কর্নওয়ালিস, লর্ড চার্লস

লর্ড চার্লস কর্নওয়ালিস

কর্নওয়ালিস, লর্ড চার্লস (১৭৩৮-১৮০৫)  ১৭৮৬ সালের ১২ সেপ্টেম্বর থেকে ১৭৯৩ সালের ১০ অক্টোবর পর্যন্ত বাংলায় ফোর্ট উইলিয়ম এর গভর্নর জেনারেল। তিনি ছিলেন চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত ও বাংলায় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির প্রশাসনিক ও বিচার ব্যবস্থার রূপকার। কর্নওয়ালিস ইটনে শিক্ষালাভ করে ১৭৫৬ সালে সৈন্যবিভাগে যোগ দান করেন। ১৭৭৫ সালে মেজর জেনারেলের পদে পদোন্নতি লাভের পর তিনি আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধে ব্রিটিশ সৈন্যবাহিনীর একজন কমান্ডার হিসেবে নিয়োগ পান। আমেরিকার কলোনীসমূহ ব্রিটিশদের হস্তচ্যুত হওয়া সত্ত্বেও কর্নওয়ালিস একজন সাহসী, সৎ ও নীতিবান ব্যক্তি হিসেবে নিজের উচ্চ ভাবমূর্তি বজায় রাখতে সক্ষম হন।

১৭৮৪ সালের পিট-এর ভারত আইন এর অধীনে কর্নওয়ালিস ফোর্ট উইলিয়মের গভর্নর জেনারেল নিযুক্ত হন। বাংলায় বিরাজমান দুর্নীতি সমূলে উৎপাটন এবং সুশাসন প্রতিষ্ঠিত করার স্পষ্ট নির্দেশ ছিল তাঁর উপর। অস্থায়ী রাজস্ব ব্যবস্থা দূর করে  চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রবর্তন করার জন্য তাঁকে বিশেষভাবে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। লর্ড কর্নওয়ালিস প্রশাসনে বিদ্যমান দুর্নীতি দূর করতে মোটেই সময় নেন নি। তিনি প্রশাসন থেকে কোম্পানির বাণিজ্যকে আলাদা করেন এবং প্রশাসনকে সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য উচ্চ বেতনভোগী ও পেশাগতভাবে সুশৃঙ্খল ‘সিভিল সার্ভিস’ গঠন করেন। জেলা পর্যায়ে প্রশাসন ব্যবস্থাকে তিনি পুনর্বিন্যাস করেন। তাঁর সংস্কার কর্মসূচি পরিচালনার জন্য কাউন্সিলের একজন সদস্যকে সভাপতি করে ব্যাপক ক্ষমতা সম্পন্ন একটি রাজস্ব পরিষদ (বোর্ড অব রেভিনিউ) স্থাপন করা হয়। জেলা পর্যায়ের কর্মকর্তাবৃন্দকে রাজস্ব পরিষদের সরাসরি তত্ত্বাবধান ও নিয়ন্ত্রণাধীনে আনা হয়। বেসামরিক প্রশাসনের বাইরে কোম্পানির বাণিজ্যিক কর্মকান্ড দেখাশুনার জন্য ‘বোর্ড অব ট্রেড’ নামে একটি নতুন প্রতিষ্ঠানও স্থাপন করা হয়।

চার্লস কর্নওয়ালিস বিচার এবং পুলিশ প্রশাসন ব্যবস্থার উপর সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার প্রদান করেন। তিনি চারস্তর বিশিষ্ট বিচার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করেন। এ ব্যবস্থায় বিচার বিভাগের সর্ব নিম্নে ছিল মুনসিফ আদালত এবং সর্বোচ্চে ছিল সদর আদালত। এ দু স্তরের মাঝের দুটি স্তর ছিল জিলা আদালত এবং কোর্ট অব সার্কিট। প্রতিটি আদালতের ছিল দুটি শাখা দীউয়ানি আদালত (সিভিল কোর্ট) এবং নিজামত আদালত (ক্রিমিনাল বা ফৌজদারি কোর্ট। সর্বোচ্চ আদালতের আবার দুটি বিভাগ ছিল সদর দীউয়ানি আদালত এবং সদর নিজামত আদালত। বিচার কার্যে সহায়তা প্রদান ও দেশের আইন শৃঙ্খলা রক্ষা করার জন্য একটি নিয়মিত পুলিশ প্রশাসন গড়ে তোলা হয়।

প্রশাসনের বিভিন্ন শাখার সংস্কার ও পুনর্গঠনের জন্য কর্নওয়ালিসের প্রচেষ্টা একটি স্থায়ী বিবেচনার দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিল। এ স্থায়ী বিবেচনাটি ছিল প্রশাসনকে দক্ষ ও দুর্নীতিমুক্ত করা। কিন্তু তাঁর পরিকল্পনা বাস্তবায়িত করতে গিয়ে তিনি বর্ণবাদী নীতি গ্রহণ করেন। তিনি প্রশাসনকে সম্পূর্ণরূপে শ্বেতাঙ্গদের বিষয়ে রূপান্তরিত করার সিদ্ধান্ত নেন। বেসামরিক উচ্চ ও নিম্নপদগুলি ইউরোপীয়দের জন্য নির্দিষ্ট করে রাখা হলো। স্থানীয়দের জন্য রাখা হলো শুধু অফিস সহকারী বা অফিস সহকারীর সহায়ক পদগুলি।

কর্নওয়ালিসকে বিশ্বাস করানো হয়েছিল যে, অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান এবং দেশিয়রা উভয়েই ছিল দুর্নীতিপরায়ণ এবং শেষোক্তরা ছিল এমনই দুর্নীতিপরায়ণ যে তারা ছিল সংশোধনেরও অতীত। তাই প্রশাসনে সততা এবং দক্ষতা আনার জন্য তিনি মনে করলেন যে, স্থানীয়দেরকে সকল গুরুত্বপূর্ণ পদ থেকে দূরে সরিয়ে রাখাই হবে বিচক্ষণতার কাজ। এ পর্যন্ত সকল শাসকই যে স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গের সাথে ক্ষমতা ও সুবিধাদি ভাগাভাগি করে নিয়েছিলেন তা তিনি অগ্রাহ্য করেন। ব্রিটিশ শাসনের প্রথমদিকেও প্রশাসনে স্থানীয় জনগণের অংশগ্রহণ ছিল বেশ ব্যাপক। সুতরাং সঙ্গত কারণেই কর্নওয়ালিসের বর্ণবাদী প্রশাসনিক নীতি আধুনিক গবেষকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে এবং তাঁরা তার এ বর্জন নীতিকে নজিরবিহীন, অন্যায্য ও অমানবিক বলে বর্ণনা করেছেন।

যাহোক, বাংলার ইতিহাসে কর্নওয়ালিস তাঁর চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের জন্য বিশেষভাবে পরিচিত যদিও এ ধারণাটি তাঁর নিজস্ব ছিল না। প্রকৃতপক্ষে, ওয়ারেন হেস্টিংস এর শাসনামলে কাউন্সিলের সদস্য ফিলিপ ফ্রান্সিসই প্রথম চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত সম্পর্কে ধারণা করেন এবং ধারণাটির বিকাশ ঘটাতে প্রয়াসী হন। কিন্তু তখন এটিকে অযৌক্তিক বলে ফেলে রাখা হয়। ১৭৭৩ সাল থেকে রাজস্ব ব্যবস্থার উপর পরিচালিত পরীক্ষা-নিরীক্ষার ধারাবাহিক ব্যর্থতা এবং অর্থনীতির উপর এর বিরূপ প্রতিক্রিয়ার ফলে নীতি-নির্ধারকগণ ফিলিপের ধারণাকে পুনরুজ্জীবিত করেন। ১৭৮৪ সালের পীটের ভারত শাসন আইনে বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয় যে, বাংলার ভূমি ব্যবস্থা জমিদারদের সঙ্গে স্থায়ী ভিত্তিতে করতে হবে।

নীতি-নির্ধারকদের মধ্যে দীর্ঘ বিতর্কের পর ১৭৯৩ সালের মার্চ মাসে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের পরিকল্পনা চূড়ান্তভাবে গৃহীত হয়। লর্ড কর্নওয়ালিস অনেক প্রবিধানের আকারে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের বিস্তারিত নিয়মাবলি নির্ধারণ করেন যার মাধ্যমে এ ব্যবস্থার সংজ্ঞা ও বর্ণনা পাওয়া যায়। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের আইনের আওতাধীনে জমিদার ও অন্যান্য ভূস্বামীদেরকে জমির স্থায়ী মালিক হিসেবে ঘোষণা দেওয়া হয়। ব্যক্তিগত সম্পত্তির মতোই হিন্দু ও মুসলমানদের উত্তরাধিকার আইন অনুসারে জমিদারদের ভূমি সহজভাবে হস্তান্তরযোগ্য এবং উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্তিসাধ্য করা হয়। ১৭৯০ সালে দশসালা বন্দোবস্তের মাধ্যমে ভূ-স্বামীদের উপর যে রাজস্ব নির্ধারণ করা হয়েছিল তাই চিরস্থায়ী রাজস্ব হিসেবে ঘোষণা করা হয়। রাজস্ব পরিশোধে অক্ষম জমিদারদের বকেয়া রাজস্ব আদায়ের উদ্দেশ্যে তাদের ভূমি নিলামে বিক্রি করা হতো।

লর্ড কর্নওয়ালিস এ আশায় চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রবর্তন করেছিলেন যে, নতুন ব্যবস্থা ইংল্যান্ডের ভূ-স্বামীদের মতোই অত্র অঞ্চলের জমিদারদেরকে তাদের উন্নয়নে উদ্বুদ্ধ করবে। আশা করা হয়েছিল যে, জমিদারগণ তাদের নিজেদের স্বার্থেই কৃষি ব্যবস্থাকে উৎসাহিত করবেন এবং রায়তদের স্বার্থ রক্ষা করবেন। কর্নওয়ালিস দৃঢ়ভাবে আশা করেছিলেন যে, চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের কারণে দেশে কৃষির নিশ্চিত সম্প্রসারণ ঘটবে এবং এর ফলে দেশ শিল্প বিপ্লবের দিকে এগিয়ে যাবে। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত এ ধরনের রূপান্তর কখনোই হয় নি। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল পূর্বের মতোই অবহেলিত এবং দরিদ্র থেকে যায়।

চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত ছাড়াও, ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে মহীশূরের রাজা টিপু সুলতানকে সংযত রাখার জন্য তার সামরিক পদক্ষেপগুলি ছিল লর্ড কর্নওয়ালিসের বড় অবদান। ১৭৯০ সালে কর্নওয়ালিস নিজে মহীশূরের সুলতানের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান পরিচালনা করেন এবং মহীশূর রাজ্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ কোম্পানি রাজ্যের সাথে অন্তর্ভুক্ত করেন। টিপু সুলতানকে পরাজিত এবং একটি আরোপিত শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরে বাধ্য করে কর্নওয়ালিস সত্যিকার অর্থেই কোম্পানি রাজ্যের নিরাপত্তা বলয় বৃদ্ধি করেন। প্রকৃতপক্ষে, টিপু সুলতানের ওপর কর্নওয়ালিসের বিজয় ভারতে সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে লর্ড ওয়েলেসলীর কাজকে সুগম করে দেয়। কর্নওয়ালিসের সামরিক সাফল্য এবং কোম্পানির রাজ্য গঠনে প্রশাসনিক, বিচার, এবং সামরিক ক্ষেত্রে তাঁর কৃতিত্ব বিবেচনা করে ১৭৯২ সালের আগস্ট মাসে তাঁকে ‘মার্কুইস’ উপাধি প্রদান করা হয়।

চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রণয়নের পরপরই কর্নওয়ালিস ইংল্যান্ডে ফিরে যান। কোর্ট অব ডাইরেক্টর্স, বোর্ড অব কন্ট্রোল, এবং পার্লামেন্ট তাঁকে বীরোচিত সংবর্ধনা প্রদান করে। ১৭৯৭ সালে তিনি পুনরায় গভর্নর জেনারেল পদে নিয়োগ লাভ করেছিলেন। কিন্তু স্বাস্থ্যগত কারণে তিনি উক্ত পদ গ্রহণ করতে অস্বীকার করেন। ১৮০৫ সালে তিনি আবারও গভর্নর জেনারেল নিযুক্ত হন। এবার তিনি নিয়োগপত্র গ্রহণ করেন এবং ১৮০৫ সালের ৩০ জুলাই দায়িত্ব বুঝে নেন। কিন্তু ১৮০৫ সালের ৫ অক্টোবর দেশে প্রত্যাবর্তনের পথে তিনি গাজীপুরে মারা যান।  [সিরাজুল ইসলাম]