ইবরাহিম খান

ইবরাহিম খান ১৬৮৯ থেকে ১৬৯৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত বাংলার সুবাহদার ছিলেন। তিনি ছিলেন সম্রাট শাহজাহান এর দরবারের পারস্য দেশিয় বিখ্যাত আমীর আলী মর্দান খান জিগের জ্যেষ্ঠ পুত্র। পিতার মৃত্যুর পর ইবরাহিম খানকে চার হাজারি মনসব প্রদান করা হয়। শাহজাহানের পুত্রদের মধ্যে উত্তরাধিকার যুদ্ধের সময় দারার পক্ষ অবলম্বন করে ইবরাহিম খান সামুগড়ের যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। দারার পতনের পর তিনি মুরাদের অধীনে চাকরি গ্রহণ করেন এবং শেষ পর্যন্ত আওরঙ্গজেব এর পক্ষে যোগ দেন। তিনি পর পর কাশ্মীর, লাহোর ও বিহারের সুবাহদার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন এবং তাঁর পদমর্যাদা পাঁচ হাজারি মনসবে উন্নীত করা হয়। ১৬৭৬ খ্রিস্টাব্দে তিনি তাঁর মনসব থেকে পদত্যাগপত্র পেশ করেন এবং তা গৃহীত হয়। কিন্তু আওরঙ্গজেবের রাজত্বের একবিংশতম বছরে (১৬৭৯) তিনি পুনরায় কাশ্মীরের সুবাহদার নিযুক্ত হন। পুত্র ফিদাই খান এর সহায়তায় ১৬৮৩ খ্রিস্টাব্দে তিনি তিববত জয় করেন। সম্রাট তাঁকে প্রশংসাসূচক একটি ফরমান পাঠান এবং বিশেষ পদমর্যাদাসূচক এক প্রস্থ পোশাক, সাত হাজার টাকা মূল্যের ইলাকা মুক্তাসহ রত্নখচিত একটি ফুলকাটারা তরবারি, দু শত মোহর মূল্যের একটি স্বর্ণসজ্জিত আরবীয় অশ্ব এবং সম্রাটের নিজের হস্তীশালা থেকে পনেরো হাজার টাকা মূল্যের একটি হাতি উপহার দেন। বাংলার সুবাহদার হিসেবে তিনি যখন নিয়োগ লাভ করেন তখন তিনি সামরিক শৌর্যহীন বৃদ্ধ এবং ফার্সি বই পড়াই ছিল তাঁর একমাত্র অভিলাষ। কিন্তু নিরপেক্ষভাবে ন্যায় বিচার এবং কৃষি ও বাণিজ্যের উন্নতিতে তাঁর প্রয়াস ইংরেজ বণিকদের উৎসাহিত করে এবং তারা তাঁকে একজন বিখ্যাত ন্যায়পরায়ণ ও যোগ্য নওয়াব মনে করত।

সুবাহদার হিসাবে সম্রাটের হুকুমে ঢাকায় আটককৃত ইংরেজ বণিকদের মুক্তিদান ছিল তাঁর প্রথম কাজ। সম্রাটের মত পরিবর্তনের কারণের কোনো সুস্পষ্ট প্রমাণ আমাদের হাতে না থাকলেও, চার্লস স্টুয়ার্ট মনে করেন যে, আওরঙ্গজেব সম্ভবত ইংরেজদের বাণিজ্য থেকে প্রাপ্ত রাজস্ব আয় হারাতে চান নি। ইংরেজদের বাংলায় আনা হিরণ্যের বার্ষিক পরিমাণ ছিল প্রায় ৮৭ হাজার পাউন্ড। তাছাড়া সমুদ্রে ইংরেজদের ক্ষমতা ছিল অসীম। তাদের রণপোতগুলি মক্কায় হজ্ব যাত্রাকে দুঃসাধ্য করে তুলতে পারতো।

ইংরেজদের বাংলায় ফিরে আসার আমন্ত্রণ জানিয়ে ইবরাহিম খান ১৬৮৯ খ্রিস্টাব্দের ২ জুলাই মাদ্রাজের কুঠির কর্মকর্তাদের একটি চিঠি লেখেন। তিনি মাদ্রাজের কর্তৃপক্ষকে বাংলায় কুঠি পুনঃপ্রতিষ্ঠা করার পরামর্শ দেন। শেষ পর্যন্ত ১৬৯০ খ্রিস্টাব্দের ফ্রেরুয়ারি মাসে মুগল সরকার ও ইংরেজদের মধ্যে পশ্চিম উপকূলে ব্যবসা সংক্রান্ত শান্তি-চুক্তি সম্পাদিত হয়। কোম্পানি কর্তৃক ভারতীয় বণিকদের সকল ন্যায্য পাওনা পরিশোধ এবং সাম্রাজ্যের লোকসানের ক্ষতিপূরণ দানের শর্তে সম্রাট একটি নতুন ফরমান জারি করতে সম্মত হন।

এসব শর্ত পূরণের পর পশ্চিম উপকূল ও বাংলায় ইংরেজদের বাণিজ্য করার অনুমতিপত্র পুনর্বহাল করা হয়। কিন্তু ইংরেজরা তাদের বাণিজ্য অব্যাহত রাখার ক্ষেত্রে বাংলার জন্য একটি সুনির্দিষ্ট ফরমান দাবি করছিল। ইবরাহিম খান জব চার্নককে জানিয়ে দেন যে, বাংলায় ফিরে এলে তাদের আকাঙ্খিত ফরমানটি পাওয়া একটু সময় সাপেক্ষ হবে, তবে তা জারি হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত তাদের সব ধরনের নিরাপত্তা দেওয়া হবে। ফলে জব চার্নক তার পরিষদমন্ডলী নিয়ে সুতানটিতে ফিরে আসেন।

ইবরাহিম খানের বন্ধুসুলভ মনোভাব বাংলা থেকে কোম্পানির রেশম ও চেলি (তাফতা) বস্ত্র রপ্তানির সহায়ক হয়েছিল। ১৬৯১ খ্রিস্টাব্দের ফেব্রুয়ারি মাসে ফরমান জারি করে কোম্পানীকে বাৎসরিক ৩০০০ টাকা প্রদানের বিনিময়ে বাংলায় শুল্কমুক্ত বাণিজ্যের অধিকার দেওয়া হয়। অর্থাৎ ১৬৫১-এর অবস্থা পুনর্বহাল করা হয়।

ইতোমধ্যে ইউরোপীয় যুদ্ধের শুরু কোম্পানির বাণিজ্যের উন্নতির সহায়ক হয়। বাংলার রেশমের চাহিদা কিছুটা বৃদ্ধি পায়। ১৬৯৩ খ্রিস্টাব্দের অক্টোবরে কোর্ট অব ডাইরেক্টর্স লিখেছিল যে, ভারত থেকে পাঠানো যেতে পারে এমন পণ্যের মধ্যে বাংলার রেশম ছিল ‘সর্বোৎকৃষ্ট পণ্য’।

১৬৮৮ খ্রিস্টাব্দে ফরাসিরা চন্দননগরে একটি বাণিজ্য কুঠি স্থাপন শুরু করে যা ১৬৯২ খ্রিস্টাব্দে শেষ হয়। ১৬৯২-৯৩ খ্রিস্টাব্দে ফরাসিরা ওলন্দাজদের মতো একই শর্তে বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যায় বাণিজ্য করার অনুমতি সম্বলিত আওরঙ্গজেবের ফরমান লাভে সমর্থ হয়। কোম্পানিগুলির সক্রিয়তা স্পষ্টতই বাংলার উৎপাদন ক্ষেত্রে গতি সঞ্চার করেছিল যার প্রভাব তার অভ্যন্তরীণ অর্থনীতিতেও পড়েছিল। কিন্তু এসময় (১৬৯৫-৯৬) মেদিনীপুর জেলার চন্দ্রকোণার জমিদার শোভা সিংহ এর বিদ্রোহ বাংলায় মুগল কর্তৃত্বে প্রচন্ড আঘাত হানে। বিদেশি কোম্পানিগুলিকে জোটভুক্ত হতে অনুরোধ করা এবং তাঁর উদ্যমী পুত্র জবরদস্ত খানকে একটি সৈন্যদল প্রস্ত্তত করার আদেশ দান ছাড়া বিদ্রোহ দমনের জন্য ইবরাহিম খান তেমন কোনো কার্যকর ব্যবস্থাই গ্রহণ করেন নি। রাজকীয় গুপ্তচর মারফত এ সংবাদ সম্রাটের কাছে পৌঁছে। আওরঙ্গজেব সঙ্গে সঙ্গে বাংলার সেনাবাহিনীর কর্তৃত্ব জবরদস্ত খানের উপর ন্যস্ত করেন। বিদ্রোহ এত গুরুতর হুমকি হয়ে দাঁড়ায় যে, সম্রাট তাঁর পৌত্র  আজিম উস-শানকে বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার শাসনকর্তা নিয়োগ করেন এবং ইবরাহিম খানকে বাংলা থেকে ফিরে যেতে হয়। [অঞ্জলি চট্টোপাধ্যায়]