নন্দকুমার, মহারাজা

নন্দকুমার, মহারাজা মুগল অভিজাত শ্রেণীর খেতাব প্রাপ্ত অভিজাত এবং পলাশীর যুদ্ধের সময় হুগলীর ফৌজদার। পরবর্তীকালে তিনি নওয়াব মীরজাফরের দীউয়ান ছিলেন এবং কোম্পানি কর্তৃক দীউয়ানি লাভের অব্যবহিত পরে তিনি ছিলেন চার জন ঊর্ধ্বতন নায়েবের অন্যতম। ওয়ারেন হেস্টিংসের প্ররোচনায় এক জালিয়াতি মামলায় অভিযুক্ত করে তাঁকে ফাঁসি দেওয়া হয়। ইঙ্গ-ভারতীয় ইতিহাস সাহিত্যে মহারাজা নন্দকুমার একজন খ্যাতনামা ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত। গভর্নর হওয়ার অনেক আগে থেকেই ওয়ারেন হেস্টিংস তাঁকে অপছন্দ করতেন। ফোর্ট উইলিয়ম এর লোকদের এটা ভালভাবেই জানা ছিল যে, মীরজাফরের বিশ্বস্ত হিসেবে নন্দকুমার কোম্পানির শত্রুভাবাপন্ন কোনো কোনো শক্তির সঙ্গে গোপন অাঁতাত করতে নওয়াবকে প্ররোচিত করেছিলেন। এ অবস্থায় মীরজাফর তাঁর সিংহাসন হারান এবং নন্দকুমার নতুন শাসকদের নিকট তাঁর গ্রহণযোগ্যতা হারান।

রেগুলেটিং অ্যাক্ট এর বিধানে গভর্নর জেনারেলকে কাউন্সিলের সংখ্যাগরিষ্ঠ মতামতের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হতো। দুর্ভাগ্যবশত কাউন্সিলের চার জন সদস্যের তিন জনই হেস্টিংসের বিরুদ্ধে ছিলেন। কাউন্সিলের বিরোধী তিন জন সদস্যের (ক্ল্যাভারিং, ফ্রান্সিস ও মনসন) সঙ্গে তাঁর সংগ্রামে নন্দকুমারের কারণে হেস্টিংসকে অনেক বিব্রতকর পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে হয়। কারণ, নন্দকুমার হেস্টিংস বিরোধীদের কাছে সব সময় তাঁর দুর্নীতির বিস্তারিত তথ্য সরবরাহ করতেন। কিছুসংখ্যক নেতৃস্থানীয় জমিদার ও মুন্নী বেগমের (মীরজাফরের স্ত্রী) কাছ থেকে হেস্টিংস যে উৎকোচ গ্রহণ করেছিলেন তা নন্দকুমার বিরোধী সদস্যদের কাছে ফাঁস করে দেন। সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যদের দ্বারা গৃহীত কার্যবিবরণীতে উৎকোচ গ্রহণের বিষয়টি চিহ্নিত করেকোর্ট অব ডাইরেক্টর্স এর কাছে প্রেরণ করা হয়।

নন্দকুমারের বিচার-বিষয়ক তথ্যানুসন্ধান করে বেভারীজ বলেছেন যে, নন্দকুমারের প্রতি তাঁর অস্বাভাবিক বিদ্বেষের ফলে হেস্টিংস ’এ দুর্বৃত্তকে (তাঁর ভাষায়) তাঁর প্রাপ্য’ শাস্তি দেওয়ার সুযোগ খুঁজছিলেন। হেস্টিংস নন্দকুমারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের অভিযোগ আনার প্রয়োজনীয় কাগজপত্র তৈরি শুরু করেন। এ কাজে তেমন বেশি অগ্রগতি হওয়ার পূর্বেই জনৈক মোহনপ্রসাদ নন্দকুমারের বিরুদ্ধে জালিয়াতির অভিযোগ আনে। সুপ্রিম কোর্ট স্থাপনের চার বছর পূর্বে একটি উইলে এ ধরনের জালিয়াতি করা হয় বলে অভিযোগ আনা হয়। সুপ্রিম কোর্ট নন্দকুমারের বিচার করে এবং অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় ১৭৭৫ সালের ৬ মে তাঁকে ফাঁসি দেওয়া হয়। রাজা নন্দকুমার ছিলেন একজন অভিজাত ব্রাহ্মণ যিনি নওয়াব ও ব্রিটিশ শাসনামলে দীর্ঘ সময় ধরে ক্ষমতার কাছাকাছি থেকে কাজ করেছিলেন, তা সত্ত্বেও কাউন্সিলরগণ তাঁকে জোরালোভাবে সমর্থন করেন নি। অথচ এদের জন্য কাজ করতে গিয়ে নন্দকুমার ‘আইনি হত্যা’র শিকার হন। সুপ্রিম কোর্ট পূর্বে এক ব্যক্তির বিরুদ্ধে জালিয়াতির অভিযোগের বিচারে মৃত্যুদন্ড প্রদান করে, কিন্তু পরে ভারতীয় আইনে জালিয়াতির জন্য মৃত্যুদন্ডের বিধান না থাকায় এবং এ ব্যক্তি ব্রিটিশ নাগরিক না হওয়ায় মুত্যুদন্ড থেকে কোর্ট তাকে অব্যাহতি দেয়। নন্দকুমারের ক্ষেত্রে এ দৃষ্টান্ত অনুসরণ করা হয় নি। এর কারণ হিসেবে বলা হয়ে থাকে যে, প্রধান বিচারক এলিজা  ইম্পে সে সময় ফাঁসি দেওয়ার জন্য মানসিকভাবে প্রস্ত্তত ছিলেন।

নন্দকুমারের ফাঁসির কাহিনী নিয়ে লিখেছেন এমন লেখকদের অনেকেই সন্দেহ পোষণ করেছেন যে, সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারক স্যার এলিজা ইম্পের সহযোগিতায় হেস্টিংস এ ‘আইনি হত্যা’র আয়োজন করেন। ওয়েস্ট মিনিস্টার স্কুলে ইম্পে ছিলেন হেস্টিংসের বন্ধু। শত্রুকে নির্মূল করে ইম্পে বন্ধুকে সাহায্য করতে চেয়েছিলেন। ব্যাবিংটন মেকলের মতে, ইম্পে ছিলেন চরম প্রতিহিংসাপরায়ণ ও অসৎ চরিত্রের কুখ্যাত ব্যক্তি। ইম্পে সম্পর্কে মেকলের মন্তব্যের সঙ্গে লর্ড কর্নওয়ালিস এর মতের সাদৃশ্য রয়েছে। কর্নওয়ালিস বোর্ড অব কন্ট্রোল এর সভাপতির কাছে লিখিত বেশ কিছু চিঠিতে ইম্পের অর্থলালসা, পক্ষপাত দোষ এবং নীচতা ও অসাধুতার উল্লেখ করেন। অভিযোগটি সাধারণভাবে প্রচলিত থাকলেও হেস্টিংস কর্তৃক তাঁর বন্ধু ইম্পেকে সরাসরি প্ররোচনা দেওয়ার বিষয়টি এখনও যথাযথভাবে প্রমাণিত হয় নি।  [সিরাজুল ইসলাম]