ত্রিপুরা মুদ্রা

ত্রিপুরা মুদ্রা  ত্রিপুরা রাজ্যটি ছিল বাংলার পূর্ব সীমান্তে অবস্থিত প্রধানত একটি উপজাতীয় রাজ্য (মূলত ত্রিপুরা উপজাতি অধ্যুষিত)। রাজরত্নাকর ও  রাজমালায় বর্ণিত প্রচলিত কাহিনী মতে ত্রিপুরার প্রাচীনত্ব পৌরাণিক কালের। কিন্তু এ মতের সমর্থনে কোনো গ্রহণযোগ্য প্রমাণ নেই। ঐতিহাসিক দিক থেকে এ বংশের শাসনের প্রথম উল্লেখ দেখা যায় ধঁগর-ফা’র (Dhagar Pha) আমল থেকে (খ্রিস্টীয় চৌদ্দ শতক)। ধঁগর-ফা’র মৃত্যুর পর সিংহাসনের অধিকার নিয়ে রাজপুত্রদের মধ্যে সংঘর্ষ বাঁধে। সিংহাসন লাভে ব্যর্থ হয়ে যুবরাজ রত্ন-ফা গৌড়ে গিয়ে আশ্রয় গ্রহণ করেন। কিছুকাল সেখানে অবস্থানের পর তিনি শেষ পর্যন্ত বাংলার সুলতানের সহায়তায় সিংহাসন পুনরুদ্ধার করেন। অতঃপর রত্ন-ফা ‘মাণিক্য’ উপাধি গ্রহণ করেন। তিনিই সর্বপ্রথম তাঁর রাজ্যে মুদ্রা প্রবর্তন করে ত্রিপুরার মুদ্রাতাত্ত্বিক ইতিহাসের সূচনা করেন। ত্রিপুরা রাজ্যের যে শাসকবৃন্দ নিজেদের নামে মুদ্রা জারি করেন তাদের একটি কালানুক্রমিক তালিকা মুদ্রাগুলির বৈশিষ্ট্যসহ নিম্নে দেওয়া হলো। ত্রিপুরার সকল মুদ্রার ভাষা সংস্কৃত এবং তা বাংলা লিপিতে উৎকীর্ণ।

ত্রিপুরা মুদ্রা

ত্রিপুরা রাজ্যে রত্ন মাণিক্যই (১৩৮৬ শকাব্দ) প্রথম মুদ্রা চালু করেন। নকশা ও ওজন-মানের দিক থেকে তাঁর মুদ্রাগুলি এ সময়ের বাংলার সুলতানদের মুদ্রার সঙ্গে খুবই সাদৃশ্যপূর্ণ। অলঙ্করণের সাদৃশ্য ছাড়াও রত্ন মাণিক্যর মুদ্রায় খোদাই করা রৈখিক সিংহমূর্তি স্পষ্টত সুলতান নাসিরুদ্দীন মুহম্মদের মুদ্রা থেকে গৃহীত। সম্ভবত নাসিরুদ্দীন মুহম্মদই তাকে প্রথম আশ্রয় দিয়েছিলেন। যেহেতু রত্ন মাণিক্যর পূর্বে মুদ্রা প্রচলনের কোনো নজির নেই, সংগতভাবেই এরূপ ধারণা করা যায় যে, তিনিই বাংলা থেকে মুদ্রাঙ্কন প্রযুক্তি নিয়ে এসেছিলেন। সিংহ শক্তির প্রতীক, এটি দেবী দুর্গার বাহনও। মুদ্রায় এ প্রতীক সংযোজনের মাধ্যমে সুলতানের প্রতি রত্ন মাণিক্যর কৃতজ্ঞতা প্রকাশের সম্ভাবনা সম্পূর্ণ উড়িয়ে দেওয়া যায় না। অবশ্য এ বংশের রাজাদের অধিকাংশ মুদ্রায় সিংহ একটি স্থায়ী প্রতীক হিসেবে উৎকীর্ণ ছিল।

অধিকন্তু এটি বলা যেতে পারে যে, রত্ন মাণিক্যর ‘চতুর্দশ দেবতা’ মুদ্রাগুলিতে মাল্যবেষ্টিত চৌদ্দটি খাড়া রেখা দৃশ্যত সুলতানি মুদ্রার তুগরা লিপির অনুকরণ বলে মনে হয়। তাঁর মুদ্রাগুলিতে যে ধর্মীয় স্ত্ততি নিবেদন করা হয়েছে, যথা ‘পার্বতী পরমেশ্বর চরণ পরৌ’, ‘শ্রী শ্রী দুর্গা রাধা নস্ত বিজয় রত্নপুরেণ,’ ‘শ্রী নারায়ণ চরণ পর’, ‘শ্রী চতুর্দশ দেব চরণ পর’ প্রভৃতি সুস্পষ্টভাবে ধর্মীয় বিশ্বাসের ক্ষেত্রে তাঁর উদার মানসিকতার পরিচায়ক। মুদ্রাটির উপর উৎকীর্ণ সন ১৩৮৬ শকাব্দ। সম্ভবত এটি তাঁর অভিষেকের বছর। উল্লিখিত স্থান রত্নপুর সম্ভবত তাঁর রাজধানী ছিল। এটি বর্তমান উদয়পুরের নিকটে কোনো এক স্থানে অবস্থিত ছিল বলে ধারণা করা হয়।

রত্ন মাণিক্যের মুদ্রা ব্যবস্থার সবচেয়ে লক্ষণীয় বৈশিষ্ট্য হচ্ছে মুদ্রায় তাঁর রানী লক্ষ্মী মহাদেবীর নাম উৎকীর্ণ করা। এ বংশের পরবর্তী সব রাজাদের মধ্যে এটি একটি স্থায়ী প্রথা হয়ে দাঁড়ায়। উপমহাদেশের মুদ্রাতত্ত্বের সামগ্রিক ইতিহাসে রাজার সঙ্গে মুদ্রায় রানীর নাম উৎকীর্ণ করার মাত্র পাঁচটি উদাহরণ আছে। এর কারণ প্রধানত ওই বিশেষ সময়ে রানীর প্রাধান্য। কিন্তু রত্ন মাণিক্যর ক্ষেত্রে রানীর বিশেষ ক্ষমতা প্রয়োগের কোনো প্রমাণ নেই। মুদ্রাতাত্ত্বিক বা সমাজবিজ্ঞানীদের কেউই এ অস্বাভাবিক ঘটনার ব্যাখ্যা দিতে পারেন নি।

মুদ্রা জারিকারী পরবর্তী রাজা ছিলেন মুকুট মাণিক্য (১৪১১ শকাব্দ)। তাঁর রাজত্ব ছিল অত্যন্ত স্বল্পকালীন। তিনি তাঁর মুদ্রায় সিংহের পরিবর্তে গরুড় প্রতীক উৎকীর্ণ করান। তাঁর মুদ্রায় নারায়ণ বা চন্ডীর প্রতি ধর্মীয় স্ত্ততি নিবেদন লক্ষ করা যায়। তাঁর রানীর নাম ছিল মাছত্রী মহাদেবী।

পরবর্তী শাসক ধন্য মাণিক্য ১৪১২ শকাব্দে সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হন। মুদ্রায় উৎকীর্ণ তাঁর রানীর নাম ছিল কমলা। তিনি মুদ্রায় সিংহ প্রতীক পুনঃপ্রবর্তন করেন এবং অভিষেকের বছর সুনির্দিষ্ট তারিখ সম্বলিত মুদ্রাঙ্কনের প্রচলিত প্রথা পরিবর্তন করেন। তিনি তাঁর যুদ্ধ বিজয়ের তারিখ সম্বলিত স্মারক মুদ্রা প্রবর্তন করেন। তার উপুর্যপরি সামরিক সাফল্যের পরেই ১৪২৮ ও ১৪৩৫ শকাব্দে যথাক্রমে ‘বিজয়েন্দ্র’ ও ‘চাটিগ্রাম বিজয়ী’ উপাধিসম্বলিত মুদ্রা জারি করা হয়। তবে তাঁর চট্টগ্রাম বিজয় ছিল স্বল্পস্থায়ী। বন্দর নগরীটি বাংলার সুলতান হোসেন শাহ শীঘ্রই দখল করে নেন। ধন্য মাণিক্যের ধর্মীয় স্ত্ততি নিবেদন ছিল নরসিংহ ও গোবিন্দের প্রতি।

পরবর্তী শাসক দেব মাণিক্য (১৪৪৮ শকাব্দ) সুবর্ণগ্রাম (ঢাকার নিকটে সোনারগাঁও) জয়ের পর ধারাবাহিক তারিখ সম্বলিত মুদ্রা জারি করেন। দুরশায় তাঁর পুণ্যস্নানের স্মারক হিসেবে তিনি অপর এক ধরনের মুদ্রা জারি করেন। তাঁর সময়েই প্রথম বারের মতো মুদ্রায় পদ্মাবতী ও গুণবতী এ দুজন রাণীর নাম উৎকীর্ণ দেখা যায়।

বিজয় মাণিক্য (১৪৫৪ শকাব্দ) প্রায় তিন দশক ধরে রাজ্যশাসন করেন। তাঁর অভিষেকের সন থেকে শুরু করে বিভিন্ন ঘটনার স্মারক হিসেবে তিনি মুদ্রা জারি করেছেন। তাঁর একটি মুদ্রায় তিনি নিজেকে ‘কুমুদীসদৃশী’ (পদ্মবৎ) এবং অপর একটিতে ‘বিশ্বেশ্বর’ (বিশ্বপতি) রূপে আখ্যাত করেছেন। বিভিন্ন সনে তাঁর মুদ্রাগুলি জারি করা হয়েছিল। এদের মধ্যে কয়েকটি ধজাঘাট, লক্ষ্যা, পদ্মা এবং তৎকর্তৃক প্রতিসিন্ধুসিমো বলে বর্ণিত একটি মোহনায় তাঁর পুণ্যস্নানের সময়ের সাথে মিল রেখে জারি করা হয়। উল্লিখিত স্থানসমূহের অধিকাংশই বাংলার সন্নিহিত রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত। এটি অস্পষ্ট যে, এগুলি নিছক ধর্মীয় তীর্থযাত্রা ছিল অথবা সামরিক অভিযানের অব্যবহিত পূর্ববর্তী কোনো তীর্থদর্শন ছিল। মুদ্রা ব্যবস্থায় বিজয় মাণিক্যের অভিনব অবদান ছিল প্রতিমা অংকনরীতির প্রবর্তন। এগুলি ছিল ‘অর্ধনারীশ্বর’ ও ‘গরুড়পৃষ্ঠে বিষ্ণু’। তাঁর মুদ্রায় তিন জন ভিন্ন ভিন্ন রানীর নাম উৎকীর্ণ ছিল, বিজয়া, লক্ষ্মী ও সরস্বতী/বাকদেবী। বিজয়ের পুত্র অনন্ত (১৪৮৬ শকাব্দ) মাত্র দুবছর রাজত্ব করেন। তাঁর পিতার ন্যায় তিনি বিভিন্ন নকশার ‘বিষ্ণু-গরুড়’ মুদ্রা জারি করেন। দুপাশে দুই গোপিনী পরিবৃত অবস্থায় জোড়াসনে বসে বাঁশী বাদনরত কৃষ্ণমূর্তি অংকিত মুদ্রাও তিনি জারি করেন।

উদয় মাণিক্য (১৪৮৯ শকাব্দ) তাঁর জামাতা অনন্তকে হত্যা করে সিংহাসন দখল করেন এবং প্রায় ছয় বছর রাজত্ব করেন। রাজমালায় তাঁর রাজত্বের কোনো বিশদ বর্ণনা নেই। কিন্তু সম্প্রতি আবিষ্কৃত একটি মুদ্রায় বিস্ময়করভাবে তাকে ‘চাটিগ্রাম বিজয়ী’ বলে উল্লেখ করায় বর্তমান তথ্যের সঙ্গে নতুন তথ্য সংযোজিত হয়েছে।

জয় মাণিক্য (১৪৯৫ শকাব্দ) উদয় মাণিক্যের উত্তরাধিকারী হিসেবে সিংহাসন লাভ করেন এবং তাঁর মুদ্রা থেকে জানা যায় যে, তাঁর স্ত্রীর নাম ছিল সুভদ্রা। তাঁর রাজত্বকাল ছিল সংক্ষিপ্ত ও উল্লেখযোগ্য ঘটনাবিহীন।

পরবর্তী শাসক ছিলেন বিজয় মাণিক্যের বৈপিত্রেয় ভাই অমর মাণিক্য (১৪৯৯ শকাব্দ)। তিনি দুটি সফল বিজয়াভিযান পরিচালনা করেন এবং তাঁর মুদ্রায় এর উল্লেখ রয়েছে। তাঁর সিলেট বিজয়ের পর জারি করা মুদ্রায় যে দুটি আখ্যা উৎকীর্ণ রয়েছে তাঁর একটি হচ্ছে ‘দ্বিগ্বিজয়’ এবং অন্যটি ‘শ্রীহট্টবিজয়’। পরবর্তী সময় তিনি আরাকানিদের সাথে দীর্ঘ সংঘর্ষে লিপ্ত হন। আরাকানিরা ইতোমধ্যেই চট্টগ্রাম দখল করেছিল। শেষ পর্যন্ত তিনি আরাকানিদের নিকট পরাজিত হন।

অমর মাণিক্যের পুত্র রাজধর (১৫০৮ শকাব্দ) পিতার মৃত্যুর পর সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হন। তিনি ছিলেন একজন ধর্মপ্রাণ লোক এবং তাঁর সুদীর্ঘ রাজত্বকালে তেমন কোনো উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটেনি।

পরবর্তী শাসক যশোধর মাণিক্যের সিংহাসনারোহণকালে সিংহাসনের আরও কয়েকজন দাবিদার ছিলেন। রাজমালা ও রাজরত্নাকর গ্রন্থে তাদের নামের কোনো উল্লেখ না থাকলেও মুদ্রার সাক্ষ্যে তাদের অস্তিত্ব প্রমাণ করা যায়। যশোধরের মুদ্রাগুলির তারিখ ১৫২১ ও ১৫২২ শকাব্দ। কিন্তু আরও দুটি মুদ্রা পাওয়া গেছে; এর একটির তারিখ ১৫২১ শকাব্দ এবং তা জনৈক বীরভদ্র মাণিক্য কর্তৃক জারিকৃত। অপরটি ১৫২২ শকাব্দে ঈশ্বর মাণিক্য কর্তৃক জারিকৃত। এ মুদ্রাদুটি জারির সন যশোধর মাণিক্যের রাজত্বকালের অন্তর্ভুক্ত বিধায় এবং রাজমালা ও রাজরত্নাকর গ্রন্থে এ দুটি নামের কোনো উল্লেখ না থাকায় এদেরকে সিংহাসনের নিছক দাবিদার বলে ধরে নেওয়া যায়।

যশোধর মাণিক্য প্রায় দুদশক কাল রাজক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ছিলেন। শক্তিমান আরাকানি শাসক সেলিম শাহর সহায়তায় জনৈক ধর্ম মাণিক্য খুব সম্ভবত তাঁর রাজ্যের কিয়দংশ দখল করে নেন এবং ১৫২৩ শকাব্দে নিজ নামে মুদ্রা জারি করেন। যশোধর মাণিক্যের অধিকাংশ মুদ্রার লক্ষণীয় বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এতে উৎকীর্ণ ত্রিপুরী সিংহের উপর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের নৃত্যরত মূর্তি। কোনো কোনো মুদ্রায় তিনি একজন, আবার কোনো মুদ্রায় দুপাশে দুজন গোপিনী দ্বারা পরিবৃত।

পরবর্তী সময়ে ত্রিপুরায় নৈরাজ্যকর অবস্থা চলতে থাকে। ১৫৪৮ শকাব্দে কল্যাণ মাণিক্য ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে রাজ্যে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনার পূর্বপর্যন্ত এ অবস্থা বিরাজ করছিল। তাঁর মুদ্রায় শিবলিঙ্গ উৎকীর্ণ রয়েছে। এখানে উল্লেখ্য যে, তিনি অর্ধ ও সিকি মানের ক্ষুদ্র মুদ্রা চালু করেছিলেন।

গোবিন্দ মাণিক্য তাঁর পিতা কল্যাণ মাণিক্যের মুদ্রা নির্মাণরীতি অনুসরণ করেন এবং একই ধরনের মুদ্রা চালু করেন। তিনি দুআনি মুদ্রাও প্রবর্তন করেছিলেন। তাঁর রাজত্বের প্রথম দিকেই গোবিন্দ তাঁর বৈমাত্রেয় ভাই ছত্র মাণিক্য কর্তৃক সিংহাসনচ্যূত হন (১৫৮৩ শকাব্দ)। ছত্র মাণিক্যের মৃত্যুর পরই কেবল গোবিন্দ তাঁর রাজ্য ফিরে পান। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর ‘রাজর্ষি’ উপন্যাস ও ‘বিসর্জন’ নাটকের মাধ্যমে এ গোবিন্দ মাণিক্যকে অমর করে রেখেছেন।

গোবিন্দ মাণিক্যের পুত্র ও পরবর্তী শাসক রাম মাণিক্য (১৫৯৮ শকাব্দ) অল্পকাল রাজত্ব করেন। তিনি রানী সত্যবতীর নামসহ মুদ্রা জারি করেন। রাম মাণিক্যের পরে ১৬০৭ শকাব্দে দ্বিতীয় রত্ন মাণিক্য সিংহাসন লাভ করেন। ১৬১৫ শকাব্দে তিনি নরেন্দ্র মাণিক্য কর্তৃক ক্ষমতাচ্যুত হন। নরেন্দ্রের দ’ুবছর শাসনের পর দ্বিতীয় রত্ন মাণিক্য পুনরায় রাজক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন এবং ১৬৩৪ শকাব্দ পর্যন্ত রাজত্ব করেন। তিনি এক আনা মানের (এক টাকার ১/১৬) মুদ্রা জারি করেন।

দ্বিতীয় রত্ন মাণিক্যর পর মহেন্দ্র মাণিক্য (১৬৩৪ শকাব্দ) রাজা হন এবং এর দুবছর পর ধর্ম মাণিক্য রাজা হয়ে ১৬৩৬ শকাব্দে  মুদ্রা জারি করেন। তিনি প্রায় ১৫ বৎসর রাজত্ব করেন এবং অর্ধ আনা মূল্যমানের (এক টাকার ১/৩২) মুদ্রা জারি করেন।

এসময় থেকে ত্রিপুরা রাজ্য ক্রমেই রাজনৈতিকভাবে অস্থিতিশীল হয়ে ওঠে। স্বভাবতই জারিকৃত মুদ্রার সংখ্যাও হ্রাস পায়। বছরের পর বছর ধরে মুদ্রা জারি একটি আনুষ্ঠানিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। পরবর্তী মুদ্রাসমূহের আখ্যান ছিল পূর্ববর্তী মূদ্রার হুবহু অনুকরণ। কেবল শাসকদের ধর্মবিশ্বাস অনুযায়ী স্ত্ততিনিবেদন এর ধরন পরিবর্তিত হতো। আঠারো শতকের শেষের দিকে হস্তনির্মিত মুদ্রার স্থলে আধা যান্ত্রিক মুদ্রা চালু হয়। ঊনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে তাদের নিজস্ব টাকশালে সম্পূর্ণ যান্ত্রিক পদ্ধতিতে মুদ্রা তৈরি করা হয়। বিশ শতকের মধ্যভাগ পর্যন্ত এ ধারা অব্যাহত থাকে। রাধাকিশোর মাণিক্যের শাসনকালে (ঊনিশ শতকের শেষদিক) এ ধারার একমাত্র ব্যতিক্রম দেখা দেয়। তিনি গ্রেট ব্রিটেনের কোনো এক ব্যক্তিমালিকানাধীন টাকশাল থেকে দুই তঙ্কা, এক তঙ্কা ও অর্ধ তঙ্কা মানের একপ্রস্থ মুদ্রা তৈরি করান।

প্রায় পাঁচশ বছর ধরে ত্রিপুরার মুদ্রাসমূহ অব্যাহতভাবে জারি করা হলেও এদের প্রচলন মূলত এ রাজ্যসীমা অথবা পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে সীমাবদ্ধ ছিল। মুদ্রাগুলির প্রায় সবই রৌপ্য নির্মিত, অল্প কয়েকটি মাত্র স্বর্ণের। উপমহাদেশের মুদ্রাতত্ত্বের ইতিহাসে ত্রিপুরার মুদ্রাগুলি আঞ্চলিক হস্তলিখন বিদ্যা, মুদ্রাতাত্ত্বিক নির্মাণশৈলী এবং মূর্তি খোদাই শিল্পের কয়েকটি উৎকৃষ্ট উদাহরণ।

সারণি  ত্রিপুরার রাজাদের মুদ্রা ও সন তারিখ।

রাজার নাম মুদ্রার সন-তারিখ
রত্ন মাণিক্য ১৩৮৬ শকাব্দ, ১৩৮৯ শকাব্দ (?)
মুকুট মাণিক্য ১৪১১ শকাব্দ
 ধন্য মাণিক্য ১৪১২, ১৪২৮, ১৪৩৫ শকাব্দ
দেব মাণিক্য ১৪৪৮, ১৪৪৯, ১৪৫০, ১৪৫২ শকাব্দ
বিজয় মাণিক্য ১৪৫৪, ১৪৫৬, ১৪৫৮, ১৪৭৬, ১৪৭৯, ১৪৮২, ১৪৮৫ শকাব্দ
অনন্ত মাণিক্য ১৪৮৬, ১৪৮৭ শকাব্দ
উদয় মাণিক্য ১৪৮৯ শকাব্দ
জয় মাণিক্য ১৪৯৫ শকাব্দ
 অমর মাণিক্য ১৪৯৯, ১৫০২, ১৫০৩ শকাব্দ
 রাজধর মাণিক্য ১৫০৮ শকাব্দ
যশো মাণিক্য ১৫২১, ১৫২২ শকাব্দ
বীরভদ্র মাণিক্য * ১৫২১ শকাব্দ
ঈশ্বর মাণিক্য * ১৫২২ শকাব্দ
ধর্ম মাণিক্য * ১৫২৩ শকাব্দ
 কল্যাণ মাণিক্য ১৫৪৮ শকাব্দ
 গোবিন্দ মাণিক্য ১৫৮২ শকাব্দ
 ছত্র মাণিক্য ১৫৮৩ শকাব্দ
রাম মাণিক্য ১৫৯৮ শকাব্দ
রত্ন মাণিক্য, ২য় ১৬০৭ শকাব্দ
নরেন্দ্র মাণিক্য ১৬১৫ শকাব্দ
মহেন্দ্র মাণিক্য ১৬৩৪ শকাব্দ
ধর্ম মাণিক্য ১৬৩৬ শকাব্দ
 জয় মাণিক্য ১৬৬১ শকাব্দ
 ইন্দ্র মাণিক্য ১৬৬৬ শকাব্দ
বীরেন্দ্র কিশোর  মাণিক্য ১৩১৯ ত্রিপুরাব্দ
 বীর বিক্রম কিশোর মাণিক্য ১৩৩৭, ১৩৩৮, ১৩৪১ ত্রিপুরাব্দ
  • সিংহাসনের নিছক দাবিদার।

(শকাব্দ + ৭৮ = খ্রিস্টাব্দ; ত্রিপুরাব্দ + ৫৯০ = খ্রিস্টাব্দ)।  [বসন্ত চৌধুরী]