মোগড়াপাড়া

মোগরাপাড়া  নারায়ণগঞ্জ জেলার সোনারগাঁও থানার একটি গ্রাম ও ইউনিয়ন এবং মধ্যযুগীয় একটি ঐতিহাসিক স্থান। মেনিখালী নদীর তীরবর্তী এবং বতর্মান ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের দক্ষিণদিকে অবস্থিত মোগরাপাড়ায়ই সর্বপ্রথম এ অঞ্চলে মুসলিম বসতি গড়ে উঠে এবং তের শতকের গোড়ার দিকে গড়ে উঠা মুসলিম রাজধানী শহরের কেন্দ্রস্থল ছিল এই মোগরাপাড়া।

সোনারগাঁয়ে হিন্দু শাসনামলে বর্তমান মোগরাপাড়া নামটি প্রচলিত ছিল না। সোনারগাঁয়ের শেষ হিন্দু রাজার সময়ে এ স্থানটি রথখোলা নামে অভিহিত হতো। শেষ হিন্দু রাজার প্রস্তর নির্মিত রথের ধ্বংসাবশেষসহ হিন্দু শাসনামলের রথখোলা এবং মুসলিম আমলের মোগরাপাড়া শহরের অবস্থান পানাম খাসনগরে বিস্তৃত হিন্দু রাজধানী শহর থেকে খুব একটা দূরত্বে ছিল বলে মনে হয় না। রথখোলার অবস্থান যদি হিন্দু রাজধানী শহরের বাইরেও ধরে নেয়া হয়, তাহলেও তা ছিল শহরের উপকণ্ঠে।

প্রত্নতাত্বিক সূত্রের ভিত্তিতে সহজেই অনুমান করা যায় যে, সমগ্র মোগরাপাড়া ও গোয়ালদি এলাকায় একসময় সমৃদ্ধ ও ব্যাপক মুসলিম বসতি গড়ে উঠেছিল। সোনারগাঁও নগরের অধিকাংশ স্থাপত্য নিদর্শন, বিশেষত কতিপয় মধ্যযুগীয় ইমারত যার অধিকাংশই ছিল ধর্মীয় স্থাপনা। আর এগুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল এ অঞ্চলে বিশেষত মোগরাপাড়া, সাদিপুর, শাহ চিলাপুর, ভাগলপুর ও গোয়ালদি গ্রামে। এই সমগ্র এলাকাটির ভূমি সুগঠিত ও সুসংবদ্ধ, আশপাশের এলাকা থেকে বেশ উঁচু এবং ঘনবসতিপূর্ণ। এ অঞ্চলে এখনো টিকে থাকা ঐতিহাসিক নিদর্শনের মধ্যে রয়েছে: ফতেহ শাহ মসজিদ (১৪৮৪), দরগাহবাড়ি কমপ্লেক্স, গিয়াসউদ্দিন আযম শাহের সমাধি (১৪১২), গোয়ালদি মসজিদ (১৫১৯), ইউসুফগঞ্জ মসজিদ, দমদমা (দুর্গ বা পর্যবেক্ষণ বুরুজ) নামে অভিহিত সুউচ্চ গোলাকার ঢিবি।

তেরো শতকের শেষার্ধে মোগরাপাড়া ছিল ইসলামী জ্ঞানচর্চার কেন্দ্র। এই জ্ঞানপীঠের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন বোখারার জ্ঞানতাপস বহুমুখী জ্ঞানের অধিকারী মওলানা শরফুদ্দিন আবু তাওয়ামা। তিনি ১২৭০ খ্রিস্টাব্দে এখানে তাঁর খানকা ও মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেন। এই মাদ্রাসায় ইসলামী জ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় এবং জড়বিজ্ঞান বিষয়ে শিক্ষাদান করা হতো।

মুসলিম শাসনামলে মোগরাপাড়া ও তৎসন্নিহিত কতিপয় স্থান একত্রে ‘বালাদ সোনারগাঁও’ বা সাধারণত ‘শহর সোনারগাঁও’ নামে অভিহিত হতো। মোগরাপাড়া বাজার-স্থলটি অদ্যপি ‘বড়নগর’ নামে অভিহিত। সম্ভবত মোগরাপাড়ায় শরফুদ্দিন আবু তাওয়ামার খানকা ও মাদ্রাসার কাছাকাছি কোথাও প্রথমদিকের মুসলিম শাসকদের প্রশাসনিক সদর দফতর প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। বর্তমান দরগাহ বাড়ি প্রাঙ্গণে এখনও টিকে আছে ‘তাহয়িল’ বা ‘তাহাখানা’ (কোষাগার) ভবনের ধ্বংসাবশেষ এবং ভগ্নপ্রায় ‘নহরত খানা’ (বাদ্যবাজনা কক্ষ)। এগুলো স্পষ্টতই একসময়ের প্রশাসনিক কেন্দ্রের নিদর্শন।  [মুয়ায্‌যম হুসায়ন খান]