ছন্দ

ছন্দ  কাব্যের গতিসৌন্দর্য বিধায়ক একটি স্বতঃস্ফূর্ত নির্মাণকৌশল। হাজার বছর ধরে বিচিত্র আবেগ, অনুভূতি ও বিষয়ভাবনা দ্বারা পরিপুষ্ট বাংলা কাব্যের গতিময় নান্দনিক সৌন্দর্য সৃষ্টির উদ্দেশ্যে কবিরা বহুবিধ ছন্দের নির্মাণ ও বিকাশ সাধন করেছেন।

ভারতবর্ষে ছন্দচর্চার ইতিহাস অনেক প্রাচীন। সুদূর অতীতে বৈদিক ভাষা ও সাহিত্য (খ্রি.পূ ২৫০০-৯০০ অব্দ) চর্চার সময়কাল থেকেই ভারতবর্ষে কাব্যের প্রধান উপাদানরূপে ছন্দের চর্চা হয়ে আসছে। ধ্রুপদী  সংস্কৃত ভাষায়  রামায়ণ রচয়িতা বাল্মীকিকে আদি কবি এবং তাঁর কাব্যে ব্যবহূত ছন্দকে আদি ছন্দ বলেও একটা কথা প্রচলিত আছে। একদিন ব্যাধের শরে ক্রৌঞ্চমিথুনের ক্রৌঞ্চ নিহত হলে ক্রৌঞ্চী আর্তস্বরে বিলাপ করছিল। তা শুনে বাল্মীকির বেদনার্ত হূদয় থেকে যে ছন্দে সকরুণ অভিশাপোক্তি উচ্চারিত হয় তাই আদি ছন্দ হিসেবে পরিচিত। ছন্দটির নাম অনুষ্টুপ্। বাল্মীকির এ ছন্দোভাবনাই পর্যায়ক্রমে গায়ত্রী, অনুষ্টুপ্, ত্রিষ্টুপ্ ইত্যাদি শাখায় বিভক্ত ও বিকশিত হয়ে নব্যভারতীয় বিভিন্ন ভাষার কাব্যচর্চাকে যেমন প্রভাবিত করেছে, তেমনি নতুন নতুন দেশিয় ছন্দ নির্মাণেও উদ্দীপকের ভূমিকা পালন করেছে। বাংলা ছন্দের উদ্ভব ও বিকাশও এর ব্যতিক্রম নয়। তবে বাংলা কাব্যের বিভিন্ন ছন্দ সৃষ্টির পশ্চাতে সংস্কৃত অনুষ্টুপাদি ছন্দ ভিত্তি হিসেবে কাজ করলেও এক্ষেত্রে এ ভাষার কবি-মনীষীদের আবেগসমৃদ্ধ মৌলিক ও সৃষ্টিধর্মী চিন্তা এবং কৌশলই মূল প্রেরণা হিসেবে কাজ করেছে।

হাজার বছর বয়সী বাংলা কাব্যে সময়ের ধারাবাহিকতায় নতুন নতুন ছন্দের উদ্ভব ঘটলেও এর প্রধান শাখা হচ্ছে তিনটি: মাত্রাবৃত্ত, স্বরবৃত্ত ও অক্ষরবৃত্ত। বাংলা সাহিত্যের প্রথম নিদর্শন  চর্যাপদ থেকে শুরু করে বিশ শতকের শেষপাদ পর্যন্ত রচিত বাংলা কাব্যের বিচিত্র ধারায় এ তিনটি ছন্দই অসংখ্য কবির দ্বারা চর্চিত ও পরিপুষ্ট হয়েছে। এ ছাড়া ধামালি, ভঙ্গপয়ার, ললিত, দিগক্ষরা, মহাপয়ার প্রভৃতি নামে যে ছন্দগুলি প্রচলিত, সেগুলি অনিয়মিত ও পারম্পর্যহীন। সেগুলি কবিবিশেষের সৃষ্টি এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই স্রষ্টার ব্যবহারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ।

মাত্রাবৃত্ত ছন্দ বাংলা কাব্যে ব্যবহূত অন্যতম প্রাচীন ছন্দ। অক্ষরবৃত্তের প্রভাব থেকে রবীন্দ্রনাথ একে মুক্ত করে এতে এক নতুন রীতি প্রবর্তন করেন, যে কারণে মাত্রাবৃত্তকে কেউ কেউ রবীন্দ্রনাথেরই সৃষ্টি বলে মনে করেন। এ ছন্দ চর্যাপদে  প্রথম লক্ষিত হয়। মূলত মাত্রাবৃত্ত একটি সর্বভারতীয় ছন্দ এবং সংস্কৃত ও প্রাকৃতের সময় থেকেই এটি ভারতবর্ষে প্রচলিত। বাংলা ভাষায় এটি প্রবেশ করেছে  প্রাকৃত ও  অপভ্রংশ কবিতা এবং সংস্কৃত কাব্য  গীতগোবিন্দম্-এর মাধ্যমে। রবীন্দ্রনাথও স্বীকার করেছেন যে, এ ছন্দের সৃষ্টি হয়েছে সংস্কৃত ছন্দকে বাংলায় ভেঙে নিয়ে।

অন্যান্য বাংলা ছন্দের তুলনায় মাত্রাবৃত্ত একটি দুর্বল ছন্দ; কেননা পর্বদৈর্ঘ্য অনুযায়ী চার, পাঁচ, ছয় বা সাত মাত্রার এ ছন্দে স্বাভাবিকভাবেই দুর্বল উচ্চারণভঙ্গি ফুটে ওঠে এবং এতে শক্তি বা সুরের স্বাভাবিক প্রকাশ না হয়ে কেবল মাত্রারই প্রাধান্য প্রতিফলিত হয়। এজন্যই এ ছন্দকে মাত্রাবৃত্ত ছন্দ বলা হয়। বাংলা সাহিত্যে এ ছন্দকে ধ্বনিপ্রধান, বিস্তারপ্রধান, সরল কলামাত্রিক ইত্যাদি নামেও অভিহিত করা হয়।

চর্যাপদে মাত্রাবৃত্ত ছন্দের প্রথম প্রকাশ পরিলক্ষিত হলেও সেখানে তা একেবারেই সাধারণ ও প্রাথমিক পর্যায়ের। এতে কেবল চার মাত্রার পর্বই ব্যবহূত হয়েছে; পাঁচ, ছয় বা সাত মাত্রার পর্ব অনুপস্থিত। আবার পর্বের দৈর্ঘ্য পূরণের জন্য যেহেতু চর্যাপদের মাত্রাবৃত্ত ছন্দে স্বরান্ত অক্ষরকেও দু মাত্রায় প্রসারিত করা হয়েছে, সেজন্য এ ছন্দকে স্বরপ্রসারক মাত্রাবৃত্তও বলা হয়। যেমন: কা-আ-/ তরুবর/ পঞ্চ বি/ ডা-ল-। চঞ্চল/ চী-এ-/ পইঠো-/ কা-ল- \ [পদ-১]

চর্যাপদের পরে ব্রজবুলিতে রচিত বিভিন্ন বৈষ্ণবপদে মাত্রাবৃত্ত ছন্দের সার্থক প্রয়োগ ঘটেছে। চর্যাপদের বিভিন্ন পদে এ ছন্দের যে সীমাবদ্ধতা ও অসম্পূর্ণতা ছিল, তা যেমন ব্রজবুলির ছন্দে বিদূরিত হয়েছে, তেমনি এতে চারমাত্রার পর্বের পাশাপাশি পাঁচ, ছয় ও সাত মাত্রার পর্বেরও বহুল প্রয়োগ লক্ষণীয়।  গোবিন্দদাস, বলরামদাস, শশিশেখর প্রমুখ বৈষ্ণব কবির বিভিন্ন পদে এ ধরনের সার্থক প্রয়োগবৈচিত্র্য পরিলক্ষিত হয়। এ ছাড়া চরণশেষে খন্ডপর্বের ব্যাপক ব্যবহারের মাধ্যমেও ব্রজবুলির বিভিন্ন পদ মাত্রাবৃত্ত ছন্দে একই সঙ্গে বৈচিত্র্য ও সার্থকতা আনয়ন করেছে।

ব্রজবুলির পরবর্তী সময় থেকে শুরু করে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পূর্ববর্তী সময় পর্যন্ত কালপরিসরে ব্যাপক মাত্রায় মাত্রাবৃত্ত ছন্দে কাব্য সৃষ্টি হলেও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরই প্রথম এ ছন্দে নতুনত্ব আনেন। তিনি তাঁর মানসী কাব্যের বিভিন্ন কবিতায় মাত্রাবৃত্ত ছন্দে হলন্ত অক্ষরকে দ্বিমাত্রিক হিসেব করে যেমন এক বিশিষ্ট রীতি উদ্ভাবন করেন, তেমনি অক্ষরবৃত্তের প্রভাব থেকে মাত্রাবৃত্তকে উদ্ধার করে এর স্বাতন্ত্র্য ও বৈশিষ্ট্য চিহ্নিত করেন। তাঁর পূর্বে সকল কবিই লঘু ত্রিপদী, লঘু চৌপদী, একাবলী প্রভৃতি ছয় মাত্রার ছন্দকে অক্ষরবৃত্ত বলে প্রতিপন্ন করলেও রবীন্দ্রনাথই প্রথম নিশ্চিত করেন যে, ধ্বনিধর্মে এগুলি মাত্রাবৃত্ত ছন্দোভুক্ত। ছন্দের ক্ষেত্রে এটি রবীন্দ্রনাথের শ্রেষ্ঠ অবদান।

বাংলা ভাষা ও বাঙালির ধ্বনি উচ্চারণ প্রক্রিয়ার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ ছন্দ হচ্ছে স্বরবৃত্ত ছন্দ। এর কারণ, বাংলা শব্দ স্বভাবগতভাবেই হলন্ত বা ব্যঞ্জনান্ত উচ্চারণ প্রক্রিয়াবিশিষ্ট, যাকে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন ‘হসন্তের ছাঁচ’। এ বৈশিষ্ট্য স্বরবৃত্ত ছন্দে রক্ষিত হয়েছে। চলিত বা প্রাকৃত বাংলার স্বভাব রক্ষা করে এ ছন্দের উদ্ভব ও বিকাশ ঘটেছে। ফলে এ ছন্দকে সাধু বাংলার বাইরে বাউল গানে, লোককথায় ও ছড়ায় খুঁজে পাওয়া যায়।

উচ্চারণে দ্রুততা ও সবলতা স্বরবৃত্ত ছন্দের প্রধান বৈশিষ্ট্য। প্রতি পর্বের প্রথমে প্রবল শ্বাসাঘাত যেমন এ ছন্দের দ্রুততার প্রধান কারণ, তেমনি শ্বাসাঘাতের শক্তিই একে করে তুলেছে সবল ও প্রাণবান। আবার স্বরবৃত্ত ছন্দের প্রধান পর্ব যেহেতু চার মাত্রার এবং তার পরেই থাকে একটি ক্ষুদ্র পর্ব, সেজন্যও এ ছন্দ দ্রুত উচ্চারিত হয়। যেমন: উইড়া যাও রে/ বনের কুড়া/ কইও মায়ের্/ আগে। তোমা-র্ না/ চান্দ্ বিনোদে/ খাইছে জংলার/ বাঘে\ [ মৈমনসিংহ গীতিকা]। এখানে নিম্নরেখ পর্বটি চার মাত্রার কম বলে বিশ্লিষ্ট ও বিলম্বিত উচ্চারণ করে চারমাত্রা ধরা হয়েছে। স্বরবৃত্ত ছন্দের পর্বের এ স্থিতিস্থাপক গুণ বাংলা কাব্যে বিভিন্ন সময়ে পরিলক্ষিত হয়েছে। দ্রুততা ও প্রবল শ্বাসাঘাতের জন্যই স্বরবৃত্ত ছন্দ অধিকতর প্রাণবন্ত এবং কথ্যভাষার উপযোগী হয়ে উঠেছে।

অনেকের মতে, আধুনিক স্বরবৃত্ত ছন্দ মধ্যযুগীয় কাব্য শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের ধামালি ছন্দ থেকে উদ্ভূত, কেননা ধামালিকাব্য নামে পরিচিত শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের ধামালি ছন্দে স্বরবৃত্তের পূর্ববর্তী রূপটি পরিলক্ষিত হয়। এ কাব্যের শব্দে যেহেতু হসন্ত উচ্চারণ নেই এবং অকারান্ত শব্দ অকারান্ত রূপেই উচ্চারিত হয়, সেহেতু পর্বের আদিতে শ্বাসাঘাত স্পষ্ট না হলেও তার ইঙ্গিত আছে। শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যে এমন কতগুলি  তৎসম শব্দ আছে যেগুলির আদিতে শ্বাসাঘাতের অস্তিত্ব লক্ষণীয়, যেমন: আসুখ (অসুখ), আনল (অনল), আন্তর (অন্তর), আধিক (অধিক) ইত্যাদি। মূলত উপর্যুক্ত শব্দগুলির আদিস্বরের বৃদ্ধি প্রবল শ্বাসাঘাতের জন্যই সম্ভব হয়েছে। তাই আদি স্বরের এ বৃদ্ধি দ্বারাই শব্দের আদি শ্বাসাঘাতকে বুঝে নিতে হয়, যা স্বরবৃত্ত ছন্দের প্রধান বৈশিষ্ট্য। শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যের পরে বৈষ্ণব পদাবলির কবি লোচনদাসের পদাবলিতে স্বরবৃত্ত ছন্দের পর্বগত শ্বাসাঘাত অত্যন্ত স্পষ্ট, যাকে অতি সহজেই এ ছন্দের প্রধান বৈশিষ্ট্যরূপে চিহ্নিত করা যায়: আর্ শুন্যাছ’/ আলো সই/ গোরা ভাবের/ কথা। কোণের্ ভিতর্/ কুলবধূ/ কান্দ্যা আকুল্/ তথা \

স্বরবৃত্ত ছন্দ পরবর্তী সময়ে লোচনদাসের পদের ধারাবাহিকতায় অষ্টাদশ শতকের গোপীচন্দ্রের গান,  শ্যামাসঙ্গীত, বাউল পদ,  পাঁচালি ও মৈমনসিংহ-গীতিকার  মধ্য দিয়ে পরিপুষ্টি লাভ করে আধুনিক যুগের ছড়ার ছন্দরূপে পরিপূর্ণ ও স্থিতিশীল হয়ে উঠেছে।

অক্ষরবৃত্ত ছন্দ বাংলা কাব্যের প্রধান ছন্দ। অন্য দুটির তুলনায় এ ছন্দের উচ্চারণ অধিকতর স্বাভাবিক এবং গদ্য উচ্চারণভঙ্গির অনুসারী বলেই এটি বাংলা কাব্যের প্রধান ছন্দে পরিণত হয়েছে। অক্ষরবৃত্ত শ্বাসাঘাতপ্রধান নয়, তানপ্রধান ছন্দ। তান হচ্ছে স্বরধ্বনি বা সাধারণ উচ্চারণের অতিরিক্ত টান, যা এ ছন্দে পর্বগত দীর্ঘতার জন্য প্রযুক্ত হয়। ৮/৬ বা ৮/১০ মাত্রার সর্বাধিক দীর্ঘ পর্বে অক্ষরবৃত্ত রচিত হয়। এ ছাড়া মধ্যযুগে অক্ষরবৃত্ত ছন্দে সুর একটি বড় বৈশিষ্ট্য ছিল। পনেরো শতকে বাংলা সাহিত্যে অক্ষরবৃত্ত ছন্দে রামায়ণ ও  মহাভারত অনুবাদের কারণেই এতে সুর সংযোজিত হয়। অবশ্য উনিশ শতকে অমিত্রাক্ষর ছন্দ প্রবর্তনের মধ্য দিয়ে মাইকেল মধুসূদন দত্তের হাতে এ ছন্দের সুরমুক্তি ঘটে। ফলে এ শতক থেকে রামায়ণ, মহাভারত ইত্যাদি কাব্যের ‘গান’ ব্যতিরেকে শুধু ‘পাঠ’ প্রচলিত হলেও পর্বগত দীর্ঘতার কারণে তান আজও বজায় আছে।

অক্ষরবৃত্ত ছন্দের উৎস হিসেবে অনুষ্টুপ্ (বৈদিক), বসন্ততিলক (বৃত্তছন্দ), পাদাকুলক (মাত্রাছন্দ), পারনি (তামিল ছন্দ) কিংবা ফারসি বয়েৎ ছন্দকে মনে করা হয়। মূলত এসব ছন্দ থেকে নানা উপাদান সংযোগে সমৃদ্ধ হলেও অক্ষরবৃত্ত বাংলা ভাষারই নিজস্ব ছন্দ, যা শ্রীকৃষ্ণকীর্তন  কাব্যের ধামালি বা স্বরবৃত্ত ছন্দ থেকে জন্ম লাভ করেছে। শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের স্বরবৃত্ত ছন্দে রচিত চরণের কোনো কোনো পর্বের শ্বাসাঘাত বিলুপ্ত হয়ে পূর্ববর্তী পর্বের সঙ্গে একীভূত হওয়ার মাধ্যমেই অক্ষরবৃত্ত ছন্দ গঠিত হয়েছে। আর পরবর্তীকালে এ ছন্দ বিভিন্ন কবির প্রতিভাস্পর্শে সমৃদ্ধ হয়ে উঠেছে।

বাংলা সাহিত্যে অক্ষরবৃত্ত ছন্দ একটি স্থিতিস্থাপক ছন্দ, যা মধ্যযুগের বিভিন্ন সময়ে পর্বগত সংকোচন ও সম্প্রসারণের মাধ্যমে বিভিন্ন কবির হাতে বিভিন্ন নামে পরিচিত হয়েছে। পয়ার হচ্ছে অক্ষরবৃত্ত ছন্দের ৮/৬ মাত্রার বৈশিষ্ট্যপূর্ণ একটি শ্রেণীবিভাগ। এটি মধ্যযুগীয় বাংলা কাব্যের প্রধান ছন্দোরীতিও বটে। পয়ারের পর্ব-সম্মতি প্রকাশিত নয়, বরং অন্তর্গূঢ় বলে দ্রুততা ও চাপল্য বর্জিত এবং তা গুরুগম্ভীর মহাকাব্য ও বস্ত্তনিষ্ঠু জগৎ-জীবন রূপায়ণে অধিক উপযোগী। তাই মধ্যযুগে পয়ার ছন্দেই রামায়ণ ও মহাভারতের বঙ্গানুবাদ এবং মঙ্গলকাব্যসমূহ রচিত হয়েছে। পয়ার ছন্দের উদাহরণ, যেমন: মহাভারতের কথা/ অমৃত সমান। কাশীরাম দাস ভণে/ শুনে পুণ্যবান্ \

এভাবে এ ছন্দ বাংলা সাহিত্যের চিরায়ত কাব্যসমূহ রূপায়ণের মাধ্যমে পরিণত হয়েছে শ্রেষ্ঠ ছন্দে। পয়ার ছন্দেরই একটি বিবর্ধিত রূপের নাম হচ্ছে মহাপয়ার। এতে পয়ারের ৬ মাত্রার অন্ত্যপর্বের পরিবর্তে ১০ মাত্রা হয়। এ ছন্দের প্রথম উদাহরণ পরিলক্ষিত হয় রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের পদ্মিনী উপাখ্যান কাব্যে। এ ছাড়া ষোল শতকে  মুকুন্দরাম চক্রবর্তী তাঁর কাব্যে ভঙ্গপয়ার নামে এক ধরনের ছন্দের প্রবর্তন করেন, যাতে পয়ারের প্রথম আট মাত্রা বাদ দিয়ে ৬ মাত্রার অন্তপর্বে দু মাত্রার অতিপর্ব যোগ করা হয় এবং একে পুনরুক্ত করে অন্য একটি পূর্ণ পয়ার-চরণের সঙ্গে অন্ত্যমিল তৈরি করা হয়। পরবর্তীকালে ভারতচন্দ্র রায়গুণাকরের বিদ্যাসুন্দর কাব্যেও এ ভঙ্গপয়ারের প্রয়োগ লক্ষণীয়। তাছাড়া সপ্তদশ শতকে  কাশীরাম দাস তাঁর মহাভারতে এবং কবি রামপ্রসাদ তাঁর বিদ্যাসুন্দর কাব্যে পয়ার ছন্দের পর্বমধ্যে একাধিক অনুপ্রাস প্রয়োগে বৈচিত্র্য এনে যথাক্রমে তরল পয়ার ও মালঝাঁপ পয়ার ছন্দের উদ্ভাবন করেন। এভাবে আঠারো শতকের শেষে এবং উনিশ শতকের প্রথম দিকে বাংলা সাহিত্যের কবিরা পয়ার ছন্দের প্রচলিত রীতি ভেঙে সৃষ্টি করেন একাবলী, দীর্ঘ ত্রিপদী, দীর্ঘ চৌপদী, লঘু ত্রিপদী ইত্যাদি ছন্দ।

মধুসূদন বাংলা কাব্যে বিষয়ভাবনার পাশাপাশি ছন্দের ক্ষেত্রেও নতুনত্ব আনয়ন করেন। তাঁর প্রবর্তিত ছন্দের নাম অমিত্রাক্ষর ছন্দ। মধ্যযুগীয় পয়ার ছন্দের অন্ত্যমিল, যতি ও পর্বগত সাম্যের কারণে যেহেতু আধুনিক জীবনভাবনাসমৃদ্ধ বৃহত্তর ভাবকে প্রকাশ করা অসম্ভব হয়ে পড়েছিল, সেহেতু মধুসূদন তাঁর নবউদ্ভাবিত অমিত্রাক্ষর ছন্দে নতুন কৌশল প্রযুক্ত করেন। তিনি প্রচলিত পয়ার ছন্দের যতিস্থলে ছেদ স্থাপন না করে বরং পর্বসাম্য বিযুক্ত করে এবং চরণঅতিক্রমী বাক্য ব্যবহার করে কবিতায় ভাবপ্রকাশের এক নতুন গতি সঞ্চার করেন। এটাই অমিত্রাক্ষর ছন্দ। এ ছাড়া মধুসূদনের চতুদর্শপদী কবিতাবলির ছন্দও প্রচলিত পয়ার ছন্দেরই এক নতুন রূপ।

মধুসূদনের পূর্বে ভারতচন্দ্র রায়গুণাকর এবং পরে  রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরসত্যেন্দ্রনাথ দত্ত ও  কাজী নজরুল ইসলাম বাংলা ছন্দের নবতর রূপ নির্মাণে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছেন। ভারতচন্দ্র তাঁর কাব্যে প্রচলিত বাংলা ছন্দের সীমাবদ্ধতাজনিত আড়ষ্টতা প্রত্যক্ষ করে তার প্রতিবিধানে যেমন পারঙ্গমতা দেখিয়েছেন, তেমনি সংস্কৃত বৃত্তছন্দ তোটক, তূণক ও ভুজঙ্গপ্রয়াতকে বাংলায় রূপান্তরের মাধ্যমেও কৃতিত্ব অর্জন করেন।

রবীন্দ্রনাথ বাংলা ছন্দনির্মাণে নতুনত্ব ও সার্থকতার স্বাক্ষর রেখেছেন। তিনি স্বরবৃত্ত, মাত্রাবৃত্ত ও অক্ষরবৃত্ত এ তিন প্রকার ছন্দেরই স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য নির্ধারণ করেছেন। বিশেষ করে মাত্রাবৃত্ত ছন্দের স্বকীয়তা নির্ধারণে তাঁর কৃতিত্ব অতুলনীয়। তিনি তাঁর মানসী  কাব্যে এ ছন্দের প্রথম প্রয়োগসহ একে অক্ষরবৃত্ত ছন্দের প্রভাব থেকে মুক্ত করেন। কেননা তাঁর পূর্বে বিহারীলাল চক্রবর্তীসহ সকল কবিই ছয় মাত্রার লঘু ত্রিপদী, লঘু চৌপদী, একাবলী এবং চার মাত্রার বিভিন্ন হ্রস্বপার্বিক ছন্দকে অক্ষরবৃত্ত বিবেচনায় হলন্ত অক্ষর প্রয়োগের প্রথা প্রবর্তন করেন। কিন্তু রবীন্দ্রনাথই প্রথম প্রমাণ করেন যে, ধ্বনিধর্মে এগুলি অক্ষরবৃত্ত নয়, মাত্রাবৃত্ত এবং তাঁর কবিতায় এগুলিকে তিনি মাত্রাবৃত্ত ছন্দ হিসেবেই প্রয়োগ করেন। এতদ্ব্যতীত ভাবের স্বচ্ছন্দ প্রকাশের কারণে তিনি মাত্রাবৃত্ত ছন্দে পর্বসংখ্যার হ্রাসবৃদ্ধি ঘটিয়ে কবিতার চরণকে অসমদীর্ঘ করার মাধ্যমে ‘মুক্তক’ ছন্দের প্রয়োগ করেন, যা তাঁর বলাকা কাব্যে পরিস্ফুট হয়েছে। এভাবে পর্বদৈর্ঘ্যের ওপর ছন্দের উচ্চারণভঙ্গিকে প্রতিষ্ঠিত করে তিনি বাংলা ছন্দকে বিজ্ঞানসম্মত করে তোলেন।

অন্যদিকে সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত কবিতায় মাত্রাবৃত্ত ছন্দের নানাবিধ সফল প্রয়োগের পাশাপাশি বৈদিক গায়ত্রী ছন্দে বাংলা কবিতা রচনায় সফলতা লাভ করেন। তাঁর রচিত গায়ত্রী ছন্দ বর্তমানে গৌড়ী গায়ত্রী নামে পরিচিত। বাংলা সাহিত্যের অপর প্রধান কবি কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর স্বভাবজাত চাপল্যের কারণে অক্ষরবৃত্তের তুলনায় স্বরবৃত্ত ও মাত্রাবৃত্ত ছন্দেই ছিলেন অধিক স্বচ্ছন্দ, যদিও তাঁর অনেক বিখ্যাত কবিতা অক্ষরবৃত্ত ছন্দে রচিত। তিনি তাঁর অগ্নিবীণাসহ অনেক কাব্যগ্রন্থের অধিকাংশ কবিতায় মাত্রাবৃত্ত ছন্দে নতুন এক ধরনের ঝোঁক বা শ্বাসাঘাত তৈরির চেষ্টা করেন, যা তাঁর ‘বিদ্রোহী‘, ‘ধূমকেতু’ প্রভৃতি কবিতায় লক্ষ করা যায়। এ ছাড়া তাঁর অনেক গানেও তিনি চার পর্বের স্বরবৃত্ত ছন্দে তিন অক্ষরের অতিপর্ব প্রয়োগ করে  গজল গানের নতুন ছন্দভঙ্গি উদ্ভাবন করেন। [হাকিম  আরিফ]

গ্রন্থপঞ্জি  তারাপদ ভট্টাচার্য, ছন্দ-তত্ত্ব ও ছন্দোবিবর্তন, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, কলকাতা, ১৯৭১; প্রবোধচন্দ্র সেন, ছন্দ জিজ্ঞাসা, জিজ্ঞাসা, কলকাতা, ১৯৭৪; রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ছন্দ, শ্রীপ্রবোধচন্দ্র সেন সম্পা., বিশ্বভারতী গ্রন্থবিভাগ, কলকাতা, ১৯৭৬; প্রবোধচন্দ্র সেন, ছন্দ পরিক্রমা, জিজ্ঞাসা, কলকাতা, ১৯৭৭; আবদুল কাদির, ছন্দ-সমীক্ষণ, মুক্তধারা, ঢাকা, ১৯৭৯।