টপ্পা
টপ্পা ভারতীয় মার্গসঙ্গীতের প্রধান চারটি ধারার একটি; অপর তিনটি হলো ধ্রুপদ, খেয়াল ও ঠুম্রি। টপ্পা দুই প্রকার: হিন্দুস্থানি ও বাংলা। হিন্দুস্থানি টপ্পাকে উচ্চাঙ্গসঙ্গীতের মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন অযোধ্যার নবাব-দরবারের গুণী সঙ্গীতজ্ঞ গোলাম নবী ওরফে শোরী মিঞা (১৭৪২-১৭৯২), আর বাংলা টপ্পার সূত্রপাত করেন রামনিধি গুপ্ত ওরফে নিধুগুপত (১৭৪১-১৮৩৯)।
জনশ্রুতি আছে, বহুপূর্বে আরব বণিকরা বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে ইরান ও আফগানিস্তান হয়ে ভারতের পাঞ্জাব অঞ্চলে আগমন করত। ব্যবসার জিনিসপত্র উটের পিঠে চাপিয়ে তারা রাত্রিতে দলবদ্ধভাবে পথ চলার সময় পায়ের চলার ছন্দের সঙ্গে হু হু করে কম্পনযুক্ত সাঙ্গীতিক সুর তৈরি করত, যা কালে কালে পাঞ্জাবে উট চালকদের কাছে একটি আঞ্চলিক সঙ্গীতধারায় পরিণত হয়। পাঞ্জাবে এ লোকসঙ্গীত ‘ডপা’ নামে পরিচিত ছিল, যা হিন্দিতে টপ্পায় রূপান্তরিত হয়েছে। রাধামোহন সেন সঙ্গীততরঙ্গ গ্রন্থে লিখেছেন, ‘পাঞ্জাব হইতে হইল টপ্পার জনম/ দুই চরণের মধ্যে তাহার নিয়ম।’ শোরী মিঞা একে নানা অলঙ্কারে ভূষিত করেন।
টপ্পার একটি অর্থ ‘লম্ফ’, অন্য অর্থ ‘সংক্ষেপ’। ধ্রুপদ ও খেয়ালের মতো তেমন বিস্তৃতির অবকাশ নেই বলে টপ্পা গান হয় সংক্ষিপ্ত। খেয়ালের গঠন অনুযায়ী দুই তুকে এ গানের পদ রচিত হয়। প্রেম-বিরহের কাহিনী টপ্পার মূল বিষয়বস্ত্ত। দ্রুত সূক্ষ্ম গিটকিরির গাঁথুনি দ্বারা গড়িয়ে গড়িয়ে চলা হিন্দুস্থানি টপ্পার বিশেষত্ব। জমজমা শ্রেণীর অলঙ্কারযুক্ত স্বরের কম্পন দ্বারা গানের কথার বিন্যাস এ গানে এক চমৎকার আবহ সৃষ্টি করে। তালের আগে-পরে ঝোঁক ফেলে অর্থাৎ আড়-কুয়াড় ছন্দের মধ্য দিয়ে নান্দনিক রূপ ফোটানো এ গানের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। বিশেষত খাম্বাজ, ভৈরবী, সিন্ধু, ঝিঁঝিট প্রভৃতি রাগে এবং পাঞ্জাবি মধ্যমান তালে শোরী মিঞার টপ্পা রচিত।
রামনিধি গুপ্ত ছাপরা জেলায় চাকরি করাকালে একজন মুসলমান ওস্তাদের নিকট সঙ্গীতে তালিম নেওয়ার সময় শোরী মিঞার হিন্দুস্থানি টপ্পার সঙ্গে পরিচিত হন। তিনি চাকরিশেষে কলকাতায় এসে হিন্দুস্থানি টপ্পার আদলে বাংলা টপ্পা গানের প্রবর্তন করেন। এ গানের বৈশিষ্ট্য হলো একেকটি স্বরের ওপর মধ্যলয়ে দোলায়মান কম্পন দ্বারা গানের কথাগুলির গড়িয়ে গড়িয়ে অবরোহণ। নিধুবাবু বাংলা গানের কাব্যিক সৌন্দর্য বজায় রাখার জন্য শোরী মিঞার টপ্পার তানে ক্ষিপ্রতার বদলে কোমল কম্পন ব্যবহার করেন। তবে তিনি হিন্দুস্থানি টপ্পার রাগ ও তালের ব্যবহারে সাধারণত কোনো পরিবর্তন আনেননি। প্রেমসঙ্গীত ছাড়াও তিনি টপ্পার ছাঁচে ব্রহ্মসঙ্গীত রচনা করেছেন, যেমন: ‘পরমব্রহ্ম তৎপরাৎপর পরমেশ্বর/ নিরঞ্জন নিরাময় নির্বিশেষে সদাশয়/ আপনা আপনি হেতু বিভু বিশ্বধর।’ (বেহাগ/ আড়া)।
নিধুবাবুর সমসাময়িককালে এবং কিছুকাল পরে যাঁরা বাংলা টপ্পা রচনায় অবদান রাখেন তাঁদের মধ্যে কালী মীর্জা ও শ্রীধর কথকের নাম উল্লেখযোগ্য। রবীন্দ্রনাথের কিছু গানেও টপ্পার প্রভাব লক্ষ করা যায়, যেমন: ‘হল না হল না সই, হায়/ মরমে মরমে লুকানো রহিল, বলা হল না।’ দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের রাগভঙ্গিম রচনায় টপ্পাঙ্গের চলন পরিলক্ষিত হয়, যেমন: ‘আমি রব চিরদিন তব পদ চাহি’ (ঝিঁঝিট খাম্বাজ-সৎ)। রজনীকান্ত সেন, অতুলপ্রসাদ সেন ও নজরুলের গানে টপ্পার প্রভাব খুব কমই পড়েছিল। নজরুলের পরে বাংলা গানে সুরের গতি যে ধারায় প্রবাহিত হয়েছিল, তাতে টপ্পাশৈলীর গতি আরও ক্ষীয়মাণ হয়; তবে সঙ্গীতবোদ্ধাদের নিকট টপ্পার গ্রহণযোগ্যতা একেবারে লোপ পায়নি। পশ্চিমবঙ্গের মিডিয়াগুলিতে নিধু গুপ্তের টপ্পার প্রচার আজও অব্যাহত রয়েছে। [খান মোঃ সাঈদ]