আল-কুরআন

আল-কুরআন (কুর‘আন)  ইসলাম ধর্মের পবিত্র গ্রন্থ। মহান আল্লাহ্-তা‘আলার বাণীসমূহ এতে সংকলিত হয়েছে। নুবুওয়াত লাভের পর দীর্ঘ তেইশ বছর যাবৎ  হযরত মুহাম্মদ (স.) -এর নিকট এ বাণীসমূহ ক্রমে ক্রমে অবতীর্ণ হয়। সম্পূর্ণ কুরআনে ৩০টি পারা, ১১৪টি সূরা, ৭টি মান্যিল, ১৬টি (শাফি মাযহাবে ১৫টি) সিজদা এবং ৬৬৬৬টি আয়াত রয়েছে (আয়াত সংখ্যা সম্পর্কে কিছুটা মতভেদ আছে)। সূরাগুলির কিছু মক্কায় এবং কিছু মদিনায় অবতীর্ণ হয়। কোনো কোনো সূরা অবতীর্ণ হয় মক্কায়, কিন্তু তার কিছু আয়াত অবতীর্ণ হয় মদিনায়। অনুরূপভাবে মদিনায় অবতীর্ণ কোনো কোনো সূরার কিছু আয়াত অবতীর্ণ হয় মক্কায়। আবার মক্কা-মদিনার বাইরেও কোনো কোনো সূরার আয়াত অবতীর্ণ হয়েছে। হিজরতের পূর্বে মক্কায় অবতীর্ণ সূরাগুলি মাক্কী এবং হিজরতের পরে অবতীর্ণ সূরাগুলি মাদানী নামে পরিচিত। মাক্কী সূরাসমূহে আল্লাহ্র অস্তিত্ব, একত্ব, কুরআনের সত্যতা, কিয়ামত, পুনরুত্থান, পাপ-পুণ্যের শাস্তি ও প্রতিদান, বেহেশত ও দোযখ, নৈতিক শিক্ষা ইত্যাদি সম্বন্ধে আলোকপাত করা হয়েছে। অপরদিকে মাদানী সূরাসমূহে ধর্মীয় বিধি-বিধান, শরীয়তের বিভিন্ন নিয়ম-নীতি ও সমস্যাসমূহের সমাধান উল্লেখ করা হয়েছে।

রাসুলুল্লাহ (স.)-এর ওফাতের পূর্বে কুরআন পরিপূর্ণ গ্রন্থরূপে সংকলিত হয়নি, কারণ তাঁর ওফাত পর্যন্ত কুরআনের অবতরণ-প্রক্রিয়া অব্যাহত ছিল। অবতীর্ণ অংশসমূহ তখন চামড়া, গাছের বাকল, পাথর, চওড়া হাড়ের খন্ড ইত্যাদিতে লিপিবদ্ধ করা হতো। তবে রাসুলুল্লাহ (স.) তাঁর জীবদ্দশায় আল্লাহ্র নির্দেশ অনুযায়ী কুরআনের সমুদয় আয়াতের বিন্যাসক্রম ঠিক করে দিয়েছিলেন এবং তিনি ও তাঁর বহু সাহাবী সম্পূর্ণ কুরআন মুখস্থ করেছিলেন। যাঁরা কুরআন মুখস্থ করেন তাঁদের বলা হয় হাফিজ। ইয়ামামার যুদ্ধে (৬৩৩ খ্রি) অনেক হাফিজ শহীদ হওয়ায় হযরত ‘উমর (রা.) কুরআনের সঠিক সংরক্ষণ বিষয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন এবং তাঁর প্রস্তাবেই খলিফা হযরত আবু বকর (রা.) কুরআনের বিচ্ছিন্ন অংশগুলি একত্র করে গ্রন্থাকারে লিপিবদ্ধ করার ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। হযরত আবূ বকর (রা.)-এর ইন্তেকালের পর খলিফা হযরত ‘উমর (রা.) এর নিকট কুরআনের অনুলিপিটি সংরক্ষিত থাকে। তৃতীয় খলিফা হযরত ‘উছমান (রা.) কুরআনের কিছুসংখ্যক অনুলিপি তৈরি করে মুসলিম বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রেরণ করেন। এ জন্য হযরত ‘উছমান (রা.)-কে বলা হয় আল-কুরআনের সংকলক (জামি‘উল-কুরআন)।

কুরআনের অনেকগুলি নামের মধ্যে বিশেষ চারটি নাম আল-কুরআন, আল-ফুরকান, আল-কিতাব ও আয-যিক্র। ‘আল-কুরআন’ নামের অর্থ যাহা পঠিত হয়। এটি বহু আয়াত ও সূরার সংকলন। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, কুরআনের প্রথম আয়াতের প্রথম শব্দ ‘ইকরা’-পাঠকর। ‘আল-ফুরকান’ নামের অর্থ পার্থক্যকারী, সত্য ও মিথ্যার, আলো ও অন্ধকারে এবং ন্যায় ও অন্যায়ের পার্থক্যকারী। ‘আল্-কিতাব’ অর্থ লিখিত গ্রন্থ যা যথাযথভাবে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। ‘আয-যিক্র’ নামের অর্থ উপদেশ যা  আল্লাহ্-তা‘আলা স্বীয় বান্দাগণকে দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনের নিমিত্তে দিয়েছেন।

কুরআনের ভাষা ও প্রকাশভঙ্গি সমসাময়িক  আরবি সাহিত্য থেকে আলাদা। এতে একদিকে যেমন রয়েছে কাব্যের মাধুর্য, তেমনি অন্যদিকে রয়েছে গদ্যের সহজ-সাবলীল গতি ও গাম্ভীর্য। এ ছাড়াও কুরআনের আয়াতগুলিতে সাধারণত অন্ত্যমিল পরিদৃষ্ট হয় এবং এককালীন অবতীর্ণ আয়াতগুলির অন্ত্যমিল একই প্রকৃতির। কুরআনের রচনাশৈলীর আর একটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এর উপমাসম্ভার।

ঐতিহাসিক ঘটনার বর্ণনা আল-কুরআনের একটি উল্লেখযোগ্য দিক। এসব বর্ণনায় সত্য-মিথ্যার দ্বন্দ্ব এবং আল্লাহ্র অনুসারী ও শয়তানের অনুগতদের মধ্যে বিবাদ-বিসম্বাদ মানবজাতির পথ-নির্দেশনার উদ্দেশ্যে উপদেশরূপে বর্ণিত হয়েছে। এর দ্বারা তুলে ধরা হয়েছে ধর্মীয় শিক্ষা ও আদর্শের মৌলিক বিষয়। এ ছাড়া কুরআনে জ্ঞান-বিজ্ঞানের নানা বিষয় তুলে ধরা হয়েছে।

আল্লাহ্-তা‘আলা মানুষের হিদায়াত ও উপদেশের জন্য পৃথিবীতে বহু নবী-রাসুল প্রেরণ করেছেন। তাঁদের মধ্যে কারো কারো ঘটনা কুরআনে বর্ণিত হয়েছে। কুরআনে সর্বপ্রথম বর্ণিত হয়েছে হযরত আদম (আ.)-এর ঘটনা। তিনি দুনিয়ার প্রথম মানব ও প্রথম নবী। মানব সৃষ্টি বিষয়ে মহান আল্লাহ্ ও ফেরেশতাদের মধ্যে কথোপকথন, শয়তান কর্তৃক আল্লাহ্র নির্দেশ অমান্যকরণ ইত্যাদির মধ্যদিয়েই এ ঘটনার সূত্রপাত। এ ছাড়া হযরত নুহ (আ.) থেকে পর্যায়ক্রমে হযরত মুহাম্মদ (স.) পর্যন্ত নবী-রাসুলদের কথা বিবৃত হয়েছে।

কুরআনের সর্বপ্রথম ব্যাখ্যাদাতা ছিলেন স্বয়ং রাসুলুল্লাহ্ (স.)। তিনি কুরআনের যে অংশ যখন অবতীর্ণ হতো তখনই তার ব্যাখ্যা দিতেন। পরবর্তীকালে ইসলামী চিন্তাবিদগণ তাঁদের স্ব-স্ব জ্ঞান ও প্রতিভার আলোকে কুরআনের তাফসির রচনা করেন। কয়েকটি প্রসিদ্ধ তাফসির গ্রন্থ হলো: তাফসীর জামি‘উল বায়ান, তাফসীর আল-কাশশাফ, তাফসীর আল-বায়দাবী, তাফসীর ইব্ন কাছীর ইত্যাদি।

কুরআন একটি সর্বাধিক পঠিত গ্রন্থ। মুসলমানগণ নামাযে কুরআনের আয়াত পাঠ করে। কুরআনের  বিষয়াবলি ব্যাপক। ইসলামের মূল ভিত্তি তাওহিদ ও ইসলামের সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ নবী হযরত মুহাম্মদ (স.) সম্পর্কে বিস্তারিত ও স্পষ্ট আলোচনা রয়েছে। কুরআনের  বিষয়াবলির মধ্যে চারটি বিষয় প্রণিধানযোগ্য: ১. স্রষ্টার সঙ্গে সৃষ্টির সম্পর্ক, ২. স্রষ্টার সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক, ৩. মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক, ৪. মানুষের সঙ্গে অন্যান্য সৃষ্টির সম্পর্ক। যেসকল বিষয় মানবজাতির কল্যাণের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে সম্পর্কিত এবং যেগুলি সকলেরই জানা উচিত সেগুলি হলো: ক. মানবের পার্থিব অবস্থা ও তার জীবন-যাপন পদ্ধতির সংশোধন ও উন্নতি বিধান; খ. মানবাত্মার উন্নতি ও সংশোধনের উদ্দেশ্যে উপদেশাবলি ও বিধানাবালি প্রদান এবং দৃষ্টান্তসমূহের উল্লেখ; গ. মানুষের ইহকালীন ও পরকালীন মঙ্গল ও সৌভাগ্য সম্পর্কিত বিধি-নিষেধ; ঘ. আন্তরিক দৃঢ়তা, উন্নত মনোবল এবং সাহসিকতা অর্জনের লক্ষ্যে পূর্বের নবী-রাসুলগণের জীবনী বর্ণনা; ঙ. সামাজিক জীবন যাপনের জন্য প্রয়োজনীয় রীতি-নীতি, আদব-কায়দা ও কর্তব্যসমূহের বর্ণনা; চ. সৎ ও ন্যায় কার্যাবলি সম্পাদনের প্রতি উৎসাহ প্রদান এবং অসৎ ও অন্যায় কার্যাবলি থেকে বিরত থাকার উপদেশ প্রদান এবং ছ. বিশ্ব প্রকৃতির সৃষ্টিরহস্য বিষয়ে চিন্তা ও গবেষণার জন্য জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার প্রতি আহবান।

সামগ্রিকভাবে কুরআন  মানুষের মধ্যে সাম্য, মৈত্রী, ভ্রাতৃত্ব ও নৈতিক শিক্ষার প্রতি গুরুত্বারোপ করেছে। এমনকি অন্যান্য ধর্ম সম্বন্ধেও কুরআন উদার দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ করেছে এবং ঘোষণা করেছে যে, পৃথিবীর কোনো জাতিই আল্লাহ্র রহমত থেকে বঞ্চিত নয়; আল্লাহ্ প্রত্যেক জাতির হিদায়াতের উদ্দেশ্যেই নবী ও রাসুল প্রেরণ করেছেন। কুরআন নাজিলকৃত অন্যান্য ধর্মগ্রন্থের সত্যায়নকারী। কুরআন বিশেষ সম্প্রদায়ের জন্য নয়, সমগ্র মানব জাতির জন্য। কুরআন একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন-বিধান। একে যথাযথভাবে অনুসরণ করলে সকল মানুষই শান্তিপূর্ণভাবে জীবন-যাপন করতে পারে ও আখিরাতের জন্য পুণ্য সঞ্চয় করতে পারে।  [আবু মূসা মোঃ আরিফ বিল্লাহ]