো হেস্টিংসও বিশ্বাস করতেন যে বাংলা একটি সমৃদ্ধিশালী প্রদেশ। এখানকার জমি উর্বর, এখানে ফসল ফলে প্রচুর আর শ্রমিকগণ শিল্পোৎপাদনে দক্ষ। শেষ দিকের ভারতীয় শাসকদের নির্যাতনে এরা ছিল পিষ্ট, ব্রিটিশ শাসন প্রতিষ্ঠিত হওয়ার কালেও এরা নির্যাতিত ছিল। ১৭৭০ সালের মহাদুর্ভিক্ষে প্রদেশটি বিপর্যস্ত হয়। নতুন সরকারের দায়িত্ব ছিল দুঃসময়ের অবসান ঘটিয়ে আশার আলো প্রজ্জ্বলন করা। ১৭৭২ সালে ক্ষমতা গ্রহণের পর হেস্টিংসের লক্ষ্য হলো কিভাবে তা অর্জন করা যায়। তিনি বিশ্বাস করতেন যে, বাংলাকে অবশ্যই সেভাবে শাসন করতে হবে যেভাবে এখানকার জনগণ শাসিত হয়ে অভ্যস্ত। শাসনের ক্ষেত্রে ভারতীয় রীতি এবং ভারতীয় আইন কানুন বহাল রাখার পক্ষপাতি ছিলেন হেস্টিংস। এদেশের জনগণকে সহূদয়তা ও সহানুভূতির সাথে তাদের নিজস্ব চিন্তাধারা, আচার-আচরণের ও সংস্কারের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে শাসন করাই হবে ব্রিটিশদের জন্য সর্বোত্তম পন্থা।

ভারতে প্রাথমিক পর্যায়ের ব্রিটিশ শাসনের মূল বিষয় ছিল রাজস্ব। প্রদেশটিকে ক্ষতিগ্রস্ত না করে এ থেকে কি পরিমাণ রাজস্ব সংগ্রহ করা যায় সে ব্যাপারে ব্রিটিশদের কোন নিশ্চিত ধারণা ছিল না। ১৭৭২ সালে হেস্টিংস সিদ্ধান্ত নিলেন প্রদেশটি কত বেশি রাজস্ব দিতে পারে সে ব্যাপারে পাঁচ বছরের জন্য রাজস্ব সংগ্রহ করার অধিকার প্রদানের ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতার সৃষ্টি করতে হবে। যেখানে জমিদার বা বংশপরম্পরায় রাজস্ব আদায়কারীগণ যৎপরোনাস্তি রাজস্ব দিতে স্বীকৃত না হবে সেখানে এতদপেক্ষা অধিকতর রাজস্ব প্রদানে স্বীকৃত ব্যক্তিকে রাজস্ব আদায়ের অধিকার দিতে হবে। এই তথাকথিত ইজারাদারী ব্যবস্থও ব্যর্থ প্রমাণিত হয়, এমনকি হেস্টিংসের কাছেও। হেস্টিংসের শাসনামলের বাদবাকি সময় কোম্পানি রাজস্ব নির্ধারণ করত সাংবৎসরিক ভিত্তিতে এবং চুক্তি হতো সাধারণত জমিদারদের সাথে।

সম্পত্তি ও উত্তরাধিকার সংক্রান্ত মামলা-মোকদ্দমা রাজস্ব প্রদানের সাথে ঘনিষ্টভাবে সম্পর্কিত হওয়ায় ১৭৬৫ সালের পর বাংলার দীউয়ান হিসেবে কোম্পানির উপর দীউয়ানি মামলা নিষ্পত্তি করার দায় বর্তায়। ফৌজদারি বিচারের দায়-দায়িত্ব ছিল নওয়াবের এবং তিনি ইসলামি দন্ড-বিধি মোতাবেক ফৌজদারি মামলার বিচার করতেন। হেস্টিংস মনে করতেন দেশীয় ক্ষয়িষ্ণু বিচার ব্যবস্থা পুররুজ্জীবনের জন্য ব্রিটিশ হস্তক্ষেপ প্রয়োজন। তিনি ব্রিটিশ তত্ত্বাবধানে দীউয়ানি ও ফৌজদারি উভয়বিধ বিচারালয়ের নতুন স্তর বিন্যাস ঘটালেন। বাংলায় প্রচলিত আইনের আওতায়ই বিচারালয়সমূহের কাজকর্ম পরিচালিত হবে। যে সকল ইউরোপীয় বিচারক এসকল আইনের প্রয়োগ করবেন তাদের সুবিধার্থে হেস্টিংস এগুলির অনুবাদ করালেন।

বাংলার গভর্নর হিসেবে হেস্টিংসকে শুধু একটা বিশাল প্রদেশের অভ্যন্তরীণ শাসনই পরিচালনা করতে হয় নি, তাঁকে ভারতীয় বিভিন্ন রাজ্য এবং কখনও কখনও অপরাপর ইউরোপীয় শক্তিসমূহের সাথেও কূটনৈতিক সম্পর্ক বজায় রাখতে হয়েছে। সতেরশ সত্তরের দশকে বাংলার বা মাদ্রাজ ও বোম্বাইয়ের ব্রিটিশ শক্তির পক্ষে মুগল সাম্রাজ্যের উত্তরসূরি হিসেবে নতুন বিকাশলাভকারী ভারতীয় শক্তিগুলি থেকে নির্লিপ্ত থাকা সম্ভব ছিল না। নতুন জয়ের অভিষ্পা হেস্টিংসের যদিও ছিল না, কিন্তু মৈত্রীচুক্তির মাধ্যমে প্রভাববলয় সম্প্রসারণের অভিলাস তাঁর অবশ্যই ছিল। ঘটনা প্রবাহ যেভাবে মোড় নিচ্ছিল তাতে শান্তির মাধ্যমে প্রভাব বৃদ্ধির সম্ভাবনা খুব কমই ছিল। কোম্পানিকে বার বার যুদ্ধে জড়িয়ে পড়তে হচ্ছিল। প্রথম যুদ্ধ বাধে রোহিলাদের সাথে ১৭৭৪ সালে। যুদ্ধের উদ্দেশ্য ছিল উত্তর ভারতে কোম্পানির সর্বপ্রধান মিত্র অযোধ্যার নওয়াবের শক্তি বৃদ্ধি। নওয়াবের ভূখন্ডে একদল ব্রিটিশ সৈন্য প্রতিপালিত হচ্ছিল।

১৭৭৩ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির উপর সংস্কার চাপিয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্যে ব্রিটিশ সরকার হস্তক্ষেপ করে। বাংলার শাসন ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হবে একজন গভর্নর জেনারেল এবং পাঁচ সদস্য বিশিষ্ট একটি সুপ্রিম কাউন্সিলের ওপর। এছাড়া রাজকীয় জজদের সমন্বয়ে গঠিত হবে কলকাতায় একটি সুপ্রিম কোর্ট। হেস্টিংসকে প্রথম গভর্নর জেনারেল হিসেবে মনোনীত করা হয়। জন ক্লেভারিং, জর্জ মনসন এবং ফিলিপ  ফ্রান্সিসকে কাউন্সিলের তিন জন্য সদস্য হিসেবে সরাসরি বিলেত থেকে পাঠানো হয়।

১৭৭৪ সালের ১৯ অক্টোবর কলকাতা পৌঁছবার পর থেকেই বিলেত থেকে আসা নতুন কাউন্সিলরগণ হেস্টিংসের প্রতি অবিরত বিরোধিতা চালিয়ে যেতে থাকেন। তাঁরা ছিলেন ঐক্যবদ্ধ এবং কাউন্সিলে সংখ্যাগরিষ্ঠ। অচিরেই তাঁরা এই বিশ্বাসে উপনীত হলেন যে, পূর্বতন সরকারের সব কার্যকলাপই দূর্নীতিতে আচ্ছন্ন এবং স্বয়ং হেস্টিংস বাংলার সম্পদ লুটপাট এবং অপচয়ের ক্ষেত্রে বাধা দিচ্ছেন না। মেধায় ও মননে হেস্টিংসের সমকক্ষ ফ্রান্সিস ছিলেন গভর্নর জেনারেলের প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বী।

নতুন কাউন্সিলরগণ রোহিলা যুদ্ধের কঠোর সমালোচনা দিয়ে ভারতে তাদের কার্যক্রম শুরু করলেন। হেস্টিংসের রজস্ব নীতিও ধীকৃত (condemned) হলো এবং ভারতীয়দেরকে উৎসাহিত করা হলো তার বিরুদ্ধে ব্যক্তিগত অসাধুতার অভিযোগ উত্থাপন করতে। মহারাজা  নন্দকুমার ছিলেন অভিযোগ উত্থাপনকারীদের মধ্যে নেতৃস্থানীয়। তিনি মনে করতেন যে, নতুন কাউন্সিলরগণ যদি হেস্টিংসকে উৎখাত করতে সক্ষম হন তাহলে তিনি নিজেও আর্থিক দিক থেকে প্রভূতপরিমানে লাভবান হবেন। হেস্টিংসের উৎকোচ গ্রহণের পরিমাণ হয়তো অতিরঞ্জিত করে দেখান হয়েছিল, তবে এটি অসম্ভব নয় যে অবৈধ উপায়ে কিঞ্চিত অর্থপ্রাপ্তি তাঁর ঘটেছিল। তবে কোন কিছু প্রমাণিত হওয়ার আগেই নতুন সুপ্রিম কোর্টে নন্দকুমারের বিরুদ্ধে জালিয়াতির অভিযোগ উত্থাপিত হয়। তিনি দোষী সাব্যস্ত হন, তাঁকে মুত্যুদন্ড দেওয়া হয় এবং ১৭৭৫ সালের ৫ আগস্ট তাঁর ফাঁসি কার্যকর করা হয়। হেস্টিংসের বিরুদ্ধবাদীগণ তাঁর সময়কাল থেকেই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে আসছেন এবং তাদের এই সিদ্ধান্ত অমূলক নয় যে, তিনি তড়িঘড়ি করে নন্দকুমারের বিরুদ্ধে অভিযোগ উত্থাপন করিয়েছেন এবং রায় প্রভাবিত করে থাকতে পারেন। এ বিষয়ে যে সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায়, তা হচ্ছে হেস্টিংসের বন্ধুদের দ্বারা উৎসাহিত হয়ে নন্দকুমারের দেশীয় শত্রুগণ তার বিরুদ্ধে অভিযোগ আনয়ন করে।

হেস্টিংসের দুজন বিরুদ্ধবাদী, মনসন ও ক্লেভারিং মারা গেলে হেস্টিংস শাসনব্যবস্থায় তাঁর কর্তৃত্ব পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেন। ফ্রান্সিস একাই শুধু তার বিরুদ্ধাচরণ করে চললেন। ১৭৮০ সালের ১৭ আগস্ট হেস্টিংসের সাথে ডুয়েল লড়ে কিঞ্চিৎ আহত হয়ে তিনিও অবশেষে ভারত ত্যাগ করেন।

১৭৮৫ সাল পর্যন্ত হেস্টিংস গভর্নর জেনারেল হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। শেষ বছরগুলিতে তিনি যে সকল অসুবিধার সম্মুখীন হন তা ছিল মূলত যুদ্ধকেন্দ্রীক। ১৭৭৮ সাল থেকে ব্রিটিশগণ মারাঠাদের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হয়। ১৭৮০ সালে শক্তিশালী মহিশূর বাহিনী ব্রিটিশ আশ্রিত কর্ণাট অঞ্চল আক্রমণ করে। ১৭৮১ সালের জানুয়ারি মাসে একদল ফরাসি সৈন্য মহিশূরের সাহায্যার্থে ভারতে পদার্পণ করে।

হেস্টিংস কূটকৌশলে ভারতীয় মৈত্রীজোটকে ভেঙ্গে দিতে সক্ষম হন। তিনি প্রচুর অর্থ, রসদ ও সৈন্যবাহিনী বাংলা থেকে মাদ্রাজে পাঠান। এর ফলে মহিশূর বাহিনীকে পিছু হটতে হয় এবং ফরাসি বাহিনীকে প্রতিরোধ করা সম্ভব হয়। সঙ্গতকারণেই ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের ত্রাণকর্তা হিসেবে হেস্টিংস নিজেকে দাবি করতে পারেন। এতদসত্ত্বেও যুদ্ধের কারণে স্বদেশে হেস্টিংসের ব্যাপক সমালোচনা হয়। তিনি একজন যুদ্ধংদেহী মনোভাবাপন্ন শাসক হিসেবে চিত্রিত হন। অভিযোগ ওঠে যে ধ্বংসাত্মক ব্যয়বহুল যুদ্ধে কোম্পানির জড়িয়ে পড়ার জন্য তিনিই দায়ী।

যুদ্ধের প্রয়োজনে হেস্টিংস কোম্পানির উত্তরভারতীয় কিছু মিত্র শক্তি ও আশ্রিত রাজ্যের সাথে বিরোধে জড়িয়ে পড়েন। বেনারসের রাজা চৈৎসিংহ কোম্পানিকে অতিরিক্ত কর দিতে বাধ্য হন। তিনি কোম্পানির ন্যায়সঙ্গত দাবি মেটাতে গড়িমসি করছেন এই অজুহাতে ১৭৮১ সালে হেস্টিংস স্বয়ং চৈৎসিংহের রাজ্যে উপনীত হয়ে তার ওপর বিপুল অঙ্কের জরিমানা ধার্য করেন। রাজার রক্ষীদল ক্ষুব্ধ হয়ে উঠলে হেস্টিংসকে পালিয়ে প্রাণ বাঁচাতে হয়।

যথাশীঘ্র ব্রিটিশ কর্তৃত্ব পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হলেও এই ঘটনা একটা বদ্ধমূল ধারণার সৃষ্টি করে যে, হেস্টিংস স্বৈরাচারী মনোভাব থেকে এহেন কাজ করেছিলেন এবং নিজের জন্য অহেতুক বিপদ ডেকে এনেছিলেন। বেনারসের পর হেস্টিংস ইংরেজদের মিত্র অযোধ্যার নওয়াবের কাছ থেকে বলপূর্বক অতিরিক্ত অর্থ জোগার করেন। নওয়াব ভূমিকর বাড়াতে এবং তাঁর মা ও পিতামহীর বিপুল সঞ্চিত সম্পদ জবরদখল করে কোম্পানির দাবি মেটাতে বাধ্য হন। এক্ষেত্রেও হেস্টিংসের জবরদস্তিমূলক উৎপীড়নমূলক হস্তক্ষেপই প্রতিভাত হয়।

তাঁর সমগ্র শাসনামল জুড়ে হেস্টিংস ছিলেন শিক্ষা-সংস্কৃতির একজন উদার পৃষ্ঠপোষক। চার্লস উইলকিন্স কৃত ভগবদ গীতার অনুবাদের জন্য তিনি বিশেষ গৌরব বোধ করতেন। তিনি এর একটা চমৎকার ভূমিকা লিখে দেন। তাঁর উৎসাহে ১৭৮৪ সালে বেঙ্গল  এশিয়াটিক সোসাইটি প্রতিষ্ঠিত হয়।

১৭৮৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে ভগ্নস্বাস্থ্য নিয়ে হেস্টিংস পদত্যাগ করেন। ষোল বছরেরও অধিকাল ভারতে কাটিয়ে ১৭৮৫ সালের ১৩ জুন তিনি পুনরায় ইংল্যান্ডের মাটিতে পা রাখেন। তিনি যুক্তিসঙ্গতভাবেই আশা করেছিলেন দেশে ফিরে তিনি দেশবাসীর কাছ থেকে সাধুবাদ ও সম্মান লাভ করবেন। কিন্তু বাস্তবে তিনি পেলেন বিরূপ আচরণ এবং শেষ পর্যন্ত তাঁকে অভিযুক্ত হয়ে কাঠগড়াতেই দাঁড়াতে হলো। বিচারকাজ ১৭৮৮ সালে শুরু হয়ে ১৭৯৫ সালে শেষ হয়। অবশ্য বিচারে তিনি নির্দোষ প্রমাণিত হন।

দুর্ভাগ্যক্রমে এডমন্ড বার্ক ভারতে দুঃশাসনের জন্য হেস্টিংসকে দায়ী করেন। ফ্রান্সিস ভারত থেকে দেশে ফেরার পর নিঃসন্দেহে বার্ক তাঁর দ্বারা প্রভাবিত হন। তবে ভারতের ব্যাপারে তাঁর মনোভাব তিনি গঠন করেন সম্পূর্ণ নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি থেকে এবং বাস্তবিকই তিনি ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠার তাড়না দ্বারাই উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন। তাঁর বিশ্বাস জন্মে যে, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এর নিজস্ব প্রদেশগুলি লুণ্ঠন, এর মিত্রদের শোষণ এবং অবিরাম যুদ্ধবিগ্রহের মাধ্যমে ভারতকে নিঃস্ব করে ফেলছিল। এসব কিছুর জন্যই তিনি মনে করেন হেস্টিংসই দায়ী। ১৭৮৬ সালে বার্ক কমন্স সভায় হেস্টিংসের বিরুদ্ধে ইমপিচমেন্ট প্রস্তাব আনয়ন করেন। এগুলি পরে লর্ড সভায় আলোচিত হওয়ার কথা। রোহিলা যুদ্ধ সংক্রান্ত প্রথম প্রস্তাবটি কমন্স সভায় উত্থাপিতই হলো না। কিন্তু চৈৎসিংহ সংক্রান্ত প্রস্তাবটি ১৭৮৭ সালের অপরাপর প্রস্তাবের সাথে পাশ হয় এবং ১৭৮৭ সালের ১০ মে হেস্টিংসকে ইমপিচ করা হয়।

বিচারকাজের শুরুর দিকে পার্লামেন্টে দর্শকের ভীর জমে। কিন্তু ১৭৯১ সালের ৩০ মে-র মধ্যে যখন হেস্টিংসের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ সমাপ্ত হয় তখন প্রায় কারোরই সন্দেহ থাকেনা যে, অভিমত এখন হেস্টিংসের অনুকূলে। ফরাসি বিপ­বের ঘটনাপ্রবাহ ব্রিটিশদের জাতীয়তাবোধে উদ্বুদ্ধ করে এবং সাম্রাজ্য তখন আর লজ্জার ব্যাপার হিসেবে বিবেচিত না হয়ে শ­াঘার বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। হেস্টিংসই এই সাম্রাজ্যের ত্রানকর্তা সে দাবি তাই সহূদয়তার সাথে বিবেচিত হয়। ১৭৯৫ সালে লর্ডসভা যখন রায় প্রদান করে তখন তিনি প্রতিটি অভিযোগের ক্ষেত্রে বিপুল ভোটাধিক্যে নির্দোষ ঘোষিত হন।

আইনের রূঢ় বৈপরিত্য ‘দোষী’ বা ‘নিদোর্ষ’ দ্বারা হেস্টিংসের কর্মজীবনের মতো জটিল কর্মজীবনের মূল্যায়ন সঠিক বলে বিবেচিত হওয়া কাম্য নয়। তাঁকে বার্ক যে অতিমাত্রায় আক্রমণাত্মক ভাষায় নিন্দা করেছেন তা গ্রহণ করা দায়। দোষী সাব্যস্ত হওয়া দূরে থাক তাঁকে যে ইমপিচমেন্ট করা হয়েছিল তাই এখন খুব কম লোকই মেনে নিতে চাইবেন। অপর পক্ষে তিনি সৎ উদ্দেশ্যে যে ছোটখাট দুএকটি নিন্দনীয় কাজ করেছিলেন তা ছাড়া তার বিরুদ্ধে তেমন কোন কঠিন অভিযোগ আনীত হয় নি কিংবা তিনি শুধু ফ্রান্সিসের প্রতিহিংসা ও বার্কের শত্রুতার শিকার হয়েছিলেন এমন যুক্তিও অচল। ইমপিচমেন্টের সময় তাঁর বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ, বিশেষ করে বেনারস ও অযোধ্যার ব্যাপারে তাঁর স্বেচ্ছাচারিতা এবং কর্মজীবনে তাঁর বিপুল পরিমাণ সঞ্চিত অর্থ ছিল উনিশ শতকের নৈতিকতা পরিপন্থি।

ইমপিচমেন্টে আনীত অভিযোগের ক্ষেত্রসমূহ ব্যতীত ভারতে তাঁর অন্যান্য অসাধারণ কৃতিত্বকে স্বীকার করতেই হবে। ভারতীয় প্রশাসনে তিনি উঁচুমাত্রার দক্ষতা আনয়ন করেন। ভারতীয় সংস্কৃতির প্রতি তাঁর ছিল গভীর শ্রদ্ধা এবং ভারতের ব্যক্তি বিশেষের প্রতিও তিনি অকৃত্রিম শ্রদ্ধা প্রদর্শন করতেন। ভারতে উচ্চপদে আসীন ব্রিটিশ নাগরিকদের ক্ষেত্রে এমনটি আর কখনও দেখা যায় নি। অংশত তাঁর পরিণাম দেখেই ভারতে ভবিষ্যৎ ব্রিটিশ প্রশাসন নিগুঢ় আইনের আওতায় থেকেছে এবং ভারতীয়দের থেকে দূরত্ব বজায় রখেছে।

১৭৯৫ সালে ইমপিচমেন্ট থেকে নিষ্কৃতিলাভের পর হেস্টিংস আরও ২৩ বছর বেঁচে ছিলেন। এই সময় তিনি গ্রামের একজন সাধারণ মানুষের মতো জীবন যাপন করেছেন। তিনি স্থানীয় কার্যকলাপে নিজেকে ব্যাপৃত রেখেছেন আর পূর্বপুরুষদের যে জমিদারি উদ্ধার করতে সক্ষম হয়েছিলেন তা আবাদ কার্যে ব্যপৃত থাকতেন। সরকারি কর্মে নিয়োজিত হওয়ার সুযোগ তিনি আর পান নি। তবে জীবন সায়াহ্নে সমাজে যথেষ্ট সম্মানলাভ করেছেন এবং দু’একটা সরকারি স্বীকৃতিও পেয়েছেন। ১৮১৮ সালের ২২ আগস্ট হেস্টিংস এর ৮৫ বছর বয়সে মৃত্যু হয়।  [পি.জে মার্শাল]