চৌতিশা

চৌতিশা  মধ্যযুগীয় বাংলা সাহিত্যের একটি বিশিষ্ট কাব্যধারা। এর একটি বিশেষ ধরণ হলো এতে বর্ণমালার প্রতিটি বর্ণকে আদিতে রেখে চরণ রচনা করা হয়। কখনও কখনও একই বর্ণ দিয়ে একই চরণে একাধিক পদও রচিত হয়। চৌত্রিশটি বর্ণকে আশ্রয় করে এরূপ কবিতা রচিত হয় বলে একে বলা হয় চৌতিশা। মধ্যযুগীয় বাংলা সাহিত্যে এ ধারার ব্যাপক চর্চা হয়েছে।

চৌতিশার প্রচলন প্রাচীন  সংস্কৃত সাহিত্যেও দেখা যায়। সংস্কৃতে প্রধানত দেবদেবীর স্তব রচনার উদ্দেশ্যেই এ আঙ্গিকে শ্লোক রচিত হয়েছে। বৃহদ্ধর্মপুরাণে চৌতিশা আছে। দেবদেবীর স্তবমূলক চৌতিশা বাংলা মঙ্গলকাব্যের গঠনগত বৈশিষ্ট্যের একটি অঙ্গ। এতে চরণগুলির প্রথম পদ অবশ্যই বর্ণানুক্রমিক হয়ে থাকে। মুকুন্দরামের কবিকঙ্কণ চন্ডীতে শ্রীপতি সওদাগর কারাগারে বন্দি অবস্থায় কালীদেবীর স্ত্ততি গেয়ে তাঁর কৃপা লাভ করে এবং দেবীর কল্যাণে রাজদন্ড থেকে মুক্তি পায়। এখানে চৌতিশা শুরু হয়েছে ‘ক’ দিয়ে এবং শেষ হয়েছে ‘ক্ষ’ দিয়ে। এর প্রথম চরণ ‘কালী কান্তি কপালিনী কপালকুন্ডলা’ এবং শেষ চরণ ‘ক্ষেণেক ধরিয়া রাখ আমি দীন হীন’। সর্বমোট ৬৭টি জোড় চরণ বা ১৩৪টি পঙ্ক্তিতে চৌতিশাটি রচিত। ভারতচন্দ্রের অন্নদামঙ্গলে এরূপ জোড়-পদের সংখ্যা ৫০টি। নায়ক সুন্দর শ্মশানে কালীস্ত্ততি করে তাঁর কৃপায় মৃত্যুদন্ড থেকে মুক্তি পায়। এখানে ‘অ’ দিয়ে শুরু এবং ‘ক্ষ’ দিয়ে শেষ হয়েছে, যেমন: ‘অপর্ণা অপরাজিতা অচ্যুত অনুজা’ এবং ‘ক্ষুব্ধ হই ক্ষোভ পাই ক্ষীণাঙ্গী ভাবিয়া’।

মধ্যযুগে একাধিক মুসলিম কবিও এ আঙ্গিকে কবিতা রচনা করেছেন, তবে প্রসঙ্গ ও বিষয় সম্পূর্ণ ভিন্ন। মুসলমান কবির পক্ষে দেবস্ত্ততি সম্ভব নয় বলে তাঁরা সঙ্গত কারণেই অন্য প্রসঙ্গের অবতারণা করেছেন।  শেখ ফয়জুল্লাহ্ জয়নবের চৌতিশা,  বাহরাম খান লায়লীর চৌতিশা,  সৈয়দ সুলতান জ্ঞানচৌতিশা উক্ত আঙ্গিকে রচনা করেছেন। দোভাষী পুথির কবি মুহম্মদ ফসীহ ‘আরবী ত্রিশ হরফে মুনাজাত’ শিরোনামে এ আঙ্গিকে আল্লাহ্র কাছে প্রার্থনা করেছেন।

পনেরো শতকের কবি শেখ ফয়জুল্লাহ্র জয়নবের চৌতিশা একটি শোককাব্য। কারবালার করুণ কাহিনী নিয়ে রচিত এ কাব্যে ইমাম হোসেনের সহধর্মিণী বিবি জয়নবের বিলাপের কথা বর্ণিত হয়েছে। ষোলো শতকের কবি বাহরাম খানের  লায়লী-মজনু কাব্যে বিরহিণী লায়লীর বিলাপে একই আঙ্গিক অনুসৃত হয়েছে। কবি এখানে ‘ক’ দিয়ে শুরু করে ‘ক্ষ’ দিয়ে ত্রিপদী ছন্দে কবিতা রচনা শেষ করেছেন, যেমন: ‘কমল নয়ান পিয়/ কঠিন তোহ্মার হিয়/ করুণা ছাড়িয়া দূরে গেলা’ এবং ‘ক্ষেমিতে মনের মান/ ক্ষিতিত চৌতিশা ভাণ/ ক্ষুদ্রবুদ্ধি দৌলত উজির’। ষোলো শতকের অপর কবি সৈয়দ সুলতান সুফি ও যোগতত্ত্বের বিষয় অবলম্বনে জ্ঞানচৌতিশা রচনা করেছেন। এখানে বিষয়ের পরিবর্তন ঘটেছে। জ্ঞানচৌতিশা একটি খন্ডকাব্য। এতে প্রতি বর্ণে ৪টি করে মোট ১৩৬টি চরণ পয়ার ছন্দে রচিত।

আঠারো শতকের কবি মুহম্মদ ফসীহ পয়ার ছন্দে আরবি অবলম্বনে চৌতিশা রচনা করে এ ধারায় নতুনত্ব আনেন। তিনি ৩০টি আরবি হরফের প্রত্যেকটি দিয়ে ৪টি করে মোট ১২০টি চরণ রচনা করেছেন। এর শুরু ‘আলিপ’ এবং শেষ ‘ইএ’ হরফ দিয়ে, যেমন: ‘আলিপে আল্লার নাম মনে করি সার’ এবং ‘ইতি সমাপ্ত এবে মোর মুনাজাত’। এভাবে মুসলমান কবিগণ আরবি-ফারসি উপাদান ব্যবহারের মাধ্যমে চৌতিশা রচনা করেছেন। মধ্যযুগে হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের নিকট এ কাব্যধারা বেশ জনপ্রিয় হয়েছিল।  [ওয়াকিল আহমদ]